মঙ্গলবার, ১৭ এপ্রিল, ২০১২

উই রিভোল্ট! আমরা বিদ্রোহ করলাম!


২০১২-০৪-০৮

গতকাল সাতটি বইয়ের মোড়ক উন্মোচন করেছেন বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল, বিএনপি-র চেয়ারপারসন ম্যাডাম খালেদা জিয়া। ইতিমধ্যে আপনারা জেনেছেন, এই প্রকাশনা উৎসব করতে ৰমতাসীন সরকার আরোপিত বিভিন্ন বাধা পেরোতে হয়েছে।
প্রথমে ম্যাডাম খালেদা জিয়ার পাচটি বইয়ের মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠান হওয়ার কথা ছিল ২৭ মার্চ ২০১২-তে সোনারগাও হোটেলের বলরম্নমে। এই অনুষ্ঠানের আয়োজক গ্রম্নপ ২০০৯, সংৰেপে জি-৯ এ জন্য এক মাস আগে ২৭ ফেব্রম্নয়ারিতে ওই হোটেলে অ্যাডভান্স পেমেন্ট করেছিল এবং প্রায় ১,০০০ অতিথির নামে কার্ড বিলি করেছিল। কিন্তু ১৮ মার্চে সোনারগাও হোটেল কর্তৃপৰ সেই বুকিং ক্যানসেল করে জানায়, প্রধানমন্ত্রীর অফিস ঠিক সেই দিন, সেই সময়ে বুকিং চেয়েছে। তাই বিরোধী দলীয় নেত্রীর অনুষ্ঠানের বুকিং ক্যানসেল করতে তারা বাধ্য হয়েছে।
এই বুকিং বাতিল হয়ে যাওয়ার পরে জি-৯ সাবেক শেরাটন, বর্তমানে রূপসী বাংলা হোটেলের উইন্টার গার্ডেন হল রম্নমটির বুকিং দেয়, দিন ও সময় অপরিবর্তিত রেখে । জি-নাইন নতুন কার্ড ছেপে আবারও বিলি করে।
অনুষ্ঠানের আগের রাতে। ২৬ মার্চ রাত সাড়ে দশটায় আমি রূপসী বাংলা হোটেলে যাই বিভিন্ন প্রস্তুতি কাজ সুসম্পন্ন হয়েছে কি না দেখার জন্য। তখন আমাকে বলা হয়, হোটেল কর্তৃপৰ ফোনে জানতে চেয়েছেন বইগুলোর বিষয়বস্তু কি এবং প্রকাশিত পাচটি বই তাদের কাছে পরদিন সকাল দশটায় জমা দিতে হবে। তারপর বইগুলো পরীৰা করে তারা জানাবেন, এই হোটেলে এ প্রকাশনা উৎসব করা যাবে কি না।
আমি অবাক হয়ে বললাম, পরদিন সকাল দশটায় যদি বলা হয় এই হোটেলে অনুষ্ঠান করা যাবে না তাহলে আমরা কিভাবে অতিথিদের জানাবো যে অনুষ্ঠানটি বাতিল হয়ে গিয়েছে?
অতিথিরা হোটেলে এসে যদি বাতিল হওয়ার সংবাদটি পান তাহলে সেটা হবে হোটেল কর্তৃপৰের জন্য নিন্দাজনক এবং আয়োজক জি-নাইনের জন্য বিব্রতজনক। সুতরাং রূপসী বাংলায় অনুষ্ঠান হতে পারবে কি না সেটা রাতের মধ্যে জানাতে হবে।

রূপসী নয়, কুরূপা কুশ্রী কুচরিত্র
এর আধা ঘণ্টা পরে জি-নাইনের কাছে ০১৭১৩ ০৪৭ ৬৮৭ নাম্বার থেকে আসে একটি এসএমএস। তাতে লেখা ছিল :
Dear Sir, as I had shared with you few minutes earlier over cell phone that we cannot organize your event tomorrow. I have been instructed to you from authority of national intelligent department of Bangladesh. Sorry for the inconvenience.
Thanks n regards Mosharrof Hossain, Catering sales executive, Ruposhi Bangla Hotel.
অর্থাৎ, সুধী, কয়েক মিনিট আগে সেলফোনে আমি জানিয়েছিলাম আগামীকাল আপনাদের অনুষ্ঠান আমরা করতে পারবো না। এ বিষয়ে বাংলাদেশের জাতীয় গোয়েন্দা বিভাগের কর্তৃপৰ আমাকে নির্দেশ দিয়েছেন। আপনাদের অসুবিধার জন্য আমরা দুঃখিত। ধন্যবাদ ও শ্রদ্ধানেৱ মোশাররফ হোসেন, কেটারিং সেলস একজিকিউটিভ, রম্নপসী বাংলা হোটেল।

এভাবেই কিছু অকালকুষ্মাণ্ড, অর্বাচীন ও অভদ্র সরকারি কর্মচারিদের কাছে রূপসী বাংলা হোটেলটি হয়ে গেল কুরূপা, কুশ্রী ও কুচরিত্র। ঠিক ওই কর্মচারীদের পেছনে ৰমতাসীন লোকজনের মতোই!

এখন সোচ্চার তখন অনুপস্থিত
এখানে আমি বিনীতভাবে জানাতে চাই, একাত্তরে যখন এটি ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেল ছিল তখন আমি ছিলাম চিফ অ্যাকাউন্টেন্ট এবং এক পর্যায়ে যুদ্ধভীত শেতাঙ্গ জেনারেল ম্যানেজার বার্নার্ড হোল্ট ইংল্যান্ডে চলে গেলে আমি ছিলাম অ্যাকটিং জেনারেল ম্যানেজার। এ হোটেল থেকে আমারই উদ্যোগে ১৭ মার্চ ১৯৭১-এ শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মদিনে বাংলাদেশের ম্যাপ ও ফ্যাগ খচিত বড় বার্থডে কেক পাঠানো হয়েছিল তার ৩২ নাম্বার রোডের বাড়িতে। এ হোটেলে সেই সময়ে অবস্থানরত পাকিসৱানি নেতা জুলফিকার আলি ভুট্টোকে লিফটে আটকে রেখে স্যানডাল পেটা করা হয়েছিল তদানীনৱন সিকিউরিটি অফিসার মি. করিমের পস্ন্যান অনুযায়ী। পরবর্তীকালে এ ঘটনাটি তিনি লাল গোলাপ টিভি অনুষ্ঠানে বর্ণনা করেন। এই ব্যক্তিগত কথাগুলো বললাম এই জন্য যে, বর্তমানে মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে সবচেয়ে বেশি সোচ্চার প্রধানমন্ত্রীকে তখন কোনো মুক্তি আন্দোলনে অংশ নিতে আমি দেখিনি।
আমার বইগুলো প্রকাশনার তৃতীয় প্রচেষ্টায় ন্যাশনাল প্রেস কাবের শরণাপন্ন হই। প্রেস কাব কর্তৃপৰ সদয় ও সাহসী অনুমতি দেন। জি-নাইন তৃতীয়বার কার্ড ছাপে ও বিলি করে। ধন্যবাদ ন্যাশনাল প্রেস কাব কর্তৃপৰ ও সদস্যদের।

সরকার কেন বাধা দিল
সরকার কেন বই প্রকাশনা উৎসবে বাধা দিয়েছে তার কয়েকটি ব্যাখ্যা ইতিমধ্যে বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। এর একটি ব্যাখ্যা হলো, ২৭ মার্চ সোনারগাও ও রূপসী বাংলা হোটেলে বিদেশি কয়েক অতিথি ছিলেন। প্রকাশিতব্য পাচটি বইয়ের মধ্যে দুটি ইংরেজিতে।
সরকার চায়নি এ ইংরেজি বই দুটি বিদেশিদের হাতে পড়ুক। কারণ দুটি বই পড়লেই জানা যাবে স্বাধীনতার ঘোষণা ও মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে এই সরকার কি রকম মিথ্যাচার করেছে।
বস্তুত এ কারণেই আমি এসব বই লেখার তাড়না বোধ করেছিলাম।
আমি যখন দেখলাম এবং এখনো দেখছি, আমাদের ইতিহাস, বিশেষত স্বাধীনতার ঘোষণা ও স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস অবিরামভাবে বিকৃত করা হচ্ছে এবং অব্যাহতভাবে ভিন্নমত পোষণকারী প্রয়াত এবং জীবিত ব্যক্তিদের চরিত্র হনন করা হচ্ছে তখন আমি যন্ত্রণায় পড়ে যাই। আমি বাধ্য হই সেই যন্ত্রণায় বই লিখতে। আর তারই ফসল এ সাতটি বই ।
১৪ ফেব্রম্নয়ারি ২০১০-এ অর্থাৎ দুই বছর আগে টার্কির প্রেসিডেন্ট আবদুলস্নাহ গুল ঢাকায় এসেছিলেন। তার ঢাকা সফরের আগে টার্কিশ দূতাবাস ম্যাডাম জিয়ার কার্যালয়ে ফোন করে জানতে চান ম্যাডাম জিয়ার জীবনীমূলক প্রামাণ্য তথ্য। ওই তথ্য সরবরাহের দায়িত্ব আমার ওপর পড়ে। আমি অবাক হয়ে যাই দেখে যে, উইকিপিডিয়া থেকে শুরম্ন করে বিভিন্ন সূত্রে ম্যাডাম খালেদা সম্পর্কে তথ্যগুলো অসম্পূর্ণ, অসত্য অথবা অর্ধসত্য। এই সময়ে আমি ইংরেজিতে তার একটি সংৰিপ্ত জীবনী লিখি এবং সেটাই টার্কিশ দূতাবাসকে পাঠিয়ে দেয়া হয়। এরপরই ম্যাডাম খালেদার এ সংৰিপ্ত জীবনীর বাংলা ও ইংরেজি ভার্শন প্রকাশ করার কথা ভাবতে থাকি।

কে কখন কোথায়
কাজটি করতে গিয়ে আমি প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান-এর জীবন ও কর্মকাণ্ড সম্পর্কে কিছু রিসার্চে লৰ্য করি, তার সম্পর্কে অনেক অসত্য এবং অর্ধসত্য প্রচারিত হয়েছে। আরো দুঃখের বিষয় যে, এসব চালানো হচ্ছে সরকারিভাবে। শুধু তাই নয়, জিয়াউর রহমানের বিপরীতে আরেক ব্যক্তির স্তুতি ও বন্দনা একনিষ্ঠভাবে অহরহ চলছে। ফলে বিশেষত তরম্নণ প্রজন্মের পৰে বোঝা অসম্ভব হয়ে দাড়িয়েছে, স্বাধীনতা যুদ্ধের ঘোষণা কে বা কারা দিয়েছিলেন? কখন দিয়েছিলেন? স্বাধীনতা যুদ্ধে কে, কোথায় ছিলেন? প্রত্যৰ স্বাধীনতা যুদ্ধ কারা করেছিলেন?
এসব প্রশ্নের অনেক হাস্যকর উত্তর এখন পাওয়া যাচ্ছে। যেমন, একটি চাকরির ইন্টারভিউয়ের গল্প বললেই আপনারা সেটা বুঝবেন। গল্পটি হচ্ছে এ রকম :

সেনাবাহিনীতে নতুন সেনা নিয়োগ করা হচ্ছে। যুবকদের ইন্টারভিউ নিচ্ছেন জনৈক মেজর। তিনি প্রশ্ন করলেন, বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ তিনজন মুক্তিযোদ্ধা কে ছিলেন?
চাকরি পেতে ব্যগ্র যুবকটি উত্তর দিল : প্রথম জন ছিলেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। দ্বিতীয়জন ছিলেন গণতন্ত্রের মানসকন্যা জননেত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনা এবং স্যার, মাফ করবেন, আপনার নামটা জানি না, তৃতীয় জন ছিলেন আপনিই!

উই রিভোল্ট! আমরা বিদ্রোহ করলাম!
ইতিহাস বিকৃতির ফলটা কি হচ্ছে সেটা আশা করি আপনারা বুঝবেন।
তবে সত্য ইতিহাস লেখায় বিপদ হতে পারে। বিশেষত আজকের মিডিয়ার অধিকাংশ যখন একদলদর্শী বা ৰমতাসীন দলদর্শী। আপনি সত্য ইতিহাস বললে বা লিখলে অভিযুক্ত হতে পারেন, আপনি স্বাধীনতা যুদ্ধ বিরোধী, মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী, সামপ্রদায়িক, অগণতান্ত্রিক, হয়তো বা যুদ্ধাপরাধী! ইত্যাদি ইত্যাদি।
এই ধরনের মাতাল প্রচার এখন এমন পর্যায়ে চলে এসেছে যে, বলা হচ্ছে, জিয়াউর রহমান, যিনি নয় মাস স্বদেশে থেকে মুক্তিযুদ্ধ করেছেন তিনি ছিলেন পাকিসৱানি গুপ্তচর। সেই হিসেবে জিয়া হচ্ছেন নিন্দিত। আর যে নেতা নয় মাস বিদেশে, পাকিসৱানে বন্দি ছিলেন তিনিই হচ্ছেন নন্দিত।
সত্যটা হচ্ছে এই যে, ২৫ মার্চ ১৯৭১-এ রাত একটা থেকে রাত সোয়া দুইটার মধ্যে জিয়াউর রহমান চট্টগ্রাম পোর্ট এরিয়াতে ঘোষণা করেন, উই রিভোল্ট! আমরা বিদ্রোহ করলাম!
এই বিদ্রোহের বিবরণ প্রকাশিত হয় তারই জবানীতে, দৈনিক বাংলায় ২৬ মার্চ ১৯৭২-এর স্বাধীনতা সংখ্যায়। দৈনিক বাংলা ছিল সরকারি পত্রিকা। অর্থাৎ জিয়ার এ লেখাটি ছিল শেখ মুজিবুর রহমানের আওয়ামী লীগ সরকার কর্তৃক অনুমোদিত ও প্রকাশিত। এটাই তাহলে সত্য যে, ২৫ মার্চ রাত একটা থেকে সোয়া দুটোর মধ্যে জিয়া বিদ্রোহ ঘোষণা করে অস্ত্র হাতে তুলে নেন। এরপর আরেক সময়ে আনুষ্ঠানিকভাবে কালুরঘাট ট্রান্সমিটিং স্টেশন থেকে প্রথমে নিজের তরফ থেকে এবং পরে শেখ মুজিবুর রহমানের নাম নিয়ে তার পৰে স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। আমরা ঢাকায় এই ঘোষণা শুনেছিলাম ২৭ মার্চ ১৯৭১-এ।
নিয়তির সেন্স অফ টাইমিং
এখন তরম্নণ প্রজন্ম প্রশ্ন করতে পারে, সেই সময়ে শেখ মুজিবুর রহমান কোথায় ছিলেন?
নিয়তির কি অবাক সেন্স অফ টাইমিং!
জিয়াউর রহমান যখন চট্টগ্রামে ২৫ মার্চ দিবাগত রাত একটা থেকে সোয়া দুটোর মধ্যে স্বাধীনতা সংগ্রামে আত্মনিয়োগ করছিলেন ঠিক সেই সময়ে ঢাকায় শেখ মুজিবুর রহমান পাকিসৱানিদের কাছে আত্মসমর্পণ করছিলেন।
এখানে মনে করিয়ে দিতে পারি গ্যারিবল্ডি, ম্যাজিনি, মাও, ক্যাসট্রো-র মতো বিপস্নবী নেতারা বিপস্নবের সময়ে নিজে উপস্থিত থেকে সংগ্রাম করেছেন।
সে রকম কিছু না করে শেখ মুজিবুর রহমানের আত্মসমর্পণের পেছনে নিশ্চয়ই তার নিজস্ব জোরালো যুক্তি ছিল। আজ আমি সেই প্রসঙ্গে যাবো না। তবে এটুকু বলতে পারি, ৭ মার্চে তার ভাষণে অনুপ্রাণিত হয়ে জিয়াও মুক্তিযুদ্ধ শুরম্ন করেছিলেন। ঠিক তেমনি আমিও ’৭১-এ মুক্তি আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলাম। কিন্তু ১৯৭১-এ মুক্তিযুদ্ধে জিয়ার বীরত্ব এবং আগস্ট ১৯৭৫-এর পরে দেশ পুনর্গঠনে জিয়ার সবল নেতৃত্বের ইতিহাস যখন অনুচ্চারিত থাকে তখন সচেতন ব্যক্তি ও লেখকের ওপর দায়িত্ব বর্তায় সত্য ইতিহাসটা তুলে ধরার।
বলতেই হবে, ইতিহাস লেখার সময়ে আমি ভাবিনি প্রকাশিত বইগুলোও আওয়ামী লীগ সরকারের স্বৈরাচারের ইতিহাসের একটি অংশ হবে।
যে সাতটি বইয়ের মোড়ক উন্মোচিত হলো তার মধ্যে চারটি বইয়ে রাষ্ট্রপতি জিয়া এবং ম্যাডাম খালেদা জিয়ার বিভিন্ন গঠনমূলক অবদানের সংৰিপ্ত টাইমলাইন তুলে ধরা হয়েছে।
রাষ্ট্রনায়ক জিয়াউর রহমান বইয়ে তার একটি আত্মকথন প্রকাশিত হয়েছে। তার জীবনের বিভিন্ন দিক বিষয়ে এ বইয়ের লেখকরা অনেক অজানা ইন্টারেস্টিং তথ্য জানিয়েয়েছেন। সব লেখককে জানাচ্ছি ধন্যবাদ।

