শুক্রবার, ৯ মে, ২০১৪

ক্ষমতা হস্তান্তর যেভাবে সম্ভব : টনি বেনের বাণী


শফিক রেহমান
৪ মে ২০১৪, রবিবার, ৫:০৬

শেখ হাসিনা ক্ষমতা হস্তান্তর না করা পর্যন্ত কোনো ক্যু সফল হবে না। তাই ক্যু সফল করতে হলে শেখ হাসিনার কাছে পৌছাতে হবে। প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবন (গণভবন) যে গার্ডরা পাহারা দিচ্ছে তারা শেখ হাসিনার প্রতি বিশ্বস্ত। এই গার্ডরা ভেতরে কাউকেই কোনোভাবেই ঢুকতে দেবে না। তাছাড়া, আমি মনে করি, কোনো ক্যু-র প্রচেষ্টা এত রক্তক্ষয়ী হবে যে, সেই ঝুকি নেওয়ার মতো কোনো অফিসার নেই। আমি আপনাকে বলতে পারি যে, শেখ হাসিনা ক্ষমতা হস্তান্তর করবেন না। সেটা হতে পারে শুধুমাত্র আমাদের লাশের ওপর দিয়ে।
-ঢাকায় ইনডিয়ান সাংবাদিক দেবদীপ পুরোহিতকে দেওয়া সজীব ওয়াজেদ জয়-এর ইন্টারভিউয়ের একাংশ যা প্রকাশিত হয়েছিল কলকাতার দি টেলিগ্রাফ পত্রিকায় ২৪ নভেম্বর ২০১৩-তে।
To have a successful coup, you will have to physically get Sheikh Hasina to hand over power. The guards guarding this house (Gano Bhaban, the official residence of the Prime Minister) are faithful to Sheikh Hasina. There is no way the guards will allow anybody to step in.
Besides, any (coup) attempt will be so bloody that I dont think there is any group of officers inclined to take that risk. I can tell you that Sheikh Hasina will not hand over power. It can only happen over our dead bodies.
-Sajib Wazed Joy, in an interview taken by Devadeep Purohit in Dhaka and published in the Telegraph, Calcutta, India on 24 November 2013..

বাকশাল গঠনের মাধ্যমে একদলীয় শাসন ব্যবস্থার বিরুদ্ধে আব্বু (তাজউদ্দীন আহমদ) তার চূড়ান্ত মতামত মুজিব কাকুকে জানিয়েছিলেন। ব্যক্তিগত সচিব আবু সায়ীদ চৌধুরীকে সাক্ষী রেখে তিনি মুজিব কাকুকে ফোন করে বলেছিলেন, আপনি একদলীয় শাসন ব্যবস্থা করতে যাচ্ছেন, কিন্তু আপনাকে আমি অনেকবারই বলেছি আমার দ্বিমতের কথা। আর আজ আমার চূড়ান্ত মতামত দিচ্ছি। আমি আপনার এই একদলীয় শাসনের সাথে একমত নই... বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে আপনার হাতে এতই ক্ষমতা দেওয়া আছে যে সেই ক্ষমতাবলে দেশে একদলীয় ব্যবস্থা বা আর কোনো পরিবর্তনের প্রয়োজন আছে বলে আমি মনে করি না। আমরা বক্তৃতায় সব সময় বলেছি একটি সুখী সমৃদ্ধিশালী দেশের কথা, যার ভিত্তি হবে গণতন্ত্র। যে গণতন্ত্রের গুণগান করেছি আমরা সবসময়ে, আজকে আপনি একটি কলমের খোচায় সেই গণতন্ত্র শেষ করে দিয়ে দেশে একদলীয় শাসন ব্যবস্থা করতে যাচ্ছেন।... বাই টেকিং দিস স্টেপ ইউ আর কোজিং অল দি ডোরস টু রিমুভ ইউ পিসফুলি ফ্রম ইওর পজিশন (...আপনার অবস্থান থেকে শান্তিপূর্ণভাবে আপনাকে সরিয়ে দেওয়ার সব দরজাই আপনি এই পদক্ষেপ নিয়ে বন্ধ করে দিচ্ছেন)।
-শারমিন আহমদ : তাজউদ্দীন আহমদ নেতা ও পিতা (পৃষ্ঠা ১৯১-১৯২)