বই কিনুন বই পড়ুন
কেউ কেউ বলেন, মাগনা পেলে বাঙালি বিষ খেতে রাজি হয়। এটা একটা অপবাদ। এই অপবাদ মিথ্যা প্রমাণ করার দায়িত্ব আপনাদের। বিশেষত বিএনপি নেতাদের। আপনাদের নিশ্চয়ই মনে আছে, ম্যাডাম জিয়ার প্রধানমন্ত্রিত্বের সময়ে তিনি একটা সেস্নাগান দিয়েছিলেন, প্রিয়জনকে বই উপহার দিন। তার সেই সুন্দর সেস্নাগানটি একটু পরিবর্ধিত করে আজ আমি বলতে চাই, বই কিনে প্রিয়জনকে বই উপহার দিন। বিএনপি নেতাদের অনুরোধ করতে চাই, বই কিনে আপনারা কর্মী, সমর্থক ও ভোটারদের উপহার দিন। না হলে প্রতিপৰের শক্তিশালী সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের মোকাবেলা আপনারা কিছুতেই করতে পারবেন না।
এসব কথা বলার আরেকটি কারণ হচ্ছে, আমাদের সামর্থ খুবই সীমিত। বিনামূল্যে বা মাগনা বই দেয়া আমাদের পৰে সম্ভব নয়। সরি ফোকস। আমরা মি. দুররানির অনুগ্রহে আইএসআই বা পাকিসৱান থেকে টাকা পাইনি। আর ইনডিয়ান ‘র’ যে আমাদের টাকা দেবে না সেটা বলা বাহুল্য।
এসব বই পড়া নেতা, কর্মী-সমর্থকদের জন্য অত্যনৱ জরম্নরি। আগেই আমি বলেছি, জিয়াউর রহমানের বিরম্নদ্ধে অপপ্রচার সভ্যতার মাত্রা ছাড়িয়ে গিয়েছে। তিনি প্রয়াত। তিনি তো আর কিছু বলতে পারবেন না। সে কাজটি আপনাদেরই করতে হবে। কারণ এখন ম্যাডাম খালেদা জিয়ার বিরম্নদ্ধেও অপ্রপ্রচার শুরম্ন হয়ে গিয়েছে। তিনি জীবিত থাকতেই! একেই বোধহয় হয় বলে, অসভ্যতার অগ্রগতি।

যেতে পারেন ইনডিয়া অথবা আমেরিকা
বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ও তার সৱাবকরা একাধিকবার বলেছেন, আইএসআই থেকে ১৯৯১-এ বিএনপি টাকা নিয়েছিল। তিনি অবশ্য ভুলে গিয়েছেন, মাত্র তিন বছর আগের নির্বাচনে তার পার্টি ব্যাগফুল অফ মানি ইনডিয়া থেকে যে পেয়েছিল সে বিষয়ে দি ইকনমিস্ট রিপোর্ট করেছিল। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী উপদেশ দিয়েছেন, বিরোধী নেত্রী খালেদা যেন পাকিসৱান চলে যান। খালেদা পাকিসৱান যাবেন কেন? তিনি তো আগেই বলেছেন, বাংলাদেশই তার একমাত্র ঠিকানা। বরং আমি প্রধানমন্ত্রীকে অনুরোধ করবো তিনি যেন ইনডিয়া অথবা আমেরিকায় চলে যান। ওই দুই দেশে দীর্ঘকাল থাকার অভ্যাস তার আছে।
প্রসঙ্গত. এশিয়ান কৃকেট কাপে সাম্প্রতিক ফাইনালে বাংলাদেশ-পাকিসৱানের ম্যাচে বিরোধী নেত্রীর উপস্থিতি নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর একাধিকবার অশালীন মনৱব্যের বিষয়টি বলতে চাই। তিনি বলতে চেয়েছেন, ম্যাডাম জিয়া স্টেডিয়ামে গিয়েছিলেন পাকিসৱান টিমকে সমর্থন করতে। এ তথ্যটি প্রমাণ করার জন্য প্রধানমন্ত্রী তার কাজের বুয়ার রেফারেন্সও দিয়েছেন।
প্রধানমন্ত্রীর স্ট্যান্ডার্ড যে আরো নিচে নেমে গিয়েছে সেটা আমি বলতে চাই না। সম্প্রতি বিএনপির সেক্রেটারি জেনারেল মির্জা ফখরম্নল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, তিনি একজন চপলমতি বালিকা। যা মনে আসে তাই বলে ফেলেন।
হয়তো তিনি তাই। আমি এখানে একটু যোগ করবো। দেশের বালক-বালিকাদের ইতিহাস পড়তে বলবো। ইতিহাস পড়লেই জানা যাবে ১৯৪৭ সালে এই প্রধানমন্ত্রীর পিতা পাকিসৱান আন্দোলনের একজন অগ্রণী কর্মী ছিলেন এবং ১৯৭১-এ তিনি পাকিসৱানেই চলে গিয়েছিলেন।
আবার ১৯৭২-এ স্বাধীন বাংলাদেশে ফিরে এসে পাকিসৱানের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তোলায় মনোযোগী হয়েছিলেন। এ কারণে তিনি তার পরম শত্রম্ন জুলফিকার আলি ভুট্টোকে ৰমা করে দিয়ে বাংলাদেশে সফরের আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন এবং ১৯৭৪-এ ভুট্টো এখানে এসেছিলেন।
এটি ছিল শেখ মুজিবুর রহমানের দূরদৃষ্টি সম্পন্ন পররাষ্ট্রনীতি যেটা পরবর্তীকালে জিয়াউর রহমান এবং খালেদা জিয়াও অনুসরণ করেন। এখানে মনে করিয়ে দিতে পারি যে, ভিয়েতনাম দশটি বছর আমেরিকার বিরম্নদ্ধে লড়েছিল। তারা এখন আমেরিকার সঙ্গে গভীর বন্ধু সম্পর্ক রেখে চলেছে। যে জাপানের বিরম্নদ্ধে মহাযুদ্ধে আমেরিকা লড়েছিল সেই জাপান এখন আমেরিকার সবচেয়ে বড় বন্ধু রাষ্ট্রের একটি।
বস্তুত বর্তমান প্রধানমন্ত্রী যদি সেই রকম দূরদর্শী হতেন তাহলে বাংলাদেশ-পাকিসৱান ফাইনাল ম্যাচের দিনে পাকিসৱানের প্রধানমন্ত্রী মি. গিলানিকে ঢাকায় এসে পাশাপাশি বসে খেলা দেখার আমন্ত্রণ জানাতে পারতেন। যেমনটা ভারত-পাকিসৱানের একটি ফাইনাল ম্যাচ পাশাপাশি বসে দেখেছিলেন মনমোহন সিং ও গিলানি। কিন্তু প্রতিহিংসা প্রতিশোধের হামলা-মামলার রাজনীতি যার অবলম্বন তার কাছে থেকে এ রকম সৌজন্যতা আশা করা অসম্ভব।
এরশাদের প্রশ্নের উত্তর :মুগুর
এখানে আমি প্রধানমন্ত্রীর দীর্ঘকালের বিশ্বসৱ ও অনৱরঙ্গ সহযাত্রী জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের একটি প্রশ্নের উত্তর দিতে চাই। সম্প্রতি জেনারেল এরশাদ পার্লামেন্টে মনে করিয়ে দিয়েছেন, ১৯৮৬-তে আমার সম্পাদিত সাপ্তাহিক যায়যায়দিন-এ সংসদের তৎকালীন নারী সদস্যদের টাইটেল দিয়েছিলাম সংসদের শোভা ত্রিশসেট অলংকার।
তারপর তিনি প্রশ্ন রাখেন, এখন আমি সংসদের নারী সদস্যদের কি টাইটেল দেবো? প্রশ্নটি তিনি করেন বিএনপির দুই নারী সদস্য রেহানা আখতার রানু ও সৈয়দা আসিফা আশরাফি পাপিয়া সম্প্রতি সংসদের প্রধানমন্ত্রীর যে সমালোচনা করেছেন সেই পরিপ্রেৰিতে।
জেনারেল এরশাদ অবশ্য সেদিন বলেননি ওই টাইটেল দেয়ার জন্য আমাকে ছয় বছর নির্বাসনে তিনি পাঠিয়ে দিয়েছিলেন।
সে যাই হোক। আমি পুলকিত হয়েছি জেনে যে, জেনারেল এরশাদের দুটি গুণ, এক. তার ভাষা শালীন আছে এবং দুই. নারীদের প্রতি তার নজর এখনো প্রখর। তিনি জানতে চেয়েছেন, এখন সংসদের নারী সদস্যদের টাইটেল কি হবে? উত্তরটা হচ্ছে, বিএনপির সাত নারী সদস্য হচ্ছেন বাঘা তেতুল অথবা মুগুর। আর বাকি সব নারী সদস্যদের টাইটেল দেয়া থেকে বিরত থাকলাম। কারণ ১৯৮৬-তে ওই টাইটেল দেয়ার জন্য আমার বিরম্নদ্ধে তিন কোটি টাকার মানহানির মামলা করা হয়েছিল। সেই ঘটনার পুনরাবৃত্তি আমি এখন চাই না।
কিন্তু সাতজনকে মুগুর টাইটেল কেন দিচ্ছি?
বাংলা ভাষায় দুটি বচন আছে, বুনো ওল বাঘা তেতুল এবং যেমন কুকুর তেমন মুগুর।

সম্প্রতি সংসদের বিএনপি দুই এমপি রেহানা আক্তার রানু এবং সৈয়দা আশরাফি পাপিয়া কিছু সময়ের জন্য মুগুর চালিয়েছেন। এতেই সরকারি দল বিচলিত হয়েছে। তাদের এই সন্ত্রসৱ প্রতিক্রিয়া প্রমাণ করে দিয়েছে রানু ও পাপিয়ার মুগুর চালানোর প্রয়োজন ছিল।
তারপরও সেদিকে আমরা কাউকে যেতে বলবো না। আমরা এটাই বলবো, রাজনীতিতে শালীনভাবে কথা বলুন এবং ভদ্র ভাষায় সত্যটা লিখুন। ঠিক এ বইগুলোর মতোই। এ বইগুলোর উত্তর বইতেই অর্থাৎ শালীন লেখাতেই দেয়া হবে বলে আমি আশা করি। কাউকে চ্যাংদোলা করার, কোলে তোলার অথবা থুথু চেটে খাওয়ার উপদেশ দেবেন না। কাজের বুয়ার রেফারেন্স টেনে পাকিসৱানে চলে যেতে বলবেন না।
যে সাতটি বই প্রকাশ হলো তার মধ্যে দুটি ইংরেজি এবং পাচটি বাংলায়। ইংরেজি বই দুটির নাম হচ্ছে Statesman Ziaur Rahman এবং Democratic Leader Khaleda Zia. বাংলা বই পাচটির নাম রাষ্ট্রনায়ক জিয়া, সংগ্রামী নেত্রী খালেদা জিয়া, চট্টগ্রাম পোলো গ্রাউন্ড লুণ্ঠন, নেড়ি কুকুরের কান্ড ও নেড়িকুকুরের কীর্তি।

ও হ্যা। রাষ্ট্রনায়ক জিয়াউর রহমান নামে একটি বই লিখেছি খবরটি প্রকাশিত হবার পর গত ৪ এপৃল থেকে সারা ঢাকা শহরে আওয়ামী লীগ ব্যানার ছেড়েছে যেখানে তাদের নেত্রীর নতুন বিশেষণ হয়েছে রাষ্ট্রনায়ক। লেখা হয়েছে রাষ্ট্রনায়ক হাসিনা। স্বাধীনতার ঘোষক বিশেষণটি যেমন হা্‌ইজ্যাক হয়েছে, ঠিক তেমনি রাষ্ট্রনায়ক বিশেষণটিও হাইজ্যাক হয়ে গেলো।
এই বইগুলো প্রকাশের পেছনে যারা কাজ করেছেন তাদের আনৱরিক ধন্যবাদ জানাই। এই বইগুলো প্রকাশনা উৎসবের আয়োজন যারা করেছেন সেই গ্রম্নপ ২০০৯ তথা জি-নাইনের সদস্যদের জানাই অশেষ কৃতজ্ঞতা। ম্যাডামকেও ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা। অনুষ্ঠানে এসে মোড়ক উন্মোচন করার জন্য।

নিরপেৰ থাকা অনৈতিক
কেউ কেউ আমাকে সমালোচনা করতে পারেন। আমি একটি বিশেষ দলের বা বিশেষ ব্যক্তির পৰে লিখেছি। অর্থাৎ আমি পৰপাতিত্ব করছি। অন্যভাবে তারা বলতে পারেন, আমি নিরপেৰ নই।
এই সমালোচনার উত্তরে ম্যাডাম খালেদা জিয়ারই একটি বানী আমি আপনাদের মনে করিয়ে দিতে চাই। তিনি বলেছিলেন, পাগল ও শিশু ছাড়া কেউ নিরপেৰ নয়।
তার সেই কথা আমি একটু সমপ্রসারিত করে আজ বলতে চাই, পাগল, শিশু ও সুবিধাবাদী ছাড়া কেউ নিরপেৰ নয়। আমি সমালোচিত হতে পারি জেনেও সত্য প্রতিষ্ঠার জন্য বিবেকের তাড়নায় এই বইগুলো লিখেছি। আমি মুক্তিযুদ্ধের সময়ে নিরপেৰ ছিলাম না। মুক্তির পৰে অবস্থান নিয়েছিলাম। আমি স্বৈরশাসক এরশাদের সময়ে নিরপেৰ ছিলাম না। আমি গণতন্ত্রের পৰে অবস্থান নিয়েছিলাম।
জার্মান কবি দানেৱ বলেছিলেন,

The hottest places in hell are reserved for those who, in a time of great moral crisis maintain their neutrality.