ক্ষমতাসীনকে প্রশ্ন করুন, কিভাবে আপনি ক্ষমতায় এসেছেন এবং কিভাবে আমরা আপনাকে ক্ষমতা থেকে সরাতে পারি? রাজনীতিতে এই দুটি হচ্ছে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন।
- টনি বেন
টনি বেন কে ছিলেন এই প্রশ্নটির উত্তর হয়তো বাংলাদেশের অনেকেরই জানা নেই।
বিংশ শতাব্দির দ্বিতীয়ার্ধে বৃটেনের বামপন্থী রাজনীতিতে টনি বেন ছিলেন একজন প্রধান নেতা যার ওপর অনেক সময়ে নির্ভর করতো লেবার পার্টির সাফল্য এবং ব্যর্থতা। প্রতিপক্ষ টোরি বা কনজারভেটিভ পার্টি দ্বারা তিনি যেমন সমালোচিত হতেন, ঠিক তেমনি তার নিজের লেবার পার্টির মধ্যেও তিনি বিতর্কিত হতেন। কিন্তু দুটি দলই স্বীকার করতে বাধ্য হতো টনি বেনের ভূমিকা অনেক সময়ে ছিল দলের ঊর্ধ্বে দেশের স্বার্থে। তাই টনি বেন ছিলেন নিজেই একটি জাতীয় রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান।
টনি বেনের এই ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যকে প্রতিষ্ঠিত করেছিল তার অসাধারণ কণ্ঠস্বর, গভীর আত্মবিশ্বাস এবং ধূমায়িত পাইপ হাতে মগে চা খাওয়া।
১৪ মার্চ ২০১৪-তে টনি বেন ৮৮ বছর বয়সে পরলোক গমন করেছেন। প্রতিদ্বন্দ্বী টোরি পার্টির নেত্রী মার্গারেট থ্যাচারের মতো তিনি বৃটেনের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন না। নিজের পার্টি, লেবার পার্টির পক্ষ থেকে তিনি কখনো পার্লামেন্টে বিরোধীদলীয় নেতাও হতে পারেন নি। তবে তিনি একবার লেবার পার্টির চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছিলেন। কিন্তু টনি বেন ১৯৫০ থেকে ২০০১ সালের মধ্যে ১৬ বার পার্লামেন্টের সদস্য বা এমপি নির্বাচিত হন। লেবার পার্টির মধ্যে সর্বাধিকবার নির্বাচিত হবার রেকর্ড তারই।
রাষ্ট্রীয় সম্মানে সমাহিত
তার মৃত্যুর পর দলমত নির্বিশেষে তাকে রাষ্ট্রীয়ভাবে শেষ সম্মান জানানোর প্রস্তাব ওঠে। এ নিয়ে কিছুটা বিতর্কের সৃষ্টি হয়। কারণ মার্গারেট থ্যাচার নিজের মৃত্যুর আগে ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন তার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া যেন রাষ্ট্রীয়ভাবে করা হয়। তার সেই অনুরোধ রাখা হয়েছিল। কিন্তু টনি বেন, যিনি শাদাসিধে অনাড়ম্বর জীবন যাপন করতেন, তিনি নিজের মৃত্যুর আগে এই ধরনের জাকজমক ভরা অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার কোনো অনুরোধ করে যান নি। অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া রাষ্ট্রীয়ভাবে করার জন্য অনুমতি নিতে হয় বৃটিশ রানীর। কিন্তু বেন ছিলেন বৃটেনে রাজতন্ত্র অবসানের পক্ষপাতী।
এই প্রেক্ষিতে বৃটিশ জনগণ আশ্চর্য হয়ে যায় যখন জানা গেল বর্তমানে ক্ষমতাসীন টোরি পার্টির পক্ষ থেকে প্রস্তাব করা হয়েছে টনি বেনকে রাষ্ট্রীয়ভাবে শেষ বিদায় দেওয়ার জন্য এবং রানী এলিজাবেথও তার অনুমতি দিয়েছেন। কিছু কট্টর ডানপন্থী টোরি এবং কিছু কট্টর বামপন্থী লেবার নেতাকর্মীরা মৃদু সমালোচনা করলেও শেষ পর্যন্ত টনি বেনের মরদেহ এনে রাখা হয় বৃটিশ পার্লামেন্টের নিজস্ব গির্জা সেইন্ট মেরি আন্ডারক্রফটে। একটি উচু টেবিলে তার কফিন ঢাকা হয় বৃটিশ পতাকা দিয়ে এবং তার ওপর রাখা হয় ফুলের তোড়া। এর আগে একমাত্র মার্গারেট থ্যাচারই এমন সম্মান পেয়েছিলেন।
ইতিমধ্যে ইন্টারনেট জুড়ে চলতে যাকে সকল দলের টপ নেতা, সাহিত্যিক, অভিনেতা, পপস্টার এবং বৃটিশ সুধী সমাজ ও সংস্কৃতিসেবীদের শ্রদ্ধাসূচক স্মৃতিচারণ। টনি বেনের সুদীর্ঘ জীবনের বিভিন্ন দিক আলোচিত হতে থাকে রেডিও-টিভিতে। টনি বেনের স্মরণীয় বহু উদ্ধৃতি প্রকাশিত হতে থাকে বিভিন্ন ব্লগে।
বাংলাদেশিদের গণতান্ত্রিক আন্দোলনে
এই ব্যাপক ও দীর্ঘ সময়ব্যাপী শ্রদ্ধাঞ্জলির মধ্যে বাদ পড়ে যায় টনি বেনের জীবনের একটি দিক এবং সেটি হলো বাংলাদেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পক্ষে বৃটেন প্রবাসী বাংলাদেশিদের বিভিন্ন আন্দোলনকে তার সমর্থন দান।
টনি বেনকে আমি প্রথম দেখি ১৯৬০-এর ফেব্রুয়ারিতে শীতের এক বিকেলে সেন্ট্রাল লন্ডনে রেড লায়ন স্কোয়ারে অবস্থিত কনওয়ে হলে একটি মিটিংয়ে। সেই সময়ে প্রবাসী পূর্ব পাকিস্তানি ছাত্রছাত্রীদের কার্যক্রম হোবর্নের এই অঞ্চল জুড়ে হতো। এখানেই অবস্থিত ব্যারিস্টার হতে আগ্রহীদের পীঠস্থান লিংকন্স ইন, ইকনমিস্ট হতে আগ্রহীদের লন্ডন স্কুল অফ ইকনমিক্স, অন্যান্য সব বিষয়ে পড়াশোনার জন্য লন্ডন ইউনিভার্সিটি, স্কুল অফ ওরিয়েন্টাল স্টাডিজ (সংক্ষেপে সোয়াস) এবং ছাত্রদের থাকার বিভিন্ন হল। এদের কাছেই ছিল বুশ হাউসে বিবিসি বাংলা বিভাগের দফতর যেটি এখন সরে গিয়েছে অন্যখানে। তাই ছাত্রছাত্রীদের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সমাবেশ এখানে ঘটতো। কনওয়ে হলটি খুবই শাদামাটা বলে ভাড়া ছিল কম।
১৯৫৮-তে পাকিস্তানে জেনারেল মোহাম্মদ আইয়ুব খান ক্ষমতা দখল করার পর থেকে তার সেনাতন্ত্রের বিরুদ্ধে লন্ডনে ছাত্র আন্দোলন গড়ে উঠতে থাকে। এই ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্ব দিচ্ছিল পাকিস্তান স্টুডেন্টস ফেডারেশন বা সংক্ষেপে পিএসএফ। রাজনীতি সচেতন পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের ছাত্ররা এই সংগঠনের সদস্য ছিল। তবে এর মধ্যে পূর্ব পাকিস্তানের ছাত্রদের একটা নিজস্ব ধারাও প্রবাহিত ছিল।
লর্ড উপাধি ছেড়ে দেওয়ার একক আন্দোলন
পিএসএফের আমন্ত্রণে সেই শীতের বিকেলে টনি বেন কনওয়ে হলে এসেছিলেন গণতন্ত্রের পক্ষে কথা বলার জন্য প্রধান অতিথি হয়ে। সেই সময়ে তার সম্পর্কে দুটি কথা জানতাম। এক. তিনি বৃস্টল সাউথ-ইস্ট আসন থেকে নির্বাচিত লেবার এমপি এবং দুই. বংশগত কারণে বৃটিশ আইন অনুযায়ী তিনি আর এমপি থাকতে পারবেন না তার পিতা ভাইকাউন্ট স্ট্যানসগেইটের মৃত্যুর পরে।
শেষের তথ্যটি আমাকে কৌতূহলী করেছিল।
বৃটেনের পার্লামেন্টে দুটি হাউস বা কক্ষ আছে। আপার হাউস বা উচ্চকক্ষ যাকে বলা হয় হাউস অফ লর্ডস বা লর্ডস সভা এবং লোয়ার হাউস বা নিম্নকক্ষ যাকে বলা হয় হাউস অফ কমন্স বা কমন্স সভা। বৃটেনে নির্বাচনে যারা বিজয়ী হন, তারা হন কমন্স সভার সদস্য বা এমপি এবং এদের সদস্য পদের মেয়াদ থাকে পাচ বছর। পার্লামেন্টে নিম্নকক্ষে এরাই হন প্রকৃত ক্ষমতার অধিকারী। এমপিদের মধ্য থেকেই নির্বাচিত হন প্রধানমন্ত্রী এবং বিরোধীদলীয় নেতা। অন্যদিকে উচ্চকক্ষে লর্ডরা সদস্য হন তাদের বংশগত যোগ্যতায় অথবা সরকারের মনোনয়নে। এদের সদস্য পদের মেয়াদ থাকে আজীবন অথবা স্বেচ্ছায় অবসর নেওয়া পর্যন্ত। নিম্নকক্ষ কর্তৃক পাস হওয়া কোনো বিল পর্যালোচনা করা এবং সেটা পুনর্বিবেচনার জন্য আবার নিম্নকক্ষে ফেরত পাঠানো ছাড়া আর বিশেষ কোনো ক্ষমতা উচ্চকক্ষ সদস্যদের বা লর্ডদের নেই। তাই যারা রাজনীতি করতে চান এবং প্রকৃত ক্ষমতার অধিকারী হয়ে দেশ পরিচালনা করতে চান তারা হাউস অফ কমন্স বা নিকক্ষের সদস্য হতে চান। অর্থাৎ, তারা হতে চান এমপি। অন্যভাবে বলা চলে, তারা লর্ড হতে চান না যদিও লর্ড শব্দটির সঙ্গে মর্যাদা, সম্ভ্রম এবং আভিজাত্য জড়িয়ে আছে।
১৯৬০-এ প্রচলিত বৃটিশ আইন অনুযায়ী লর্ডস সভার সদস্য ভাইকাউন্ট স্ট্যানসগেইট, যার পূর্ণ নাম ছিল উইলিয়াম ওয়েজউড বেন, তার মৃত্যুর পর তার প্রথম পুত্র মাইকেলের হবার কথা ছিল ভাইকাউন্ট স্ট্যানসগেইট এবং সেই সুবাদে লর্ডস সভার সদস্য। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে ওই পুত্রের মৃত্যু হওয়ায়, তার দ্বিতীয় পুত্র এনটনি নিল ওয়েজউড বেন, যিনি সংক্ষিপ্ত টনি বেন নামে পরিচিত হয়েছিলেন, তাকেই উত্তরাধিকার সূত্রে লর্ডস সভার সদস্য হতে হতো। টনি বেন ইতিমধ্যে মাত্র পচিশ বছর বয়সে ১৯৫০-এ বিপুল ভোটে বৃস্টল সাউথ-ইস্ট থেকে লেবার এমপি নির্বাচিত হয়েছিলেন। সেই সময়ে তিনি হয়েছিলেন পার্লামেন্টে সর্বকনিষ্ঠ এমপি বা বেবি অফ দি হাউস। তিনি দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলেন যে পিতার মৃত্যুর পরে কিছুতেই তিনি নিম্নকক্ষ ছেড়ে উচ্চকক্ষে লর্ড হয়ে যাবেন না। তাই তিনি এককভাবে একটি আন্দোলন চালাচ্ছিলেন যেন বৃটিশ নাগরিকদের অধিকার থাকে লর্ডস সভার সদস্য পদ ছেড়ে দেওয়ার।
নভেম্বর ১৯৬০-এ ভাইকাউন্ট স্ট্যানসগেইটের মৃত্যুর পর টনি বেন অটোম্যাটিকালি হয়ে যান লর্ড এবং হাউস অফ কমন্সের দরজা তার জন্য বন্ধ হয়ে যায়। এপৃল ১৯৬১-তে টনি বেনের আসনে উপনির্বাচন ধার্য হয়। টনি বেন এর বিরুদ্ধে কমন্সে একটি ভাষণ দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু স্পিকার তাকে ভাষণ দেওয়ার অনুমতি দেননি।
টনি বেন তার একক আন্দোলন চালিয়ে যেতে থাকেন। তিনি জানতেন ভোটাররা তাকে চায় এবং তিনি এটাও জানতেন যে বৃটিশ আইনে একটা ফাক আছে। কমন্সে ঢুকতে না পারলেও কমন্সের নির্বাচনে দাড়ানোর বিরুদ্ধে কোনো আইন নেই। তিনি মনোনয়নপত্র দাখিল করেন এবং উপনির্বাচনে বিজয়ী হন। বিষয়টি তখন ইলেকশন কোর্টে গড়ায়। আদালত রায় দেন যে ভোটাররা সচেতন ছিলেন। সুতরাং টনি বেনের পক্ষে তাদের ভোট দেয়া অনুচিত হয়েছিল। কমন্সে বেন ঢুকতে পারবেন না এবং উপনির্বাচনে দ্বিতীয় স্থান অধিকারী টোরি পার্টির প্রার্থী ম্যালকম সেইন্ট কেয়ারকে বিজয়ী ঘোষণা করেন। মজার কথা এই যে ম্যালকম সেইন্ট কেয়ারের অবস্থাও টনি বেনের মতো ছিল। সেইন্ট কেয়ারের পিতাও ছিলেন লর্ড এবং তার মৃত্যুর পর সেইন্ট কেয়ারের কমন্স সভার সদস্য পদ খারিজ হয়ে যেত।
আদালতের রায়ে গভীরভাবে হতাশ হলেও টনি বেন তার ক্যামপেইন চালিয়ে যেতে থাকেন।
ঠিক এই সময়টায় টনি বেনকে আমরা কয়েকবারই পেয়েছিলাম আমাদের ছাত্রসমাবেশে। তিনি সেখানে শ্রেণী-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে প্রতিটি মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার বিষয়ে বলতে আসতেন। পরোক্ষভাবে এটা ছিল তার নিজের গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠার ক্যামপেইনের একটা অংশ।
বিজয়ী বেন
অবশেষে টোরি সরকার দি পিয়ারেজ অ্যাক্ট (The Peerage Act 1963) পাস করে, যার ফলে লর্ড পদবি ছেড়ে দেওয়া আইনসম্মত হয়।
৩১ জুলাই ১৯৬৩-তে সন্ধ্যা ছয়টার সময়ে এই আইনটি পাস হয়। বেন-ই ছিলেন প্রথম লর্ড যিনি তার পদবি ছেড়ে দেন। এটি তিনি করেন সেই দিনই সন্ধ্যা ৬-২২ মিনিটে!
সেই সন্ধ্যায় আমরা, বেন গুণগ্রাহীরা, একটি পাবে (Pub-এ) কয়েক রাউন্ড বিয়ার কিনে তার এই ঐতিহাসিক সাফল্য সেলিব্রেট করেছিলাম। সেদিনের সান্ধ্য পত্রিকাগুলোতে ছিল শুধুই বেনের সাফল্যের সংবাদ।
চূড়ান্ত সাফল্যের জন্য বেনকে অপেক্ষা করতে হয় আরো বিশ দিন। সেইন্ট কেয়ার তার নির্বাচনের সময়ে বলেছিলেন, আইন বদলে গেলে তিনি এমপি পদ ছেড়ে দেবেন। সেইন্ট কেয়ার তার প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেন। বৃটিশ সাউথ-ইস্টে আবার উপনির্বাচন হয় ২০ আগস্ট ১৯৬৩-তে। ওই উপনির্বাচনে বিজয়ী হয়ে টনি বেন পার্লামেন্টে ফিরে আসেন।
ব্যক্তিগত ন্যায্য দাবি আদায় করার জন্য দেশের কয়েক শ বছরের পুরনো আইন বদলানোর লক্ষ্যে এককভাবে আন্দোলন করে সফল হওয়ার এই দৃষ্টান্ত আমাদের খুবই অনুপ্রাণিত করেছিল। সমষ্টিগতভাবে আন্দোলন করে বিজয়ী হবার বহু দৃষ্টান্ত আছে। কিন্তু এককভাবে আন্দোলন করে সফল হবার এমন দৃষ্টান্ত বিরল।
মায়ের প্রভাব
টনি বেনের জন্ম হয়েছিল ৩ এপ্রিল ১৯২৫-তে লন্ডনে তার পিতা ভাইকাউন্ট হবার আগে ছিলেন লেবার পার্টির এমপি এবং দুইবার মন্ত্রী। টনির মা মার্গারেট ছিলেন নারীদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় অগ্রণী নেত্রী এবং ধর্মতত্ত্ব বিষয়ে জ্ঞানী। টনির ওপর তার মায়ের প্রভাব পড়েছিল বেশি। মা যখন তাকে বাইবেল পড়াতেন তখন বলতেন, বাইবেলের গল্পগুলোর ভিত্তি হচ্ছে পয়গম্বর এবং রাজাদের মধ্যে যুদ্ধ। রাজারা ছিল ক্ষমতাবান। কিন্তু পয়গম্বররা ছিলেন ন্যায় ও নীতিবান। সুতরাং টনির উচিত হবে তার নিজের জীবনে রাজাদের বিরুদ্ধে পয়গম্বরদের সাপোর্ট করা। সম্ভবত বৃটেনের রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে টনি বেনের বিতৃষ্ণার সূচনা হয়েছিল তার মায়ের শিক্ষাতে।
টনি বেনের দাদা এবং নানা উভয়েই ছিলেন লিবারাল পার্টির এমপি। অর্থাৎ তিন পুরুষ ধরে টনি বেনরা ছিলেন এমপি। তিন পুরুষেই তারা হয়েছিলেন মন্ত্রী। তার পিতা যখন লেবার সরকারের ইনডিয়া দফতরের মন্ত্রী ছিলেন তখন ১৯৩১-এ মহাত্মা গান্ধীর সঙ্গে টনি বেনের দেখা হয়েছিল।
বেনের পৈত্রিক পরিবারের মূল আয় ছিল একটি প্রকাশনা ব্যবসা থেকে। তিনি পড়াশোনা করতে যান অক্সফোর্ডে। ১৯৩৯-এ দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ শুরু হয়ে গেলে তিনি এয়ার ফোর্সে পাইলট রূপে যোগ দেন। যন্ত্র এবং আধুনিকতার প্রতি টনি আগ্রহী ছিলেন। পরবর্তীকালেও তার এই আগ্রহ অটুট ছিল। যুদ্ধ শেষের পর তিনি আবার অক্সফোর্ডে ফিরে যান এবং সেখানে ফিলসফি, পলিটিক্স ও ইকনমিক্স পড়েন। ১৯৪৭-এ তিনি অক্সফোর্ড ছাত্র ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট হন। তখন ধনী এবং অভিজাত পরিবারের সন্তানরাই অক্সফোর্ড-কেমবৃজে পড়াশোনার সুযোগ পেত। সম্ভবত সেই কারণে সাধারণ মানুষের স্টেটাস পেতে উৎসাহী টনি বেন পরবর্তী সময়ে অক্সফোর্ডে তার লেখাপড়ার বিষয়টি অনুক্ত রাখতেন। ১৯৭৫-এ হু ইজ হু (Whos Who) জীবনীকোষে তিনি তার শিক্ষাগত যোগ্যতা সম্পর্কে তথ্য দিয়েছিলেন, শিক্ষা এখনো চলছে (Education- still in progress).
অসাধারন পরিবার সাধারন নাম
১৯৪৮-এ গ্র্যাজুয়েট হবার পর কিছু কাল আমেরিকায় কাটিয়ে বেন বিবিসি রেডিওতে প্রডিউসার পদে কাজ করেন (১৯৪৯-৫০)। এই সময় পর্যন্ত তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে এনটনি ওয়েজউড বেন এবং ওয়েজি নামে বন্ধুবৃত্তে ও পরিবারে পরিচিত ছিলেন। ১৯৭৩-এ বিবিসির একটি প্রোগ্রামে তিনি ঘোষণা করেন যে, এখন থেকে এনটনি ওয়েজউড বেনের পরিবর্তে তিনি শুধু টনি বেন নামে পরিচিত হতে চান। এখানেও তার সেই একই মনস্তত্ত্ব কাজ করেছিল। তিনি তার অভিজাত এবং দীর্ঘ নাম বদলে সাধারণ মানুষের কাছাকাছি যাওয়ার জন্য সাধারণ ও সংক্ষিপ্ত নাম রাখেন। এই ধারাতে পরবর্তীকালে আমেরিকার উইলিয়াম জেফারসন কিনটন হয়ে যান বিল কিনটন এবং বৃটেনে এনটনি চার্লস লিনটন ব্লেয়ার হয়ে যান টনি ব্লেয়ার। একই ধারায় বর্তমান বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী ডেভিড উইলিয়াম ডোনাল্ড ক্যামেরন হয়েছেন ডেভিড ক্যামেরন এবং বর্তমান বৃটিশ বিরোধীদলীয় নেতা এডওয়ার্ড স্যামুয়েল মিলিব্যান্ড হয়েছেন এড মিলিব্যান্ড!
কিন্তু নাম বদলে ফেললেও তিনি যে উচ্চবংশীয় অভিজাত পরিবারের সন্তান সেটা গোপন করা অসম্ভব ছিল। তাই তিনি এক সময়ে বলেন, যে উচ্চ শ্রেণীর মানুষরা বৃটেন চালায় তাদের আপাদমস্তক আমি জানি। তারা কিসের তালে আছে সেটাও আমি জানি। আর এটাই হচ্ছে লেবার পার্টিতে আমার অবদান।
১৯৪৯-এ তিনি বিয়ে করেন আমেরিকান ধনী নারী ক্যারোলাইন মিডলটন ডিক্যাম্পকে। ক্যারোলাইন বিশ্বাস করতেন সমাজতন্ত্রে এবং কাজ করতেন শিক্ষা ক্ষেত্রে। অক্সফোর্ডে পড়ার সময়ে টনি বেনের সঙ্গে তার দেখা হয়েছিল। এর নয় দিন পরে অক্সফোর্ডে একটি পার্কের বেঞ্চে ক্যারোলাইনকে পাশে বসিয়ে টনি তাকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছিলেন। টনি বেন বলেন, আমি খুব লাজুক ছিলাম। তাদের দাম্পত্য জীবন সুখের ছিল এবং তারা এক কন্যা ও তিন পুত্রের জন্ম দেন। পুত্রদের মধ্যে মধ্যমজন হিলারি রাজনীতিতে এসেছেন এবং লেবার সরকারের আমলে মন্ত্রী হয়েছিলেন। অর্থাৎ, চতুর্থ পুরুষেও বেন পরিবার থেকে এমপি ও মন্ত্রী হয়েছেন। টনি বেন ও তার স্ত্রী বসবাস করতেন পশ্চিম লন্ডনে নটিং হিল এলাকায় একটি বড় বাড়িতে, যেখানে অনেকটা জায়গা জুড়ে ছিল লাইব্রেরি। ২০০০-এ ক্যারোলাইন মারা যান। যে বেঞ্চে বসে টনি বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছিলেন, পরবর্তীকালে সেই বেঞ্চটি তিনি অক্সফোর্ড থেকে কিনে লন্ডনে নিজের বাড়ির বাগানে স্থাপন করেন।
যুদ্ধ বিরোধী বেন
১৯৪৯-এ বিয়ের পরপরই টনি বেন বৃস্টল সাউথ-ইস্টের এমপি হবার জন্য কাজে লেগে যান। ওই আসনে লেবার এমপি ছিলেন স্যার স্ট্যাফোর্ড কৃপস, যিনি রিটায়ার করেছিলেন। ২০০১-এ টনি বেন ৫১ বছর পার্লামেন্টে সদস্য থাকার পর রিটায়ার করেন। রিটায়ার করার সময়ে তিনি বলেন,আমি পলিটিক্সে আরো সময় দেওয়ার জন্য রিটায়ার করছি।
কথাটা টনি বেন হালকাভাবে বলেননি। যখন মার্চ ২০০৩-এ ইরাকের বিরুদ্ধে বৃটেন যুদ্ধে যায় তখন প্রধানমন্ত্রী ছিলেন লেবার পার্টির টনি ব্লেয়ার। টনি বেন বলতেন, প্রতিটি যুদ্ধই হচ্ছে কূটনীতির ব্যর্থতার পরিচয় (All war represents a failure of diplomacy)। তাই ফেব্রুয়ারি ২০০৩-এ টনি বেন চলে যান বাগদাদে এবং সাদ্দাম হোসেনের সঙ্গে আলোচনা করে আসন্ন যুদ্ধ থামানোর চেষ্টা করেন। কিন্তু তিনি সফল হন না। তিনি মনে করতেন দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ শেষ হবার পর থেকে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র সারা বিশ্বে আধিপত্য বিস্তার ও বজায় রাখতে সচেষ্ট থেকেছে। আমেরিকার সহযোগী হবার জন্য তিনি ব্লেয়ারের সমালোচনা করেন।
টনি বেনের যুদ্ধবিরোধী হবার কারণ ছিল, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে এয়ার ফোর্স পাইলট রূপে তিনি যুদ্ধের নৃশংসতা ও ভয়াবহতা স্বচোখে দেখেছিলেন। এই যুদ্ধে একটি দুর্ঘটনায় তার বড় ভাই নিহত হয়েছিলেন। তাই ১৯৫৪ থেকে তিনি পারমাণবিক বোমাবিরোধী আন্দোলনে জড়িয়ে ছিলেন। ২০০১-এ তিনি আফগানিস্তান যুদ্ধে বৃটেনের জড়িয়ে পড়ার বিরোধিতা করেন।
বাগদাদ থেকে ফিরে এসে টনি বেন ফেব্রুয়ারি ২০০৩-এ স্টপ দি ওয়ার কোয়ালিশন (যুদ্ধ থামাও জোট) নামে একটি সংগঠনের নেতৃত্ব দেন। ওই মাসে বৃটেনে যুদ্ধবিরোধীদের একটি মহাসমাবেশে বহু মানুষ যোগ দেয়। এতে পুলিশের মতে ৭,৫০,০০০ প্রতিবাদকারী মানুষ উপস্থিত ছিল এবং সেই সময় পর্যন্ত সেটাই ছিল বৃটেনের সবচেয়ে বড় জনসমাবেশ। দি ওয়ার কোয়ালিশন দাবি করে সেখানে ১,০০০,০০০ প্রতিবাদকারী উপস্থিত ছিল। টনি বেনের আবেগি কিন্তু যুক্তিপূর্ণ বক্তৃতা ও সাংগঠনিক দক্ষতা এই সমাবেশের সাফল্যের প্রধান কারণ ছিল। পার্লামেন্ট থেকে বিদায় নিয়ে তিনি আমৃত্যু এই জোটের হয়ে যুদ্ধবিরোধী কাজ চালিয়ে যান।
বিনয়ী বেন
প্রায় ৫১ বছর পার্লামেন্টের সদস্য থাকলেও এবং তার দল লেবার পার্টি একাধিকবার ক্ষমতায় এলেও টনি বেন কখনোই প্রধানমন্ত্রী হননি এমনকি লেবার পার্টি বিরোধী অবস্থানে গেলেও তিনি বিরোধীদলীয় নেতা হতে পারেননি। তাই টনি বেন আক্ষেপ করে বলেছিলেন, সব রাজনৈতিক জীবনই ব্যর্থতায় শেষ হয়। আমার রাজনৈতিক জীবন অধিকাংশের তুলনায় আগেই শেষ হয়েছে (All political careers end in failure. Mine ended earlier than most)।
এই উক্তিটি ছিল তার বিনয়ের বহিঃপ্রকাশ। প্রধানমন্ত্রী অথবা বিরোধীদলীয় নেতা না হতে পারলেও তিনি লেবার সরকারের আমলে একাধিকবার মন্ত্রীর সমমর্যাদাসম্পন্ন পদে অথবা মন্ত্রী পদে কাজ করেছিলেন। তিনি হয়েছিলেন পোস্টমাস্টার জেনারেল (১৯৬৪-১৯৬৬), টেকনলজি মন্ত্রী (১৯৬৬-১৯৭০), শিল্পমন্ত্রী (১৯৭৪-১৯৭৫) এবং এনার্জি মন্ত্রী (১৯৭৫-১৯৭৯)।
টনি বেন সম্পর্কে বলা হয়, মন্ত্রী পদে থাকার পরে যে গুটিকয়েক পলিটিশিয়ান আরো বামপন্থী হয়ে গিয়েছিলেন তাদের অন্যতম ছিলেন তিনি। এতে তার সোশালিজম বা সমাজতন্ত্র মার্কসবাদের চাইতে বাইবেল দ্বারাই বেশি প্রভাবিত হয়েছিল তার মায়ের কারণে। এক সময়ে বৃটেনে উগ্র বামপন্থীদের বলা হতো বেনপন্থী বা বেনাইট (Bennite)।
চারটি শিক্ষা
মন্ত্রিত্বের পরে কেন তিনি আরো বামপন্থী হয়ে যান সে বিষয়ে টনি বেন বলেন, আমি চারটি শিক্ষা পেয়েছিলাম। এক. জনগণের দ্বারা নির্বাচিত সরকারের নীতি এবং সিদ্ধান্তগুলো কিভাবে আমলারা বা সিভিল সার্ভিস পণ্ড করে দেয়। দুই. লেবার পার্টি যে ধারায় চলছে সেখানে কেন্দ্রীয় নেতৃত্বই সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী এবং তার ফলে পার্টির নেতা তার জমিদারির মতো পার্টিকে চালাতে পারেন। তিন. লেবার সরকারের বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক চাপ সৃষ্টি করার ক্ষমতা আছে শিল্পপতি, ব্যবসায়ী ও ব্যাংকার্সদের এবং চার. মিডিয়ার যে ক্ষমতা আছে সেটা মধ্যযুগীয় চার্চের সঙ্গে তুলনীয়। সমাজে যারা অর্থনৈতিক সুবিধা ভোগ করছে তাদের দৃষ্টিকোণ থেকেই মিডিয়া প্রতিদিনের ঘটনাগুলো দর্শক, শ্রোতা ও পাঠকদের কাছে উপস্থাপন করে।
এই লেখাটি যারা পড়ছেন তারা বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে টনি বেনের এই চারটি শিক্ষা বিবেচনা করতে পারেন।
পার্টির মধ্যে গণতন্ত্র চর্চার পক্ষে
দেশের শিল্প-ব্যবসা-বাণিজ্য ক্ষেত্রে আরো প্রতিযোগিতা নিশ্চিত করার জন্য বেন ছিলেন রাষ্ট্রীয় পরিকল্পনার পক্ষে। দলের মধ্যে তিনি আরো গণতন্ত্র চর্চার পক্ষে সোচ্চার ছিলেন। বৃটেনে প্রতি বছর রাজনৈতিক দলগুলোর সম্মেলন বা কনফারেন্স হয়। বেন চাইতেন ওই সম্মেলনে ভোটের ভিত্তিতে গৃহীত সিদ্ধান্তগুলোর বাস্তবায়ন। ইইউ বা ইওরোপিয়ান ইউনিয়নে বৃটেনের যোগদানের বিরোধী ছিলেন বেন। এই ইসুতে টনি বেন ছিলেন একজন জাতীয়তাবাদী বা ন্যাশনালিস্ট পলিটিশিয়ান এবং নিজের দল লেবার পার্টির চাইতে প্রতিপক্ষ দল টোরি পার্টির কাছাকাছি।
টনি বেনের সুদীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে তার দলের মূলধারার সঙ্গে বহুবার তীব্র বিরোধিতা ঘটেছিল। যেমন, ইওরোপিয়ান ইউনিয়নে যোগদান ইসুতে, কিন্তু তিনি কখনোই দল ছেড়ে যান নি। তিনি বলতেন,দলের মধ্যে থেকেই দলের দৃষ্টিভঙ্গি বদলানোর চেষ্টা করে যেতে হবে। কোনো ব্যক্তির অধীনে প্রতিদ্বন্দ্বী দল টেকে না।
বাংলাদেশে বিদ্রোহী অঙ্গ দল গঠনের প্রবণতা যাদের মধ্যে আছে তাদের উচিত হবে টনি বেনের পূর্ণ জীবনী পড়ে দেখা।
পরিশ্রমী লেখক
তাদের অসুবিধা হবে না। কারণ টনি বেন ছিলেন পরিশ্রমী ডায়রি লেখক। তার জীবন কেন্দ্রিক আটটি ডায়রি প্রকাশিত হয়েছে। সর্বশেষ ডায়রি প্রকাশিত হয় ২০১৩ সালে। নাম : এ ব্লেইজ অফ অটাম সানশাইন (A Blaze of Autumn Sunshine বা হেমন্তের কড়া সুর্যালোক)। এই চূড়ান্ত ডায়রিতে তিনি ২০০৭-৯ সালগুলোর ঘটনা লিপিবদ্ধ করেছেন। জীবনের হেমন্তকালে বা পড়ন্ত বেলায় এই দুই বছরে তিনি দেশ জুড়ে প্রায় আশিটি শহরে ঘুরে বেড়ান, ভাষণ দেন, বিক্ষোভ সমাবেশে যোগ দেন এবং ওয়ান-ম্যান শো বা একক শো উপস্থাপন করেন। যেহেতু তিনি ছিলেন সুবক্তা এবং তার বক্তৃতায় ঘৃণার চাইতে বেশি ব্যঙ্গরস, ক্রোধের চাইতে বেশি যুক্তি এবং কল্পকথার চাইতে বেশি বাস্তব সমাধানের রূপরেখা থাকত, তাই তার ভাষণ শুনতে সর্বত্রই অনেক শ্রোতা টিকেট কিনে আসত। বিশেষত তরুণরা।
একটি স্ট্রোকের পর তিনি শারীরিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়েন। শেষ ডায়রিতে তিনি লেখেন, আমি আশা করি আবার আমি একাই চলাফেরা করতে পারব। আমি পরনির্ভর হয়ে থাকতে চাই না।... এই ডায়রিতে আমি লিখেছি কিভাবে মানুষ বুড়ো হয়ে যায়। এই রূঢ় বাস্তবতা আমাকে মেনে নিতে হয়েছে। কিন্তু এটা মেনে নেওয়া আমার জন্য খুব কষ্টকর হয়েছে।
এই আট খণ্ডের ডায়রি ছাড়াও আরো দুটি বই লিখেছেন। রেডিও এবং টেলিভিশনে বহু শো দিয়েছেন। টনি বেন লেখালেখির জন্য বিশাল লাইব্রেরি করেছিলেন যেখানে বইয়ের সঙ্গে ছিল অজস্র নিউজ পেপার কিপিংস। এসব লেখা, শো, জনসভার ভাষণ এবং পার্লামেন্টে বিতর্কে বেন তার প্রতিপক্ষকে কখনোই অশোভন ভাষায় আক্রমণ করেন নি। তিনি বলতেন, প্রতিপক্ষকে তিনি ঘৃণা করেন না প্রতিপক্ষের নীতিকে তিনি সমালোচনা করেন।
বাংলাদেশে যারা বর্তমান ((অবৈ:) প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জনসভার ভাষণ শুনেছেন (আপনি (খালেদা) পেয়ারের পাকিস্তানে চলে যান ১ মে ২০১৪, গাজীপুর) তারা টনি বেনের কয়েকটি ভাষন পড়লেই বুঝবেন বাংলাদেশকে মধ্যম আয়ের দেশ না হোক, মধ্যম সভ্যতার দেশে উন্নীত করতে হলে পলিটিশিয়ানদের ভাষা কেমন হওয়া উচিত।
টনি বেন কেন তার ভাষা ও ভাষণ সম্পর্কে এত সতর্ক থাকতেন? কারণ তিনি জানতেন প্রবীণ পলিটিশিয়ানদের দ্বারা নবীন পলিটিশিয়ানরা প্রভাবিত হয়। বেন সবসময়ই নবীনদের কাছে পৌছাতে চেয়েছেন। তিনি খুব মনোযোগ দিয়ে তরুণদের কথা শুনতেন। এটা শুধু যে তিনি ইংরেজ তরুণদের বেলায়ই করতেন, তা নয়। ষাটের দশকে আইয়ুব খান বিরোধী যেসব ছাত্র সম্মেলনে তিনি আসতেন তখন আমাদের কথাও তিনি গভীর মনোযোগ দিয়ে শুনতেন এবং ভালো সাজেশন দিতেন। তার বই পড়ে এবং ভাষণ শুনে ছাত্রজীবনে ডেভিড ক্যামেরন উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন রাজনীতিতে যোগ দিতে। পরবর্তী সময়ে অবশ্য ক্যামেরন টোরি পার্টিতে যোগ দেন এবং প্রধানমন্ত্রী হন। কিন্তু ক্যামেরন শ্রদ্ধা প্রকাশ করেন টনি বেনের সৎ এবং আদর্শ ভিত্তিক রাজনীতির প্রতি।
পপ ও পোশাক, চা ও পাইপ
তরুণদের সঙ্গে রাজনৈতিক যোগসূত্র বজায় রাখতে টনি বেন খুব আন্তরিকভাবে জড়িয়ে ছিলেন পপ মিউজিকে। তিনি জানতেন রাজনীতির চাইতে তরুণরা মিউজিকে বেশি আগ্রহী। এ কারণেই প্রতি বছর তিনি ইংল্যান্ডের গ্ল্যাস্টনবেরি ফেস্টিভালে যেতেন। প্রতি জুনের শেষে সমারসেট, গ্ল্যাস্টনবেরিতে এই আন্তর্জাতিক উৎসবে পপ, ব্লুজ, রক, রেগে, হিপহপ এবং লোকসঙ্গীতের অনুষ্ঠান চলে পাচ দিন ব্যাপী। পাশাপাশি চলে নাচ, নাটক, সার্কাস, ক্যাবারে মিউজিক এবং অন্যান্য ধরনের আর্টস প্রদর্শনী। বিশ্বের টপ পপ আর্টিস্টরা এই ফেস্টিভালে যোগ দেন এবং উপস্থিত দর্শক-শ্রোতার সংখ্যা পৌনে দুই লক্ষের বেশি হয়। টনি বেন বলতেন, গ্ল্যাস্টনবেরি আমার জন্য একটা বার্ষিক তীর্ঘযাত্রা। এখানে এলে রাজনৈতিক তৃনমূলের সঙ্গে আমি পরিচিত হই। তরুণদের আইডিয়া জানি। নতুন শক্তি নিয়ে ফিরে যাই।
প্রশ্ন হচ্ছে, বিএনপি অথবা আওয়ামী লীগের কজন সিনিয়র পলিটিশিয়ান বাংলাদেশের কোনো পপ মিউজিক ফেস্টিভালে নিয়মিত গিয়েছেন কি? তারা কি জানেন, আসিফ আকবর, আইয়ুব বাচ্চু, শাফিন আহমেদ প্রমুখ পপ শিল্পীরা এখন কি গাইছেন? তারা কি জানেন, আর্টসেল, শূন্য, অর্থহীন প্রভৃতি নতুন কোন পপ ব্যান্ড এখন তরুণদের মধ্যে প্রিয়?
ষাটের দশক কনওয়ে হলে তিনি আসতেন ক্যাজুয়াল পোশাক পরে। সাধারণত কালো অথবা ব্রাউন টাউজার্স এবং ব্রাউন কর্ডরয়ের জ্যাকেট পরে। তরুণদের সংস্পর্শে থাকার ফলে পরবর্তী সময়ে তরুণদের প্রিয় মালটিপকেট জ্যাকেট পরে তিনি সভায় যেতেন। তিনি ভেজিটারিয়ান বা নিরামিষাসী ছিলেন। কোনো এলকোহলিক ডৃংকস খেতেন না। অনবরত চা খেতেন। তার হাতে থাকত ধূমায়িত পাইপ। ইন্টারনেটে পাইপ হাতে টনি বেনের অনেক ছবি আছে। তবে কেউ কেউ বলেন, সবসময় হাতে পাইপ থাকলেও টনি বেন সবসময় পাইপ স্মোক করতেন না। এ বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে টনি বেন বলেছিলেন,পাইপ স্মোকিং আমার নেশা নয় - ওটা পেশা... প্যাকেটের গায়ে লেখা থাকে ধূমপান স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। কিন্তু তারপর সেই প্যাকেট বৈধভাবে কেনা যায়। বিষয়টা বেশ বিচিত্র।

তরুণদের প্রতি
নিজের জীবনে একক সংগ্রাম চালিয়ে সফল হবার প্রেক্ষিতে প্রচণ্ড আত্মবিশ্বাসী টনি বেন তরুণদের প্রতি একটি মূল্যবান উপদেশ এবং আশার বানী দিয়ে গিয়েছেন। সেটা হলো, ‘প্রথমে তোমাকে ওরা অবজ্ঞা করবে। তারপর ওরা বলবে তুমি একটা পাগল। তারপর বলবে তুমি বিপজ্জনক। তারপর চলবে একটা নীরবতা। আর তারপর তোমার সঙ্গে দ্বিমত পোষণকারী কাউকে তুমি দেখবে না।’
তরুণদের যে কর্মসংস্থান দরকার সেটা টনি বেন বুঝতেন। তার যুদ্ধ বিরোধিতার এটাও একটা কারণ ছিল। তিনি বলেন, “যুদ্ধের জন্য যদি টাকা পাওয়া যায় তাহলে মানুষকে সাহায্য করার জন্যও টাকা পাওয়া সম্ভব... স্কুল, কলেজ, ইউনিভার্সিটি এবং সব কিনিক ও হসপিটালে আরো বেশি লোক নিয়োগ করলে দেশের শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের উন্নতি হবে।”
 
পাচটি প্রশ্ন করবে
টনি বেন একজন চিন্তাবিদও ছিলেন। বিশেষত গণতন্ত্র বিষয়ে তিনি খুব সহজ ভাষায় তরুণদের প্রতি কিছু উপদেশ দেন। ২০০৫ সালে তিনি লেখেন : 
ক্ষমতাশালীদের পাচটি প্রশ্ন করবে :
১ আপনার কি ক্ষমতা আছে?
২ এই ক্ষমতা আপনি কোনখান থেকে পেয়েছেন?
৩ কার স্বার্থে এই ক্ষমতা আপনি কাজে লাগাচ্ছেন?
৪ কার কাছে আপনি জবাবদিহি করেন?
৫ আপনাকে আমরা কিভাবে ক্ষমতাচ্যুত করতে পারি?
মনে রেখ :
ক্ষমতাচ্যুত করার অধিকার শুধু গণতন্ত্রই আমাদের দেয়।
সে জন্যই কোনো ক্ষমতাবান ব্যক্তি গণতন্ত্র পছন্দ করে না।
আর সে জন্যই প্রতিটি প্রজন্মকে লড়ে যেতে হবে গণতান্ত্রিক অধিকার আদায় করতে এবং সেটা বজায় রাখতে।
এই প্রজন্মের মধ্যে তুমিও আছ, আমিও আছি - এখানে এবং এখনই।
 
এই উপদেশের অরিজিনাল ইংরেজিটা নিচে প্রকাশিত হলো। টনি বেন নিজের হাতে কয়েকটি শব্দ ক্যাপিটাল লেটারে লিখে আন্ডারলাইন করে দেন। আশা করি তরুণ পাঠকরা সেটা লক্ষ্য করবেন।
Ask the powerful five questions: 
1 What power have you got?
2 Where did you get it from?
3 In whose interest do you exercise it?
4 To whom are you accountable?
5 How can we get rid of you?
- Tony Benn, 2005
 
Only democracy gives us that right.
That is why NO-ONE with power likes democracy. 
And that is why EVERY generation must struggle to win it and keep it. 
- Including you and me here and NOW. 
 
টনি বেন তার একটি ডায়রিতে আরো তিনটি মূল্যবান উপদেশ নিয়ে গেছেন :
১ জনগণকে বিশ্বাস করো।
২ তুমি যা বিশ্বাস করো তার প্রতি সৎ থেকো।
৩ নিজের পরিবারের সঙ্গে থেকো।
 
বাংলাদেশে যখন রাজনীতি থেকে নীতি বিদায় নিয়েছে, সমাজ থেকে আদর্শ বিদায় নিয়েছে, শিক্ষায়তন থেকে মূল্যবোধ বিদায় নিয়েছে, তখন টনি বেনের এসব উপদেশ পলিটিশিয়ান, সমাজপতি ও শিক্ষাবিদরা প্রচারে উদ্যোগী হতে পারেন।
 
একাই একশ হতে পারে
৫ জানুয়ারি ২০১৪-র নির্বাচন বিহীন নির্বাচনে ইনডিয়া ব্র্যান্ড আওয়ামী লীগ “বিজয়ী” হবার পর এবং একজন (অবৈ:) প্রধানমন্ত্রী ক্ষমতা আকড়ে ধরে থাকার পর তরুণ-প্রবীণ কিছু রাজনৈতিক কর্মী-নেতা হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়েছেন। তারা যদি টনি বেনের জীবন পর্যালোচনা করেন অথবা তার আত্মজীবনীমূলক ডায়রিগুলো পড়েন তাহলে তারা আবার আশাবাদী হবেন। পুনরুজ্জীবিত হবেন। তারা বুঝবেন মানুষ একাই একশ হতে পারে। একাই অনেক কিছু ঘটিয়ে ফেলতে পারে।
আর সেখানেই (অবৈ:) প্রধানমন্ত্রী ও তদীয় পুত্রের ভয়। 
ইনডিয়ান সহযোগিতায় প্রতিটি দলের উপর নজরদারি করা যায়। দলের কিছু নেতাকর্মীকে ফাসি দেওয়া যায়। গুম করা যায়।
কিন্তু বাংলাদেশের প্রতিটি ব্যক্তির ওপর নজরদারি করা অসম্ভব। প্রতিটি ব্যক্তিকে গুম-খুন করা অসম্ভব।
ব্যক্তি যখন আদর্শে বলীয়ান এবং ক্ষোভে ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে, তখন কোনো সরকারের পক্ষেই তাকে সামলানো সম্ভব নয়। এটাই সত্য।
নারায়ণগঞ্জে সিরিয়াল অপহরণ, গুম ও খুন এবং তারপর শীতলক্ষ্যাতে সাতটি লাশ পাওয়ার পরে গত কয়েক দিনে সেই শহরে যে জনরোষ বিরাজ করছে সেসব এই সত্যটির প্রাথমিক প্রমাণ মাত্র।
 
ফিরে যাই সেই প্রথম প্রশ্নে।
টনি বেন কে ছিলেন?
এই প্রশ্নের উত্তরটা পাওয়া যায় জানুয়ারি ২০০৭-এ বিবিসি-র দি ডেইলি পলিটিক্স প্রোগ্রাম কর্তৃক পরিচালিত একটি জনমত জরিপে। এই জরিপে অংশগ্রহণকারী ভোটারদের ৩৮% -এর মতে বৃটেনের এক নাম্বার পলিটিকাল হিরো টনি বেন। মার্গারেট থ্যাচার পেয়েছিলেন ৩৫% ভোট।
 
এবার ফিরে যাবো ক্ষমতা হস্তান্তর প্রসঙ্গে। এই রচনার প্রথম তিনটি উদ্ধৃতিতে :
 
৩ টনি বেন আজীবন কর্মকাণ্ডে তার বাণী বাস্তবায়িত ও সফল করে গেছেন।
২ তাজউদ্দীন আহমদ যে সতর্কবাণী দিয়েছিলেন শেখ মুজিবুর রহমানকে, সেটাও বাস্তবে ঘটে গিয়েছে।
১ সজীব ওয়াজেদ জয় যে আত্মবিশ্বাসমূলক নির্ভয়বাণী দিয়েছেন সেটা কি বাস্তবে চলমান থাকবে? নাকি সেটা অবাস্তব ও ভুল প্রমাণিত হবে? ভবিষ্যতই সেটা বলে দেবে।
 
৩ এপৃল ২০১৪

সোমবার, ২৫ ফেব্রুয়ারী, ২০১৩

বাংলাদেশে নৈরাজ্যের প্রত্যাবর্তন


শ ফি ক রে হ মা ন




মঞ্চে উপস্থিত গুণীজন এবং সামনে উপস্থিত সুধীজন, সাংবাদিকজন ও ক্যামেরাজন।
১৪ ফেব্রুয়ারি ভালোবাসা দিনের কয়েকদিন পরে হলেও, আপনাদের সবাইকে জানাচ্ছি আমার হৃদয়ের অন্তঃস্থল থেকে গভীর ভালোবাসা এবং সেই সঙ্গে শ্রদ্ধা।
এখন বাংলাদেশে চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতার সাম্প্রতিক বহিঃপ্রকাশে সমাজের একাংশের কালেকটিভ সহিংসতা, নির্মমতা ও রূঢ়তার প্রতিফলন ঘটছে।
কিন্তু আপনারা নিশ্চয়ই স্বীকার করবেন যে, ঘৃণার চাইতে ভালোবাসার বাণী ভালো। হিংসার চাইতে অহিংসার আন্দোলন কাম্য। নির্মমের চাইতে মমতাময় আচরণ কাঙ্ক্ষিত। রূঢ়তার চাইতে নম্র ব্যবহারই সভ্য। এবং আরও ইম্পোরট্যান্ট হলো প্রতিশোধের চাইতে ক্ষমা এবং প্রতিহিংসার চাইতে দয়া—মানব সভ্যতার এই দুটি ধাপ পেরুনো। আমাদের সবাইকে মনে রাখতে হবে, এই সভ্যতার অস্তিত্ব বজায় রাখতে এবং তাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে দরকার যুদ্ধ নয়, দরকার শান্তি। যুদ্ধের কুিসত হুঙ্কার-স্লোগান মানুষ শুনতে চায় না—মানুষ শুনতে চায় শান্তির ললিত বাণী।
তাই ব্যক্তিগতভাবে আমি বেছে নিয়েছি ঘৃণা দিবস উদযাপনের পরিবর্তে ভালোবাসা দিন উদযাপনের বিভিন্ন পথ ও পন্থা।
গোলাপ ও চকলেট ভালোবাসার প্রকাশ
১৪ ফেব্রুয়ারি ভালোবাসা দিনে আমার এই অনুভূতি প্রচারের জন্য আমি সকাল থেকে রাত পর্যন্ত ছুটছিলাম এক টিভি স্টুডিও থেকে আরেক টিভি স্টুডিওতে। আমি আন্তরিক ধন্যবাদ জানাচ্ছি বাংলাভিশন, আরটিভি, এশিয়াটিভি, দিগন্ত টিভি, এটিএন বাংলা, মোহনা টিভি প্রভৃতির কর্তৃপক্ষ ও কর্মকর্তাদের, যারা আমাকে ভালোবাসা তথা শান্তির বাণী প্রচারের সুযোগ দিয়েছেন। থ্যাংকস এ লট।
আপনারা নিশ্চয়ই স্বীকার করবেন যে, আমার হাতের গোলাপ ও চকলেট হচ্ছে মানুষের কোমল অনুভূতির সুন্দর প্রকাশ। কিন্তু আমি যদি আজ এখানে উপস্থিত হই রক্তাক্ত ছুরি চাপাতি নিয়ে, তাহলে সেটা হবে মানুষের নিষ্ঠুর অনুভূতির অসুন্দর প্রকাশ। একই সঙ্গে আমি বলতে পারি, ফাঁসিও মানুষের বর্বর আচরণের অসভ্য প্রকাশ।
রাজাদের আমলে প্রাণদণ্ড
সম্প্রতি বাংলাদেশে যে ফাঁসি চাই আন্দোলন চলছে, তার প্রেক্ষিতে আমি জানার চেষ্টা করেছি আমাদের এই ভূখণ্ডে অতীতে মানুষের প্রাণদণ্ড কীভাবে কার্যকর করা হতো।
যখন এই দেশে রাজাদের রাজত্ব ছিল, অর্থাত্ ১৮৫৮-তে ব্রিটিশরাজ শুরু হওয়ার আগে, তখন মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তিকে হাত-পা বাঁধা অবস্থায় মাটিতে রাখা একটা পিঁড়িতে মাথা পাততে হতো। তারপর একটি হাতি তার শুঁড় দিয়ে ওই ব্যক্তির হাত-পা ছিঁড়ে ফেলতো। সবশেষে ব্যক্তির মাথা পিষ্ট করতো হাতির পা। কী বিতিকিচ্ছি দৃশ্য ছিল ভেবে দেখুন আপনারা। নিহত মানুষটির রক্ত, ঘিলু চারদিকে ছিটকে পড়ছে।
অষ্টাদশ ও ঊনবিংশ শতাব্দীতে ব্রিটিশরাজ এ ধরনের মৃত্যুদণ্ড এখানে নিষিদ্ধ করে দেয়।
রাজাদের রাজত্বে আরেকটা পদ্ধতি ছিল মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তিকে শূলে চড়ানো। কী ভয়ঙ্কর দৃশ্য ছিল ভেবে দেখুন। নিহত মানুষের গুহ্যদ্বার থেকে ধীরে ধীরে উপরের দিকে উঠে যাচ্ছে একটি লোহার শলাকা। আপনারা কি চিন্তা করতে পারেন, সেই সময়ে ওই ব্যক্তিটির মৃত্যুযন্ত্রণা কেমন ছিল? কেমন ছিল তার আর্তচিত্কার?
আরও আশ্চর্যের বিষয় ছিল, এসব মৃত্যু দেখতে বহু মানুষ জড়ো হতো, যেমনটা এই একবিংশ শতাব্দীতে মানুষ জড়ো হয় সউদি আরব, ইরান, আফগানিস্তানে শিরশ্ছেদ দেখতে। অর্থাত্, এখনও মানুষ কালেকটেড হয় মৃত্যু দেখতে এবং কালেকটিভলি মানুষ দেখে মৃত্যু। এটাকে যদি আপনারা অসভ্য বা বর্বর বলেন, তাহলে বর্তমান সময়ে কিছু ব্যক্তি বিচারবহির্ভূতভাবে কালেকটিভলি অপর কিছু ব্যক্তির ফাঁসি চাইছে, সেই দাবিকে আপনারা কি সভ্য অথবা মানবিক বলতে পারবেন?
ফাঁসিতে একটি মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার ঘটনা আমি আজ আপনাদের মনে করিয়ে দিতে চাই। ইরাকে প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেনের শাসন আমলে প্রধান বিচারপতি ছিলেন আওয়াদ হামেদ আল-বন্দর। সাদ্দাম সরকারের পতনের পর তার বিচার হয়। মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের অভিযোগ প্রমাণ হওয়ার পর তাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়। তখন তার বয়স ছিল ৬২। ১৫ জানুয়ারি ২০০৭-এ তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। ফাঁসিতে ঝুলে যাওয়ার পরপরই দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় আল-বন্দরের মাথা এবং সেটা মেঝেতে গড়িয়ে কিছুটা দূরে চলে যায়।
এখন ধরুন, এই বয়সের এক ব্যক্তিকে যদি শাহবাগে ফাঁসি দেয়া হয়, তাহলে তার দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে রক্তাক্ত মুণ্ডুটা ছিটকে এসে আপনার কোলে পড়ে, তাহলে কি আপনি আনন্দিত হবেন? নাকি আতঙ্কিত হবেন? উল্লসিত হবেন? নাকি ভীত হবেন? উত্তরটা আপনিই জানেন।
ব্রিটিশ আমলে প্রাণদণ্ড
ফিরে যাই অতীতে। ঊনবিংশ শতাব্দীতে ব্রিটিশরা সভ্য হওয়ার চেষ্টা করছিল। অতীতে নিজেদের দেশে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্তদের শিরশ্ছেদ করা হতো কুড়াল দিয়ে টাওয়ার অফ লন্ডনে। কালক্রমে ব্রিটিশরা নিজেদের দেশে এবং তাদের উপনিবেশ ইনডিয়াতে, ফাঁসির ব্যবস্থা চালু করে। ফাঁসির পূর্বমুহূর্তে দণ্ডিত ব্যক্তির মাথায় যমটুপি বা কালো টুপি পরিয়ে দেয়া হতো যেন তার মৃত্যুযন্ত্রণার বীভত্স চেহারা উপস্থিত ব্যক্তিদের দেখতে না হয়। এসব ফাঁসি দেয়া হতো জেলখানায়, যেখানে সাধারণ মানুষ বা দর্শকের উপস্থিতি নিষিদ্ধ ছিল। সেখানে উপস্থিত থাকতেন শুধু জেল কর্তৃপক্ষ, ডাক্তার প্রমুখ সরকারি লোকজন। অর্থাত্ মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হতো, লোকচোখের আড়ালে।
একদিকে ব্রিটিশরা আইন প্রয়োগ করে ফাঁসি দিলেও অন্যদিকে তারা আইনবহির্ভূত ফাঁসি বন্ধ করেছিল। ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে সারা ইনডিয়াতে ঠগী দস্যুরা নিরীহ মানুষকে রুমাল দিয়ে ফাঁসি দিত। ১৮৩৬ থেকে ১৮৪২-এর মধ্যে ব্রিটিশরা দি ঠাগিস অ্যান্ড ড্যাকোইটি সাপ্রেশন (ঠগী ও ডাকাতি দমন) আইনগুলো পাস করেছিল।
এই ছিল ব্রিটিশরাজের সময়ে ফাঁসির ব্যবস্থা। তখন প্রকাশ্যে ফাঁসি হতো না। প্রকাশ্যে ফাঁসির দাবিও উঠতো না।
আমি এতক্ষণ অতীতের কথা বললাম, এই কারণে যে আমরা বর্তমানে কোন ধরনের রাজ্যে বসবাস করছি, সে বিষয়ে আপনাদের সচেতন করতে। প্রসঙ্গত জানিয়ে রাখছি, বর্তমানে ৯৭টি দেশ মৃত্যুদণ্ড বন্ধ করেছে। ৫৮টি দেশে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। আর বাদবাকি দেশে মৃত্যুদণ্ডের আইন থাকলেও সেটা খুব কমই কার্যকর করা হয়। বিশ্বে সবচেয়ে বেশি হত্যার রেকর্ডধারী নরওয়ের ৩৪ বছর বয়স্ক অ্যানডার্স বেহরিং ব্রেভিক ২২ জুলাই ২০১১-তে নরওয়ের অসলো এবং উলেয়া-তে একদিনে, গাড়িবোমা ফাটিয়ে এবং গুলি চালিয়ে ৭৭ জনকে নিহত এবং ২৪২ জনকে আহত করে। বিচারের পর তাকে ২১ বছরের জেলদণ্ড দেয়া হয়। ফাঁসি নয়। তবে এই জেলদণ্ডের সময় বাড়ানোর সম্ভাবনা আছে।
চান্স এডিটরের অবস্থান ও দুরবস্থা
সিরামিকস ইনডাস্ট্রি বিশেষজ্ঞ, ইনভেস্টমেন্ট বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান, সরকারের সাবেক জ্বালানি উপদেষ্টা এবং বর্তমানে লেখক ও আমার দেশ পত্রিকার সম্পাদক মি. মাহমুদুর রহমানের সদ্য প্রকাশিত বই গুমরাজ্যে প্রত্যাবর্তন বিষয়ে আমাকে কিছু বলার অনুরোধ করা হয়েছিল। ধন্যবাদ এই বইয়ের লেখক, প্রকাশক ও সংশ্লিষ্ট সবাইকে। কারণ এই চান্সে আমি একজন চান্স এডিটরের, সাবেক বিচারপতি খায়রুল হকের ভাষায়, বর্তমান অবস্থান ও দুরবস্থা সম্পর্কে কিছু বলতে চাই।
প্রথমত, আপনারা জানেন মাহমুদুর রহমান বর্তমানে অবরুদ্ধ অবস্থায় তার পত্রিকা অফিসে দিনযাপন করতে বাধ্য হচ্ছেন। অন্য সবকিছু বাদ দিলেও, এটা বলা যায়, একই অফিসে দিনের পর দিন কাটানো তার স্বাস্থ্যের জন্য ভালো হতে পারে না। আমি মনে করি, এক্ষেত্রে সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে এবং মাহমুদুর রহমান ও তার পরিবারের সার্বিক ও সম্পূর্ণ নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। তারা যেন নিরাপদে তাদের বাড়িতে থাকতে পারেন এবং অফিসে যাতায়াত করতে পারেন, সেই ব্যবস্থা সরকারকেই নিতে হবে। এ প্রসঙ্গে আমি ধন্যবাদ জানাতে চাই সরকারকে। আপনারা জানেন, শাহবাগ-জনতার উগ্র ঘোষণার পরপরই সরকার নিরাপত্তা বাহিনী মোতায়েন করেছিল, আমার দেশ পত্রিকার অফিস ভবনের নিচতলায়।
ডাবল স্ট্যান্ডার্ড নয়
দ্বিতীয়ত, আপনাদের মধ্যে কেউ কেউ হয়তো জানেন মাহমুদুর রহমানের চরিত্র হননের ব্যর্থ চেষ্টায় কে বা কারা মাহমুদুর রহমানের কিছু টেলিফোন কথোপকথন ফেসবুকে তুলে দিয়েছেন। এসব কথা তিনি বলেছেন তার স্ত্রী পারভীন এবং তার কিছু শুভাকাঙ্ক্ষীর সঙ্গে। কথাপ্রসঙ্গে পারভীন বুঝিয়ে দিয়েছেন কীভাবে ফটোশপ পদ্ধতিতে শাহবাগের অতিরঞ্জিত ছবি দৈনিক প্রথম আলো প্রকাশ করেছে এবং সেটা শুনে মাহমুদুর রহমান প্রথম আলোকে একটা গালি দিয়েছেন। এতে মাহমুদুর রহমানের বিন্দুমাত্র বিব্রত বা লজ্জিত হওয়ার কারণ নেই। কারণ, এসব কথোপকথন বা ফোন কনভারসেশন শুনলেই বোঝা যাবে, মাহমুদুর রহমানের কোনো ডাবল স্ট্যান্ডার্ড বা দ্বিমুখী আচরণ নেই। তিনি যা প্রকাশ্যে এবং অপ্রকাশ্যে বলেন, সেসব তিনি টেলিফোনেও বলেছেন।
আর এখানেই ফাঁস করা এই টেলি কনভারসেশনের সঙ্গে আন্তর্জাতিক যুদ্ধ অপরাধ ট্রাইব্যুনালের বিচারপতি নিজামুল হকের সঙ্গে ব্রাসেলস প্রবাসী জনৈক বাঙালি আইনবিদের সঙ্গে তার স্কাইপ কনভারসেশন ফাঁস হয়ে যাওয়ার মৌলিক তফাত্। স্কাইপ কনভারসেশনে সুস্পষ্টভাবে প্রমাণ হয়ে যায় বিচারপতি নিজামুল ডাবল স্ট্যান্ডার্ড বা দ্বৈতনীতি অনুসরণ করছেন। একদিকে তিনি প্রকাশ্যে নিরপেক্ষ ও ন্যায়পরায়ণ বিচারপতির ভূমিকায় অভিনয় করছেন; অন্যদিকে তিনি গোপনে পক্ষপাতদুষ্ট হয়ে সরকারের পক্ষে কীভাবে রায় দেয়া যায়, সেই বিষয়ে ব্রাসেলস নিবাসীর সঙ্গে আলোচনা করছেন। আপনারা জানেন, এই ডাবল স্ট্যান্ডার্ড ধরা পড়ে যাওয়ার পর ওই বিচারপতিকে ওই ট্রাইব্যুনাল থেকে বিদায় নিতে হয়। মাহমুদুর রহমান একই জায়গাতেই ছিলেন এবং আছেন। সুতরাং তাকে তার পদ ত্যাগ করতে হয়নি।
মাহমুদুর রহমানের সঙ্গে বহু বিষয়ে আমার মতপার্থক্য আছে। তার রাজনৈতিক দর্শন আমার চাইতে ভিন্ন। কিন্তু এটা স্বীকার করতেই হবে, মন্ত্রী থাকাকালে তার দুর্নীতি-ঊর্ধ্ব ভূমিকা এবং চান্স এডিটর, আবারও সেই বিচারপতি খায়রুল হকের ভাষায়, মাহমুদুর রহমানের সাহস অনুকরণীয়।
বেঠিক শিরোনাম
তৃতীয়ত, মাহমুদুর রহমানের বইয়ের শিরোনামটি আমার কাছে মনে হয়েছে বেঠিক। বাংলাদেশ কি গুমরাজ্যে ফিরে গিয়েছে? না। বাংলাদেশ ফিরে গিয়েছে নৈরাজ্যে। ব্রিটিশরাজ নয়, ইনডিয়ান রাজা-বাদশাহদের রাজ্যে নয়, একেবারে সেই আদিম অন্ধকার যুগের নৈরাজ্যে। যেখানে সমাজ ছিল না, রাজ্যও ছিল না। যেখানে নিয়ম ছিল না, আইন ছিল না। আজকের এই নৈরাজ্যের পরিণতি হতে পারে আরও অসভ্যতা, বর্বরতা এবং আরও নৈরাজ্য।
তাই কখনোই যেন মাহমুদুর রহমানকে নৈরাজ্যে প্রত্যাবর্তন শিরোনামে কোনো বই লিখতে না হয়, সেই কামনা করছি। আরেকটি কথা, মাত্র কয়েকদিন আগে মাহমুদুর রহমান বাধ্য হয়েছেন দৈনিক আমার দেশ পত্রিকার দাম বাড়াতে। পত্রিকাটির দাম এখন হয়েছে বারো টাকা। আপনারা অনেকেই জানেন পত্রিকার সার্কুলেশন বেশি হলে পত্রিকার ক্ষতি হয়, যদি না যথেষ্ট পরিমাণে বিজ্ঞাপন পাওয়া যায়। তখন প্রতি কপির দাম না বাড়িয়ে উপায় থাকে না। দৈনিক আমার দেশ-এ সরকারি বিজ্ঞাপন, সরকার সমর্থক বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলোর বিজ্ঞাপন এবং সরকারের ভয়ে ভীত বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলোর বিজ্ঞাপন আসছে না অথবা খুব কমে গেছে—সেহেতু শুধু সার্কুলেশনের ওপর বেঁচে থাকতে হলে কপির দাম তাকে বাড়াতেই হবে। অন্যথায় বর্ধিত জনপ্রিয়তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে বর্ধিত পরিমাণ নিউজপৃন্ট কেনা সম্ভব হবে না। আর সেক্ষেত্রে আমার দেশ যে বার্তা ও মতামত প্রচার করছে, সেটা সীমিত হয়ে যাবে। তাই মাহমুদুর রহমানের গুণগ্রাহীদের কাছে আমার আবেদন, আপনারা আমার দেশ পত্রিকায় যেন বিজ্ঞাপন আসে সেদিকে প্রভাব খাটান। অন্তত এই দায়িত্বটুকু আপনারা পালন করুন। বিজ্ঞাপনদাতাদের আপনারা জানিয়ে দিন, ঢাকা ও সিলেটে আমার দেশ-এর সার্কুলেশন এখন মৃত্যুদণ্ডকামীদের পৃষ্ঠপোষক পত্রিকাগুলোর চাইতে বেশি। আর হ্যাঁ, আপনারা সবাইকে অনুরোধ করবেন মাহমুদুর রহমানের বইগুলো কিনতে। তা না হলে আজকের এই সমাবেশের লক্ষ্য ব্যর্থ হবে।
লন্ডনে ৩৫ বছরের অবস্থান আন্দোলন সফল হওয়ার কারণ
গত ৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৩-তে শাহবাগ স্কোয়ারে তরুণ-কিশোর-মাঝবয়সী এবং কিছু শিশুর যে সম্মিলন ঘটেছে, সেটা দেখে আমার মনে পড়েছে লন্ডনে ট্রাফালগার স্কোয়ারের পাশে অবস্থিত সাউথ আফৃকা ভবনের সামনে নেলসন ম্যানডেলার মুক্তির এবং সাউথ আফৃকাতে অ্যাপারথেইড বা বর্ণবাদ অবসানের জন্য ১৯৫৯ থেকে ১৯৯৪ পর্যন্ত জাতি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সুদীর্ঘ ৩৫ বছর যাবত্ একটানা দিনরাত চব্বিশ ঘণ্টা জনসমাবেশ। শীত বরফ বৃষ্টি গরম উপেক্ষা করে এই জনসমাবেশে কখনো বা একটা ছোট তাঁবুর নিচে বিশ-পঁচিশজন আন্দোলনকারী, আবার কখনো বা ভালো আবহাওয়ার সময়ে কয়েকশ’ মানুষ সমবেত হতেন। আমি সেই সময়ে লন্ডনে ছিলাম এবং কাছেই বিবিসিতে মধ্যরাতে নাইট ডিউটি সেরে ফেরার পথে একাধিক রাতে সাউথ আফৃকা ভবনের সামনে গিয়ে আন্দোলনকারীদের প্রতি একাত্মতা প্রকাশ করেছিলাম। শেষ পর্যন্ত এই আন্দোলনের লক্ষ্য অর্জিত হয়। রোবেন আইল্যান্ড ও পলসমুর পৃজনে সুদীর্ঘ সাতাশ বছর সশ্রম জেল খাটার পর ১৯৯০-এ নেলসন ম্যানডেলা মুক্তি পান। এবং ১৯৯৪-এ সাউথ আফৃকাতে বর্ণবাদের অবসান ঘটে। আন্দোলনকারীরা বাড়ি ফিরে যান লক্ষ্য অর্জিত হওয়ার পর। পক্ষান্তরে শাহবাগ আন্দোলনকারীরা বলেছিলেন, লক্ষ্য অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত তারা বাড়ি ফিরে যাবেন না; কিন্তু তারা ফিরে যান। শুধু তা-ই নয়, ১৭ দিন ফাঁসির দাবি তুলে বাড়ি ফেরার সময়ে যে ছয়টি দাবি তারা পেশ করেন, সেখানে ফাঁসির দাবি ছিল না।
সাউথ আফ্রিকার ওই আন্দোলন সফল হওয়ার অন্যতম কয়েকটি কারণ ছিল—
এক. এটি ছিল নির্যাতনকারী একটি সরকারের বিপক্ষে।
দুই. এক বন্দি রাজনৈতিক নেতার মুক্তির লক্ষ্যে। এবং
তিন. ঘৃণিত বর্ণবাদের অবসান ঘটিয়ে মানবতাবাদ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে।
বাংলাদেশে ব্যর্থ সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা
কিন্তু বাংলাদেশের শাহবাগ আন্দোলন চলেছে একটি ব্যর্থ সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায়। এর লক্ষ্য কারও মুক্তি নয়—লক্ষ্য কারও ফাঁসি এবং তাও বিচারবহির্ভূতভাবে। এর লক্ষ্য মানবতাবাদ প্রতিষ্ঠা নয়—ঘৃণাবাদ প্রচার করা। এ সবই অশুভ এবং তাই এই আন্দোলন শেষ পর্যন্ত সফল হবে না। সাউথ আফৃকার আন্দোলন সফল হয়েছিল কারণ সেটা ছিল অশুভর বিপক্ষে, শুভর পক্ষে। বন্দিত্বের বিপক্ষে, মুক্তির পক্ষে। মৃত্যুর বিপক্ষে, জীবনের পক্ষে।
তাই আশ্চর্য নয়, সাধারণ মানুষের মধ্যে শাহবাগ আন্দোলনের তীব্র সমালোচনা হয়েছে। তারা লক্ষ্য করেছে একটি পর্যায় থেকে শাহবাগ আন্দোলন নিয়ন্ত্রণ করেছে আওয়ামী লীগ সরকার সমর্থকরা। আর সেজন্যই এই জনসমাবেশ থেকে আওয়ামী সরকারের বিভিন্ন ব্যর্থতা বিষয়ে কোনো দাবি ওঠেনি। এসব ব্যর্থতার মধ্যে রয়েছে পদ্মা সেতু দুর্নীতি, ডেসটিনি এবং ইউনিপেটুইউসহ প্রায় ত্রিশটি মালটি লেভেল মার্কেটিং কম্পানি দ্বারা আধা কোটির বেশি মানুষকে প্রতারণা করা, হলমার্ক এবং অন্যান্য কম্পানির মাধ্যমে বিশেষত সরকারি ব্যাংক লুটপাট করা, গ্রামীণ ব্যাংকে অবাঞ্ছিত সরকারি হস্তক্ষেপ, কুইক রেন্টাল দ্বারা বিদ্যুতের দাম কুইক বাড়িয়ে আওয়ামী সমর্থকদের কুইক ধনী করা, শেয়ারবাজারে প্রায় তেত্রিশ লক্ষ বিনিয়োগকারীকে নিঃস্ব করা, মিডল ইস্ট থেকে চাকরি হারিয়ে প্রায় দেড় লক্ষ শ্রমিকের দেশে ফেরা, গার্মেন্ট শিল্পে যথার্থ নিরাপত্তা বিধানে অসমর্থ হওয়া এবং নৌ ও স্থলপথে দুর্ঘটনা রোধে বিফল হওয়া।
আজই দৈনিক মানবজমিনের একটি রিপোর্ট বলেছে, চাঁদপুরের মেঘনা-পদ্মা-ডাকাতিয়ায় বারো বছরে বারোটি লঞ্চডুবিতে কয়েকশ’ মানুষের মৃত্যু হয়েছে। শাহবাগ স্কোয়ারে সমাবেশের সময়েও লঞ্চডুবিতে বহু যাত্রীর মৃত্যু হয়েছে। এই বারো বছরে গার্মেন্ট শিল্পে কতোজনের মৃত্যু ঘটেছে? রোড অ্যাকসিডেন্টে কতোজনের মৃত্যু ঘটেছে? কতো মানুষ পঙ্গু হয়েছে? এসব তথ্য জানার জন্য এবং প্রতিকার বিধানের জন্য শাহবাগ স্কোয়ার থেকে দাবি ওঠা উচিত ছিল। একজন মানুষের ফাঁসি দাবির পরিবর্তে হাজার হাজার মানুষের প্রাণরক্ষার আওয়াজ ওঠা উচিত ছিল। একজন জল্লাদের চাকরির পরিবর্তে বেকার মানুষের কর্মসংস্থানের দাবি করা উচিত ছিল। শাহবাগ আন্দোলনকারীরা এখনও তা-ই করতে পারেন এবং একইসঙ্গে জুড়ে দিতে পারেন নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দামের ঊর্ধ্বগতি বন্ধ করতে। এ সবই বর্তমান সময়ের সাধারণ মানুষের দাবি।
শাহবাগ আন্দোলনকারীরা বলতে পারেন, শাহবাগের জনসংখ্যাই সাধারণ মানুষের প্রতিনিধিত্বের পরিচায়ক। কিন্তু এই ধারণা ভুল। তারা হয়তো সাধারণ মানুষের একাংশের প্রতিনিধিত্ব করছেন, বৃহত্ অংশের নয়। আমার এই কথাটি যে ভুল, সেটা প্রমাণের জন্য তারা দুটি চ্যালেঞ্জ নিতে পারেন।
দুটি চ্যালেঞ্জ ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি
এক. অভিযুক্ত বন্দি দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীকে একদিনের জন্য প্যারলে একটি জনসমাবেশ করার অনুমতি দিলে সেই সমাবেশে জনসংখ্যা কতো হয়, সেটা তারা দেখতে পারেন।
দুই. যেহেতু কোনো নির্দিষ্ট দিনে শুধু কিছু নির্দিষ্ট স্থানে জনসমাবেশ ঘটানো সম্ভব, সেহেতু এই চ্যালেঞ্জে দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী বিজয়ী হলেও সামগ্রিকভাবে দেশে কোন পক্ষে কতো মানুষ আছে, সেটা জানার জন্য একটি নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে একই দিনে অবাধ ও সুষ্ঠু সাধারণ নির্বাচনের ডাক দিন।
সুকুমারবৃত্তির নয়, নিষ্ঠুরতার প্রকাশ
বস্তুত বিএনপিসহ অন্যান্য বিরোধী দল তত্ত্বাবধায়ক সরকারের যে দাবি তুলেছে সেখান থেকে এবং আওয়ামী সরকারের সার্বিক ব্যর্থতা থেকে সাধারণ মানুষের চোখ সরানোর লক্ষ্যেই আওয়ামী সরকার শাহবাগ সমাবেশে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা দিয়েছে, আইন ও আদালতবিরোধী এই জনসমাবেশকে সরকারি অনুমোদন দিয়েছে।
শাহবাগ আন্দোলনের কিছু বৈপরীত্য কল্পনাকে হার মানিয়েছে। মোমবাতি, আলপনা ও গান মানুষের সুকুমারবৃত্তির প্রকাশ মাধ্যম হতে পারে। কিন্তু সেখানে শোনা গেছে মোমবাতির নরম আলোর বিপরীতে আগুন জ্বালো, আগুন জ্বালো গরম স্লোগান। আলপনার সৌন্দর্যের বিপরীতে দেখা গেছে ফাঁসিকাঠের পুতুল ও ফাঁসির দড়ির নিষ্ঠুরতা। সারল্য ও নিষ্পাপতার প্রতীক শিশুদের মাথায় দেখা গেছে ফাঁসির নির্মম বাণীর হেডক্যাপ, তাদের হাতে দেখা গেছে ফাঁসি চাই লেখা কেক-পেসটৃ।
এই শিশুরা কি বোঝে ফাঁসি চাই কী? তাদের সুকুমারবৃত্তি এভাবে নষ্ট করে দেয়ার অধিকার কোনো পিতামাতার আছে কি?
প্রসঙ্গত আমি শাহবাগ আন্দোলনের অন্যতম নেতা ব্লগার রাজীবকে হত্যার তীব্র নিন্দা জানাতে চাই। এ ধরনের নিষ্ঠুর অকাল মৃত্যু কারও কাম্য হতে পারে না। মানুষের মৃত্যু নয়—জীবনই কাম্য।
রাজীব নয়, দায়ী তার সমর্থকরা
আমরা কেউ জানি না রাজীব কেন খুন হয়েছেন। তবে আমি বলতে চাই লেখার উত্তর লেখাতেই কাম্য। রাজীব তার ব্লগে যা লিখেছিলেন, তাতে ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের অনুভূতি আহত হয়েছে। বিশ্বে এখন প্রায় সাতশ’ কোটি মানুষ আছে, এদের মধ্যে যে কেউ ইন্টারনেটে ইসলামবিরোধী লেখা পোস্ট করতে পারে। তাতে বিচলিত হয়ে উগ্রমূর্তি ধারণ করলে ক্ষতি বই লাভ হবে না। এখানে যেটা বিবেচ্য সেটা হলো, রাজীবের আদর্শের প্রতি অকুণ্ঠ সমর্থন জানিয়েছেন এই দেশের প্রধানমন্ত্রীসহ আরও কিছু ব্যক্তি। রাজীব ব্যক্তি হিসেবে যা করেছেন, তাকে দলগত সমর্থন জানিয়েছেন তারা এবং সেভাবেই তারা দেশগত ধর্মীয় অনুভূতিকে আহত করেছেন। এটা নিন্দনীয় এবং বিপজ্জনক। গোটা দেশকে আজ নাস্তিক বনাম আস্তিকের গৃহযুদ্ধের দিকে পরিকল্পিতভাবে ঠেলে দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী ও তার অনুসারীরা।
যারা সুস্থ মানুষ, যারা শান্তি ও অহিংসায় বিশ্বাস করেন, যারা মমত্ব ও ভালোবাসায় আস্থা রাখেন, তাদের ওপর আজ গুরুদায়িত্ব পড়েছে বর্তমান নৈরাজ্য থেকে দেশের মানুষকে মঙ্গলের দিকে, নিয়মের দিকে, আইনের দিকে ফিরিয়ে আনার।
যুদ্ধাপরাধীরূপে সন্দেহভাজনদের বিচার চাইতে পারেন শাহবাগ আন্দোলনকারীরা, কিন্তু বিচারবহির্ভূত মৃত্যুদণ্ডের দাবি তারা তুলতে পারেন না। আশা করবো, ফাঁসির দাবি, তা-ও বিচারবহির্ভূত এবং সম্মিলিতভাবে তোলাটা যে কতো অসভ্যতা ও বর্বরতা, সেটা সবাই অচিরেই বুঝবেন এবং বিশ্ববাসীর সামনে বাংলাদেশকে কলঙ্কিত করা থেকে বিরত হবেন।
মৃত্যুদণ্ডের বিরুদ্ধে লেখা ও ম্যানিফেস্টো
আমি নিউজপেপার ও টেলিভিশনে সংশ্লিষ্ট সবাইকে অনুরোধ করবো তারা যেন একটু কষ্ট করে, পড়াশোনা করে জানার চেষ্টা করেন কেন এবং কখন বিশ্বের বিভিন্ন দেশে মৃত্যুদণ্ড নিষিদ্ধ হয়ে গিয়েছে।
এপৃল ১৯৮০-তে সউদি আরবের একজন পৃন্সেস প্রেমে পড়েছিলেন এক সাধারণ সউদি যুবকের। সউদি রাজপরিবার এই বিয়েতে রাজি না হওয়ায় ওই প্রেমিকযুগল দেশ থেকে পালানোর চেষ্টা করেন। কিন্তু তারা ধরা পড়েন এবং উভয়েরই শিরশ্ছেদ করা হয়। ওই ঘটনায় বিশ্ববাসীর বিবেক তাড়িত হয় এবং বিবিসি তখন ডেথ অফ এ পৃন্সেস নামে একটি ডকুমুভি প্রচার করে। ওই ঘটনা ও মুভি আমাকে খুব আলোড়িত করে এবং আমি যায়যায়দিন নামে একটি ধারাবাহিক কলাম লেখা শুরু করি সাপ্তাহিক সচিত্র সন্ধানীতে। এ ঘটনাই আমাকে রাজনৈতিক লেখকরূপে নিয়ে আসে। ওই লেখার সূচনাতেই আমি ওই মুভির ক্লিপ দেখে প্রাণদণ্ডের তীব্র সমালোচনা করি এবং এখনো করে যাচ্ছি।
আমি এটাও আশা করবো, যদি ক্ষমতার পটপরিবর্তন হয় এবং আজ যারা নিগৃহীত ও নির্যাতিত হচ্ছেন, তারা যদি ক্ষমতায় আসেন, তখন যেন তারা প্রতিহিংসা-প্রতিশোধ নেয়ার জন্য ফাঁসির দাবি না তোলেন। ফাঁসি যেন তারা বাংলাদেশে চিরনিষিদ্ধ করেন। আমি আশা করি বিএনপি, জামায়াত ও জাতীয় পার্টি আগামী নির্বাচনী ম্যানিফেস্টোতে মৃত্যুদণ্ড নিষিদ্ধকরণের অঙ্গীকার করবে।
মৃত্যু নয় জীবনে, ঘৃণায় নয় ভালোবাসায়
গৃহযুদ্ধে নয় শান্তিতে
আমি মৃত্যুতে নয়, জীবনে বিশ্বাসী।
আমি ঘৃণায় নয়, ভালোবাসায় বিশ্বাসী।
আমি গৃহযুদ্ধে নয়, শান্তিতে বিশ্বাসী।
আমি ফাঁসির মঞ্চ ও দড়িতে নয়, গোলাপ ও চকলেটে বিশ্বাসী।
সবাইকে চকলেট উপহার দিচ্ছি।
সবাই এখন চকলেট খেলে খুশি হবো।
এতক্ষণ আমার কথা শোনার জন্য সবাইকে ধন্যবাদ।
থ্যাংক ইউ।