অর্থাৎ খুব বড় নৈতিক সংকটের সময়ে যারা তাদের নিরপেৰতা বজায় রাখেন তাদের জন্য নরকের সবচেয়ে বেশি গরম জায়গা রিজার্ভ করা আছে।
দানেৱর এই অমর বাণী পুনঃউচ্চারণ করেছিলেন আমেরিকান প্রেসিডেন্ট জন কেনেডি। আজ আমিও সেই আপ্তবাক্যটি পুনঃউচ্চারণ করলাম। প্রাবন্ধিক বদরম্নদ্দীন উমর-এর উদ্ধৃতি দিয়ে বলতে হয়, বাংলাদেশে এখন উম্মাদ ও বিকারগ্রসৱ শাসকের সময় চলছে।
এই সংকটের সময়ে নৈতিক বোধ সম্পন্ন কোনো ব্যক্তির পৰে নিরপেৰ থাকা সম্ভব নয়। যেমনটা সম্ভব ছিল না মুক্তিযুদ্ধ ও গণতন্ত্র যুদ্ধের সময়ে।
৭ এপৃল ২০১২

শুক্রবার, ২৭ জানুয়ারী, ২০১২


এয়ারপোর্ট, ঢাকা।
কাল : সকাল এগারোটা, ৬ জানুয়ারি ২০১০।
পাত্র : লন্ডন থেকে আগত একজন স্মার্ট, ইয়াং বাঙালি যাত্রী। পরনে নেভি ব্লু সুট, ডিপ ব্লু শার্ট, ব্রাইট রেড টাই। এয়ারপোর্টে নিযুক্ত মধ্যবয়সী ইমিগ্রেশন অফিসার, পরনে ইউনিফর্ম ও ব্যাজ। এবং একজন ড্রাইভার।
ইমিগ্রেশন অফিসার : আপনার পাসপোর্ট ঠিক আছে। ল্যান্ডিং ফর্ম, সোয়াইন ফ্লু ফর্ম এবং ব্যাগেজ ডিক্লারেশন ফর্মও ঠিক আছে। কিন্তু আপনার কন্সপিরেসি ডিক্লারেশন ফর্ম কই? ওই ফর্মটা কি আপনি ফিল আপ করেননি? প্লেন ল্যান্ড করার আগে ওই ফর্ম কি আপনাকে দেয়া হয়নি?
যাত্রী : হ্যা। দেয়া হয়েছিল।
অফিসার : তাহলে ফর্মটা ফিল আপ করেননি কেন?
যাত্রী : আমি ভেবেছিলাম এমিরেটস এয়ারলাইন একটা জোক করছে। তাই।
অফিসার (ভ্রূ কুচকে) : জোক?
যাত্রী : দেখুন, কোনো কন্সপিরেসি বা ষড়যন্ত্র করার সময় আমার নেই। আমি একজন বিজনেসম্যান। সারা বছর জুড়ে বিজনেস টৃপ দিই। বিভিন্ন দেশে যাই। কোথাও কন্সপিরেসি ফর্মের নাম শুনিনি। ফিল আপ তো দূরের কথা। তাই ওই ফর্মটা হাতে পেয়ে ভেবেছিলাম ওটা একটা জোক। আমি ওটাকে সিরিয়াসলি নিই নি।
অফিসার : কন্সপিরেসি একটা সিরিয়াস ম্যাটার। ভেরি সিরিয়াস ম্যাটার। ভেরি ভেরি সিরিয়াস ম্যাটার। বিশেষত বাংলাদেশে। আপনি কি সেটা জানেন না?
যাত্রী : কিছু কন্সপিরেসি সিরিয়াস ম্যাটার হতে পারে। কিন্তু সব ষড়যন্ত্রই কি সিরিয়াস হতে পারে? যেমন ধরুন, আমি যদি আমার ব্যাংকের চোখে ধুলা দিতে চাই? আমার পার্টনারকে পথে বসাতে চাই?
অফিসার : না, না। আমি বিজনেসের কথা বলছি না। আমি বলছি রাষ্ট্রবিরোধী কন্সপিরেসির কথা। সরকার বিরোধী চক্রান্তের কথা। এই ধরনের কন্সপিরেসি খুবই সিরিয়াস ম্যাটার হতে পারে। ১৯৬৯-এ আগরতলা ষড়যন্ত্র, ১৯৭৫-এর রাজনৈতিক হত্যাকান্ডের কন্সপিরেসি, ১৯৭৭-এ এই ঢাকা এয়ারপোর্টেই বাংলাদেশ এয়ার ফোর্সের কন্সপিরেসি, ১৯৮১-তে চিটাগংয়ে সার্কিট হাউজে হত্যাকান্ডের ষড়যন্ত্র, ১৯৮২-তে জেনারেল এরশাদের ক্ষমতা দখলের চক্রান্ত, এসব নিশ্চয়ই আপনি জানেন। তারপর যশোরে উদীচির সভায় বোমা, রমনার বটমূলে বোমা, কোটালিপাড়ায় হামলার প্ল্যান, চিটাগংয়ে বহির্নোঙ্গরে অস্ত্র খালাস, ঢাকায় শেখ হাসিনার জনসভায় গ্রেনেড হামলা, সারা দেশ জুড়ে চারশ স্থানে একই দিনে প্রায় একই সময়ে এক যোগে বোমা বিস্ফোরণ এবং গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে ঢাকায় পিলখানায় বিডিআর বিদ্রোহ – এসবই তো গভীর ষড়যন্ত্রের ফল। এসব কি আপনি জানেন না?
যাত্রী : জানি। এসব তো ইতিহাস। নতুন কোনো ষড়যন্ত্রের আভাস কি আপনারা পেয়েছেন যেজন্য সব আগত যাত্রীদের একটা ফর্ম ফিল আপ করতে বলছেন?
অফিসার : সরকার সতর্কতামূলক অগ্রিম ব্যবস্থা নিয়েছে। আমরা সেটা পালন করছি। বর্তমান সরকারের ক্ষমতায় থাকার প্রথম বছর পূর্তি হচ্ছে আজ। দ্বিতীয় ডিজিটাল বছর নামে আজকের দিনটি দেশ জুড়ে পালিত হচ্ছে। এই দিনটিকে পন্ড করার জন্য সরকার বিরোধীরা নাশকতামূলক কাজ করতে পারে। চারদিকে তাকিয়ে দেখুন কতো একস্ট্রা সিকিউরিটি ফোর্স মোতায়েন করা হয়েছে। সারা দেশে এখন একটা স্টেট অফ এলার্টনেস চলছে।
যাত্রী (চারিদিকে তাকিয়ে) : হ্যা। দেখছি। আনসার, পুলিশ, র‌্যাব-এর সব লোকজন! ওদের অনেকের হাতে অস্ত্র। প্যাসেঞ্জারের চাইতে সিকিউরিটির লোকের সংখ্যাই বেশি মনে হচ্ছে।
অফিসার : সরকার আর আমরা সবাই খুব টেনশনে আছি। কখন যে কোথায় কি ঘটে যায়!
যাত্রী : এভাবে তো আপনারা চক্রান্তকারীদের দমাতে পারবেন না। যারা চক্রান্ত করবে তারা তো প্ল্যান করেই করবে যাতে কেউ জানতে না পারে। তারা কি কেউ জানিয়ে চক্রান্ত করবে?

অফিসার : সেজন্যই তো চক্রান্তকারীদের একটা সুযোগ সরকার দিয়েছে ডিক্লেয়ার করার জন্য। সেজন্যই তো কন্সপিরেসি ডিক্লারেশন ফর্ম চালু করা হয়েছে। এই নিন একটা ফর্ম। চটপট ফিল আপ করে দিন।
যাত্রী (ফর্মটা হাতে নিয়ে ফর্মের দিকে দ্রুত চোখ বুলিয়ে) ; এখানে প্রশ্ন করা হয়েছে, আমার সঙ্গে কটা হাত বোমা, কটা গ্রেনেড, কটা মলোটভ ককটেল, কটা রিভলভার, ইত্যাদি আছে। এসব প্রশ্নের উত্তরে কেউ কি “হ্যা” লিখবে?

অফিসার : লিখতেও পারে। যারা নার্ভাস টাইপের চক্রান্তকারী তারা সব লিখে দিয়ে এখানেই সারেন্ডার করতে পারে।
যাত্রী : আর যারা দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ টাইপের চক্রান্তকারী, তারা?
অফিসার : তারা “না” লিখে বেরিয়ে যাবার চেষ্টা করবে। কিন্তু তারা ধরা পড়বে রেড চ্যানেলে অথবা গ্রীন চ্যানেলে। সকল যাত্রীকে উভয় চ্যানেলেই বডি সার্চ, লাগেজ সার্চ করা হচ্ছে।
যাত্রী : কিন্তু কন্সপিরেসি তো চিন্তা প্রসূত বিষয়। চিন্তার মধ্যেও তো চক্রান্ত থাকতে পারে। সেটা আপনারা চেক করবেন কি করে?
অফিসার (মৃদু হেসে) : সেটা চেক করার যন্ত্রও সরকার এয়ারপোর্টে বসিয়েছে। এক ধরনের লেটেস্ট সিটিস্ক্যানিং মেশিনে প্রতিটি যাত্রীর ব্রেইন স্ক্যান করা হচ্ছে। মেইড ইন ইসরেল। ইমপোর্টেড ভায়া ইনডিয়া। সব চক্রান্তই এই মেশিনে ধরা পড়ে যাবে।
যাত্রী : মনে হয় না। আই অ্যাম নট সো শিওর। চক্রান্ত বন্ধ করতে হলে অন্য কিছু করতে হবে।
অফিসার : কি করতে হবে?

যাত্রী : দেশে সন্দেহ এবং সাংঘর্ষিক রাজনীতি অনুসরণ না করে, সম্প্রীতি এবং সহঅবস্থানের রাজনীতি চালু করতে হবে। রিমান্ড, টর্চার ও মামলার রাজত্ব কায়েম না করে, কর্মসংস্থান, ন্যায্যমূল্য ও আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতিমূলক শাসন চালু করতে হবে। জনসাধারণের মনে বিরক্তি, ক্ষোভ ও ক্রোধ পুঞ্জিভূত হতে থাকলে, চক্রান্ত হতেই থাকবে। দয়া করে এই সহজ সত্যটা বোঝার চেষ্টা করুন। বিডিআরের ঘটনা কিন্তু সেই লেসনটাই সবাইকে দিয়েছিল। (ফর্মটা ফিরিয়ে দিয়ে) এই নিন আপনার ফর্ম। এটা আমি ফিল আপ করবো না।
অফিসার (কঠিন মুখে) : আপনার সমস্যা হবে।
যাত্রী : হতে পারে। আই ডোন্ট কেয়ার। দেখুন, যে কোনো দেশের প্রেসিডেন্ট, প্রাইম মিনিস্টারের প্রাণের ঝুকি সবসময়ই থাকে। ক্ষমতার আনন্দ ভোগের পাশাপাশি বিপদের সম্ভাবনা থাকে জেনেই পলিটিশিয়ানরা রাজনীতিতে আসেন। কিন্তু তার জন্য সাধারণ মানুষকে এত ভোগান্তির মধ্যে পড়তে হবে কেন? আমি ফর্ম ফিল আপ করবো না।
অফিসার : কন্সপিরেসি ডিক্লারেশন ফর্ম ফিল আপ করার শেষ সুযোগ আপনাকে দিচ্ছি।
যাত্রী : আইরিশ নাট্যকার অস্কার ওয়াইন্ড যখন নিউ ইয়র্কে গিয়েছিলেন, তখন তাকে এক কাস্টমস অফিসার প্রশ্ন করেছিলেন, হ্যাভ ইউ এনিথিং টু ডিক্লেয়ার? অস্কার ওয়াইন্ড উত্তরে বলেছিলেন, আই হ্যাভ নাথিং টু ডিক্লেয়ার একসেপটিং মাই জিনিয়াস (I have nothing to declare execpting my genius)। অস্কার ওয়াইন্ডের মতো জিনিয়াস আমার নেই। তাই আমি বলবো না, আমার জিনিয়াস ছাড়া আর কিছুই ডিক্লেয়ার করার নেই। তবে হ্যা, একটা জিনিস আমি ডিক্লেয়ার করতে চাই।
অফিসার : সেটা কি?
যাত্রী : (জ্যাকেটের পকেট থেকে একটা কালো চকচকে মোবাইল ফোন বের করে) : এটা। এটা অ্যাপলের লেটেস্ট আইফোন।
অফিসার (খুব কৌতূহলী হয়ে) : বাঃ। চমৎকার দেখতে তো! খুব বড় স্কৃন তো!
যাত্রী : এই মোবাইলে ফোন করা, ফটো তোলা, ভিডিও করা, ইমেইল করা, ইন্টারনেটে যাওয়া, সবকিছু সম্ভব। ইন্টারনেটে একটা পর্নো দেখবেন?
অফিসার (চারদিকে তাকিয়ে)। হ্যা। দেখবো। খুব তাড়াতাড়ি দেখান। কেউ যেন সন্দেহ না করে।
যাত্রী : নিশ্চয়ই।
এ কথা বলার পর যাত্রী কয়েকটা নাম্বার টিপে আই ফোনটা মুখের কাছে নিয়ে এসে বললেন, হ্যালো।  তুমি এখন একশনে যেতে পারো। রেডি, স্টেডি, গো।
সঙ্গে সঙ্গে বাইরে এক প্রচণ্ড বিস্ফোরণের শব্দ হলো।
এয়ারপোর্ট ভবনটা কেপে উঠলো।
কয়েকটা কাচের দেয়াল ভেঙে পড়লো।
অফিসার দৌড়ে পালালেন।
এয়ারপোর্ট ভবনের মধ্যে টহলরত আনসার, পুলিশ, র‌্যাব সবাই আতঙ্কিত হয়ে রাইফেল ফেলে ছোটাছুটি শুরু করলো। কেউ কেউ ফ্লোরে শুয়ে পড়লো।
অন্যান্য যাত্রী এবং সিভিল এভিয়েশন স্টাফরা আতংকে দিগবিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে পালাতে থাকলো।
সবাই নিরাপদ জায়গা খুজছিল।
কয়েকটা সিকিউরিটি এলার্ম বেল বিদঘুটে শব্দে বাজা শুরু করলো।
যাত্রী তার আইফোনটা পকেটে পুরে গটগট করে হেটে এয়ারপোর্ট ভবনের বাইরে এসে দাড়ালেন।
বাইরে সবাই আরো বেশি সন্ত্রস্ত হয়ে ছোটাছুটি করছিল।
কয়েকটা ভীত কাক ইলেকটৃক তারের ওপর জড়ো হয়ে কর্কশ স্বরে কা-কা করছিল।
একটা পাজেরো এসে যাত্রীর সামনে থামলো।
ড্রাইভার (পাজেরোর দরজা খুলে দিয়ে) : গুড মর্নিং স্যার।
যাত্রী : (গাড়িতে উঠে দরজা বন্ধ করে দিয়ে) সব কিছুই প্ল্যান মোতাবেক হলো দেখছি একসেলেন্ট। এ গুড জব হ্যাজ বিন ডান।
ড্রাইভার : হ্যা। সব কিছুই প্ল্যান মোতাবেক হয়েছে। (রিমোট কনট্রোলটা দেখিয়ে) তবে গ্যাস সিলিন্ডারটা বড় সাইজের কিনতে হয়েছিল। বেশি শব্দের জন্য। দামটা একটু বেশি পড়ে গিয়েছে।
যাত্রী : নেভার মাইন্ড। আমার আইফোনটা নিয়ে আমি বেরিয়ে আসতে পেরেছি। (পকেট থেকে আবার আইফোনটা বের করে পরম যত্নের সঙ্গে হাত বুলিয়ে) এখানেই সব সিক্রেট নাম্বারগুলো আছে!
২২ নভেম্বর ২০০৯

নাম রক্ষা করার সহজ উপায়


স্থান: লন্ডন
কাল: জুলাই ২০১০
চরিত্র: লন্ডন সফরকারী বাংলাদেশি বিজনেসম্যান আদিল, বৃটিশ ইমিগ্রেশন অফিসার জোনস, ট্যাক্সি ড্রাইভার টম, রানী এলিজাবেথের প্রাইভেট সেক্রেটারি ও রানী এলিজাবেথ।