গুমরাজ্যে প্রত্যাবর্তন বই প্রকাশনা উপলক্ষে ভাষণ


জাতীয় প্রেস ক্লাব

২৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৩

মঙ্গলবার, ১৭ এপ্রিল, ২০১২

উই রিভোল্ট! আমরা বিদ্রোহ করলাম!


২০১২-০৪-০৮

গতকাল সাতটি বইয়ের মোড়ক উন্মোচন করেছেন বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল, বিএনপি-র চেয়ারপারসন ম্যাডাম খালেদা জিয়া। ইতিমধ্যে আপনারা জেনেছেন, এই প্রকাশনা উৎসব করতে ৰমতাসীন সরকার আরোপিত বিভিন্ন বাধা পেরোতে হয়েছে।
প্রথমে ম্যাডাম খালেদা জিয়ার পাচটি বইয়ের মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠান হওয়ার কথা ছিল ২৭ মার্চ ২০১২-তে সোনারগাও হোটেলের বলরম্নমে। এই অনুষ্ঠানের আয়োজক গ্রম্নপ ২০০৯, সংৰেপে জি-৯ এ জন্য এক মাস আগে ২৭ ফেব্রম্নয়ারিতে ওই হোটেলে অ্যাডভান্স পেমেন্ট করেছিল এবং প্রায় ১,০০০ অতিথির নামে কার্ড বিলি করেছিল। কিন্তু ১৮ মার্চে সোনারগাও হোটেল কর্তৃপৰ সেই বুকিং ক্যানসেল করে জানায়, প্রধানমন্ত্রীর অফিস ঠিক সেই দিন, সেই সময়ে বুকিং চেয়েছে। তাই বিরোধী দলীয় নেত্রীর অনুষ্ঠানের বুকিং ক্যানসেল করতে তারা বাধ্য হয়েছে।
এই বুকিং বাতিল হয়ে যাওয়ার পরে জি-৯ সাবেক শেরাটন, বর্তমানে রূপসী বাংলা হোটেলের উইন্টার গার্ডেন হল রম্নমটির বুকিং দেয়, দিন ও সময় অপরিবর্তিত রেখে । জি-নাইন নতুন কার্ড ছেপে আবারও বিলি করে।
অনুষ্ঠানের আগের রাতে। ২৬ মার্চ রাত সাড়ে দশটায় আমি রূপসী বাংলা হোটেলে যাই বিভিন্ন প্রস্তুতি কাজ সুসম্পন্ন হয়েছে কি না দেখার জন্য। তখন আমাকে বলা হয়, হোটেল কর্তৃপৰ ফোনে জানতে চেয়েছেন বইগুলোর বিষয়বস্তু কি এবং প্রকাশিত পাচটি বই তাদের কাছে পরদিন সকাল দশটায় জমা দিতে হবে। তারপর বইগুলো পরীৰা করে তারা জানাবেন, এই হোটেলে এ প্রকাশনা উৎসব করা যাবে কি না।
আমি অবাক হয়ে বললাম, পরদিন সকাল দশটায় যদি বলা হয় এই হোটেলে অনুষ্ঠান করা যাবে না তাহলে আমরা কিভাবে অতিথিদের জানাবো যে অনুষ্ঠানটি বাতিল হয়ে গিয়েছে?
অতিথিরা হোটেলে এসে যদি বাতিল হওয়ার সংবাদটি পান তাহলে সেটা হবে হোটেল কর্তৃপৰের জন্য নিন্দাজনক এবং আয়োজক জি-নাইনের জন্য বিব্রতজনক। সুতরাং রূপসী বাংলায় অনুষ্ঠান হতে পারবে কি না সেটা রাতের মধ্যে জানাতে হবে।

রূপসী নয়, কুরূপা কুশ্রী কুচরিত্র
এর আধা ঘণ্টা পরে জি-নাইনের কাছে ০১৭১৩ ০৪৭ ৬৮৭ নাম্বার থেকে আসে একটি এসএমএস। তাতে লেখা ছিল :
Dear Sir, as I had shared with you few minutes earlier over cell phone that we cannot organize your event tomorrow. I have been instructed to you from authority of national intelligent department of Bangladesh. Sorry for the inconvenience.
Thanks n regards Mosharrof Hossain, Catering sales executive, Ruposhi Bangla Hotel.
অর্থাৎ, সুধী, কয়েক মিনিট আগে সেলফোনে আমি জানিয়েছিলাম আগামীকাল আপনাদের অনুষ্ঠান আমরা করতে পারবো না। এ বিষয়ে বাংলাদেশের জাতীয় গোয়েন্দা বিভাগের কর্তৃপৰ আমাকে নির্দেশ দিয়েছেন। আপনাদের অসুবিধার জন্য আমরা দুঃখিত। ধন্যবাদ ও শ্রদ্ধানেৱ মোশাররফ হোসেন, কেটারিং সেলস একজিকিউটিভ, রম্নপসী বাংলা হোটেল।

এভাবেই কিছু অকালকুষ্মাণ্ড, অর্বাচীন ও অভদ্র সরকারি কর্মচারিদের কাছে রূপসী বাংলা হোটেলটি হয়ে গেল কুরূপা, কুশ্রী ও কুচরিত্র। ঠিক ওই কর্মচারীদের পেছনে ৰমতাসীন লোকজনের মতোই!

এখন সোচ্চার তখন অনুপস্থিত
এখানে আমি বিনীতভাবে জানাতে চাই, একাত্তরে যখন এটি ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেল ছিল তখন আমি ছিলাম চিফ অ্যাকাউন্টেন্ট এবং এক পর্যায়ে যুদ্ধভীত শেতাঙ্গ জেনারেল ম্যানেজার বার্নার্ড হোল্ট ইংল্যান্ডে চলে গেলে আমি ছিলাম অ্যাকটিং জেনারেল ম্যানেজার। এ হোটেল থেকে আমারই উদ্যোগে ১৭ মার্চ ১৯৭১-এ শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মদিনে বাংলাদেশের ম্যাপ ও ফ্যাগ খচিত বড় বার্থডে কেক পাঠানো হয়েছিল তার ৩২ নাম্বার রোডের বাড়িতে। এ হোটেলে সেই সময়ে অবস্থানরত পাকিসৱানি নেতা জুলফিকার আলি ভুট্টোকে লিফটে আটকে রেখে স্যানডাল পেটা করা হয়েছিল তদানীনৱন সিকিউরিটি অফিসার মি. করিমের পস্ন্যান অনুযায়ী। পরবর্তীকালে এ ঘটনাটি তিনি লাল গোলাপ টিভি অনুষ্ঠানে বর্ণনা করেন। এই ব্যক্তিগত কথাগুলো বললাম এই জন্য যে, বর্তমানে মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে সবচেয়ে বেশি সোচ্চার প্রধানমন্ত্রীকে তখন কোনো মুক্তি আন্দোলনে অংশ নিতে আমি দেখিনি।
আমার বইগুলো প্রকাশনার তৃতীয় প্রচেষ্টায় ন্যাশনাল প্রেস কাবের শরণাপন্ন হই। প্রেস কাব কর্তৃপৰ সদয় ও সাহসী অনুমতি দেন। জি-নাইন তৃতীয়বার কার্ড ছাপে ও বিলি করে। ধন্যবাদ ন্যাশনাল প্রেস কাব কর্তৃপৰ ও সদস্যদের।

সরকার কেন বাধা দিল
সরকার কেন বই প্রকাশনা উৎসবে বাধা দিয়েছে তার কয়েকটি ব্যাখ্যা ইতিমধ্যে বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। এর একটি ব্যাখ্যা হলো, ২৭ মার্চ সোনারগাও ও রূপসী বাংলা হোটেলে বিদেশি কয়েক অতিথি ছিলেন। প্রকাশিতব্য পাচটি বইয়ের মধ্যে দুটি ইংরেজিতে।
সরকার চায়নি এ ইংরেজি বই দুটি বিদেশিদের হাতে পড়ুক। কারণ দুটি বই পড়লেই জানা যাবে স্বাধীনতার ঘোষণা ও মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে এই সরকার কি রকম মিথ্যাচার করেছে।
বস্তুত এ কারণেই আমি এসব বই লেখার তাড়না বোধ করেছিলাম।
আমি যখন দেখলাম এবং এখনো দেখছি, আমাদের ইতিহাস, বিশেষত স্বাধীনতার ঘোষণা ও স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস অবিরামভাবে বিকৃত করা হচ্ছে এবং অব্যাহতভাবে ভিন্নমত পোষণকারী প্রয়াত এবং জীবিত ব্যক্তিদের চরিত্র হনন করা হচ্ছে তখন আমি যন্ত্রণায় পড়ে যাই। আমি বাধ্য হই সেই যন্ত্রণায় বই লিখতে। আর তারই ফসল এ সাতটি বই ।
১৪ ফেব্রম্নয়ারি ২০১০-এ অর্থাৎ দুই বছর আগে টার্কির প্রেসিডেন্ট আবদুলস্নাহ গুল ঢাকায় এসেছিলেন। তার ঢাকা সফরের আগে টার্কিশ দূতাবাস ম্যাডাম জিয়ার কার্যালয়ে ফোন করে জানতে চান ম্যাডাম জিয়ার জীবনীমূলক প্রামাণ্য তথ্য। ওই তথ্য সরবরাহের দায়িত্ব আমার ওপর পড়ে। আমি অবাক হয়ে যাই দেখে যে, উইকিপিডিয়া থেকে শুরম্ন করে বিভিন্ন সূত্রে ম্যাডাম খালেদা সম্পর্কে তথ্যগুলো অসম্পূর্ণ, অসত্য অথবা অর্ধসত্য। এই সময়ে আমি ইংরেজিতে তার একটি সংৰিপ্ত জীবনী লিখি এবং সেটাই টার্কিশ দূতাবাসকে পাঠিয়ে দেয়া হয়। এরপরই ম্যাডাম খালেদার এ সংৰিপ্ত জীবনীর বাংলা ও ইংরেজি ভার্শন প্রকাশ করার কথা ভাবতে থাকি।

কে কখন কোথায়
কাজটি করতে গিয়ে আমি প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান-এর জীবন ও কর্মকাণ্ড সম্পর্কে কিছু রিসার্চে লৰ্য করি, তার সম্পর্কে অনেক অসত্য এবং অর্ধসত্য প্রচারিত হয়েছে। আরো দুঃখের বিষয় যে, এসব চালানো হচ্ছে সরকারিভাবে। শুধু তাই নয়, জিয়াউর রহমানের বিপরীতে আরেক ব্যক্তির স্তুতি ও বন্দনা একনিষ্ঠভাবে অহরহ চলছে। ফলে বিশেষত তরম্নণ প্রজন্মের পৰে বোঝা অসম্ভব হয়ে দাড়িয়েছে, স্বাধীনতা যুদ্ধের ঘোষণা কে বা কারা দিয়েছিলেন? কখন দিয়েছিলেন? স্বাধীনতা যুদ্ধে কে, কোথায় ছিলেন? প্রত্যৰ স্বাধীনতা যুদ্ধ কারা করেছিলেন?
এসব প্রশ্নের অনেক হাস্যকর উত্তর এখন পাওয়া যাচ্ছে। যেমন, একটি চাকরির ইন্টারভিউয়ের গল্প বললেই আপনারা সেটা বুঝবেন। গল্পটি হচ্ছে এ রকম :

সেনাবাহিনীতে নতুন সেনা নিয়োগ করা হচ্ছে। যুবকদের ইন্টারভিউ নিচ্ছেন জনৈক মেজর। তিনি প্রশ্ন করলেন, বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ তিনজন মুক্তিযোদ্ধা কে ছিলেন?
চাকরি পেতে ব্যগ্র যুবকটি উত্তর দিল : প্রথম জন ছিলেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। দ্বিতীয়জন ছিলেন গণতন্ত্রের মানসকন্যা জননেত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনা এবং স্যার, মাফ করবেন, আপনার নামটা জানি না, তৃতীয় জন ছিলেন আপনিই!

উই রিভোল্ট! আমরা বিদ্রোহ করলাম!
ইতিহাস বিকৃতির ফলটা কি হচ্ছে সেটা আশা করি আপনারা বুঝবেন।
তবে সত্য ইতিহাস লেখায় বিপদ হতে পারে। বিশেষত আজকের মিডিয়ার অধিকাংশ যখন একদলদর্শী বা ৰমতাসীন দলদর্শী। আপনি সত্য ইতিহাস বললে বা লিখলে অভিযুক্ত হতে পারেন, আপনি স্বাধীনতা যুদ্ধ বিরোধী, মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী, সামপ্রদায়িক, অগণতান্ত্রিক, হয়তো বা যুদ্ধাপরাধী! ইত্যাদি ইত্যাদি।
এই ধরনের মাতাল প্রচার এখন এমন পর্যায়ে চলে এসেছে যে, বলা হচ্ছে, জিয়াউর রহমান, যিনি নয় মাস স্বদেশে থেকে মুক্তিযুদ্ধ করেছেন তিনি ছিলেন পাকিসৱানি গুপ্তচর। সেই হিসেবে জিয়া হচ্ছেন নিন্দিত। আর যে নেতা নয় মাস বিদেশে, পাকিসৱানে বন্দি ছিলেন তিনিই হচ্ছেন নন্দিত।
সত্যটা হচ্ছে এই যে, ২৫ মার্চ ১৯৭১-এ রাত একটা থেকে রাত সোয়া দুইটার মধ্যে জিয়াউর রহমান চট্টগ্রাম পোর্ট এরিয়াতে ঘোষণা করেন, উই রিভোল্ট! আমরা বিদ্রোহ করলাম!
এই বিদ্রোহের বিবরণ প্রকাশিত হয় তারই জবানীতে, দৈনিক বাংলায় ২৬ মার্চ ১৯৭২-এর স্বাধীনতা সংখ্যায়। দৈনিক বাংলা ছিল সরকারি পত্রিকা। অর্থাৎ জিয়ার এ লেখাটি ছিল শেখ মুজিবুর রহমানের আওয়ামী লীগ সরকার কর্তৃক অনুমোদিত ও প্রকাশিত। এটাই তাহলে সত্য যে, ২৫ মার্চ রাত একটা থেকে সোয়া দুটোর মধ্যে জিয়া বিদ্রোহ ঘোষণা করে অস্ত্র হাতে তুলে নেন। এরপর আরেক সময়ে আনুষ্ঠানিকভাবে কালুরঘাট ট্রান্সমিটিং স্টেশন থেকে প্রথমে নিজের তরফ থেকে এবং পরে শেখ মুজিবুর রহমানের নাম নিয়ে তার পৰে স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। আমরা ঢাকায় এই ঘোষণা শুনেছিলাম ২৭ মার্চ ১৯৭১-এ।
নিয়তির সেন্স অফ টাইমিং
এখন তরম্নণ প্রজন্ম প্রশ্ন করতে পারে, সেই সময়ে শেখ মুজিবুর রহমান কোথায় ছিলেন?
নিয়তির কি অবাক সেন্স অফ টাইমিং!
জিয়াউর রহমান যখন চট্টগ্রামে ২৫ মার্চ দিবাগত রাত একটা থেকে সোয়া দুটোর মধ্যে স্বাধীনতা সংগ্রামে আত্মনিয়োগ করছিলেন ঠিক সেই সময়ে ঢাকায় শেখ মুজিবুর রহমান পাকিসৱানিদের কাছে আত্মসমর্পণ করছিলেন।
এখানে মনে করিয়ে দিতে পারি গ্যারিবল্ডি, ম্যাজিনি, মাও, ক্যাসট্রো-র মতো বিপস্নবী নেতারা বিপস্নবের সময়ে নিজে উপস্থিত থেকে সংগ্রাম করেছেন।
সে রকম কিছু না করে শেখ মুজিবুর রহমানের আত্মসমর্পণের পেছনে নিশ্চয়ই তার নিজস্ব জোরালো যুক্তি ছিল। আজ আমি সেই প্রসঙ্গে যাবো না। তবে এটুকু বলতে পারি, ৭ মার্চে তার ভাষণে অনুপ্রাণিত হয়ে জিয়াও মুক্তিযুদ্ধ শুরম্ন করেছিলেন। ঠিক তেমনি আমিও ’৭১-এ মুক্তি আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলাম। কিন্তু ১৯৭১-এ মুক্তিযুদ্ধে জিয়ার বীরত্ব এবং আগস্ট ১৯৭৫-এর পরে দেশ পুনর্গঠনে জিয়ার সবল নেতৃত্বের ইতিহাস যখন অনুচ্চারিত থাকে তখন সচেতন ব্যক্তি ও লেখকের ওপর দায়িত্ব বর্তায় সত্য ইতিহাসটা তুলে ধরার।
বলতেই হবে, ইতিহাস লেখার সময়ে আমি ভাবিনি প্রকাশিত বইগুলোও আওয়ামী লীগ সরকারের স্বৈরাচারের ইতিহাসের একটি অংশ হবে।
যে সাতটি বইয়ের মোড়ক উন্মোচিত হলো তার মধ্যে চারটি বইয়ে রাষ্ট্রপতি জিয়া এবং ম্যাডাম খালেদা জিয়ার বিভিন্ন গঠনমূলক অবদানের সংৰিপ্ত টাইমলাইন তুলে ধরা হয়েছে।
রাষ্ট্রনায়ক জিয়াউর রহমান বইয়ে তার একটি আত্মকথন প্রকাশিত হয়েছে। তার জীবনের বিভিন্ন দিক বিষয়ে এ বইয়ের লেখকরা অনেক অজানা ইন্টারেস্টিং তথ্য জানিয়েয়েছেন। সব লেখককে জানাচ্ছি ধন্যবাদ।

বই কিনুন বই পড়ুন
কেউ কেউ বলেন, মাগনা পেলে বাঙালি বিষ খেতে রাজি হয়। এটা একটা অপবাদ। এই অপবাদ মিথ্যা প্রমাণ করার দায়িত্ব আপনাদের। বিশেষত বিএনপি নেতাদের। আপনাদের নিশ্চয়ই মনে আছে, ম্যাডাম জিয়ার প্রধানমন্ত্রিত্বের সময়ে তিনি একটা সেস্নাগান দিয়েছিলেন, প্রিয়জনকে বই উপহার দিন। তার সেই সুন্দর সেস্নাগানটি একটু পরিবর্ধিত করে আজ আমি বলতে চাই, বই কিনে প্রিয়জনকে বই উপহার দিন। বিএনপি নেতাদের অনুরোধ করতে চাই, বই কিনে আপনারা কর্মী, সমর্থক ও ভোটারদের উপহার দিন। না হলে প্রতিপৰের শক্তিশালী সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের মোকাবেলা আপনারা কিছুতেই করতে পারবেন না।
এসব কথা বলার আরেকটি কারণ হচ্ছে, আমাদের সামর্থ খুবই সীমিত। বিনামূল্যে বা মাগনা বই দেয়া আমাদের পৰে সম্ভব নয়। সরি ফোকস। আমরা মি. দুররানির অনুগ্রহে আইএসআই বা পাকিসৱান থেকে টাকা পাইনি। আর ইনডিয়ান ‘র’ যে আমাদের টাকা দেবে না সেটা বলা বাহুল্য।
এসব বই পড়া নেতা, কর্মী-সমর্থকদের জন্য অত্যনৱ জরম্নরি। আগেই আমি বলেছি, জিয়াউর রহমানের বিরম্নদ্ধে অপপ্রচার সভ্যতার মাত্রা ছাড়িয়ে গিয়েছে। তিনি প্রয়াত। তিনি তো আর কিছু বলতে পারবেন না। সে কাজটি আপনাদেরই করতে হবে। কারণ এখন ম্যাডাম খালেদা জিয়ার বিরম্নদ্ধেও অপ্রপ্রচার শুরম্ন হয়ে গিয়েছে। তিনি জীবিত থাকতেই! একেই বোধহয় হয় বলে, অসভ্যতার অগ্রগতি।

যেতে পারেন ইনডিয়া অথবা আমেরিকা
বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ও তার সৱাবকরা একাধিকবার বলেছেন, আইএসআই থেকে ১৯৯১-এ বিএনপি টাকা নিয়েছিল। তিনি অবশ্য ভুলে গিয়েছেন, মাত্র তিন বছর আগের নির্বাচনে তার পার্টি ব্যাগফুল অফ মানি ইনডিয়া থেকে যে পেয়েছিল সে বিষয়ে দি ইকনমিস্ট রিপোর্ট করেছিল। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী উপদেশ দিয়েছেন, বিরোধী নেত্রী খালেদা যেন পাকিসৱান চলে যান। খালেদা পাকিসৱান যাবেন কেন? তিনি তো আগেই বলেছেন, বাংলাদেশই তার একমাত্র ঠিকানা। বরং আমি প্রধানমন্ত্রীকে অনুরোধ করবো তিনি যেন ইনডিয়া অথবা আমেরিকায় চলে যান। ওই দুই দেশে দীর্ঘকাল থাকার অভ্যাস তার আছে।
প্রসঙ্গত. এশিয়ান কৃকেট কাপে সাম্প্রতিক ফাইনালে বাংলাদেশ-পাকিসৱানের ম্যাচে বিরোধী নেত্রীর উপস্থিতি নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর একাধিকবার অশালীন মনৱব্যের বিষয়টি বলতে চাই। তিনি বলতে চেয়েছেন, ম্যাডাম জিয়া স্টেডিয়ামে গিয়েছিলেন পাকিসৱান টিমকে সমর্থন করতে। এ তথ্যটি প্রমাণ করার জন্য প্রধানমন্ত্রী তার কাজের বুয়ার রেফারেন্সও দিয়েছেন।
প্রধানমন্ত্রীর স্ট্যান্ডার্ড যে আরো নিচে নেমে গিয়েছে সেটা আমি বলতে চাই না। সম্প্রতি বিএনপির সেক্রেটারি জেনারেল মির্জা ফখরম্নল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, তিনি একজন চপলমতি বালিকা। যা মনে আসে তাই বলে ফেলেন।
হয়তো তিনি তাই। আমি এখানে একটু যোগ করবো। দেশের বালক-বালিকাদের ইতিহাস পড়তে বলবো। ইতিহাস পড়লেই জানা যাবে ১৯৪৭ সালে এই প্রধানমন্ত্রীর পিতা পাকিসৱান আন্দোলনের একজন অগ্রণী কর্মী ছিলেন এবং ১৯৭১-এ তিনি পাকিসৱানেই চলে গিয়েছিলেন।
আবার ১৯৭২-এ স্বাধীন বাংলাদেশে ফিরে এসে পাকিসৱানের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তোলায় মনোযোগী হয়েছিলেন। এ কারণে তিনি তার পরম শত্রম্ন জুলফিকার আলি ভুট্টোকে ৰমা করে দিয়ে বাংলাদেশে সফরের আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন এবং ১৯৭৪-এ ভুট্টো এখানে এসেছিলেন।
এটি ছিল শেখ মুজিবুর রহমানের দূরদৃষ্টি সম্পন্ন পররাষ্ট্রনীতি যেটা পরবর্তীকালে জিয়াউর রহমান এবং খালেদা জিয়াও অনুসরণ করেন। এখানে মনে করিয়ে দিতে পারি যে, ভিয়েতনাম দশটি বছর আমেরিকার বিরম্নদ্ধে লড়েছিল। তারা এখন আমেরিকার সঙ্গে গভীর বন্ধু সম্পর্ক রেখে চলেছে। যে জাপানের বিরম্নদ্ধে মহাযুদ্ধে আমেরিকা লড়েছিল সেই জাপান এখন আমেরিকার সবচেয়ে বড় বন্ধু রাষ্ট্রের একটি।
বস্তুত বর্তমান প্রধানমন্ত্রী যদি সেই রকম দূরদর্শী হতেন তাহলে বাংলাদেশ-পাকিসৱান ফাইনাল ম্যাচের দিনে পাকিসৱানের প্রধানমন্ত্রী মি. গিলানিকে ঢাকায় এসে পাশাপাশি বসে খেলা দেখার আমন্ত্রণ জানাতে পারতেন। যেমনটা ভারত-পাকিসৱানের একটি ফাইনাল ম্যাচ পাশাপাশি বসে দেখেছিলেন মনমোহন সিং ও গিলানি। কিন্তু প্রতিহিংসা প্রতিশোধের হামলা-মামলার রাজনীতি যার অবলম্বন তার কাছে থেকে এ রকম সৌজন্যতা আশা করা অসম্ভব।
এরশাদের প্রশ্নের উত্তর :মুগুর
এখানে আমি প্রধানমন্ত্রীর দীর্ঘকালের বিশ্বসৱ ও অনৱরঙ্গ সহযাত্রী জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের একটি প্রশ্নের উত্তর দিতে চাই। সম্প্রতি জেনারেল এরশাদ পার্লামেন্টে মনে করিয়ে দিয়েছেন, ১৯৮৬-তে আমার সম্পাদিত সাপ্তাহিক যায়যায়দিন-এ সংসদের তৎকালীন নারী সদস্যদের টাইটেল দিয়েছিলাম সংসদের শোভা ত্রিশসেট অলংকার।
তারপর তিনি প্রশ্ন রাখেন, এখন আমি সংসদের নারী সদস্যদের কি টাইটেল দেবো? প্রশ্নটি তিনি করেন বিএনপির দুই নারী সদস্য রেহানা আখতার রানু ও সৈয়দা আসিফা আশরাফি পাপিয়া সম্প্রতি সংসদের প্রধানমন্ত্রীর যে সমালোচনা করেছেন সেই পরিপ্রেৰিতে।
জেনারেল এরশাদ অবশ্য সেদিন বলেননি ওই টাইটেল দেয়ার জন্য আমাকে ছয় বছর নির্বাসনে তিনি পাঠিয়ে দিয়েছিলেন।
সে যাই হোক। আমি পুলকিত হয়েছি জেনে যে, জেনারেল এরশাদের দুটি গুণ, এক. তার ভাষা শালীন আছে এবং দুই. নারীদের প্রতি তার নজর এখনো প্রখর। তিনি জানতে চেয়েছেন, এখন সংসদের নারী সদস্যদের টাইটেল কি হবে? উত্তরটা হচ্ছে, বিএনপির সাত নারী সদস্য হচ্ছেন বাঘা তেতুল অথবা মুগুর। আর বাকি সব নারী সদস্যদের টাইটেল দেয়া থেকে বিরত থাকলাম। কারণ ১৯৮৬-তে ওই টাইটেল দেয়ার জন্য আমার বিরম্নদ্ধে তিন কোটি টাকার মানহানির মামলা করা হয়েছিল। সেই ঘটনার পুনরাবৃত্তি আমি এখন চাই না।
কিন্তু সাতজনকে মুগুর টাইটেল কেন দিচ্ছি?
বাংলা ভাষায় দুটি বচন আছে, বুনো ওল বাঘা তেতুল এবং যেমন কুকুর তেমন মুগুর।

সম্প্রতি সংসদের বিএনপি দুই এমপি রেহানা আক্তার রানু এবং সৈয়দা আশরাফি পাপিয়া কিছু সময়ের জন্য মুগুর চালিয়েছেন। এতেই সরকারি দল বিচলিত হয়েছে। তাদের এই সন্ত্রসৱ প্রতিক্রিয়া প্রমাণ করে দিয়েছে রানু ও পাপিয়ার মুগুর চালানোর প্রয়োজন ছিল।
তারপরও সেদিকে আমরা কাউকে যেতে বলবো না। আমরা এটাই বলবো, রাজনীতিতে শালীনভাবে কথা বলুন এবং ভদ্র ভাষায় সত্যটা লিখুন। ঠিক এ বইগুলোর মতোই। এ বইগুলোর উত্তর বইতেই অর্থাৎ শালীন লেখাতেই দেয়া হবে বলে আমি আশা করি। কাউকে চ্যাংদোলা করার, কোলে তোলার অথবা থুথু চেটে খাওয়ার উপদেশ দেবেন না। কাজের বুয়ার রেফারেন্স টেনে পাকিসৱানে চলে যেতে বলবেন না।
যে সাতটি বই প্রকাশ হলো তার মধ্যে দুটি ইংরেজি এবং পাচটি বাংলায়। ইংরেজি বই দুটির নাম হচ্ছে Statesman Ziaur Rahman এবং Democratic Leader Khaleda Zia. বাংলা বই পাচটির নাম রাষ্ট্রনায়ক জিয়া, সংগ্রামী নেত্রী খালেদা জিয়া, চট্টগ্রাম পোলো গ্রাউন্ড লুণ্ঠন, নেড়ি কুকুরের কান্ড ও নেড়িকুকুরের কীর্তি।

ও হ্যা। রাষ্ট্রনায়ক জিয়াউর রহমান নামে একটি বই লিখেছি খবরটি প্রকাশিত হবার পর গত ৪ এপৃল থেকে সারা ঢাকা শহরে আওয়ামী লীগ ব্যানার ছেড়েছে যেখানে তাদের নেত্রীর নতুন বিশেষণ হয়েছে রাষ্ট্রনায়ক। লেখা হয়েছে রাষ্ট্রনায়ক হাসিনা। স্বাধীনতার ঘোষক বিশেষণটি যেমন হা্‌ইজ্যাক হয়েছে, ঠিক তেমনি রাষ্ট্রনায়ক বিশেষণটিও হাইজ্যাক হয়ে গেলো।
এই বইগুলো প্রকাশের পেছনে যারা কাজ করেছেন তাদের আনৱরিক ধন্যবাদ জানাই। এই বইগুলো প্রকাশনা উৎসবের আয়োজন যারা করেছেন সেই গ্রম্নপ ২০০৯ তথা জি-নাইনের সদস্যদের জানাই অশেষ কৃতজ্ঞতা। ম্যাডামকেও ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা। অনুষ্ঠানে এসে মোড়ক উন্মোচন করার জন্য।

নিরপেৰ থাকা অনৈতিক
কেউ কেউ আমাকে সমালোচনা করতে পারেন। আমি একটি বিশেষ দলের বা বিশেষ ব্যক্তির পৰে লিখেছি। অর্থাৎ আমি পৰপাতিত্ব করছি। অন্যভাবে তারা বলতে পারেন, আমি নিরপেৰ নই।
এই সমালোচনার উত্তরে ম্যাডাম খালেদা জিয়ারই একটি বানী আমি আপনাদের মনে করিয়ে দিতে চাই। তিনি বলেছিলেন, পাগল ও শিশু ছাড়া কেউ নিরপেৰ নয়।
তার সেই কথা আমি একটু সমপ্রসারিত করে আজ বলতে চাই, পাগল, শিশু ও সুবিধাবাদী ছাড়া কেউ নিরপেৰ নয়। আমি সমালোচিত হতে পারি জেনেও সত্য প্রতিষ্ঠার জন্য বিবেকের তাড়নায় এই বইগুলো লিখেছি। আমি মুক্তিযুদ্ধের সময়ে নিরপেৰ ছিলাম না। মুক্তির পৰে অবস্থান নিয়েছিলাম। আমি স্বৈরশাসক এরশাদের সময়ে নিরপেৰ ছিলাম না। আমি গণতন্ত্রের পৰে অবস্থান নিয়েছিলাম।
জার্মান কবি দানেৱ বলেছিলেন,

The hottest places in hell are reserved for those who, in a time of great moral crisis maintain their neutrality.