দৃশ্য ১
এয়ারপোর্ট ইমিগ্রেশন কাউন্টার
বিজনেসম্যান আদিল (চিন্তিত চেহারায় পাসপোর্ট বাড়িয়ে দিয়ে): আচ্ছা, আমি কি সঠিক এয়ারপোর্টে এসেছি? চারদিকে নাম দেখছি সেইন্ট জর্জ (St. George) এয়ারপোর্ট। বিজ্ঞাপন দেখছি, ওয়েলকাম টু সেইন্ট জর্জ এয়ারপোর্ট, টেক এ ফাস্ট ট্রেন ফ্রম সেইন্ট জর্জ এয়ারপোর্ট টু সিটি সেন্টার, গেট ফর্টি পার্সেন্ট ডিসকাউন্ট অন ডিউটি ফ্রি গুডস অ্যাট সেইন্ট জর্জ এয়ারপোর্ট। এটা কি লন্ডনের হিথরো এয়ারপোর্ট নয়?
ইমিগ্রেশন অফিসার জোনস (পাসপোর্ট নিয়ে পাতা ওলটাতে ওলটাতে): স্যার, আপনি সঠিক এয়ারপোর্টেই ল্যান্ড করেছেন। এটাই হিথরো এয়ারপোর্ট। বৃটেনের সবচেয়ে বড় এয়ারপোর্ট তো বটেই — তাছাড়া বিশ্বের সবচেয়ে ব্যস্ত আন্তর্জাতিক এয়ারপোর্টও এটি। এই এয়ারপোর্ট দিয়ে বছরে প্রায় সাত কোটি প্যাসেঞ্জার এবং তের লাখ টন কার্গো চলাচল করে। লন্ডনের পশ্চিম দিকে ১৯৪৬-এ একটা তাবু খাটিয়ে এই এয়ারপোর্টের সূচনা হয়েছিল। এখন এই এয়ারপোর্টের চারটি টার্মিনাল ভবন আছে। টার্মিনাল ফাইভের উদ্বোধন হবে আগামী বছরে। আপনি এসেছেন টার্মিনাল থ্রিতে।
আদিল: তাহলে এখানে হিথরো এয়ারপোর্ট কোথাও লেখা নেই কেন? আগে তো ল্যান্ড করে সর্বত্রই দেখতাম, ওয়েলকাম টু হিথরো, সাইন। এখন সবখানেই দেখছি সেইন্ট জর্জ এয়ারপোর্ট সাইন! ব্যাপার কী?
জোনস: গত মাসে ইলেকশনে টোরি পার্টি বিরাট মেজরিটি নিয়ে জেতার পর নতুন প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন দলীয় নেতা ডেভিড ক্যামেরন। তারই অর্ডারে হিথরো এয়ারপোর্টের নাম বদলে গেছে। নতুন নাম হয়েছে সেইন্ট জর্জ এয়ারপোর্ট।
আদিল: সেইন্ট জর্জ? সেইন্ট জর্জ কে?
জোনস: সেইন্ট জর্জ হচ্ছেন ইংল্যান্ডের পেট্রন সেইন্ট। তার প্রতীক হচ্ছে একটি শাদা পটভূমিকায় একটি লাল ক্রস। এটাই ইংল্যান্ডের ফ্ল্যাগ এবং বৃটিশ ফ্ল্যাগেরও অংশ। ইউনিয়ন জ্যাক নামে যে বৃটিশ ফ্ল্যাগ আছে, সেটা মনোযোগ দিয়ে দেখুন। দেখবেন সেখানে একটি লাল ক্রস আছে। কথিত আছে, দ্বাদশ শতাব্দীতে ইংল্যান্ডের রাজা রিচার্ড দি লায়নহার্ট, যিনি ক্রুসেডের জন্য বিখ্যাত হয়েছিলেন, তিনি সেইন্ট জর্জের নামে লড়াই করতেন এবং পরবর্তী সময়ে তার নাম ইংল্যান্ডে প্রতিষ্ঠা করেন। এখন দেশের গভীর বিপদের সময়ে ইংল্যান্ডবাসীরা সেইন্ট জর্জের সাহায্য প্রার্থনা করে। কথিত আছে, সেইন্ট জর্জ ঘোড়ার পিঠে চড়ে, একটি লাল ক্রস আকা ঢাল নিয়ে, এক হিংস্র ড্রাগনের বিরুদ্ধে লড়াই করে বিজয়ী হয়েছিলেন। আসল সেইন্ট জর্জ ছিলেন একজন রোমান সৈন্য। ক্রিশ্চিয়ানদের যখন রোমানরা টর্চার করতো তখন সেইন্ট জর্জ তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন এবং তার ফলে তাকে মৃত্যুবরণ করতে হয়েছিল। আসল সেইন্ট জর্জ কখনোই কোনো ড্রাগনের বিরুদ্ধে লড়াই করেননি। সম্ভবত তিনি কখনো ইংল্যান্ডেও যাননি। তবু তিনি ইংল্যান্ডে নাম্বার ওয়ান পুণ্য ব্যক্তি রূপে গণ্য হন। তারই নামে এখন টোরি পার্টি হিথরোর নাম দিয়েছে সেইন্ট জর্জ এয়ারপোর্ট।
আদিল (বিস্মিত মুখে): হঠাৎ এ নাম বদল কেন হলো?
জোনস : জানি না স্যার। তবে মনে হয়, ইংল্যান্ডে বর্তমানে যে গভীর অর্থনৈতিক মন্দাবস্থা চলছে, সেটা থেকে উদ্ধার পাওয়ার আশায় নতুন প্রাইম মিনিস্টার ক্যামেরন এই সিদ্ধান্তটা নিয়েছেন। (গলার স্বর নামিয়ে) বিটউইন ইউ অ্যান্ড মি স্যার, এয়ারপোর্টের এই নাম বদলানোটা, আমরা, এয়ারপোর্টের কোনো স্টাফই পছন্দ করিনি। চৌষট্টি বছর ধরে এই এয়ারপোর্টকে আমরা হিথরো নামেই জানি। হঠাৎ বলা নেই কওয়া নেই, ডেভিড ক্যামেরন প্রাইম মিনিস্টার হয়েই নাম বদলে ফেলার আদেশ দিলেন। ইলেকশনের আগে টোরি পার্টি তাদের ম্যানিফেস্টোতেও বলেনি যে হিথরো এয়ারপোর্টের নাম তারা বদলে ফেলবে। ভেরি স্যাড স্যার, ভেরি স্যাড। জানি না গভর্নমেন্ট কোন দিকে যাচ্ছে। নাম বদলানোর চাইতে অনেক বেশি দরকার এই এয়ারপোর্টের ফ্যাসিলিটিগুলো সিঙ্গাপুর, ব্যাংকক, কুয়ালা লামপুর এয়ারপোর্টের মতো আরো উন্নত করা। তাতে যাত্রীরা উপকৃত হতো। (পাসপোর্টে সিল মেরে দিয়ে) হিয়ার ইউ আর স্যার। এনজয় ইয়োর ট্রিপ টু লন্ডন।
আদিল (পাসপোর্ট নিয়ে): থ্যাংক ইউ অফিসার।
দৃশ্য ২
এয়ারপোর্ট থেকে ট্যাক্সিতে সিটি সেন্টারে যাবার পথে।
আদিল: এটা ওয়েম্বলি স্টেডিয়াম না? এখানেই তো ১৯৬৬-এ ওয়ার্ল্ড কাপ ফুটবল ফাইনাল ম্যাচটি হয়েছিল।
ট্যাক্সি ড্রাইভার টম: হ্যা। তা ঠিক। এখানেই সব ইম্পরটেন্ট স্পোর্টিং ইভেন্টগুলো হয়। তবে এই স্টেডিয়ামের নাম পালটে গেছে। এর নাম হয়েছে স্যার উইনস্টন চার্চিল স্টেডিয়াম। সংক্ষেপে চার্চিল স্টেডিয়াম।
আদিল: কখন থেকে এই নতুন নাম হয়েছে?
টম: গত ইলেকশনে টোরি পার্টি জেতার পর থেকে। নতুন প্রাইম মিনিস্টার ডেভিড ক্যামেরনের অর্ডারে।
আদিল: কেন তিনি এই অর্ডার দিলেন?
টম: আপনি হয়তো জানেন দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময়ে উইনস্টন চার্চিল ছিলেন বৃটেনের প্রধানমন্ত্রী। তারই অনুপ্রেরণায় বৃটিশরা বিজয়ী হয়েছিল হিটলারের জার্মানির বিরুদ্ধে। চার্চিল ছিলেন টোরি নেতা। তাই তার নামে এখন টোরি পার্টি ওয়েম্বলি স্টেডিয়ামের নাম দিয়েছে চার্চিল স্টেডিয়াম।
আদিল: আপনার তথ্যে একটু ফাক আছে। সেপ্টেম্বর ১৯৩৯-এ যখন পোল্যান্ডের বিরুদ্ধে জার্মানি অভিযান চালায় তখন বৃটেন যুদ্ধ ঘোষণা করে। ওই সময়ে বৃটেনের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন নেভিল চেম্বারলেইন। ১০ মে ১৯৪০-এ জার্মানি যখন হল্যান্ড ও তার পাশের দেশগুলোর বিরুদ্ধে অভিযান চালায় তখন চেম্বারলেইন পদত্যাগ করেন। এরপর উইনস্টন চার্চিলের নেতৃত্বে টোরি, লেবার ও লিবারাল পার্টিকে মিলিয়ে, একটি অল পার্টি কোয়ালিশন বা সর্বদলীয় জোট সরকার গঠিত হয়। সেই সরকার ন্যাশনাল গভর্নমেন্ট বা জাতীয় সরকার নামে পরিচিত হয়েছিল। অর্থাৎ, দেশের ওই সঙ্কটের সময়ে চার্চিল কোনো দলীয় নেতা ছিলেন না — তিনি ছিলেন সর্বদলীয় সরকারের প্রধানমন্ত্রী। অথচ, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পয়ষট্টি বছর পরে চার্চিলকে ডিমোশন দেয়া হয়েছে। তাকে জাতীয় নেতা থেকে নামিয়ে দলীয় নেতা করা হয়েছে।
টম: এবার টোরি পার্টি ইলেকশনে জেতার পর থেকেই অনেক নাম বদলে ফেলছে। মনে হচ্ছে এটাই তাদের প্রধান কাজ। অথচ, তারা যে নাম বদলানোর কাজে এভাবে ঝাপিয়ে পড়বে তার বিন্দুমাত্র উল্লেখ ছিল না তাদের ইলেকশন ম্যানিফেস্টোতে।
আদিল: আর কোনো স্থাপনার নাম বদলানো হয়েছে?
টম: অনেক স্থাপনার নামই বদলানো হয়েছে। যেমন, লন্ডনের টপ হসপিটাল ওয়েলিংটন-হিউমানা-র নাম বদলে হয়েছে চার্চিল হসপিটাল, ম্যাডাম টুশো প্ল্যানেটারিয়ামের নাম বদলে হয়েছে চার্চিল নভোথিয়েটার, হাইড পার্কের নাম বদলে হয়েছে চার্চিল পার্ক। এমনকি কুইন এলিজাবেথ কনফারেন্স সেন্টারের নাম বদলে হয়েছে চার্চিল ইন্টারন্যাশনাল কনফারেন্স সেন্টার। এই যে, আমরা পৌছে গেছি চার্চিল হোটেলে।
আদিল (ট্যাক্সি থেকে নেমে): চার্চিল হোটেল! ভাগ্যিস নামটা আগে থেকেই ছিল।
টম (ট্যাক্সি থেকে আদিলের সুটকেস নামিয়ে): আপনি ভাড়া দেবেন কোন কারেন্সিতে?
আদিল: পাউন্ডেই দেব। এয়ারপোর্টে আমি কারেন্সি চেঞ্জ করে নিয়েছি। কিন্তু এই প্রশ্ন কেন?
টম: লক্ষ্য করে দেখুন, সব নোট বদলে গিয়েছে। আগে পাউন্ড নোটে রানীর ছবি ছিল। এখন সব নোটে শুধুই চার্চিলের ছবি ছাপা হয়েছে। টোরি পার্টি ক্ষমতায় এসেই এসব নতুন নোট ছেপেছে।
আদিল (মানিব্যাগ বের করে কয়েকটা নোট দেখে): আশ্চর্য! তাই তো!
দৃশ্য ৩
চার্চিল হোটেলে আদিলের রুম।
টেলিফোন বাজার শব্দ।
আদিল: হ্যালো। কে বলছেন?
অপর প্রান্ত থেকে টেলিফোন কলার: আমি মহামান্য রানীর প্রাইভেট সেক্রেটারি বলছি।
আদিল (চমকিত হয়ে): আপনি আমার সঙ্গে কথা বলতে চাইছেন?
প্রাইভেট সেক্রেটারি: বিশেষ জরুরি কারণে মহামান্য রানী চাইছেন আপনার সঙ্গে কিছু কথা বলতে। তিনি অনুরোধ করেছেন আমার সঙ্গে আপনাকে যেতে। আমি হোটেলের রিসেপশনে অপেক্ষা করছি। আপনি কি দয়া করে আসবেন? প্লিজ।
আদিল (অবাক হয়ে): মহামান্য রানী আমার সঙ্গে কথা বলতে চান! এ তো পরম সৌভাগ্য আমার। আমি আসছি। কিন্তু আমার সঙ্গে কেন কথা বলতে চান তিনি? তিনি কী করে জানলেন যে আমি এই হোটেলে আছি?
প্রাইভেট সেক্রেটারি: মহামান্য রানীর প্রাইভেট সিকিউরিটি নেটওয়ার্কের মাধ্যমে আমরা জেনেছি, আপনি লন্ডনে এসে নাম বদলের পালা দেখে কৌতূহল প্রকাশ করেছেন। আমরা এটাও জেনেছি যে আপনি উইনস্টন চার্চিল বিষয়ে জ্ঞান রাখেন। মহামান্য রানী এই বিষয়েই আলাপ করতে আগ্রহী।
দৃশ্য ৪
বাকিংহাম প্যালেস। দেয়ালে একটা স্কৃনের টিভি সাইলেন্টলি চলছে। কফি টেবিলের দুই দিকে মুখোমুখি আসনে আদিল এবং রানী এলিজাবেথ।
মহামান্য রানী এলিজাবেথ: বিনা নোটিশে আপনাকে ডেকে পাঠিয়েছি এ জন্য দুঃখিত। আপনি যে দয়া করে এসেছেন সে জন্য কৃতজ্ঞ।
আদিল: অ্যাট ইয়োর সার্ভিস, ইয়োর ম্যাজেস্টি।
রানী: আমি পত্রিকায় পড়েছি বৃটেনের আগে বাংলাদেশ নাম বদলের পালা শুরু করেছিল সেখানের নবনির্বাচিত সরকার। আমার নাম নিয়ে এখানের নবনির্বাচিত সরকার টানাহেচড়া করছে। আমাকে উপদেশ দিন, আমি বৃটেনে কীভাবে নিজের নাম রক্ষা করতে পারি।
আদিল: আমি কল্পনাও করতে পারিনি আমাকে এত বড় দায়িত্ব দেবেন। ইয়োর ম্যাজেস্টি, এক্ষেত্রে আপনার সামনে বোধহয় মাত্র দুটি পথই খোলা আছে। প্রথম পথটি হলো উইনস্টন চার্চিলকে জাতির রক্ষক ঘোষণা করুন। তার জন্ম ও মৃত্যু উভয় দিবসেই ছুটি দিন।
রানী: সে কী করে হয়? আমি তো ইংল্যান্ডের ডিফেন্ডার অফ দি ফেইথ বা ধর্মের রক্ষক। ১৫২১-এ পোপ দশম লিও এই টাইটেল দিয়েছিলেন রাজা অষ্টম হেনরিকে। তখন থেকে ইংল্যান্ডের সব রাজা বা রানী এই টাইটেল নিয়ে দেশ শাসন করেছেন। এখন চার্চিলকে যদি জাতির রক্ষক ঘোষণা করি এবং অন্যদিকে যদি আমি ধর্মের রক্ষক থাকি — তাহলে দেশবাসীর কাছে বিষয়টা খুব জটিল মনে হতে পারে। তাছাড়া চার্চিল তো আর জীবিত নেই। তিনি মারা গিয়েছেন পয়তাল্লিশ বছর আগে। তাকে নিয়ে টোরি পার্টি টানাহেচড়া করতে চায়, করুক। কিন্তু সেটা আমার রুচিতে বাধবে।
আদিল: তাহলে দ্বিতীয় পথে চেষ্টা করতে পারেন।
রানী: সেটা কী?
আদিল: আপনি বাংলাদেশের ব্যারিস্টার রফিক-উল হককে আপনার আইনজীবী নিযুক্ত করুন। তাকে লন্ডনে নিয়ে আসুন। সরকারের বিরুদ্ধে তাকে দিয়ে মামলা দায়ের করুন।
রানী: আমার দেশে এত বাঘা বাঘা সব কিউসি, ব্যারিস্টার থাকা সত্ত্বেও ব্যারিস্টার রফিক-উল হককে কেন?
আদিল: ব্যারিস্টার রফিক-উল হক সরকারের বিরুদ্ধে মামলা লড়তে এক্সপার্ট। তার সাকসেস রেট ভালো। ইংল্যান্ডেও তিনি সফল হতে পারেন।
টেলিভিশনে ব্রেকিং নিউজ স্ক্রল দেখে রানী তুলে নিলেন রিমোট কনট্রোল।
রানী: এক্সকিউজ মি। একটু নিউজটা শুনে নিই। আমার সম্পর্কেই ব্রেকিং নিউজ যাচ্ছে। বৃটেনের সব ডাকটিকেট থেকে আমার ছবি বাদ দিয়ে চার্চিলের ছবি ছাপার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। আমার ব্যক্তিগত সম্পত্তি বাকিংহাম প্যালেসেরও নতুন নাম দিয়েছে সরকার…।
আদিল: নিশ্চয়ই চার্চিল প্যালেস?
রানী (বিষণ্ন মুখে টিভি নিউজ দেখতে দেখতে): হ্যা। তাই। আমার মনে হচ্ছে, ইংল্যান্ডের নামও বদলিয়ে সরকার নতুন নাম দেবে চার্চিল্যান্ড।
নিউজ শেষের পর টিভি অফ করলেন রানী।
রানী: ঠিক আছে। আমি দ্বিতীয় পথেই যাবো। আমি তো সরকারকে এড়িয়ে ঢাকায় বৃটিশ হাই কমিশনারের মাধ্যমে ব্যারিস্টার রফিক-উল হকের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারবো না। আপনি কি এই দায়িত্বটা নিতে পারবেন? প্লিজ।
আদিল: নিশ্চয়ই ইয়োর ম্যাজেস্টি। ১৯৬৩-তে ইয়েন ফ্লেমিং লিখেছিলেন তার জেমস বন্ড সিরিজের একাদশতম উপন্যাস অন হার ম্যাজেস্টিস সিক্রেট সার্ভিস। সাতচল্লিশ বছর পরে আমি অন হার ম্যাজেস্টিস সিক্রেট লিগাল সার্ভিসের দায়িত্ব পেয়ে খুবই গর্বিত বোধ করছি। (হাটু গেড়ে বসে) আই অ্যাম অনার্ড। থ্যাংক ইউ, ইয়োর ম্যাজেস্টি।