অর্থাৎ খুব বড় নৈতিক সংকটের সময়ে যারা তাদের নিরপেৰতা বজায় রাখেন তাদের জন্য নরকের সবচেয়ে বেশি গরম জায়গা রিজার্ভ করা আছে।
দানেৱর এই অমর বাণী পুনঃউচ্চারণ করেছিলেন আমেরিকান প্রেসিডেন্ট জন কেনেডি। আজ আমিও সেই আপ্তবাক্যটি পুনঃউচ্চারণ করলাম। প্রাবন্ধিক বদরম্নদ্দীন উমর-এর উদ্ধৃতি দিয়ে বলতে হয়, বাংলাদেশে এখন উম্মাদ ও বিকারগ্রসৱ শাসকের সময় চলছে।
এই সংকটের সময়ে নৈতিক বোধ সম্পন্ন কোনো ব্যক্তির পৰে নিরপেৰ থাকা সম্ভব নয়। যেমনটা সম্ভব ছিল না মুক্তিযুদ্ধ ও গণতন্ত্র যুদ্ধের সময়ে।
৭ এপৃল ২০১২

শুক্রবার, ২৭ জানুয়ারী, ২০১২


এয়ারপোর্ট, ঢাকা।
কাল : সকাল এগারোটা, ৬ জানুয়ারি ২০১০।
পাত্র : লন্ডন থেকে আগত একজন স্মার্ট, ইয়াং বাঙালি যাত্রী। পরনে নেভি ব্লু সুট, ডিপ ব্লু শার্ট, ব্রাইট রেড টাই। এয়ারপোর্টে নিযুক্ত মধ্যবয়সী ইমিগ্রেশন অফিসার, পরনে ইউনিফর্ম ও ব্যাজ। এবং একজন ড্রাইভার।
ইমিগ্রেশন অফিসার : আপনার পাসপোর্ট ঠিক আছে। ল্যান্ডিং ফর্ম, সোয়াইন ফ্লু ফর্ম এবং ব্যাগেজ ডিক্লারেশন ফর্মও ঠিক আছে। কিন্তু আপনার কন্সপিরেসি ডিক্লারেশন ফর্ম কই? ওই ফর্মটা কি আপনি ফিল আপ করেননি? প্লেন ল্যান্ড করার আগে ওই ফর্ম কি আপনাকে দেয়া হয়নি?
যাত্রী : হ্যা। দেয়া হয়েছিল।
অফিসার : তাহলে ফর্মটা ফিল আপ করেননি কেন?
যাত্রী : আমি ভেবেছিলাম এমিরেটস এয়ারলাইন একটা জোক করছে। তাই।
অফিসার (ভ্রূ কুচকে) : জোক?
যাত্রী : দেখুন, কোনো কন্সপিরেসি বা ষড়যন্ত্র করার সময় আমার নেই। আমি একজন বিজনেসম্যান। সারা বছর জুড়ে বিজনেস টৃপ দিই। বিভিন্ন দেশে যাই। কোথাও কন্সপিরেসি ফর্মের নাম শুনিনি। ফিল আপ তো দূরের কথা। তাই ওই ফর্মটা হাতে পেয়ে ভেবেছিলাম ওটা একটা জোক। আমি ওটাকে সিরিয়াসলি নিই নি।
অফিসার : কন্সপিরেসি একটা সিরিয়াস ম্যাটার। ভেরি সিরিয়াস ম্যাটার। ভেরি ভেরি সিরিয়াস ম্যাটার। বিশেষত বাংলাদেশে। আপনি কি সেটা জানেন না?
যাত্রী : কিছু কন্সপিরেসি সিরিয়াস ম্যাটার হতে পারে। কিন্তু সব ষড়যন্ত্রই কি সিরিয়াস হতে পারে? যেমন ধরুন, আমি যদি আমার ব্যাংকের চোখে ধুলা দিতে চাই? আমার পার্টনারকে পথে বসাতে চাই?
অফিসার : না, না। আমি বিজনেসের কথা বলছি না। আমি বলছি রাষ্ট্রবিরোধী কন্সপিরেসির কথা। সরকার বিরোধী চক্রান্তের কথা। এই ধরনের কন্সপিরেসি খুবই সিরিয়াস ম্যাটার হতে পারে। ১৯৬৯-এ আগরতলা ষড়যন্ত্র, ১৯৭৫-এর রাজনৈতিক হত্যাকান্ডের কন্সপিরেসি, ১৯৭৭-এ এই ঢাকা এয়ারপোর্টেই বাংলাদেশ এয়ার ফোর্সের কন্সপিরেসি, ১৯৮১-তে চিটাগংয়ে সার্কিট হাউজে হত্যাকান্ডের ষড়যন্ত্র, ১৯৮২-তে জেনারেল এরশাদের ক্ষমতা দখলের চক্রান্ত, এসব নিশ্চয়ই আপনি জানেন। তারপর যশোরে উদীচির সভায় বোমা, রমনার বটমূলে বোমা, কোটালিপাড়ায় হামলার প্ল্যান, চিটাগংয়ে বহির্নোঙ্গরে অস্ত্র খালাস, ঢাকায় শেখ হাসিনার জনসভায় গ্রেনেড হামলা, সারা দেশ জুড়ে চারশ স্থানে একই দিনে প্রায় একই সময়ে এক যোগে বোমা বিস্ফোরণ এবং গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে ঢাকায় পিলখানায় বিডিআর বিদ্রোহ – এসবই তো গভীর ষড়যন্ত্রের ফল। এসব কি আপনি জানেন না?
যাত্রী : জানি। এসব তো ইতিহাস। নতুন কোনো ষড়যন্ত্রের আভাস কি আপনারা পেয়েছেন যেজন্য সব আগত যাত্রীদের একটা ফর্ম ফিল আপ করতে বলছেন?
অফিসার : সরকার সতর্কতামূলক অগ্রিম ব্যবস্থা নিয়েছে। আমরা সেটা পালন করছি। বর্তমান সরকারের ক্ষমতায় থাকার প্রথম বছর পূর্তি হচ্ছে আজ। দ্বিতীয় ডিজিটাল বছর নামে আজকের দিনটি দেশ জুড়ে পালিত হচ্ছে। এই দিনটিকে পন্ড করার জন্য সরকার বিরোধীরা নাশকতামূলক কাজ করতে পারে। চারদিকে তাকিয়ে দেখুন কতো একস্ট্রা সিকিউরিটি ফোর্স মোতায়েন করা হয়েছে। সারা দেশে এখন একটা স্টেট অফ এলার্টনেস চলছে।
যাত্রী (চারিদিকে তাকিয়ে) : হ্যা। দেখছি। আনসার, পুলিশ, র‌্যাব-এর সব লোকজন! ওদের অনেকের হাতে অস্ত্র। প্যাসেঞ্জারের চাইতে সিকিউরিটির লোকের সংখ্যাই বেশি মনে হচ্ছে।
অফিসার : সরকার আর আমরা সবাই খুব টেনশনে আছি। কখন যে কোথায় কি ঘটে যায়!
যাত্রী : এভাবে তো আপনারা চক্রান্তকারীদের দমাতে পারবেন না। যারা চক্রান্ত করবে তারা তো প্ল্যান করেই করবে যাতে কেউ জানতে না পারে। তারা কি কেউ জানিয়ে চক্রান্ত করবে?

অফিসার : সেজন্যই তো চক্রান্তকারীদের একটা সুযোগ সরকার দিয়েছে ডিক্লেয়ার করার জন্য। সেজন্যই তো কন্সপিরেসি ডিক্লারেশন ফর্ম চালু করা হয়েছে। এই নিন একটা ফর্ম। চটপট ফিল আপ করে দিন।
যাত্রী (ফর্মটা হাতে নিয়ে ফর্মের দিকে দ্রুত চোখ বুলিয়ে) ; এখানে প্রশ্ন করা হয়েছে, আমার সঙ্গে কটা হাত বোমা, কটা গ্রেনেড, কটা মলোটভ ককটেল, কটা রিভলভার, ইত্যাদি আছে। এসব প্রশ্নের উত্তরে কেউ কি “হ্যা” লিখবে?

অফিসার : লিখতেও পারে। যারা নার্ভাস টাইপের চক্রান্তকারী তারা সব লিখে দিয়ে এখানেই সারেন্ডার করতে পারে।
যাত্রী : আর যারা দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ টাইপের চক্রান্তকারী, তারা?
অফিসার : তারা “না” লিখে বেরিয়ে যাবার চেষ্টা করবে। কিন্তু তারা ধরা পড়বে রেড চ্যানেলে অথবা গ্রীন চ্যানেলে। সকল যাত্রীকে উভয় চ্যানেলেই বডি সার্চ, লাগেজ সার্চ করা হচ্ছে।
যাত্রী : কিন্তু কন্সপিরেসি তো চিন্তা প্রসূত বিষয়। চিন্তার মধ্যেও তো চক্রান্ত থাকতে পারে। সেটা আপনারা চেক করবেন কি করে?
অফিসার (মৃদু হেসে) : সেটা চেক করার যন্ত্রও সরকার এয়ারপোর্টে বসিয়েছে। এক ধরনের লেটেস্ট সিটিস্ক্যানিং মেশিনে প্রতিটি যাত্রীর ব্রেইন স্ক্যান করা হচ্ছে। মেইড ইন ইসরেল। ইমপোর্টেড ভায়া ইনডিয়া। সব চক্রান্তই এই মেশিনে ধরা পড়ে যাবে।
যাত্রী : মনে হয় না। আই অ্যাম নট সো শিওর। চক্রান্ত বন্ধ করতে হলে অন্য কিছু করতে হবে।
অফিসার : কি করতে হবে?

যাত্রী : দেশে সন্দেহ এবং সাংঘর্ষিক রাজনীতি অনুসরণ না করে, সম্প্রীতি এবং সহঅবস্থানের রাজনীতি চালু করতে হবে। রিমান্ড, টর্চার ও মামলার রাজত্ব কায়েম না করে, কর্মসংস্থান, ন্যায্যমূল্য ও আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতিমূলক শাসন চালু করতে হবে। জনসাধারণের মনে বিরক্তি, ক্ষোভ ও ক্রোধ পুঞ্জিভূত হতে থাকলে, চক্রান্ত হতেই থাকবে। দয়া করে এই সহজ সত্যটা বোঝার চেষ্টা করুন। বিডিআরের ঘটনা কিন্তু সেই লেসনটাই সবাইকে দিয়েছিল। (ফর্মটা ফিরিয়ে দিয়ে) এই নিন আপনার ফর্ম। এটা আমি ফিল আপ করবো না।
অফিসার (কঠিন মুখে) : আপনার সমস্যা হবে।
যাত্রী : হতে পারে। আই ডোন্ট কেয়ার। দেখুন, যে কোনো দেশের প্রেসিডেন্ট, প্রাইম মিনিস্টারের প্রাণের ঝুকি সবসময়ই থাকে। ক্ষমতার আনন্দ ভোগের পাশাপাশি বিপদের সম্ভাবনা থাকে জেনেই পলিটিশিয়ানরা রাজনীতিতে আসেন। কিন্তু তার জন্য সাধারণ মানুষকে এত ভোগান্তির মধ্যে পড়তে হবে কেন? আমি ফর্ম ফিল আপ করবো না।
অফিসার : কন্সপিরেসি ডিক্লারেশন ফর্ম ফিল আপ করার শেষ সুযোগ আপনাকে দিচ্ছি।
যাত্রী : আইরিশ নাট্যকার অস্কার ওয়াইন্ড যখন নিউ ইয়র্কে গিয়েছিলেন, তখন তাকে এক কাস্টমস অফিসার প্রশ্ন করেছিলেন, হ্যাভ ইউ এনিথিং টু ডিক্লেয়ার? অস্কার ওয়াইন্ড উত্তরে বলেছিলেন, আই হ্যাভ নাথিং টু ডিক্লেয়ার একসেপটিং মাই জিনিয়াস (I have nothing to declare execpting my genius)। অস্কার ওয়াইন্ডের মতো জিনিয়াস আমার নেই। তাই আমি বলবো না, আমার জিনিয়াস ছাড়া আর কিছুই ডিক্লেয়ার করার নেই। তবে হ্যা, একটা জিনিস আমি ডিক্লেয়ার করতে চাই।
অফিসার : সেটা কি?
যাত্রী : (জ্যাকেটের পকেট থেকে একটা কালো চকচকে মোবাইল ফোন বের করে) : এটা। এটা অ্যাপলের লেটেস্ট আইফোন।
অফিসার (খুব কৌতূহলী হয়ে) : বাঃ। চমৎকার দেখতে তো! খুব বড় স্কৃন তো!
যাত্রী : এই মোবাইলে ফোন করা, ফটো তোলা, ভিডিও করা, ইমেইল করা, ইন্টারনেটে যাওয়া, সবকিছু সম্ভব। ইন্টারনেটে একটা পর্নো দেখবেন?
অফিসার (চারদিকে তাকিয়ে)। হ্যা। দেখবো। খুব তাড়াতাড়ি দেখান। কেউ যেন সন্দেহ না করে।
যাত্রী : নিশ্চয়ই।
এ কথা বলার পর যাত্রী কয়েকটা নাম্বার টিপে আই ফোনটা মুখের কাছে নিয়ে এসে বললেন, হ্যালো।  তুমি এখন একশনে যেতে পারো। রেডি, স্টেডি, গো।
সঙ্গে সঙ্গে বাইরে এক প্রচণ্ড বিস্ফোরণের শব্দ হলো।
এয়ারপোর্ট ভবনটা কেপে উঠলো।
কয়েকটা কাচের দেয়াল ভেঙে পড়লো।
অফিসার দৌড়ে পালালেন।
এয়ারপোর্ট ভবনের মধ্যে টহলরত আনসার, পুলিশ, র‌্যাব সবাই আতঙ্কিত হয়ে রাইফেল ফেলে ছোটাছুটি শুরু করলো। কেউ কেউ ফ্লোরে শুয়ে পড়লো।
অন্যান্য যাত্রী এবং সিভিল এভিয়েশন স্টাফরা আতংকে দিগবিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে পালাতে থাকলো।
সবাই নিরাপদ জায়গা খুজছিল।
কয়েকটা সিকিউরিটি এলার্ম বেল বিদঘুটে শব্দে বাজা শুরু করলো।
যাত্রী তার আইফোনটা পকেটে পুরে গটগট করে হেটে এয়ারপোর্ট ভবনের বাইরে এসে দাড়ালেন।
বাইরে সবাই আরো বেশি সন্ত্রস্ত হয়ে ছোটাছুটি করছিল।
কয়েকটা ভীত কাক ইলেকটৃক তারের ওপর জড়ো হয়ে কর্কশ স্বরে কা-কা করছিল।
একটা পাজেরো এসে যাত্রীর সামনে থামলো।
ড্রাইভার (পাজেরোর দরজা খুলে দিয়ে) : গুড মর্নিং স্যার।
যাত্রী : (গাড়িতে উঠে দরজা বন্ধ করে দিয়ে) সব কিছুই প্ল্যান মোতাবেক হলো দেখছি একসেলেন্ট। এ গুড জব হ্যাজ বিন ডান।
ড্রাইভার : হ্যা। সব কিছুই প্ল্যান মোতাবেক হয়েছে। (রিমোট কনট্রোলটা দেখিয়ে) তবে গ্যাস সিলিন্ডারটা বড় সাইজের কিনতে হয়েছিল। বেশি শব্দের জন্য। দামটা একটু বেশি পড়ে গিয়েছে।
যাত্রী : নেভার মাইন্ড। আমার আইফোনটা নিয়ে আমি বেরিয়ে আসতে পেরেছি। (পকেট থেকে আবার আইফোনটা বের করে পরম যত্নের সঙ্গে হাত বুলিয়ে) এখানেই সব সিক্রেট নাম্বারগুলো আছে!
২২ নভেম্বর ২০০৯

নাম রক্ষা করার সহজ উপায়


স্থান: লন্ডন
কাল: জুলাই ২০১০
চরিত্র: লন্ডন সফরকারী বাংলাদেশি বিজনেসম্যান আদিল, বৃটিশ ইমিগ্রেশন অফিসার জোনস, ট্যাক্সি ড্রাইভার টম, রানী এলিজাবেথের প্রাইভেট সেক্রেটারি ও রানী এলিজাবেথ।