৯ মার্চ ২০১০

রাষ্ট্রীয় সফর সফল করার সহজ উপায়


দৃশ্য ১.
স্থান : চায়নার রাজধানী বেইজিংয়ে গ্রেট হল অফ দি পিপল-এ রাষ্ট্রীয় মিটিং রুম।
কাল : ১৮ মার্চ ২০১০
চরিত্র : চায়নার প্রধানমন্ত্রী (চাপ্রম), বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী (বাপ্রম) এবং দুজন ইন্টারপ্রেটার বা দোভাষী।
চাপ্রম : চায়নায় আপনাকে স্বাগতম জানাচ্ছি। আমরা আন্তরিকভাবে আশা করি আপনার এই সফরের পর চায়না-বাংলাদেশ বন্ধুত্ব সম্পর্ক এক নতুন পর্যায়ে উন্নীত হবে।
বাপ্রম : আমরাও ঠিক সেই রকমটাই আশা করি।
চাপ্রম : পূর্ব অনুষ্ঠিত আলোচনা অনুযায়ী আমরা আজ এখানে উপস্থিত হয়েছি তিনটি অ্যাকর্ড বা চুক্তিপত্র এবং একটি এমওইউ বা সমঝোতাপত্রে স্বাক্ষর করতে।
বাপ্রম : হ্যা। এই তিনটি চুক্তিপত্র হবে, এক. অর্থনৈতিক ও কারিগরি খাতে সহযোগিতা যেখানে চায়না দেবে পর্যাপ্ত গ্রান্ট বা মঞ্জুরি, দুই. শাহজালাল ফার্টিলাইজার ফ্যাক্টরি নির্মাণের একটি কাঠামো প্রস্তুত এবং তিন. সপ্তম বাংলাদেশ-চায়না মৈত্রী সেতু নির্মাণ বিষয়ে। আর সমঝোতাপত্রটি হবে তেল ও গ্যাস খাতে বাংলাদেশ-চায়নার সহযোগিতা বিষয়ে।
চাপ্রম : চমৎকার। আপনি সবই জানেন দেখছি। বেইজিংয়ে আর কি করতে চান আপনি?
বাপ্রম : ২০০৮-এর অলিম্পিক গেমস উপলক্ষে নির্মিত বেইজিংয়ের স্টেডিয়ামটা দেখবো।
চাপ্রম : এই স্টেডিয়ামটা দর্শনীয় স্থানই বটে। ৪২৩ মিলিয়ন আমেরিকান ডলার খরচ করে এই স্টেডিয়ামটা আমরা বানিয়েছিলাম। এটিই হচ্ছে বিশ্বের সর্ববৃহৎ স্টিল স্ট্রাকচার। এর নাম স্টিলের খাচা হওয়াই সঙ্গত ছিল। তবে এর নাম আমরা দিয়েছি বার্ডস নেস্ট বা পাখির নীড়। কিন্তু এখনো চায়নার সবচেয়ে বড় দর্শনীয় স্থান হচ্ছে দি গ্রেট ওয়াল বা চায়নার বিশাল দেয়াল। এই গ্রেট ওয়াল বিষয়ে তথ্যগুলো জানলে আপনি অবাক হয়ে যাবেন।
বাপ্রম : দয়া করে কয়েকটি তথ্য আমাকে বলবেন কি?
চাপ্রম : অবশ্যই। আনন্দের সঙ্গে বলবো। যিশু খৃস্টের জন্মের পাচশ বছর আগে অর্থাৎ আজ থেকে প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে চায়নার উত্তর অঞ্চলে এই দেয়াল বানানোর কাজ শুরু হয়েছিল। তারপর প্রায় ২১০০ বছর জুড়ে এই দেয়াল নির্মাণ, মেরামতি, পুনঃনির্মাণ প্রভৃতি কাজ চলে ষোড়শ শতাব্দী পর্যন্ত। পাথরে তৈরি এই দেয়াল তৈরি করা হয়েছিল চায়নিজ সাম্রাজ্যের উত্তর সীমান্তকে রক্ষার জন্য। মিং বংশের রাজত্বের সময়ে এই দেয়ালের বেশিরভাগ তৈরি হয়েছিল। পূর্বে শানহাইগুয়ান থেকে পশ্চিমে লপ নুর পর্যন্ত বিস্তৃত এই দেয়ালটির তার শাখা-প্রশাখাসহ দৈর্ঘ ৮,৬৫১ কিলোমিটার বা ৫,৫০০ মাইল। এটি চওড়ায় সর্বোচ্চ ৯.১ মিটার বা ৩০ ফিট। চিন্তা করুন ৩০ ফিট চওড়া দেয়াল ৫,৫০০ মাইল জুড়ে চায়নাকে শতাব্দীর পর শতাব্দী সুরক্ষিত রেখেছে। (হাসি মুখে) পৃথিবীর সপ্তম আশ্চর্যের অন্যতম এই দি গ্রেট ওয়াল।
বাপ্রম : এই ওয়াল আমি দেখেছি। সত্যিই অতি আশ্চর্যজনক সৃষ্টি!
চাপ্রম : এই পাচ দিন সফরের শেষ দিনে আপনি যাবেন, কুনমিংয়ে। সেখানে আপনার সঙ্গে দেখা হবে ইউনান প্রদেশের গভর্নর মি. জিন গুয়াগং-য়ের সঙ্গে। যদিও আমরা আজকে তিনটি চুক্তিপত্র এবং একটি সমঝোতাপত্রে সই করবোÑ তবুও এসবই বাস্তবায়িত হবে একটি শর্ত সাপেক্ষে।
বাপ্রম (অবাক হয়ে) : একটি শর্ত! সেই শর্তটা কি? এ বিষয়ে আমার পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. দীপু মনি এবং পররাষ্ট্র দফতর তো কিছুই আমাকে বলেনি!
চাপ্রম : এটা ওরা কেউ জানেন না। আপনাকে এই শর্ত বিষয়ে জানাবেন গভর্নর জিন গুয়াগং। তার আগে আগামীকাল আপনার সঙ্গে দেখা হবে আমাদের প্রেসিডেন্ট হু জিনতাও-য়ের সঙ্গে। আশা করি আপনার এই সৌজন্য সাক্ষাৎ আনন্দদায়ক হবে।
দৃশ্য ২
স্থান : এমপার্ক গ্র্যান্ড হোটেল, কুনমিং
কাল : ২১ মার্চ ২০১০, লাঞ্চ আওয়ার
পাত্র : ইউনান প্রদেশের গভর্নর জিন গুয়াগং, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী, দুজন ইন্টারপ্রেটার এবং দুজন ফুড টেস্টার।
জিন গুয়াগং : অনেক ধন্যবাদ এই লাঞ্চে অতিথি হবার জন্য। আপনি জানেন কুনমিংয়ে কিছু বাংলাদেশি আছেন। বাংলাদেশি খাবারের জায়গা আছে। আমরা ইচ্ছা করলে আপনার জন্য বাংলাদেশি খাবারের আয়োজন করতে পারতাম। কিন্তু আমরা মনে করেছি চায়নাতে এসে আপনি চায়নিজ খাবারই খেতে পছন্দ করবেন। তাই আজকের লাঞ্চ মেনুতে সব চায়নিজ।
বাপ্রম : ঠিকই করেছেন। তবে দেখবেন সব যেন হালাল হয়। সাপ, ব্যাঙ, ইদুর, কুকুর যেন না থাকে।
জিন গুয়াগং : আমরা সে বিষয়ে কড়া নজর রেখেছি। সব হালাল এবং বিষমুক্ত খাবার ও পানীয় সার্ভ করা হবে। কোনো খাবার এবং পানীয়তে বিষ আছে কি না সেটা পরীক্ষা করার জন্য দুজন ফুড টেস্টার আমরা রেখেছি। প্রতিটি খাবার ও পানীয় সার্ভ হবার আগে ওরা দুজন (উপস্থিত দুই ফুড টেস্টারের দিকে আঙ্গুল দেখিয়ে) টেস্ট করে দেখবেন। তারপর সেটা আপনাকে সার্ভ করা হবে। আমরা জানি আপনি অভিযোগ করেছেন বাংলাদেশে সেনা-সমর্থিত গত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে যখন সাবজেলে বন্দি ছিলেন তখন আপনাকে স্লো ফুড পয়জনিং করা হয়েছিল। তাই চায়নাতে আপনাকে যেসব ফুড ও ড্রিংকস সার্ভ করা হয়েছে এবং হবে সেসব সম্পর্কে আমরা একস্ট্রা কেয়ারফুল আছি।
বাপ্রম : আপনাদের দূরদর্শিতার তারিফ করতেই হয়। কি খাওয়াবেন আজ?
জিন গুয়াগং : ট্রাডিশনাল চায়নিজ খাবার সাধারণত ছোট ছোট টুকরো বা পোর্শনে হয়, ফলে সেসব চপ স্টিকস দিয়ে খেতে সুবিধা হয়। সাধারণত চায়নিজ মেনু তৈরি হয় বিপরীত জাতীয় ফুডকে ব্যালান্স করে। যেমন হট ফুডকে ব্যালান্স করা হয় কোল্ড ফুড দিয়ে। পিকলড ফুড বা আচার জাতীয় সংরক্ষিত ফুড ব্যালান্স করা হয় ফ্রেশ ফুড দিয়ে। অনেক মশলাযুক্ত ফুড ব্যালান্স করা হয় কম মশলাযুক্ত ফুড দিয়ে। আমরা শুরু ও শেষ করবো চায়নিজ টি দিয়ে। আপনি বোধ হয় জানেন, চায়নিজরা মনে করে জীবন ধারণের সবচেয়ে প্রয়োজনীয় সাতটি বস্তু হচ্ছে, জ্বালানি কাঠ, চাল, তেল, লবণ, সয়া সস, ভিনিগার এবং চা।
বাপ্রম : এটা জানতাম না।
জিন গুয়াগং : আমরা টেবিলে ছুরি-কাটাচামচ রেখেছি। ইচ্ছা করলে সেসব ব্যবহার করতে পারেন। পাশেই চপ স্টিকসও রেখেছি। ৩,২০০ বছর আগেও আমরা চায়নিজরা চপ স্টিকস দিয়েই যে খেতাম তার প্রমাণ পাওয়া গেছে ইয়িন-এর ধ্বংসাবশেষে। সভ্য আচার-আচরণের বিকাশ যে প্রথম চায়নাতেই হয়েছিল তার প্রমাণ ৩,২০০ বছর আগেও চায়নিজরা আঙ্গুল দিয়ে নয়, চপ স্টিকস দিয়ে খেত।
বাপ্রম : চপ স্টিকস ধরা জানি না। তাই আমি আজ কাটাচামচ দিয়ে খাবো।
জিন গুয়াগং : শুরু করা যাক তাহলে।
ডাইনিং টেবিলে খাবার ও পানীয় সার্ভ শুরু হলো। ফুড টেস্টার দুজন সেসব চেখে দিলেন।
জিন গুয়াগং (খেতে খেতে) : আমাদের প্রধানমন্ত্রী মি. ওয়েন জিয়াবাও বিষয়ে আপনি কি জানেন?
বাপ্রম : তিনি গণপ্রজাতন্ত্রী চায়নার স্টেট কাউন্সিলের ষষ্ঠ এবং বর্তমান প্রধানমন্ত্রী। স্ট্যান্ডিং কমিটিরও সদস্য তিনি। দেশের প্রকৃত ক্ষমতার অধিকারী এই স্ট্যাডিং কমিটি এবং এর নয় সদস্যের মধ্যে তার স্থান তৃতীয়। (হেসে) অর্থাৎ, চায়নাতে তিনিই সবচেয়ে ক্ষমতাধর ব্যক্তি। একদিকে প্রধানমন্ত্রী এবং অন্যদিকে স্ট্যান্ডিং কমিটির তিন নাম্বার সদস্য।
জিন গুয়াগং : উত্তরাধিকার সূত্রে নয়, নিজের যোগ্যতা বলেই তিনি শীর্ষে পৌছেছেন। পেশাগতভাবে তিনি একজন জিওলজিস্ট ও ইঞ্জিনিয়ার। বেইজিং ইন্সটিটিউট অফ জিওলজি থেকে পোস্ট গ্র্যাজুয়েট ডিগ্রি নিয়েছেন। চায়নার কমিউনিস্ট পার্টিতে এখন যে চতুর্থ প্রজন্ম নেতৃত্ব দিচ্ছে, তিনি তার মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছেন।
বাপ্রম : তার সঙ্গে কথা বলে আমি মুগ্ধ হয়েছি। তবে সেই আলোচনার শেষে তিনি একটা রহস্য করেন। তিনি একটা শর্তের কথা বলেছিলেন, যেটা…
জিন গুয়াগং : হ্যা। সেটা আপনাকে অবশ্যই বলবো। তার আগে বলুন, আপনি কি মনে করেন, আপনার এই চায়না সফর সফল হয়েছে? আপনার সব আশা পূরণ করেছে?
বাপ্রম : আমার তো মনে হয় খুব সফল হয়েছে। অবশ্য শর্তটা জানলে আমি এই সাফল্য সম্পর্কে নিশ্চিত হতে পারতাম।
জিন গুয়াগং : আপনি কি ডিপ সিপোর্ট বা গভীর সমুদ্রবন্দর এবং চট্টগ্রাম থেকে মিয়ানমার হয়ে কুনমিং পর্যন্ত রোড ও রেল যোগাযোগ বিষয়ে আলোচনা করতে চান না? আপনাকে জানিয়ে রাখি আমরা মিয়ানমার, শ্রী লংকা এবং পাকিস্তানে ডিপ সিপোর্ট তৈরি করতে যাচ্ছি। আমাদের ইচ্ছা ছিল বাংলাদেশের সমুদ্রসীমায় একটা সিপোর্ট করে দেব।
বাপ্রম (চিন্তিত মুখে) : সেক্ষেত্রে এটা কি মনে হতে পারে না যে ইনডিয়াকে ঘিরে রাখার জন্য চারটি সিপোর্ট আপনারা করতে চান?
জিন গুয়াগং : সেটা ইনডিয়া মনে করতে পারে বৈকি। চট্টগ্রাম-কুনমিং রোড-রেল যোগাযোগ স্থাপিত হলে ইনডিয়া আরো মনে করতে পারে, বাংলাদেশ তাদের এড়িয়ে সরাসরি চায়নার সঙ্গে আরো ঘনিষ্ঠ স্ট্র্যাটেজিক সম্পর্ক স্থাপন করতে চাইছে। আমাদের প্রধানমন্ত্রী ওয়েন জিয়াবাও আশা করেছিলেন আপনি এই সেন্টিমেন্টের ঊর্ধে উঠে একটা দেয়াল নির্মাণ বিষয়েও আমাদের সাহায্য চাইবেন।
বাপ্রম : সেজন্যই কি তিনি দি গ্রেট ওয়াল সম্পর্কে এত তথ্য আমাকে দেন?
জিন গুয়াগং : হ্যা। আমরা জানি আপনার পার্টি ক্ষমতায় আসার পরে ফেব্রুয়ারি ২০০৯-এ ঢাকায় বিডিআর বিদ্রোহ হয়েছিল। তারপর থেকে বাংলাদেশের সীমান্ত প্রায় অরক্ষিত আছে। বিডিআর সদস্যদের নিরস্ত্র রাখা হয়েছে। আমরা অবশ্য এটাও জানি যে আপনি ফিরে গিয়ে কিছু অস্ত্র দেবেন। কিন্তু আমরা ভেবেছিলাম, ইনডিয়ার সঙ্গে সীমান্ত রক্ষা সমস্যাটির স্থায়ী সমাধানের জন্য দি গ্রেট ওয়ালের মডেলে একটা ওয়াল তৈরির জন্য আমাদের সাহায্য চাইবেন। ইনডিয়া কাটাতারের বেড়া দিচ্ছে। আপনারা পাথরের ওয়াল দিন। এতে দেশের সুরক্ষা হবে। চোরাচালান বন্ধ হবে। বিএসএফের গুলিতে আর বাংলাদেশি নিহত হবে না। চাই কি একটা টুরিস্ট এট্রাকশনও হতে পারে এই ওয়াল।
বাপ্রম : বিষয়টি নিয়ে ভেবে দেখতে হবে। এর সঙ্গে ইনডিয়া জড়িত। কিন্তু এখন বলুন সেই শর্তটা কি যার ওপরে নির্ভর করছে চুক্তিগুলোর বাস্তবায়ন।
জিন গুয়াগং : আপনি জানেন, আপনার পিতার শাসন আমলে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়নি চায়না। পাকিস্তানের সঙ্গে সুদীর্ঘকালের বন্ধু সম্পর্কের মূল্য দেয়ার কারণে আমরা একাত্তরে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে সমর্থন করিনি। তারপর বাংলাদেশ স্বাধীন হলেও আমরা স্বীকৃতি দেইনি। শেখ মুজিবুর রহমানের মৃত্যুর পরে আমরা স্বীকৃতি দিয়েছিলাম। তারপর জিয়াউর রহমান যখন বাংলাদেশের শাসক হন তখন চায়না-বাংলাদেশ সম্পর্কে নতুন মোড় নেয়। জিয়াউর রহমানের উদ্যোগে আমাদের দুই দেশের মধ্যে বন্ধু সম্পর্ক গড়ে ওঠে। তিনি প্রয়াত হলেও আমরা তাকে শ্রদ্ধা করি।
বাপ্রম (মুখে গভীর বিরক্তির চিহ্ন) : আপনি জিয়াউর রহমানের কথা টেনে আনছেন কেন? শর্তের সঙ্গে ওই অখ্যাত মেজরটার সম্পর্ক কি?
জিন গুয়াগং : সম্পর্ক আছে বলেই তো বলছি। আপনি জানেন আধুনিক চায়নার রূপকার ছিলেন আমাদের পরম শ্রদ্ধেয় নেতা দেং জিয়াও পিং। আপনি জানেন আমাদের প্রধানমন্ত্রী ওয়েন জিয়াবাও। আর কুনমিং এয়ারপোর্ট থেকে যখন দেশে ফিরবেন তখন লক্ষ্য করবেন চায়নার এই সপ্তম বৃহৎ এয়ারপোর্টের নাম কুনমিং উজিয়াবা এয়ারপোর্ট। আমরা জানি, জিয়া নামের প্রতি আপনার প্রচন্ড এলার্জি আছে। জিয়া নাম দেখলেই আপনি তা বদলে ফেলার নির্দেশ দেন। তাই আমাদের শর্ত থাকবে চায়না-বাংলাদেশের কোনো চুক্তিপত্র, সমঝোতাপত্র, স্মারকপত্র, সফরসূচি, কর্মসূচি প্রভৃতিতে দেং জিয়াও পিং, ওয়েন জিয়াবাও, উজিয়াবা এয়ারপোর্ট প্রভৃতি নাম বদলানো যাবে না, বাদও দেয়া যাবে না। বহু চায়নিজ নামের অচ্ছেদ্য অংশ জিয়া এবং সেটা বজায় রাখতে হবে। এটাই আমাদের একমাত্র পূর্বশর্ত।

৫ এপ্রিল ২০১০

নিউ ইয়র্কে নেড়িকুকুরের ইন্টারভিউ



sr১৭ ও ১৮ জুলাই ২০১০-এ নিউ ইয়র্কে আমেরিকা-বাংলাদেশ-কানাডা কনভেনশন (সংক্ষেপে এবিসি কনভেনশন)-এ এবার নিমন্ত্রিত হয়েছিলেন নেড়িকুকুর।
সমবেত মানুষবৃন্দ,
প্রথমেই আমি এবিসি কনভেনশনের আয়োজকদের ধন্যবাদ জানাতে চাই এই রকম একটি বিরাট আন্তর্জাতিক সম্মেলনে বাংলাদেশের এক নেড়িকুকুরকে নিমন্ত্রণ করার জন্য।
থ্যাংক ইউ। ঘেউ ঘেউ।
আর তারপর ধন্যবাদ জানাতে চাই আপনাদের সবাইকে, যারা এখানে এসেছেন আমার কথা শুনতে।
থ্যাংক ইউ। ঘেউ ঘেউ।
এবিসি কনভেনশন আয়োজকরা যে আমাকে, নেড়িকুকুরকে, নিমন্ত্রণ করেছেন তাতে আনন্দিত হলেও, অবাক হইনি। কারণ, আমেরিকানরা কুকুর ভালোবাসে। আমেরিকায় সাড়ে ছয় কোটি কুকুর আছে। অর্থাৎ গড়ে প্রতি পাচজন আমেরিকানের একটি কুকুর আছে। ৮৩ শতাংশ আমেরিকান বলেন, তারা তাদের কুকুরের প্রাণ রক্ষায় নিজের জীবনের ঝুকি নিতে প্রস্তুত আছেন। আর ২৭ শতাংশ আমেরিকান উইল করে বলে যান মৃত্যুর পরে তাদের পোষা কুকুরটির দেখাশোনা কিভাবে করতে হবে। আমেরিকানদের এই কুকুরপ্রীতি সাধারণ মানুষ থেকে প্রেসিডেন্ট পর্যন্ত বিদ্যমান।
আপনারা জানেন, বারাক হুসেন ওবামা প্রেসিডেন্ট হবার পরে পূর্ব প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী একটি কুকুর তার দুই মেয়েকে উপহার দিয়েছেন যার নাম বি.ও অর্থাৎ বারাক ওবামা ইংরেজি বানানের দুটি আদ্যাক্ষর। লক্ষণীয় যে, তার কুকুরের নামকরণে হুসেন-এর আদ্যক্ষরটি বাদ পড়ে গিয়েছে। বস্তুত, প্রেসিডেন্ট পদে শপথ নেয়ার সময়ে একবার উচ্চারিত হুসেন শব্দটি, এখন আমেরিকায় প্রশাসন থেকে শুরু করে মিডিয়া পর্যন্ত হারিয়ে গিয়েছে। যারা এই কা-টি করেছেন, তারা হয়তো প্রেসিডেন্টের সঙ্গে জন্মসূত্রে ইসলামের সম্পৃক্ততার বিষয়টি মুছে দিতে চেয়েছেন। তাই তারা ওবামার পোষা কুকুরের নামে হুসেনের আদ্যক্ষর, এইচ, দিতে চাননি। এটা একটা কারণ হতে পারে।
আরেকটা কারণ হতে পারে একটি ইসলামি শব্দের সঙ্গে কুকুরের সম্পৃক্ততা তারা চাননি। কারণ ইসলামের সঙ্গে কুকুরের বরাবরই একটা দূরত্ব আছে।
আর তাই এবিসি কনভেনশনে যোগ দেয়ার জন্য এয়ার টিকেট পাওয়ার পরে আমি দুঃশ্চিন্তায় ছিলাম। ভাবছিলাম ঢাকায় জিয়া ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টের নতুন নাম হয়েছে হজরত শাহজালাল (রাঃ) ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট। এই পবিত্র নামধারী এয়ারপোর্টের মধ্য দিয়ে এক নেড়িকুকুরকে যেতে দেয়া হবে তো?
প্রশ্নটি আমার মনে ঘুরপাক খাচ্ছিল। যদি ইমিগ্রেশন অথরিটি অভিযোগ করে, আমি এয়ারপোর্টের পবিত্রতা লংঘন করেছি এবং সেই অভিযোগে যদি তারা আমাকে অ্যারেস্ট করে, রিমান্ডে নেয়? আর বাংলাদেশে, যেটা এখন মামলাদেশে রূপান্তরিত হয়েছে, সেখানে রিমান্ড মানেই তো টর্চার! আর এসব টর্চারে মানুষ মারাও যাচ্ছে। বিডিআর বিদ্রোহের মামলায় বিচারাধীন ৫৬ আসামির মৃত্যু হয়েছে।