দৃশ্য ১
এয়ারপোর্ট ইমিগ্রেশন কাউন্টার
বিজনেসম্যান আদিল (চিন্তিত চেহারায় পাসপোর্ট বাড়িয়ে দিয়ে): আচ্ছা, আমি কি সঠিক এয়ারপোর্টে এসেছি? চারদিকে নাম দেখছি সেইন্ট জর্জ (St. George) এয়ারপোর্ট। বিজ্ঞাপন দেখছি, ওয়েলকাম টু সেইন্ট জর্জ এয়ারপোর্ট, টেক এ ফাস্ট ট্রেন ফ্রম সেইন্ট জর্জ এয়ারপোর্ট টু সিটি সেন্টার, গেট ফর্টি পার্সেন্ট ডিসকাউন্ট অন ডিউটি ফ্রি গুডস অ্যাট সেইন্ট জর্জ এয়ারপোর্ট। এটা কি লন্ডনের হিথরো এয়ারপোর্ট নয়?
ইমিগ্রেশন অফিসার জোনস (পাসপোর্ট নিয়ে পাতা ওলটাতে ওলটাতে): স্যার, আপনি সঠিক এয়ারপোর্টেই ল্যান্ড করেছেন। এটাই হিথরো এয়ারপোর্ট। বৃটেনের সবচেয়ে বড় এয়ারপোর্ট তো বটেই — তাছাড়া বিশ্বের সবচেয়ে ব্যস্ত আন্তর্জাতিক এয়ারপোর্টও এটি। এই এয়ারপোর্ট দিয়ে বছরে প্রায় সাত কোটি প্যাসেঞ্জার এবং তের লাখ টন কার্গো চলাচল করে। লন্ডনের পশ্চিম দিকে ১৯৪৬-এ একটা তাবু খাটিয়ে এই এয়ারপোর্টের সূচনা হয়েছিল। এখন এই এয়ারপোর্টের চারটি টার্মিনাল ভবন আছে। টার্মিনাল ফাইভের উদ্বোধন হবে আগামী বছরে। আপনি এসেছেন টার্মিনাল থ্রিতে।
আদিল: তাহলে এখানে হিথরো এয়ারপোর্ট কোথাও লেখা নেই কেন? আগে তো ল্যান্ড করে সর্বত্রই দেখতাম, ওয়েলকাম টু হিথরো, সাইন। এখন সবখানেই দেখছি সেইন্ট জর্জ এয়ারপোর্ট সাইন! ব্যাপার কী?
জোনস: গত মাসে ইলেকশনে টোরি পার্টি বিরাট মেজরিটি নিয়ে জেতার পর নতুন প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন দলীয় নেতা ডেভিড ক্যামেরন। তারই অর্ডারে হিথরো এয়ারপোর্টের নাম বদলে গেছে। নতুন নাম হয়েছে সেইন্ট জর্জ এয়ারপোর্ট।
আদিল: সেইন্ট জর্জ? সেইন্ট জর্জ কে?
জোনস: সেইন্ট জর্জ হচ্ছেন ইংল্যান্ডের পেট্রন সেইন্ট। তার প্রতীক হচ্ছে একটি শাদা পটভূমিকায় একটি লাল ক্রস। এটাই ইংল্যান্ডের ফ্ল্যাগ এবং বৃটিশ ফ্ল্যাগেরও অংশ। ইউনিয়ন জ্যাক নামে যে বৃটিশ ফ্ল্যাগ আছে, সেটা মনোযোগ দিয়ে দেখুন। দেখবেন সেখানে একটি লাল ক্রস আছে। কথিত আছে, দ্বাদশ শতাব্দীতে ইংল্যান্ডের রাজা রিচার্ড দি লায়নহার্ট, যিনি ক্রুসেডের জন্য বিখ্যাত হয়েছিলেন, তিনি সেইন্ট জর্জের নামে লড়াই করতেন এবং পরবর্তী সময়ে তার নাম ইংল্যান্ডে প্রতিষ্ঠা করেন। এখন দেশের গভীর বিপদের সময়ে ইংল্যান্ডবাসীরা সেইন্ট জর্জের সাহায্য প্রার্থনা করে। কথিত আছে, সেইন্ট জর্জ ঘোড়ার পিঠে চড়ে, একটি লাল ক্রস আকা ঢাল নিয়ে, এক হিংস্র ড্রাগনের বিরুদ্ধে লড়াই করে বিজয়ী হয়েছিলেন। আসল সেইন্ট জর্জ ছিলেন একজন রোমান সৈন্য। ক্রিশ্চিয়ানদের যখন রোমানরা টর্চার করতো তখন সেইন্ট জর্জ তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন এবং তার ফলে তাকে মৃত্যুবরণ করতে হয়েছিল। আসল সেইন্ট জর্জ কখনোই কোনো ড্রাগনের বিরুদ্ধে লড়াই করেননি। সম্ভবত তিনি কখনো ইংল্যান্ডেও যাননি। তবু তিনি ইংল্যান্ডে নাম্বার ওয়ান পুণ্য ব্যক্তি রূপে গণ্য হন। তারই নামে এখন টোরি পার্টি হিথরোর নাম দিয়েছে সেইন্ট জর্জ এয়ারপোর্ট।
আদিল (বিস্মিত মুখে): হঠাৎ এ নাম বদল কেন হলো?
জোনস : জানি না স্যার। তবে মনে হয়, ইংল্যান্ডে বর্তমানে যে গভীর অর্থনৈতিক মন্দাবস্থা চলছে, সেটা থেকে উদ্ধার পাওয়ার আশায় নতুন প্রাইম মিনিস্টার ক্যামেরন এই সিদ্ধান্তটা নিয়েছেন। (গলার স্বর নামিয়ে) বিটউইন ইউ অ্যান্ড মি স্যার, এয়ারপোর্টের এই নাম বদলানোটা, আমরা, এয়ারপোর্টের কোনো স্টাফই পছন্দ করিনি। চৌষট্টি বছর ধরে এই এয়ারপোর্টকে আমরা হিথরো নামেই জানি। হঠাৎ বলা নেই কওয়া নেই, ডেভিড ক্যামেরন প্রাইম মিনিস্টার হয়েই নাম বদলে ফেলার আদেশ দিলেন। ইলেকশনের আগে টোরি পার্টি তাদের ম্যানিফেস্টোতেও বলেনি যে হিথরো এয়ারপোর্টের নাম তারা বদলে ফেলবে। ভেরি স্যাড স্যার, ভেরি স্যাড। জানি না গভর্নমেন্ট কোন দিকে যাচ্ছে। নাম বদলানোর চাইতে অনেক বেশি দরকার এই এয়ারপোর্টের ফ্যাসিলিটিগুলো সিঙ্গাপুর, ব্যাংকক, কুয়ালা লামপুর এয়ারপোর্টের মতো আরো উন্নত করা। তাতে যাত্রীরা উপকৃত হতো। (পাসপোর্টে সিল মেরে দিয়ে) হিয়ার ইউ আর স্যার। এনজয় ইয়োর ট্রিপ টু লন্ডন।
আদিল (পাসপোর্ট নিয়ে): থ্যাংক ইউ অফিসার।
দৃশ্য ২
এয়ারপোর্ট থেকে ট্যাক্সিতে সিটি সেন্টারে যাবার পথে।
আদিল: এটা ওয়েম্বলি স্টেডিয়াম না? এখানেই তো ১৯৬৬-এ ওয়ার্ল্ড কাপ ফুটবল ফাইনাল ম্যাচটি হয়েছিল।
ট্যাক্সি ড্রাইভার টম: হ্যা। তা ঠিক। এখানেই সব ইম্পরটেন্ট স্পোর্টিং ইভেন্টগুলো হয়। তবে এই স্টেডিয়ামের নাম পালটে গেছে। এর নাম হয়েছে স্যার উইনস্টন চার্চিল স্টেডিয়াম। সংক্ষেপে চার্চিল স্টেডিয়াম।
আদিল: কখন থেকে এই নতুন নাম হয়েছে?
টম: গত ইলেকশনে টোরি পার্টি জেতার পর থেকে। নতুন প্রাইম মিনিস্টার ডেভিড ক্যামেরনের অর্ডারে।
আদিল: কেন তিনি এই অর্ডার দিলেন?
টম: আপনি হয়তো জানেন দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময়ে উইনস্টন চার্চিল ছিলেন বৃটেনের প্রধানমন্ত্রী। তারই অনুপ্রেরণায় বৃটিশরা বিজয়ী হয়েছিল হিটলারের জার্মানির বিরুদ্ধে। চার্চিল ছিলেন টোরি নেতা। তাই তার নামে এখন টোরি পার্টি ওয়েম্বলি স্টেডিয়ামের নাম দিয়েছে চার্চিল স্টেডিয়াম।
আদিল: আপনার তথ্যে একটু ফাক আছে। সেপ্টেম্বর ১৯৩৯-এ যখন পোল্যান্ডের বিরুদ্ধে জার্মানি অভিযান চালায় তখন বৃটেন যুদ্ধ ঘোষণা করে। ওই সময়ে বৃটেনের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন নেভিল চেম্বারলেইন। ১০ মে ১৯৪০-এ জার্মানি যখন হল্যান্ড ও তার পাশের দেশগুলোর বিরুদ্ধে অভিযান চালায় তখন চেম্বারলেইন পদত্যাগ করেন। এরপর উইনস্টন চার্চিলের নেতৃত্বে টোরি, লেবার ও লিবারাল পার্টিকে মিলিয়ে, একটি অল পার্টি কোয়ালিশন বা সর্বদলীয় জোট সরকার গঠিত হয়। সেই সরকার ন্যাশনাল গভর্নমেন্ট বা জাতীয় সরকার নামে পরিচিত হয়েছিল। অর্থাৎ, দেশের ওই সঙ্কটের সময়ে চার্চিল কোনো দলীয় নেতা ছিলেন না — তিনি ছিলেন সর্বদলীয় সরকারের প্রধানমন্ত্রী। অথচ, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পয়ষট্টি বছর পরে চার্চিলকে ডিমোশন দেয়া হয়েছে। তাকে জাতীয় নেতা থেকে নামিয়ে দলীয় নেতা করা হয়েছে।
টম: এবার টোরি পার্টি ইলেকশনে জেতার পর থেকেই অনেক নাম বদলে ফেলছে। মনে হচ্ছে এটাই তাদের প্রধান কাজ। অথচ, তারা যে নাম বদলানোর কাজে এভাবে ঝাপিয়ে পড়বে তার বিন্দুমাত্র উল্লেখ ছিল না তাদের ইলেকশন ম্যানিফেস্টোতে।
আদিল: আর কোনো স্থাপনার নাম বদলানো হয়েছে?
টম: অনেক স্থাপনার নামই বদলানো হয়েছে। যেমন, লন্ডনের টপ হসপিটাল ওয়েলিংটন-হিউমানা-র নাম বদলে হয়েছে চার্চিল হসপিটাল, ম্যাডাম টুশো প্ল্যানেটারিয়ামের নাম বদলে হয়েছে চার্চিল নভোথিয়েটার, হাইড পার্কের নাম বদলে হয়েছে চার্চিল পার্ক। এমনকি কুইন এলিজাবেথ কনফারেন্স সেন্টারের নাম বদলে হয়েছে চার্চিল ইন্টারন্যাশনাল কনফারেন্স সেন্টার। এই যে, আমরা পৌছে গেছি চার্চিল হোটেলে।
আদিল (ট্যাক্সি থেকে নেমে): চার্চিল হোটেল! ভাগ্যিস নামটা আগে থেকেই ছিল।
টম (ট্যাক্সি থেকে আদিলের সুটকেস নামিয়ে): আপনি ভাড়া দেবেন কোন কারেন্সিতে?
আদিল: পাউন্ডেই দেব। এয়ারপোর্টে আমি কারেন্সি চেঞ্জ করে নিয়েছি। কিন্তু এই প্রশ্ন কেন?
টম: লক্ষ্য করে দেখুন, সব নোট বদলে গিয়েছে। আগে পাউন্ড নোটে রানীর ছবি ছিল। এখন সব নোটে শুধুই চার্চিলের ছবি ছাপা হয়েছে। টোরি পার্টি ক্ষমতায় এসেই এসব নতুন নোট ছেপেছে।
আদিল (মানিব্যাগ বের করে কয়েকটা নোট দেখে): আশ্চর্য! তাই তো!
দৃশ্য ৩
চার্চিল হোটেলে আদিলের রুম।
টেলিফোন বাজার শব্দ।
আদিল: হ্যালো। কে বলছেন?
অপর প্রান্ত থেকে টেলিফোন কলার: আমি মহামান্য রানীর প্রাইভেট সেক্রেটারি বলছি।
আদিল (চমকিত হয়ে): আপনি আমার সঙ্গে কথা বলতে চাইছেন?
প্রাইভেট সেক্রেটারি: বিশেষ জরুরি কারণে মহামান্য রানী চাইছেন আপনার সঙ্গে কিছু কথা বলতে। তিনি অনুরোধ করেছেন আমার সঙ্গে আপনাকে যেতে। আমি হোটেলের রিসেপশনে অপেক্ষা করছি। আপনি কি দয়া করে আসবেন? প্লিজ।
আদিল (অবাক হয়ে): মহামান্য রানী আমার সঙ্গে কথা বলতে চান! এ তো পরম সৌভাগ্য আমার। আমি আসছি। কিন্তু আমার সঙ্গে কেন কথা বলতে চান তিনি? তিনি কী করে জানলেন যে আমি এই হোটেলে আছি?
প্রাইভেট সেক্রেটারি: মহামান্য রানীর প্রাইভেট সিকিউরিটি নেটওয়ার্কের মাধ্যমে আমরা জেনেছি, আপনি লন্ডনে এসে নাম বদলের পালা দেখে কৌতূহল প্রকাশ করেছেন। আমরা এটাও জেনেছি যে আপনি উইনস্টন চার্চিল বিষয়ে জ্ঞান রাখেন। মহামান্য রানী এই বিষয়েই আলাপ করতে আগ্রহী।
দৃশ্য ৪
বাকিংহাম প্যালেস। দেয়ালে একটা স্কৃনের টিভি সাইলেন্টলি চলছে। কফি টেবিলের দুই দিকে মুখোমুখি আসনে আদিল এবং রানী এলিজাবেথ।
মহামান্য রানী এলিজাবেথ: বিনা নোটিশে আপনাকে ডেকে পাঠিয়েছি এ জন্য দুঃখিত। আপনি যে দয়া করে এসেছেন সে জন্য কৃতজ্ঞ।
আদিল: অ্যাট ইয়োর সার্ভিস, ইয়োর ম্যাজেস্টি।
রানী: আমি পত্রিকায় পড়েছি বৃটেনের আগে বাংলাদেশ নাম বদলের পালা শুরু করেছিল সেখানের নবনির্বাচিত সরকার। আমার নাম নিয়ে এখানের নবনির্বাচিত সরকার টানাহেচড়া করছে। আমাকে উপদেশ দিন, আমি বৃটেনে কীভাবে নিজের নাম রক্ষা করতে পারি।
আদিল: আমি কল্পনাও করতে পারিনি আমাকে এত বড় দায়িত্ব দেবেন। ইয়োর ম্যাজেস্টি, এক্ষেত্রে আপনার সামনে বোধহয় মাত্র দুটি পথই খোলা আছে। প্রথম পথটি হলো উইনস্টন চার্চিলকে জাতির রক্ষক ঘোষণা করুন। তার জন্ম ও মৃত্যু উভয় দিবসেই ছুটি দিন।
রানী: সে কী করে হয়? আমি তো ইংল্যান্ডের ডিফেন্ডার অফ দি ফেইথ বা ধর্মের রক্ষক। ১৫২১-এ পোপ দশম লিও এই টাইটেল দিয়েছিলেন রাজা অষ্টম হেনরিকে। তখন থেকে ইংল্যান্ডের সব রাজা বা রানী এই টাইটেল নিয়ে দেশ শাসন করেছেন। এখন চার্চিলকে যদি জাতির রক্ষক ঘোষণা করি এবং অন্যদিকে যদি আমি ধর্মের রক্ষক থাকি — তাহলে দেশবাসীর কাছে বিষয়টা খুব জটিল মনে হতে পারে। তাছাড়া চার্চিল তো আর জীবিত নেই। তিনি মারা গিয়েছেন পয়তাল্লিশ বছর আগে। তাকে নিয়ে টোরি পার্টি টানাহেচড়া করতে চায়, করুক। কিন্তু সেটা আমার রুচিতে বাধবে।
আদিল: তাহলে দ্বিতীয় পথে চেষ্টা করতে পারেন।
রানী: সেটা কী?
আদিল: আপনি বাংলাদেশের ব্যারিস্টার রফিক-উল হককে আপনার আইনজীবী নিযুক্ত করুন। তাকে লন্ডনে নিয়ে আসুন। সরকারের বিরুদ্ধে তাকে দিয়ে মামলা দায়ের করুন।
রানী: আমার দেশে এত বাঘা বাঘা সব কিউসি, ব্যারিস্টার থাকা সত্ত্বেও ব্যারিস্টার রফিক-উল হককে কেন?
আদিল: ব্যারিস্টার রফিক-উল হক সরকারের বিরুদ্ধে মামলা লড়তে এক্সপার্ট। তার সাকসেস রেট ভালো। ইংল্যান্ডেও তিনি সফল হতে পারেন।
টেলিভিশনে ব্রেকিং নিউজ স্ক্রল দেখে রানী তুলে নিলেন রিমোট কনট্রোল।
রানী: এক্সকিউজ মি। একটু নিউজটা শুনে নিই। আমার সম্পর্কেই ব্রেকিং নিউজ যাচ্ছে। বৃটেনের সব ডাকটিকেট থেকে আমার ছবি বাদ দিয়ে চার্চিলের ছবি ছাপার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। আমার ব্যক্তিগত সম্পত্তি বাকিংহাম প্যালেসেরও নতুন নাম দিয়েছে সরকার…।
আদিল: নিশ্চয়ই চার্চিল প্যালেস?
রানী (বিষণ্ন মুখে টিভি নিউজ দেখতে দেখতে): হ্যা। তাই। আমার মনে হচ্ছে, ইংল্যান্ডের নামও বদলিয়ে সরকার নতুন নাম দেবে চার্চিল্যান্ড।
নিউজ শেষের পর টিভি অফ করলেন রানী।
রানী: ঠিক আছে। আমি দ্বিতীয় পথেই যাবো। আমি তো সরকারকে এড়িয়ে ঢাকায় বৃটিশ হাই কমিশনারের মাধ্যমে ব্যারিস্টার রফিক-উল হকের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারবো না। আপনি কি এই দায়িত্বটা নিতে পারবেন? প্লিজ।
আদিল: নিশ্চয়ই ইয়োর ম্যাজেস্টি। ১৯৬৩-তে ইয়েন ফ্লেমিং লিখেছিলেন তার জেমস বন্ড সিরিজের একাদশতম উপন্যাস অন হার ম্যাজেস্টিস সিক্রেট সার্ভিস। সাতচল্লিশ বছর পরে আমি অন হার ম্যাজেস্টিস সিক্রেট লিগাল সার্ভিসের দায়িত্ব পেয়ে খুবই গর্বিত বোধ করছি। (হাটু গেড়ে বসে) আই অ্যাম অনার্ড। থ্যাংক ইউ, ইয়োর ম্যাজেস্টি।

৯ মার্চ ২০১০

রাষ্ট্রীয় সফর সফল করার সহজ উপায়


দৃশ্য ১.
স্থান : চায়নার রাজধানী বেইজিংয়ে গ্রেট হল অফ দি পিপল-এ রাষ্ট্রীয় মিটিং রুম।
কাল : ১৮ মার্চ ২০১০
চরিত্র : চায়নার প্রধানমন্ত্রী (চাপ্রম), বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী (বাপ্রম) এবং দুজন ইন্টারপ্রেটার বা দোভাষী।
চাপ্রম : চায়নায় আপনাকে স্বাগতম জানাচ্ছি। আমরা আন্তরিকভাবে আশা করি আপনার এই সফরের পর চায়না-বাংলাদেশ বন্ধুত্ব সম্পর্ক এক নতুন পর্যায়ে উন্নীত হবে।
বাপ্রম : আমরাও ঠিক সেই রকমটাই আশা করি।
চাপ্রম : পূর্ব অনুষ্ঠিত আলোচনা অনুযায়ী আমরা আজ এখানে উপস্থিত হয়েছি তিনটি অ্যাকর্ড বা চুক্তিপত্র এবং একটি এমওইউ বা সমঝোতাপত্রে স্বাক্ষর করতে।
বাপ্রম : হ্যা। এই তিনটি চুক্তিপত্র হবে, এক. অর্থনৈতিক ও কারিগরি খাতে সহযোগিতা যেখানে চায়না দেবে পর্যাপ্ত গ্রান্ট বা মঞ্জুরি, দুই. শাহজালাল ফার্টিলাইজার ফ্যাক্টরি নির্মাণের একটি কাঠামো প্রস্তুত এবং তিন. সপ্তম বাংলাদেশ-চায়না মৈত্রী সেতু নির্মাণ বিষয়ে। আর সমঝোতাপত্রটি হবে তেল ও গ্যাস খাতে বাংলাদেশ-চায়নার সহযোগিতা বিষয়ে।
চাপ্রম : চমৎকার। আপনি সবই জানেন দেখছি। বেইজিংয়ে আর কি করতে চান আপনি?
বাপ্রম : ২০০৮-এর অলিম্পিক গেমস উপলক্ষে নির্মিত বেইজিংয়ের স্টেডিয়ামটা দেখবো।
চাপ্রম : এই স্টেডিয়ামটা দর্শনীয় স্থানই বটে। ৪২৩ মিলিয়ন আমেরিকান ডলার খরচ করে এই স্টেডিয়ামটা আমরা বানিয়েছিলাম। এটিই হচ্ছে বিশ্বের সর্ববৃহৎ স্টিল স্ট্রাকচার। এর নাম স্টিলের খাচা হওয়াই সঙ্গত ছিল। তবে এর নাম আমরা দিয়েছি বার্ডস নেস্ট বা পাখির নীড়। কিন্তু এখনো চায়নার সবচেয়ে বড় দর্শনীয় স্থান হচ্ছে দি গ্রেট ওয়াল বা চায়নার বিশাল দেয়াল। এই গ্রেট ওয়াল বিষয়ে তথ্যগুলো জানলে আপনি অবাক হয়ে যাবেন।
বাপ্রম : দয়া করে কয়েকটি তথ্য আমাকে বলবেন কি?
চাপ্রম : অবশ্যই। আনন্দের সঙ্গে বলবো। যিশু খৃস্টের জন্মের পাচশ বছর আগে অর্থাৎ আজ থেকে প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে চায়নার উত্তর অঞ্চলে এই দেয়াল বানানোর কাজ শুরু হয়েছিল। তারপর প্রায় ২১০০ বছর জুড়ে এই দেয়াল নির্মাণ, মেরামতি, পুনঃনির্মাণ প্রভৃতি কাজ চলে ষোড়শ শতাব্দী পর্যন্ত। পাথরে তৈরি এই দেয়াল তৈরি করা হয়েছিল চায়নিজ সাম্রাজ্যের উত্তর সীমান্তকে রক্ষার জন্য। মিং বংশের রাজত্বের সময়ে এই দেয়ালের বেশিরভাগ তৈরি হয়েছিল। পূর্বে শানহাইগুয়ান থেকে পশ্চিমে লপ নুর পর্যন্ত বিস্তৃত এই দেয়ালটির তার শাখা-প্রশাখাসহ দৈর্ঘ ৮,৬৫১ কিলোমিটার বা ৫,৫০০ মাইল। এটি চওড়ায় সর্বোচ্চ ৯.১ মিটার বা ৩০ ফিট। চিন্তা করুন ৩০ ফিট চওড়া দেয়াল ৫,৫০০ মাইল জুড়ে চায়নাকে শতাব্দীর পর শতাব্দী সুরক্ষিত রেখেছে। (হাসি মুখে) পৃথিবীর সপ্তম আশ্চর্যের অন্যতম এই দি গ্রেট ওয়াল।
বাপ্রম : এই ওয়াল আমি দেখেছি। সত্যিই অতি আশ্চর্যজনক সৃষ্টি!
চাপ্রম : এই পাচ দিন সফরের শেষ দিনে আপনি যাবেন, কুনমিংয়ে। সেখানে আপনার সঙ্গে দেখা হবে ইউনান প্রদেশের গভর্নর মি. জিন গুয়াগং-য়ের সঙ্গে। যদিও আমরা আজকে তিনটি চুক্তিপত্র এবং একটি সমঝোতাপত্রে সই করবোÑ তবুও এসবই বাস্তবায়িত হবে একটি শর্ত সাপেক্ষে।
বাপ্রম (অবাক হয়ে) : একটি শর্ত! সেই শর্তটা কি? এ বিষয়ে আমার পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. দীপু মনি এবং পররাষ্ট্র দফতর তো কিছুই আমাকে বলেনি!
চাপ্রম : এটা ওরা কেউ জানেন না। আপনাকে এই শর্ত বিষয়ে জানাবেন গভর্নর জিন গুয়াগং। তার আগে আগামীকাল আপনার সঙ্গে দেখা হবে আমাদের প্রেসিডেন্ট হু জিনতাও-য়ের সঙ্গে। আশা করি আপনার এই সৌজন্য সাক্ষাৎ আনন্দদায়ক হবে।
দৃশ্য ২
স্থান : এমপার্ক গ্র্যান্ড হোটেল, কুনমিং
কাল : ২১ মার্চ ২০১০, লাঞ্চ আওয়ার
পাত্র : ইউনান প্রদেশের গভর্নর জিন গুয়াগং, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী, দুজন ইন্টারপ্রেটার এবং দুজন ফুড টেস্টার।
জিন গুয়াগং : অনেক ধন্যবাদ এই লাঞ্চে অতিথি হবার জন্য। আপনি জানেন কুনমিংয়ে কিছু বাংলাদেশি আছেন। বাংলাদেশি খাবারের জায়গা আছে। আমরা ইচ্ছা করলে আপনার জন্য বাংলাদেশি খাবারের আয়োজন করতে পারতাম। কিন্তু আমরা মনে করেছি চায়নাতে এসে আপনি চায়নিজ খাবারই খেতে পছন্দ করবেন। তাই আজকের লাঞ্চ মেনুতে সব চায়নিজ।
বাপ্রম : ঠিকই করেছেন। তবে দেখবেন সব যেন হালাল হয়। সাপ, ব্যাঙ, ইদুর, কুকুর যেন না থাকে।
জিন গুয়াগং : আমরা সে বিষয়ে কড়া নজর রেখেছি। সব হালাল এবং বিষমুক্ত খাবার ও পানীয় সার্ভ করা হবে। কোনো খাবার এবং পানীয়তে বিষ আছে কি না সেটা পরীক্ষা করার জন্য দুজন ফুড টেস্টার আমরা রেখেছি। প্রতিটি খাবার ও পানীয় সার্ভ হবার আগে ওরা দুজন (উপস্থিত দুই ফুড টেস্টারের দিকে আঙ্গুল দেখিয়ে) টেস্ট করে দেখবেন। তারপর সেটা আপনাকে সার্ভ করা হবে। আমরা জানি আপনি অভিযোগ করেছেন বাংলাদেশে সেনা-সমর্থিত গত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে যখন সাবজেলে বন্দি ছিলেন তখন আপনাকে স্লো ফুড পয়জনিং করা হয়েছিল। তাই চায়নাতে আপনাকে যেসব ফুড ও ড্রিংকস সার্ভ করা হয়েছে এবং হবে সেসব সম্পর্কে আমরা একস্ট্রা কেয়ারফুল আছি।
বাপ্রম : আপনাদের দূরদর্শিতার তারিফ করতেই হয়। কি খাওয়াবেন আজ?
জিন গুয়াগং : ট্রাডিশনাল চায়নিজ খাবার সাধারণত ছোট ছোট টুকরো বা পোর্শনে হয়, ফলে সেসব চপ স্টিকস দিয়ে খেতে সুবিধা হয়। সাধারণত চায়নিজ মেনু তৈরি হয় বিপরীত জাতীয় ফুডকে ব্যালান্স করে। যেমন হট ফুডকে ব্যালান্স করা হয় কোল্ড ফুড দিয়ে। পিকলড ফুড বা আচার জাতীয় সংরক্ষিত ফুড ব্যালান্স করা হয় ফ্রেশ ফুড দিয়ে। অনেক মশলাযুক্ত ফুড ব্যালান্স করা হয় কম মশলাযুক্ত ফুড দিয়ে। আমরা শুরু ও শেষ করবো চায়নিজ টি দিয়ে। আপনি বোধ হয় জানেন, চায়নিজরা মনে করে জীবন ধারণের সবচেয়ে প্রয়োজনীয় সাতটি বস্তু হচ্ছে, জ্বালানি কাঠ, চাল, তেল, লবণ, সয়া সস, ভিনিগার এবং চা।
বাপ্রম : এটা জানতাম না।
জিন গুয়াগং : আমরা টেবিলে ছুরি-কাটাচামচ রেখেছি। ইচ্ছা করলে সেসব ব্যবহার করতে পারেন। পাশেই চপ স্টিকসও রেখেছি। ৩,২০০ বছর আগেও আমরা চায়নিজরা চপ স্টিকস দিয়েই যে খেতাম তার প্রমাণ পাওয়া গেছে ইয়িন-এর ধ্বংসাবশেষে। সভ্য আচার-আচরণের বিকাশ যে প্রথম চায়নাতেই হয়েছিল তার প্রমাণ ৩,২০০ বছর আগেও চায়নিজরা আঙ্গুল দিয়ে নয়, চপ স্টিকস দিয়ে খেত।
বাপ্রম : চপ স্টিকস ধরা জানি না। তাই আমি আজ কাটাচামচ দিয়ে খাবো।
জিন গুয়াগং : শুরু করা যাক তাহলে।
ডাইনিং টেবিলে খাবার ও পানীয় সার্ভ শুরু হলো। ফুড টেস্টার দুজন সেসব চেখে দিলেন।
জিন গুয়াগং (খেতে খেতে) : আমাদের প্রধানমন্ত্রী মি. ওয়েন জিয়াবাও বিষয়ে আপনি কি জানেন?
বাপ্রম : তিনি গণপ্রজাতন্ত্রী চায়নার স্টেট কাউন্সিলের ষষ্ঠ এবং বর্তমান প্রধানমন্ত্রী। স্ট্যান্ডিং কমিটিরও সদস্য তিনি। দেশের প্রকৃত ক্ষমতার অধিকারী এই স্ট্যাডিং কমিটি এবং এর নয় সদস্যের মধ্যে তার স্থান তৃতীয়। (হেসে) অর্থাৎ, চায়নাতে তিনিই সবচেয়ে ক্ষমতাধর ব্যক্তি। একদিকে প্রধানমন্ত্রী এবং অন্যদিকে স্ট্যান্ডিং কমিটির তিন নাম্বার সদস্য।
জিন গুয়াগং : উত্তরাধিকার সূত্রে নয়, নিজের যোগ্যতা বলেই তিনি শীর্ষে পৌছেছেন। পেশাগতভাবে তিনি একজন জিওলজিস্ট ও ইঞ্জিনিয়ার। বেইজিং ইন্সটিটিউট অফ জিওলজি থেকে পোস্ট গ্র্যাজুয়েট ডিগ্রি নিয়েছেন। চায়নার কমিউনিস্ট পার্টিতে এখন যে চতুর্থ প্রজন্ম নেতৃত্ব দিচ্ছে, তিনি তার মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছেন।
বাপ্রম : তার সঙ্গে কথা বলে আমি মুগ্ধ হয়েছি। তবে সেই আলোচনার শেষে তিনি একটা রহস্য করেন। তিনি একটা শর্তের কথা বলেছিলেন, যেটা…
জিন গুয়াগং : হ্যা। সেটা আপনাকে অবশ্যই বলবো। তার আগে বলুন, আপনি কি মনে করেন, আপনার এই চায়না সফর সফল হয়েছে? আপনার সব আশা পূরণ করেছে?
বাপ্রম : আমার তো মনে হয় খুব সফল হয়েছে। অবশ্য শর্তটা জানলে আমি এই সাফল্য সম্পর্কে নিশ্চিত হতে পারতাম।
জিন গুয়াগং : আপনি কি ডিপ সিপোর্ট বা গভীর সমুদ্রবন্দর এবং চট্টগ্রাম থেকে মিয়ানমার হয়ে কুনমিং পর্যন্ত রোড ও রেল যোগাযোগ বিষয়ে আলোচনা করতে চান না? আপনাকে জানিয়ে রাখি আমরা মিয়ানমার, শ্রী লংকা এবং পাকিস্তানে ডিপ সিপোর্ট তৈরি করতে যাচ্ছি। আমাদের ইচ্ছা ছিল বাংলাদেশের সমুদ্রসীমায় একটা সিপোর্ট করে দেব।
বাপ্রম (চিন্তিত মুখে) : সেক্ষেত্রে এটা কি মনে হতে পারে না যে ইনডিয়াকে ঘিরে রাখার জন্য চারটি সিপোর্ট আপনারা করতে চান?
জিন গুয়াগং : সেটা ইনডিয়া মনে করতে পারে বৈকি। চট্টগ্রাম-কুনমিং রোড-রেল যোগাযোগ স্থাপিত হলে ইনডিয়া আরো মনে করতে পারে, বাংলাদেশ তাদের এড়িয়ে সরাসরি চায়নার সঙ্গে আরো ঘনিষ্ঠ স্ট্র্যাটেজিক সম্পর্ক স্থাপন করতে চাইছে। আমাদের প্রধানমন্ত্রী ওয়েন জিয়াবাও আশা করেছিলেন আপনি এই সেন্টিমেন্টের ঊর্ধে উঠে একটা দেয়াল নির্মাণ বিষয়েও আমাদের সাহায্য চাইবেন।
বাপ্রম : সেজন্যই কি তিনি দি গ্রেট ওয়াল সম্পর্কে এত তথ্য আমাকে দেন?
জিন গুয়াগং : হ্যা। আমরা জানি আপনার পার্টি ক্ষমতায় আসার পরে ফেব্রুয়ারি ২০০৯-এ ঢাকায় বিডিআর বিদ্রোহ হয়েছিল। তারপর থেকে বাংলাদেশের সীমান্ত প্রায় অরক্ষিত আছে। বিডিআর সদস্যদের নিরস্ত্র রাখা হয়েছে। আমরা অবশ্য এটাও জানি যে আপনি ফিরে গিয়ে কিছু অস্ত্র দেবেন। কিন্তু আমরা ভেবেছিলাম, ইনডিয়ার সঙ্গে সীমান্ত রক্ষা সমস্যাটির স্থায়ী সমাধানের জন্য দি গ্রেট ওয়ালের মডেলে একটা ওয়াল তৈরির জন্য আমাদের সাহায্য চাইবেন। ইনডিয়া কাটাতারের বেড়া দিচ্ছে। আপনারা পাথরের ওয়াল দিন। এতে দেশের সুরক্ষা হবে। চোরাচালান বন্ধ হবে। বিএসএফের গুলিতে আর বাংলাদেশি নিহত হবে না। চাই কি একটা টুরিস্ট এট্রাকশনও হতে পারে এই ওয়াল।
বাপ্রম : বিষয়টি নিয়ে ভেবে দেখতে হবে। এর সঙ্গে ইনডিয়া জড়িত। কিন্তু এখন বলুন সেই শর্তটা কি যার ওপরে নির্ভর করছে চুক্তিগুলোর বাস্তবায়ন।
জিন গুয়াগং : আপনি জানেন, আপনার পিতার শাসন আমলে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়নি চায়না। পাকিস্তানের সঙ্গে সুদীর্ঘকালের বন্ধু সম্পর্কের মূল্য দেয়ার কারণে আমরা একাত্তরে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে সমর্থন করিনি। তারপর বাংলাদেশ স্বাধীন হলেও আমরা স্বীকৃতি দেইনি। শেখ মুজিবুর রহমানের মৃত্যুর পরে আমরা স্বীকৃতি দিয়েছিলাম। তারপর জিয়াউর রহমান যখন বাংলাদেশের শাসক হন তখন চায়না-বাংলাদেশ সম্পর্কে নতুন মোড় নেয়। জিয়াউর রহমানের উদ্যোগে আমাদের দুই দেশের মধ্যে বন্ধু সম্পর্ক গড়ে ওঠে। তিনি প্রয়াত হলেও আমরা তাকে শ্রদ্ধা করি।
বাপ্রম (মুখে গভীর বিরক্তির চিহ্ন) : আপনি জিয়াউর রহমানের কথা টেনে আনছেন কেন? শর্তের সঙ্গে ওই অখ্যাত মেজরটার সম্পর্ক কি?
জিন গুয়াগং : সম্পর্ক আছে বলেই তো বলছি। আপনি জানেন আধুনিক চায়নার রূপকার ছিলেন আমাদের পরম শ্রদ্ধেয় নেতা দেং জিয়াও পিং। আপনি জানেন আমাদের প্রধানমন্ত্রী ওয়েন জিয়াবাও। আর কুনমিং এয়ারপোর্ট থেকে যখন দেশে ফিরবেন তখন লক্ষ্য করবেন চায়নার এই সপ্তম বৃহৎ এয়ারপোর্টের নাম কুনমিং উজিয়াবা এয়ারপোর্ট। আমরা জানি, জিয়া নামের প্রতি আপনার প্রচন্ড এলার্জি আছে। জিয়া নাম দেখলেই আপনি তা বদলে ফেলার নির্দেশ দেন। তাই আমাদের শর্ত থাকবে চায়না-বাংলাদেশের কোনো চুক্তিপত্র, সমঝোতাপত্র, স্মারকপত্র, সফরসূচি, কর্মসূচি প্রভৃতিতে দেং জিয়াও পিং, ওয়েন জিয়াবাও, উজিয়াবা এয়ারপোর্ট প্রভৃতি নাম বদলানো যাবে না, বাদও দেয়া যাবে না। বহু চায়নিজ নামের অচ্ছেদ্য অংশ জিয়া এবং সেটা বজায় রাখতে হবে। এটাই আমাদের একমাত্র পূর্বশর্ত।