শুধু টর্চারই না, মামলাদেশে ব্যক্তিবিশেষকে রিমান্ডে নিয়ে তাকে বিবস্ত্রও করা হয়। দৈনিক আমার দেশ পত্রিকার ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মাহমুদুর রহমানকে বিবস্ত্র করা হয়েছিল। কেন যে তারা রিমান্ডে নিয়ে মানুষকে বিবস্ত্র করে তা আমি জানি না। তবে ন্যাংটার যেমন বাটপাড়ের ভয় নেই, তেমনি নেড়িকুকুরের বিবস্ত্রকারী ডিবি পুলিশের ভয় নেই। কারণ আমরা তো সবসময়ই বিবস্ত্র আছি!
সে যাই হোক। হজরত শাহজালাল (রাঃ) এয়ারপোর্ট ইমিগ্রেশন অথরিটিকে ধন্যবাদ, তারা আমাকে যেতে দিয়েছেন।
So, here i come America. (সো, হিয়ার আই কাম আমেরিকা)।
আমেরিকা, আমি এসে পড়েছি।
ঘেউ ঘেউ।
নিউ ইয়র্কে গত কয়েক ঘণ্টা থাকার পর ঢাকার সঙ্গে কয়েকটি বড় মিল-গরমিল আমার চোখে পড়েছে।
নিউ ইয়র্কে মানুষ এবং কুকুর, দিনে এবং রাতে নির্ভয়ে চলাফেরা করতে পারে। পথে ছিনতাইকারীদের ভয় নেই। ঢাকনাবিহীন ম্যানহোলের মৃত্যুফাদ নেই। বিকলাঙ্গ ভিখারির হাতছানি নেই। ঢাকার পথে এ সবই আছে। প্লাস এখন যোগ হয়েছে পথে আচমকা গ্রেফতার হয়ে যাবার ভয়। যেমনটা হয়েছেন আমেরিকায় নিযুক্ত সাবেক রাষ্ট্রদূত শমসের মবিন চৌধুরী। তিনি এখন জেলে আছেন। ঢাকার পথে এখন আরেকটা ভয় হচ্ছে হঠাৎ নিখোজ হয়ে যাওয়া। কমিশনার চৌধুরী আলমকে পথ থেকে সবার সামনে ধরে নিয়ে গিয়েছে শাদা পোশাকের কিছু লোক। তার কোনো খোজ পাওয়া যাচ্ছে না।
নিউ ইয়র্কের সঙ্গে ঢাকার একটি ন্যাক্কারজনক মিল আমি দেখেছি। ঢাকার পথে মানুষ পেচ্ছাব-পায়খানা করে, বা বলা উচিত, পাবলিক টয়লেটের অভাবে করতে বাধ্য হয়। আর নিউ ইয়র্কের পথে সতর্কতামূলক নোটিশ থাকা সত্ত্বেও কুকুর পেচ্ছাব-পায়খানা করে।
আকাশছোয়া বিলডিং বা স্কাইস্ক্র্যাপারের শহর নিউ ইয়র্ক। এসব বিলডিং নির্মাণ সমাপ্তির পরে তা ভেঙ্গে ফেলার কথা ওঠেনি। ঢাকায় হাইরাইজ বিলডিং নির্মাণ সমাপ্তির পর তা ভেঙ্গে ফেলার কথা ওঠে। যেমন, সম্প্রতি গুলশানে ওয়েস্টিন হোটেল এবং জব্বার টাওয়ার যে অবৈধভাবে নির্মিত হয়েছে সে কথা উঠেছে। এই ধরনের অভিযোগে বছর দুয়েক আগে র‌্যাংগস টাওয়ার ভেঙ্গে ফেলা হয়েছে। তবে, একই অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও বিজিএমইএ বিলডিং ভাঙা হয়নি। আশ্চর্য লাগে ভেবে, যখন নির্মাণ কাজ শুরু হয়, তখন এই ধরনের অভিযোগ কেন ওঠে না?
আরেকটি তফাৎ চোখে পড়েছে। নিউ ইয়র্ক ও সংলগ্ন এলাকায় দুই কোটির বেশি মানুষ বসবাস করলেও এবং এত গাড়ি থাকলেও পথে জনযট নেই–যানজটও নেই। চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় প্লেনে পৌছাতে লাগে ৪৫ মিনিট। কিন্তু তারপর ঢাকা এয়ারপোর্ট থেকে ঢাকা সিটি সেন্টারে পৌছাতে সময় লাগতে পারে দুই ঘণ্টার বেশি।
আমি দেখেছি, নিউ ইয়র্কে, এয়ারপোর্ট থেকে সিটি সেন্টারে পৌছানো ত্বরান্বিত করতে এক্সপ্রেসওয়ে আছে, রেল সিসটেম আছে। বাংলাদেশের বর্তমান ডিজিটাল সরকারও বলছে, ঢাকায় এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে হবে, ইলেকট্রিক ট্রেন চলাচল করবে।
যেসব সময়ে এসব কথা সরকার বলেছে ঠিক সেই সময়েই ইলেকট্রিসিটির অভাবে সাধারণ মানুষ ওয়ার্ল্ড কাপ ফুটবল ম্যাচ দেখতে না পেরে বিদ্যুৎকেন্দ্র ঘেরাও করেছে, বিক্ষোভ মিছিল করেছে, ভাংচুর করেছে। বিদ্যুৎ ও গ্যাসের অভাবে পুজি বিনিয়োগ বন্ধ হয়ে গিয়েছে। বাংলাদেশের রাজধানীতে এখন বহু স্থানে প্রতি এক ঘণ্টা অন্তর বিদ্যুৎ সাপ্লাই বন্ধ হয়ে যায়, মফস্বল ও গ্রামের অবস্থা আরো করুণ। কোনো কোনো স্থানে রাতে-দিনে মাত্র দুই ঘণ্টা বিদ্যুৎ থাকছে।
পরিস্থিতিটা নিউইয়র্কে থেকে আপনাদের পক্ষে কল্পনা করা অসম্ভব। চিন্তা করে দেখুন, সম্মেলন চলার সময়ে কনভেনশন হলের বিদ্যুৎ যদি চলে যায়!
নিউ ইয়র্কের সঙ্গে ঢাকার আরেকটা তফাৎ দেখলাম। এখানে পথে পথে চমৎকার সব খাবার দোকান আছে এবং ভালো খাবার সাধারণ মানুষের খরচ করার সামর্থের মধ্যে। কিন্তু ঢাকা তথা বাংলাদেশে চাল, ডাল, পেয়াজ, শাকসবজি ও তেলের দাম বেড়েই চলেছে। আগামী রোজার মাসে আরো বাড়বে। মোটা চালের কেজি এখন হয়েছে ৩৬ টাকা। ১০ টাকা কেজি দরে চাল দেয়ার নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি হয়ে গিয়েছে নিখোঁজ। ঘরে ঘরে চাকরির প্রতিশ্রুতিও দেয়া হয়েছিল নির্বাচনী জনসমাবেশে। বরং এখন দেখা যাচ্ছে, বহু দেশে চাকরি হারিয়ে অনেক মানুষ বাংলাদেশে ফিরে আসতে বাধ্য হচ্ছে।
এই পরিস্থিতিতে আমি নেড়িকুকুর উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছি। সাধারণ মানুষেরই যদি খাবার না জোটে, তাহলে আমরা নেড়িকুকুররা তাদের উচ্ছিষ্ট কোথায় পাবো?
এসব চিন্তাভাবনা নিয়ে প্রতিবাদ জানাতে গেলে আরো বিপদ হতে পারে। সম্প্রতি বাংলাদেশে চালু হয়েছে গায়েবি গণসমন জারি। মাহমুদুর রহমানসহ আমার দেশ পত্রিকার আরো পাঁচজন নির্দিষ্ট সাংবাদিকের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়েছে। একই সঙ্গে ওই পত্রিকার আরো ১০০ জন অজ্ঞাত সাংবাদিকের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়েছে। এই ব্যবস্থায় সরকার ওই পত্রিকার যেকোনো ব্যক্তির নাম ওই মামলায় ঢুকিয়ে তাকে গ্রেফতার করতে পারে। অনেকটা শূন্যস্থান পূরণ করার মতো ব্যাপার আর কি!
একইভাবে আশুলিয়াতে গার্মেন্টস শ্রমিকদের অসন্তোষ প্রকাশের পর সেখানে অজ্ঞাত ৬০,০০০ ব্যক্তির বিরুদ্ধে গায়েবি গণসমন জারি করা হয়েছে। হ্যা। ৬০,০০০ সংখ্যাটি সঠিক। গিনেস বুক অফ রেকর্ডসে হয়তো এই উদ্ভট ব্যবস্থাটি স্থান পাবে।
বাংলাদেশে এসব চলমান সমস্যার ওপরে আরো এসে পড়েছে ইনডিয়ার সঙ্গে গত বছরে স্বাক্ষরিত বাংলাদেশের ৫০ দফা চুক্তির বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া। যদিও এই চুক্তি বিষয়ে পার্লামেন্টে কোনো আলোচনা হয়নি। তবুও বাংলাদেশে ইনডিয়ার করিডোর হচ্ছে। কিন্তু নেপালের ট্রানজিট হচ্ছে না। বাংলাদেশের পশ্চিমে ফারাক্কা বাঁধের মর্মান্তিক মরু অভিজ্ঞতার পরে, বাংলাদেশের পূর্বে বাঙালি মুখোমুখি হতে চলেছে টিপাইমুখ বাধ অভিজ্ঞতার।
বিডিআরের হাতে সেনা অফিসাররা আক্রান্ত হয়েছে। পরিণতিতে বিডিআর ও সেনা, এই দুটি বাহিনীই দুর্বল হয়ে গিয়েছে। আর তার পরিণতিতে সীমান্ত এলাকা প্রায় অরক্ষিত হয়ে পড়েছে। তাই বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার বিষয়ে অনেকেই এখন চিন্তিত।
সব মিলে বাংলাদেশের সংকট যে কতো গুরুতর আকার ধারণ করেছে সেটা হয়তো আপনারা বুঝবেন একটা ছোট গল্প যদি বলি।
আমেরিকার সাবেক প্রেসিডেন্ট জর্জ ডাবলিউ বুশের সময়ে সূচিত অর্থনৈতিক মন্দাবস্থা কবে কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হবে সেটা জানতে বর্তমান প্রেসিডেন্ট ওবামা গিয়েছিলেন গড-এর কাছে।
গড উত্তর দেন, আরো দশ বছর লাগবে।
উত্তর শুনে ওবামা কাদতে কাদতে বেরিয়ে যান।
এরপরে বৃটেনের প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন যান গডের কাছে এবং প্রশ্ন করেন বৃটেনের চলতি মন্দাবস্থা কাটিয়ে উঠতে কতো বছর লাগবে?
গড উত্তর দেন, আরো বিশ বছর লাগবে। উত্তর শুনে ক্যামেরন কাদতে কাদতে বেরিয়ে যান।
এরপরে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী যান গডের কাছে এবং তিনি জানতে চান গত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে সূচিত বাংলাদেশের দুরবস্থা কাটিয়ে উঠতে কতো বছর লাগবে? কোনো উত্তর না দিয়ে এবার গড-ই কাদতে কাদতে বেরিয়ে যান।
এটা নৈরাশ্যজনক রাজনৈতিক চুটকি।
কিন্তু এর বিপরীতে মনে রাখবেন বাংলাদেশ বিরোধী বহু প্রচারণা, স্বদেশে ও বিদেশে হওয়া সত্ত্বেও, আমেরিকার প্রভাবশালী টাইম ম্যাগাজিনের ১০ এপ্রিল ২০০৬-এ, অর্থাৎ গত বিএনপি সরকারের শেষ বছরে প্রকাশিত একটি খুবই আশাবাদী রিপোর্ট। টাইম ম্যাগাজিন তাদের কভার স্টোরি রিবিলডিং বাংলাদেশ শিরোনামে বাংলাদেশের চমৎকার অগ্রগতি ও অনুকরণীয় উন্নতির লম্বা ফিরিশতি দিয়েছিল। প্রশংসা করেছিল। মনে রাখবেন ২০০৫ সালে ক্যাটরিনা ঝড়ের পরে গত বিএনপি সরকারের আমলে বাংলাদেশ এক মিলিয়ন ডলার সাহায্য দিয়েছিল আমেরিকাকে, যার পরিমাণ ছিল অন্য দেশগুলোর তুলনায় পঞ্চম এবং জাপানের সমান।
সুতরাং শত বিপদ ও হাজার সমস্যা সত্ত্বেও বাংলাদেশ এখনো তার স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষা করে সসম্মানে ও সগর্বে সামনে এগিয়ে যেতে পারে। প্রয়োজন শুধু গভীর দেশপ্রেম ও ঐক্যবদ্ধ কর্মসূচি এবং সেটা বাস্তবায়নে অটল সাহস ও কঠোর শৃঙ্খলা। আর এসব গুণাবলী আয়ত্ত করার জন্য উচিত জীবনের সব ক্ষেত্রে শিক্ষার প্রসার।
আমি আশা করি, আপনারা, আমেরিকান বাঙালিরা সেই লক্ষ্যেই কাজ করবেন। তখন বাংলাদেশে সবাই ভালো থাকবে। তাহলে আমরা নেড়িকুকুররাও ভালো থাকবো।
সবাইকে ধন্যবাদ ও শুভেচ্ছা। ঘেউ ঘেউ।
এবিসি কনভেনশন, নিউ ইয়র্ক, ১৮ জুলাই ২০১০

জাতিকে noশিক্ষিত করার সহজ উপায়…



  • স্থান: বাংলাদেশ
  • কাল: বর্তমান সময়
  • চরিত্র: অভিভাবক, স্পাইনাল সার্জন, স্বাস্থ্যমন্ত্রী, শিক্ষামন্ত্রী এবং হেলিকপ্টার পাইলট তার ক্রুরা
প্রথম দৃশ্য: স্পাইনাল সার্জনের চেম্বার
অভিভাবক (উদ্বিগ্ন কণ্ঠে): স্যার, গভীর বিপদে পড়ে আজ এই সাত সকালেই আপনার কাছে আসতে বাধ্য হয়েছি। এত ভোরে ডিস্টার্ব করার জন্য মাইন্ড করবেন না স্যার।
স্পাইনাল সার্জন (শান্ত স্বরে): আপনিই কি পেশেন্ট? বলুন, কি হয়েছে।
অভিভাবক : না। আমি পেশেন্ট নই। আজ সকালে একটা একসিডেন্টে পড়ে তার অবস্থা এখন খুবই আশংকাজনক। খুব সম্ভবত তার মেরুদণ্ড ভেঙে গিয়েছে। সে আর দাড়াতে পারছে না। যন্ত্রণায় কাৎরাচ্ছে। তাই তাকে এখানে আনতে পারিনি। আপনাকেই তার কাছে যেতে হবে স্যার। প্লিজ।
সার্জন (কাগজ ও বলপয়েন্ট বের করে লিখতে উদ্যত হয়ে): পেশেন্টের নাম?
অভিভাবক: জাতি।
সার্জন: বয়স?
অভিভাবক: উনচল্লিশ।