৫ এপ্রিল ২০১০

নিউ ইয়র্কে নেড়িকুকুরের ইন্টারভিউ



sr১৭ ও ১৮ জুলাই ২০১০-এ নিউ ইয়র্কে আমেরিকা-বাংলাদেশ-কানাডা কনভেনশন (সংক্ষেপে এবিসি কনভেনশন)-এ এবার নিমন্ত্রিত হয়েছিলেন নেড়িকুকুর।
সমবেত মানুষবৃন্দ,
প্রথমেই আমি এবিসি কনভেনশনের আয়োজকদের ধন্যবাদ জানাতে চাই এই রকম একটি বিরাট আন্তর্জাতিক সম্মেলনে বাংলাদেশের এক নেড়িকুকুরকে নিমন্ত্রণ করার জন্য।
থ্যাংক ইউ। ঘেউ ঘেউ।
আর তারপর ধন্যবাদ জানাতে চাই আপনাদের সবাইকে, যারা এখানে এসেছেন আমার কথা শুনতে।
থ্যাংক ইউ। ঘেউ ঘেউ।
এবিসি কনভেনশন আয়োজকরা যে আমাকে, নেড়িকুকুরকে, নিমন্ত্রণ করেছেন তাতে আনন্দিত হলেও, অবাক হইনি। কারণ, আমেরিকানরা কুকুর ভালোবাসে। আমেরিকায় সাড়ে ছয় কোটি কুকুর আছে। অর্থাৎ গড়ে প্রতি পাচজন আমেরিকানের একটি কুকুর আছে। ৮৩ শতাংশ আমেরিকান বলেন, তারা তাদের কুকুরের প্রাণ রক্ষায় নিজের জীবনের ঝুকি নিতে প্রস্তুত আছেন। আর ২৭ শতাংশ আমেরিকান উইল করে বলে যান মৃত্যুর পরে তাদের পোষা কুকুরটির দেখাশোনা কিভাবে করতে হবে। আমেরিকানদের এই কুকুরপ্রীতি সাধারণ মানুষ থেকে প্রেসিডেন্ট পর্যন্ত বিদ্যমান।
আপনারা জানেন, বারাক হুসেন ওবামা প্রেসিডেন্ট হবার পরে পূর্ব প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী একটি কুকুর তার দুই মেয়েকে উপহার দিয়েছেন যার নাম বি.ও অর্থাৎ বারাক ওবামা ইংরেজি বানানের দুটি আদ্যাক্ষর। লক্ষণীয় যে, তার কুকুরের নামকরণে হুসেন-এর আদ্যক্ষরটি বাদ পড়ে গিয়েছে। বস্তুত, প্রেসিডেন্ট পদে শপথ নেয়ার সময়ে একবার উচ্চারিত হুসেন শব্দটি, এখন আমেরিকায় প্রশাসন থেকে শুরু করে মিডিয়া পর্যন্ত হারিয়ে গিয়েছে। যারা এই কা-টি করেছেন, তারা হয়তো প্রেসিডেন্টের সঙ্গে জন্মসূত্রে ইসলামের সম্পৃক্ততার বিষয়টি মুছে দিতে চেয়েছেন। তাই তারা ওবামার পোষা কুকুরের নামে হুসেনের আদ্যক্ষর, এইচ, দিতে চাননি। এটা একটা কারণ হতে পারে।
আরেকটা কারণ হতে পারে একটি ইসলামি শব্দের সঙ্গে কুকুরের সম্পৃক্ততা তারা চাননি। কারণ ইসলামের সঙ্গে কুকুরের বরাবরই একটা দূরত্ব আছে।
আর তাই এবিসি কনভেনশনে যোগ দেয়ার জন্য এয়ার টিকেট পাওয়ার পরে আমি দুঃশ্চিন্তায় ছিলাম। ভাবছিলাম ঢাকায় জিয়া ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টের নতুন নাম হয়েছে হজরত শাহজালাল (রাঃ) ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট। এই পবিত্র নামধারী এয়ারপোর্টের মধ্য দিয়ে এক নেড়িকুকুরকে যেতে দেয়া হবে তো?
প্রশ্নটি আমার মনে ঘুরপাক খাচ্ছিল। যদি ইমিগ্রেশন অথরিটি অভিযোগ করে, আমি এয়ারপোর্টের পবিত্রতা লংঘন করেছি এবং সেই অভিযোগে যদি তারা আমাকে অ্যারেস্ট করে, রিমান্ডে নেয়? আর বাংলাদেশে, যেটা এখন মামলাদেশে রূপান্তরিত হয়েছে, সেখানে রিমান্ড মানেই তো টর্চার! আর এসব টর্চারে মানুষ মারাও যাচ্ছে। বিডিআর বিদ্রোহের মামলায় বিচারাধীন ৫৬ আসামির মৃত্যু হয়েছে।

শুধু টর্চারই না, মামলাদেশে ব্যক্তিবিশেষকে রিমান্ডে নিয়ে তাকে বিবস্ত্রও করা হয়। দৈনিক আমার দেশ পত্রিকার ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মাহমুদুর রহমানকে বিবস্ত্র করা হয়েছিল। কেন যে তারা রিমান্ডে নিয়ে মানুষকে বিবস্ত্র করে তা আমি জানি না। তবে ন্যাংটার যেমন বাটপাড়ের ভয় নেই, তেমনি নেড়িকুকুরের বিবস্ত্রকারী ডিবি পুলিশের ভয় নেই। কারণ আমরা তো সবসময়ই বিবস্ত্র আছি!
সে যাই হোক। হজরত শাহজালাল (রাঃ) এয়ারপোর্ট ইমিগ্রেশন অথরিটিকে ধন্যবাদ, তারা আমাকে যেতে দিয়েছেন।
So, here i come America. (সো, হিয়ার আই কাম আমেরিকা)।
আমেরিকা, আমি এসে পড়েছি।
ঘেউ ঘেউ।
নিউ ইয়র্কে গত কয়েক ঘণ্টা থাকার পর ঢাকার সঙ্গে কয়েকটি বড় মিল-গরমিল আমার চোখে পড়েছে।
নিউ ইয়র্কে মানুষ এবং কুকুর, দিনে এবং রাতে নির্ভয়ে চলাফেরা করতে পারে। পথে ছিনতাইকারীদের ভয় নেই। ঢাকনাবিহীন ম্যানহোলের মৃত্যুফাদ নেই। বিকলাঙ্গ ভিখারির হাতছানি নেই। ঢাকার পথে এ সবই আছে। প্লাস এখন যোগ হয়েছে পথে আচমকা গ্রেফতার হয়ে যাবার ভয়। যেমনটা হয়েছেন আমেরিকায় নিযুক্ত সাবেক রাষ্ট্রদূত শমসের মবিন চৌধুরী। তিনি এখন জেলে আছেন। ঢাকার পথে এখন আরেকটা ভয় হচ্ছে হঠাৎ নিখোজ হয়ে যাওয়া। কমিশনার চৌধুরী আলমকে পথ থেকে সবার সামনে ধরে নিয়ে গিয়েছে শাদা পোশাকের কিছু লোক। তার কোনো খোজ পাওয়া যাচ্ছে না।
নিউ ইয়র্কের সঙ্গে ঢাকার একটি ন্যাক্কারজনক মিল আমি দেখেছি। ঢাকার পথে মানুষ পেচ্ছাব-পায়খানা করে, বা বলা উচিত, পাবলিক টয়লেটের অভাবে করতে বাধ্য হয়। আর নিউ ইয়র্কের পথে সতর্কতামূলক নোটিশ থাকা সত্ত্বেও কুকুর পেচ্ছাব-পায়খানা করে।
আকাশছোয়া বিলডিং বা স্কাইস্ক্র্যাপারের শহর নিউ ইয়র্ক। এসব বিলডিং নির্মাণ সমাপ্তির পরে তা ভেঙ্গে ফেলার কথা ওঠেনি। ঢাকায় হাইরাইজ বিলডিং নির্মাণ সমাপ্তির পর তা ভেঙ্গে ফেলার কথা ওঠে। যেমন, সম্প্রতি গুলশানে ওয়েস্টিন হোটেল এবং জব্বার টাওয়ার যে অবৈধভাবে নির্মিত হয়েছে সে কথা উঠেছে। এই ধরনের অভিযোগে বছর দুয়েক আগে র‌্যাংগস টাওয়ার ভেঙ্গে ফেলা হয়েছে। তবে, একই অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও বিজিএমইএ বিলডিং ভাঙা হয়নি। আশ্চর্য লাগে ভেবে, যখন নির্মাণ কাজ শুরু হয়, তখন এই ধরনের অভিযোগ কেন ওঠে না?
আরেকটি তফাৎ চোখে পড়েছে। নিউ ইয়র্ক ও সংলগ্ন এলাকায় দুই কোটির বেশি মানুষ বসবাস করলেও এবং এত গাড়ি থাকলেও পথে জনযট নেই–যানজটও নেই। চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় প্লেনে পৌছাতে লাগে ৪৫ মিনিট। কিন্তু তারপর ঢাকা এয়ারপোর্ট থেকে ঢাকা সিটি সেন্টারে পৌছাতে সময় লাগতে পারে দুই ঘণ্টার বেশি।
আমি দেখেছি, নিউ ইয়র্কে, এয়ারপোর্ট থেকে সিটি সেন্টারে পৌছানো ত্বরান্বিত করতে এক্সপ্রেসওয়ে আছে, রেল সিসটেম আছে। বাংলাদেশের বর্তমান ডিজিটাল সরকারও বলছে, ঢাকায় এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে হবে, ইলেকট্রিক ট্রেন চলাচল করবে।
যেসব সময়ে এসব কথা সরকার বলেছে ঠিক সেই সময়েই ইলেকট্রিসিটির অভাবে সাধারণ মানুষ ওয়ার্ল্ড কাপ ফুটবল ম্যাচ দেখতে না পেরে বিদ্যুৎকেন্দ্র ঘেরাও করেছে, বিক্ষোভ মিছিল করেছে, ভাংচুর করেছে। বিদ্যুৎ ও গ্যাসের অভাবে পুজি বিনিয়োগ বন্ধ হয়ে গিয়েছে। বাংলাদেশের রাজধানীতে এখন বহু স্থানে প্রতি এক ঘণ্টা অন্তর বিদ্যুৎ সাপ্লাই বন্ধ হয়ে যায়, মফস্বল ও গ্রামের অবস্থা আরো করুণ। কোনো কোনো স্থানে রাতে-দিনে মাত্র দুই ঘণ্টা বিদ্যুৎ থাকছে।
পরিস্থিতিটা নিউইয়র্কে থেকে আপনাদের পক্ষে কল্পনা করা অসম্ভব। চিন্তা করে দেখুন, সম্মেলন চলার সময়ে কনভেনশন হলের বিদ্যুৎ যদি চলে যায়!
নিউ ইয়র্কের সঙ্গে ঢাকার আরেকটা তফাৎ দেখলাম। এখানে পথে পথে চমৎকার সব খাবার দোকান আছে এবং ভালো খাবার সাধারণ মানুষের খরচ করার সামর্থের মধ্যে। কিন্তু ঢাকা তথা বাংলাদেশে চাল, ডাল, পেয়াজ, শাকসবজি ও তেলের দাম বেড়েই চলেছে। আগামী রোজার মাসে আরো বাড়বে। মোটা চালের কেজি এখন হয়েছে ৩৬ টাকা। ১০ টাকা কেজি দরে চাল দেয়ার নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি হয়ে গিয়েছে নিখোঁজ। ঘরে ঘরে চাকরির প্রতিশ্রুতিও দেয়া হয়েছিল নির্বাচনী জনসমাবেশে। বরং এখন দেখা যাচ্ছে, বহু দেশে চাকরি হারিয়ে অনেক মানুষ বাংলাদেশে ফিরে আসতে বাধ্য হচ্ছে।
এই পরিস্থিতিতে আমি নেড়িকুকুর উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছি। সাধারণ মানুষেরই যদি খাবার না জোটে, তাহলে আমরা নেড়িকুকুররা তাদের উচ্ছিষ্ট কোথায় পাবো?
এসব চিন্তাভাবনা নিয়ে প্রতিবাদ জানাতে গেলে আরো বিপদ হতে পারে। সম্প্রতি বাংলাদেশে চালু হয়েছে গায়েবি গণসমন জারি। মাহমুদুর রহমানসহ আমার দেশ পত্রিকার আরো পাঁচজন নির্দিষ্ট সাংবাদিকের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়েছে। একই সঙ্গে ওই পত্রিকার আরো ১০০ জন অজ্ঞাত সাংবাদিকের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়েছে। এই ব্যবস্থায় সরকার ওই পত্রিকার যেকোনো ব্যক্তির নাম ওই মামলায় ঢুকিয়ে তাকে গ্রেফতার করতে পারে। অনেকটা শূন্যস্থান পূরণ করার মতো ব্যাপার আর কি!
একইভাবে আশুলিয়াতে গার্মেন্টস শ্রমিকদের অসন্তোষ প্রকাশের পর সেখানে অজ্ঞাত ৬০,০০০ ব্যক্তির বিরুদ্ধে গায়েবি গণসমন জারি করা হয়েছে। হ্যা। ৬০,০০০ সংখ্যাটি সঠিক। গিনেস বুক অফ রেকর্ডসে হয়তো এই উদ্ভট ব্যবস্থাটি স্থান পাবে।
বাংলাদেশে এসব চলমান সমস্যার ওপরে আরো এসে পড়েছে ইনডিয়ার সঙ্গে গত বছরে স্বাক্ষরিত বাংলাদেশের ৫০ দফা চুক্তির বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া। যদিও এই চুক্তি বিষয়ে পার্লামেন্টে কোনো আলোচনা হয়নি। তবুও বাংলাদেশে ইনডিয়ার করিডোর হচ্ছে। কিন্তু নেপালের ট্রানজিট হচ্ছে না। বাংলাদেশের পশ্চিমে ফারাক্কা বাঁধের মর্মান্তিক মরু অভিজ্ঞতার পরে, বাংলাদেশের পূর্বে বাঙালি মুখোমুখি হতে চলেছে টিপাইমুখ বাধ অভিজ্ঞতার।
বিডিআরের হাতে সেনা অফিসাররা আক্রান্ত হয়েছে। পরিণতিতে বিডিআর ও সেনা, এই দুটি বাহিনীই দুর্বল হয়ে গিয়েছে। আর তার পরিণতিতে সীমান্ত এলাকা প্রায় অরক্ষিত হয়ে পড়েছে। তাই বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার বিষয়ে অনেকেই এখন চিন্তিত।
সব মিলে বাংলাদেশের সংকট যে কতো গুরুতর আকার ধারণ করেছে সেটা হয়তো আপনারা বুঝবেন একটা ছোট গল্প যদি বলি।
আমেরিকার সাবেক প্রেসিডেন্ট জর্জ ডাবলিউ বুশের সময়ে সূচিত অর্থনৈতিক মন্দাবস্থা কবে কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হবে সেটা জানতে বর্তমান প্রেসিডেন্ট ওবামা গিয়েছিলেন গড-এর কাছে।
গড উত্তর দেন, আরো দশ বছর লাগবে।
উত্তর শুনে ওবামা কাদতে কাদতে বেরিয়ে যান।
এরপরে বৃটেনের প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন যান গডের কাছে এবং প্রশ্ন করেন বৃটেনের চলতি মন্দাবস্থা কাটিয়ে উঠতে কতো বছর লাগবে?
গড উত্তর দেন, আরো বিশ বছর লাগবে। উত্তর শুনে ক্যামেরন কাদতে কাদতে বেরিয়ে যান।
এরপরে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী যান গডের কাছে এবং তিনি জানতে চান গত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে সূচিত বাংলাদেশের দুরবস্থা কাটিয়ে উঠতে কতো বছর লাগবে? কোনো উত্তর না দিয়ে এবার গড-ই কাদতে কাদতে বেরিয়ে যান।
এটা নৈরাশ্যজনক রাজনৈতিক চুটকি।
কিন্তু এর বিপরীতে মনে রাখবেন বাংলাদেশ বিরোধী বহু প্রচারণা, স্বদেশে ও বিদেশে হওয়া সত্ত্বেও, আমেরিকার প্রভাবশালী টাইম ম্যাগাজিনের ১০ এপ্রিল ২০০৬-এ, অর্থাৎ গত বিএনপি সরকারের শেষ বছরে প্রকাশিত একটি খুবই আশাবাদী রিপোর্ট। টাইম ম্যাগাজিন তাদের কভার স্টোরি রিবিলডিং বাংলাদেশ শিরোনামে বাংলাদেশের চমৎকার অগ্রগতি ও অনুকরণীয় উন্নতির লম্বা ফিরিশতি দিয়েছিল। প্রশংসা করেছিল। মনে রাখবেন ২০০৫ সালে ক্যাটরিনা ঝড়ের পরে গত বিএনপি সরকারের আমলে বাংলাদেশ এক মিলিয়ন ডলার সাহায্য দিয়েছিল আমেরিকাকে, যার পরিমাণ ছিল অন্য দেশগুলোর তুলনায় পঞ্চম এবং জাপানের সমান।
সুতরাং শত বিপদ ও হাজার সমস্যা সত্ত্বেও বাংলাদেশ এখনো তার স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষা করে সসম্মানে ও সগর্বে সামনে এগিয়ে যেতে পারে। প্রয়োজন শুধু গভীর দেশপ্রেম ও ঐক্যবদ্ধ কর্মসূচি এবং সেটা বাস্তবায়নে অটল সাহস ও কঠোর শৃঙ্খলা। আর এসব গুণাবলী আয়ত্ত করার জন্য উচিত জীবনের সব ক্ষেত্রে শিক্ষার প্রসার।
আমি আশা করি, আপনারা, আমেরিকান বাঙালিরা সেই লক্ষ্যেই কাজ করবেন। তখন বাংলাদেশে সবাই ভালো থাকবে। তাহলে আমরা নেড়িকুকুররাও ভালো থাকবো।
সবাইকে ধন্যবাদ ও শুভেচ্ছা। ঘেউ ঘেউ।
এবিসি কনভেনশন, নিউ ইয়র্ক, ১৮ জুলাই ২০১০