সার্জন: পুরুষ, না নারী?
অভিভাবক: উভলিঙ্গ।
সার্জন (লেখা থামিয়ে অবাক চোখে): আপনার পেশেন্টের নাম অদ্ভুত এবং লিঙ্গও…
অভিভাবক: আমি সত্যি বলছি স্যার। একসিডেন্টের বিবরণ দিলেই বুঝতে পারবেন। আমার পেশেন্ট গোটা বাংলাদেশি জাতি, যার জন্ম হয়েছিল ঊনচল্লিশ বছর আগে এবং যার পুরুষ ও নারী উভয় লিঙ্গই আছে। শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড, এই সর্বজন স্বীকৃত বাক্যটি আপনি নিশ্চয়ই জানেন। আজ সকালে খবরের কাগজ পড়ে জাতি জানতে পারে অতি অপ্রত্যাশিতভাবে আওয়ামী লীগ সরকার যানজটসহ বিভিন্ন কারণে আগামীকাল শনিবার থেকে রাজধানীসহ সারা দেশের সরকারি ও বেসরকারি স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা, কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও সমমানের ইংলিশ মিডিয়াম শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছুটির ঘোষণা দিয়েছে। একই সঙ্গে আগামী সোমবার থেকে ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে দেশের সব প্রাইমারি স্কুলেও। ১৬ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছুটি থাকবে। এ আকস্মিক ঘোষণাটি পড়ার পরপরই জাতি কাৎ হয়ে পড়ে যায়। যন্ত্রণায় কাৎরাতে থাকে। মনে হয় জাতি তার মেরুদণ্ডে প্রচণ্ড ব্যথা পেয়েছে।
সার্জন (গুরুগম্ভীর মুখে ক্যালেন্ডারের দিকে তাকিয়ে): আজ শুক্রবার ১৩ আগস্ট। ফ্রাইডে দি থার্টিনথ! পশ্চিমের বহু দেশে মনে করা হয় যদি কোনো শুক্রবার মাসের তের তারিখে পড়ে যায় তাহলে সেদিন কিছু বিপদ ঘটতে পারে। ইন ফ্যাক্ট, এই বহুল প্রচলিত কুসংস্কারের ওপর ভিত্তি করে হলিউড এখন পর্যন্ত আটটি হরর মুভি বানিয়েছে যাদের নাম, ফ্রাইডে দি থার্টিনথ, ফ্রাইডে দি থার্টিনথ পার্ট টু, ফ্রাইডে দি থার্টিনথ পার্ট থ্রি, ইত্যাদি। আমি এই কুসংস্কারে বিশ্বাস করতাম না। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে, এর একটা ভিত্তি আছে। সত্যিই তো আজ শুক্রবার ১৩ আগস্ট জাতি তার মেরুদণ্ডে আঘাত পেয়েছে।
অভিভাবক (কাতর স্বরে): স্যার, একটা কিছু করুন। একটা পাগল সরকারের পাল্লায় পড়ে এভাবে একটা জাতির মেরুদণ্ড ভেঙে যাবে? সারা দেশের ছেলেমেয়েরা এক মাসেরও বেশি সময় জুড়ে শিক্ষা থেকে বঞ্চিত থাকবে?
সার্জন (চিন্তিত মুখে): দেখুন, আপনার পেশেন্টের যা হয়েছে, তাকে আমরা, স্পাইনাল সার্জনরা এবং নিউরো সার্জনরা সংক্ষেপে বলি এসসিআই (SCI)। অর্থাৎ স্পাইনাল কর্ড ইনজুরি (Spinal Chord Injury)। এর ফলে, আহত ব্যক্তির চলাফেরার ক্ষমতা অথবা সকল শারীরিক অনুভূতি সম্পূর্ণ তিরোহিত হতে পারে। কোনো ট্রমায়, যেমন কার একসিডেন্ট, বন্দুকের গুলি, হঠাৎ পড়ে যাওয়া অথবা কোনো রোগে, যেমন পোলিও, স্পাইনা বাইফিডা, ফ্রেডারিকস, ইত্যাদিতে স্পাইনাল কর্ড ইনজুরি হতে পারে। তবে ইনজুরি হলেই যে স্পাইনাল কর্ড ভেঙে যাবে, তেমনটা না-ও হতে পারে। স্পাইনাল কর্ড না ভাঙলেও ক্ষমতা ও অনুভূতি চলে যেতে পারে।
অভিভাবক (হতবাক মুখে): তাই?
সার্জন: বিষয়টা আমি আরেকটু বুঝিয়ে বলছি। মানবদেহের কোমর থেকে ঘাড় পর্যন্ত মেরুদণ্ড গঠিত হয় সাধারণত তেত্রিশটি হাড়ের বা ভারটিব্রা (Vertebra)-র সমন্বয়ে যার মধ্যে থাকে স্পাইনাল কর্ড। ভারটিব্রা অথবা স্পাইনাল কর্ড কোনো ইনজুরিতে সাময়িক অথবা স্থায়ীভাবে মানুষকে অবশ বা অচল করে দিতে পারে। জাতির সম্ভবত সেটাই হয়েছে। আজ ফ্রাইডে দি থার্টিনথ…
অভিভাবক: এসব তত্ত্ব কথা বুঝে আমার কি লাভ? আমার পেশেন্ট তো যন্ত্রণায় কাৎরাচ্ছে। একটা চিকিৎসার কথা বলুন তাড়াতাড়ি, প্লিজ।
সার্জন: বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় স্পাইনাল কর্ড সার্জন হচ্ছেন ড. এম. ইদ্রিস। কিন্তু স্ট্রোক হবার পর তিনি এখন কম কাজ করছেন। তাছাড়া যতদূর জাতি বর্তমান প্রশাসনের হয়রানির শিকারও তিনি হয়েছেন। শুধু তিনিই নন, পিজি হসপিটাল, যাকে এখন বলা হয় বিএসএমএমইউ হসপিটাল, তার উনপঞ্চাশজন ডাক্তারকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত বা চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। এদের মধ্যে ত্রিশজনেরও বেশি টিচিং ডাক্তার। এছাড়া বহু সরকারি ডাক্তারকে আচমকা বদলি করা হয়েছে। এমনকি এক বছরের মধ্যে একজনকে চারবার বদলি করা হয়েছে। এ পরিস্থিতিতে জাতির চিকিৎসার ভার কেউ নিতে চাইবেন না। কোনো কারণে এ সরকারের বিরাগভাজন হবার বুকের পাটা কোনো ডাক্তারেরই নেই। সরি। আমি কিছু করতে পারবো না।
অভিভাবক (হতাশ মুখে): তাহলে আমি কি করবো?
সার্জন: আপনি স্বাস্থ্যমন্ত্রী ড. রুহুল হক-এর কাছে যান। তার সাহায্য চান। তিনি নিজে ট্রমা সেন্টার-এর প্রতিষ্ঠাতা।
দ্বিতীয় দৃশ্য : স্বাস্থ্যমন্ত্রীর অফিস
অভিভাবক: শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড, এ কথায় আপনি বিশ্বাস করেন?
স্বাস্থ্যমন্ত্রী (বিরক্ত মুখে): দেখুন আমরা সবাই মহাব্যস্ত আছি ১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবস পালনের কর্মসূচি নিয়ে। প্রাসঙ্গিক কথা বলুন। অপ্রাসঙ্গিক কথা শোনার সময় আমার নেই।
অভিভাবক: আমি প্রাসঙ্গিক কথাই বলতে এসেছি। একটা ট্রমাতে আমার পেশেন্ট জাতির মেরুদণ্ড ভেঙে গিয়েছে। তার ইমিডিয়েট টৃটমেন্টের জন্য আপনার পরামর্শ ও সাহায্য দরকার। আপনিই তো ট্রমা সেন্টারের প্রতিষ্ঠাতা।
স্বাস্থ্যমন্ত্রী: জাতির কেইস খুব সিরিয়াস ও কমপ্লেক্স। এত জটিল কেইসের কোনো চিকিৎসা আমার একার পক্ষে করা সম্ভব নয়। হয়তো একটা মেডিকাল বোর্ড গঠন করতে হতে পারে যেখানে থাকবেন মন্ত্রিসভার অন্য কিছু সদস্য। কিন্তু তাতেও কোনো লাভ হবে না। আমারই কলিগ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন পিছলে পড়ে কোমর ভেঙেছিলেন। তিনি ভর্তি হয়েছিলেন আমারই ট্রমা সেন্টারে। কিন্তু সেখানে কিছুদিন থেকে চলে গিয়েছিলেন সিঙ্গাপুরে। সেখান থেকেই সুস্থ হয়ে তিনি দেশে ফিরে আসেন। তবে…
অভিভাবক (জিজ্ঞাসু চোখে): তবে কি?
স্বাস্থ্যমন্ত্রী: তবে একটি সাপ্তাহিক পত্রিকায় প্রকাশিত রিপোর্টে জানা যায়, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর অগাধ বিশ্বাস শামসু পাগলার ওপরে। এমপি হবার আগে তিনি দোয়া নিতে গিয়েছিলেন পীর শামসু পাগলার মাজারে। মন্ত্রী হবার পরেও তিনি দেখা করেছেন শামসু পাগলার সঙ্গে। জানি না, সিঙ্গাপুর ডাক্তারদের চিকিৎসায়, নাকি, শামসু পাগলার দোয়ায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সুস্থ হয়েছেন।
অভিভাবক: ধন্যবাদ এই ইনফর্মেশনের জন্য। জাতির ভবিষ্যৎ আমি কোনো পাগলের হাতে তুলে দিতে পারবো না। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে আমি যাবো না।
স্বাস্থ্যমন্ত্রী: তাহলে আপনি চলে যান শিক্ষামন্ত্রী মি. নুরুল ইসলাম নাহিদ-এর কাছে। তিনি সৎ লোক। আমরা দুজনই ছাত্র ইউনিয়ন এবং বামপন্থী রাজনীতি করতাম। তিনি নিশ্চয়ই জাতির চিকিৎসার একটা উপায় বাতলে দেবেন। আমি তাকে ফোন করে দিচ্ছি।
তৃতীয় দৃশ্য: শিক্ষামন্ত্রীর অফিস
অভিভাবক: আপনি তো শিক্ষামন্ত্রী। আপনি কি বিশ্বাস করেন শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড?
শিক্ষামন্ত্রী (হতাশ সুরে): আগে তাই জানতাম এবং বিশ্বাসও করতাম। এখন সাতপাকে বাধা পড়ে গিয়েছি। দৈনিক সমকাল-এর মালিক-প্রকাশক মি. এ কে আজাদ-এর একটি বক্তব্য আপনাকে পড়ে শোনাতে চাই। (ড্রয়ার থেকে ১ জুলাই ২০১০-এর দৈনিক সমকাল বের করে) এ কে আজাদ বলেছেন, গত অর্থবছরে ব্যবসায়ীরা সরকারকে ৬০ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব দিয়েছেন। বলা হয়, শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড। এখন বলার সময় এসেছে, ব্যবসায়ীরাই জাতির মেরুদণ্ড। আমাদের সরকারকে ব্যবসায়ীরা কন্ট্রোল করছেন কি না, অথবা ইনডিয়া কন্ট্রোল করছে কি না, অথবা ইনডিয়া অনুগ্রহীত ব্যবসায়ীরা কন্ট্রোল করছেন কি না, সেটা আমি জানি না। আমি শুধু জানি আমি খুব বিপদে আছি। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় চেয়েছিল ১০ রমজান থেকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখতে। কিন্তু এর আগে যানজট নিরসনে ব্যবসায়ী ও ঢাকা মহানগর পুলিশ রমজান মাসে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধের দাবি জানিয়েছিল।
অভিভাবক: আর তারপর আপনি ১২ আগস্টের ঘোষণায় বলেছেন, রমজান ও ঈদ উপলক্ষে প্রতিবারই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছুটি দেয়া হয়। এবার ছুটি কিছুটা এগিয়ে আনা হয়েছে। অনেক শিক্ষক রোজা রাখেন। শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরাও রোজা রাখেন। সবার সুবিধার্থে এই সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। আমার প্রশ্ন হচ্ছে–সবার সুবিধার্থে বলতে আপনি কি বোঝাতে চান? এ সবাইটা কারা? যানজটে আটকে যাওয়া মোটরকার সিএনজি ড্রাইভার অথবা রিকশাওয়ালারা? এ কে আজাদের মতো সুব্যবসায়ী কিন্তু নোশিক্ষিত মিডিয়া মালিক এবং তাদের বেতনভোগী সম্পাদক ও সাংবাদিকরা? নাকি আপনার মতো নোশিক্ষিত মন্ত্রী-পলিটিশিয়ানরা? এরা কারা? দেশের শিক্ষা ধ্বংস করার অধিকার এদের কে দিয়েছে? এই সরকারের এই সিদ্ধান্ত কোনো অভিভাবকের সুবিধার্থে হয়নি।
শিক্ষামন্ত্রী: নোশিক্ষিত?
অভিভাবক: হ্যা। নোশিক্ষিত। তবে এই নো ইংরেজি know নয়। এই নো ইংরেজি no। আপনারা সবাই noশিক্ষিত। কোনো এক সময়ে আপনারা কিছু শিক্ষা পেয়েছিলেন। সুতরাং আপনাদের অশিক্ষিত বলা যাবে না। এবং সেসব শিক্ষা নিশ্চয়ই ভালো ছিল, যার ফলে আপনারা সফল ব্যবসায়ী, সম্পাদক-সাংবাদিক ও মন্ত্রী-পলিটিশিয়ান হতে পেরেছেন। তাই আপনাদের কুশিক্ষিতও বলা যাবে না। তাহলে আপনারা কি? আপনারা সবাই নোশিক্ষিত। অর্থাৎ, আপনারা নিজেরা শিক্ষার সুবিধা পেয়ে এখন অন্যদের শিক্ষা দিতে চাইছেন না। শিক্ষা মানুষের অন্যতম মৌলিক অধিকার। আচমকা টেলিভিশন ও দৈনিক পত্রিকার মাধ্যমে একটি দুর্বোধ্য ঘোষণা দিয়ে দেশের সব স্কুল-কলেজ এক মাসের জন্য বন্ধ করে দিলেন! এমনকি প্রাইভেট শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো? এত সার্বিক ক্ষমতা আপনাদের কেউ দেয়নি। আপনারা যুদ্ধ অপরাধীর বিচার করতে চান। আর আমি চাই আপনার মতো শিক্ষা অনাগ্রহীদের বিচার করতে।
শিক্ষামন্ত্রী: আপনি খুব ইমোশনাল হয়ে পড়েছেন। নিজেকে সংযত করুন।
অভিভাবক: দেখুন নোশিক্ষামন্ত্রী, আমি কিছু সত্য কথা আপনাকে বলছি। যে সত্য কথা কেউ আপনাকে বলতে সাহস করবে না। তাছাড়া আপনার আশপাশে যারা আছেন তাদের শিক্ষা ও কর্মপরিধি এখন ব্যক্তি বন্দনা ও ব্যক্তি পূজায় সীমাবদ্ধ হয়ে গিয়েছে। তারা সবাই এখন নোশিক্ষিত। বৃটেনের প্রধানমন্ত্রী হবার আগে ১ অক্টোবর ১৯৯৬-এ লেবার পার্টির বার্ষিক কনফারেন্সে টনি ব্লেয়ার বলেছিলেন, আমার সরকারের তিনটি প্রধান অগ্রাধিকার কি হবে সেই প্রশ্নটি যদি করেন তাহলে তার উত্তর হবে, শিক্ষা, শিক্ষা এবং শিক্ষা (Ask me my three main priorities for Government and I tell you: education, education and education)। টনি ব্লেয়ার প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন এবং তার কথা অনুযায়ী কাজ করেছিলেন। তাই বৃটেন এখনও একটি শক্তিশালী রাষ্ট্র রূপে বিশ্ব রাজনীতিতে ভূমিকা রাখছে। একই আদর্শে দীক্ষিত ম্যাডাম খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রী থাকার সময়ে এপ্রিল ২০০৬-এ আমেরিকার প্রভাবশালী সাপ্তাহিক টাইম ম্যাগাজিনে একটি ইন্টারভিউ দিয়েছিলেন। সে বিষয়ে টাইম লিখেছিল, (বাংলাদেশে) শতভাগ শিশু স্কুলে ভর্তি হচ্ছে। শিক্ষায় মেয়েরা পাচ্ছে সমান অধিকার। প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার কাছে বিষয়টি অগ্রাধিকার পেয়েছে। একটি রক্ষণশীল মুসলিম দেশের নেত্রী হয়েও এগুলো তিনি লক্ষ্যমাত্রা হিসেবে নির্ধারণ করেছেন। খালেদা সরকারের আমলে চট্টগ্রামে এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ফর উইমেন-এর সূচনা থেকে শুরু করে বাংলাদেশে শিক্ষা ক্ষেত্রে সার্বিক অগ্রগতি ও উন্নতি বিদেশে বহুল প্রশংসিত হয়েছিল। আর আপনারা ডিজিটাল যুগে নিয়ে যাবার স্বপ্ন দেখিয়ে এখন আক্ষরিকভাবেই বাংলাদেশকে অন্ধকার যুগে নিয়ে গিয়েছেন। দেশের অধিকাংশ স্থান চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে বেশির ভাগ সময়ই বিদ্যুতের অভাবে অচল বা অন্ধকার থাকছে। আপনারা ব্যস্ত আছেন হামলা, মামলা, গ্রেফতার, রিমান্ড, টর্চার, জামিন, বিচার, ফাসি, তদন্ত, বদলি, সাসপেন্ড এবং সর্বোপরি ব্যক্তি বন্দনা ও ব্যক্তি পূজা নিয়ে। শিক্ষাকে শুধু অবহেলাই নয়, সর্বশেষ এই ঘোষণা দিয়ে শিক্ষাকে সাময়িক নির্বাসনে পাঠিয়েছেন।
শিক্ষামন্ত্রী (কাচুমাচুভাবে): আমি নিরুপায়।
অভিভাবক: আপনার ঘোষণাটি দুর্বোধ্য বলেছি এই কারণে যে, যদি যানজটের জন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করতে হয় তাহলে শুধু রাজধানীর শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ করলেই হতো। সারা দেশের কেন? আর যদি রোজা রাখার সুবিধায় করা হয় তাহলে সেটা যে আপনাদের সেকুলার নীতির বিরোধী সেটা কি বিবেচনা করেছেন? এখন যদি মেজর জেনারেল সি.আর দত্ত-র নেতৃত্বে হিন্দু-বৌদ্ধ-খৃস্টান ঐক্য পরিষদ তাদের ধর্মীয় উৎসব পালনের সুবিধার্থে আরো দীর্ঘ ছুটি চায় তাহলে আপনারা কি বলবেন? আপনারা কি বিবেচনা করছেন এই দীর্ঘ এক মাস ছুটিতে লক্ষ লক্ষ ছাত্রছাত্রীরা কিভাবে সময় কাটাবে? আর শিক্ষকদের বেতন আমরা অভিভাবকরাই বা কেন দেব? সে যাই হোক। আপনি হয়তো জানেন না, বহু স্কুল কর্তৃপক্ষ ইতিমধ্যেই বলেছেন, তাদের সন্তানদের নিয়ে স্কুলে এসে এক মাসের হোমওয়ার্ক বুঝে নিতে। তবে তারা এটাও বলে দিয়েছেন, ছাত্রছাত্রীদের স্কুল ড্রেস না পরিয়ে সাদা পোশাকে যেন স্কুলে আনা হয়। কাদো বাঙালি, কাদো পোস্টার প্রেরণায় ছাত্রছাত্রীদের কিছু কান্নাকাটি করার জন্য প্রস্তুত করে স্কুলে আনার উপদেশও দিয়েছেন। আশা করি বুঝতেই পারছেন, আওয়ামী ভীতি এখন কোন পর্যায়ে এসেছে।
শিক্ষামন্ত্রী: আই অ্যাম সরি।
অভিভাবক: সরি বললে আমার কোনো লাভ হবে না। আমার ছেলেমেয়ের জন্য বেতনটা ঠিকই স্কুলকে দিতে হবে। অথচ তারা কোনো শিক্ষা পাবে না। সুতরাং নোশিক্ষা মন্ত্রী, যদি আপনি আমার বক্তব্যের সঙ্গে একমত হন এবং যদি আপনি বিশ্বাস করেন শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড, তাহলে আপনি পদত্যাগ করুন।
শিক্ষামন্ত্রী: সেটা সম্ভব নয়। পদত্যাগ করার স্বাধীনতা আমার নেই। আপনি নিশ্চয়ই জানেন ইতিপূর্বে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মি. সোহেল তাজ, যিনি এখন আমেরিকায় আছেন, তার পদত্যাগ নিয়ে কেমন লম্বা নাটক হয়েছিল!
হঠাৎ বাইরের প্রচণ্ড গর্জন ঘরে শোনা গেল। ঘড়ঘড়। ঘড়ঘড়। শিক্ষামন্ত্রী ছুটে গেলেন জানালার দিকে।
শিক্ষামন্ত্রী (ডেস্কে ফিরে এসে সবিস্ময়ে): দেখছি একটা হেলিকপ্টার নেমেছে।
কিছুক্ষণ পরেই হেলিকপ্টারের পাইলট তার ক্রুদের নিয়ে শিক্ষামন্ত্রীর অফিসে এলেন।
হেলিপাইলট: এই দেখুন আমার আইডি কার্ড। আমি ইনডিয়ান এয়ার ফোর্সে কাজ করি। এয়ার এমবুলেন্স চালাই। আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মি. প্রণব মুখার্জি ইমার্জেন্সি কলে এখানে আসতে বলেছেন। আপনাদের পেশেন্ট জাতিকে টৃটমেন্টের জন্য ইনডিয়ান হসপিটালে ট্রান্সফার করার জন্য এয়ার এমবুলেন্স পাঠিয়েছেন।
শিক্ষামন্ত্রী (বিগলিত মুখে): থ্যাংক ইউ সো মাচ। থ্যাংক ইউ।
অভিভাবক (প্রচণ্ড রাগান্বিত মুখে): কি বলছেন আপনি? জাতিকে নিয়ে যাবেন ইনডিয়াতে?
হেলিপাইলট (স্মিত মুখে): আপনাদের বিডিআর তো ফিনিশড। বর্ডার তো আগেই উঠে গেছে। বাংলাদেশ আর ইনডিয়ার মধ্যে সীমারেখা টানার বৃথা চেষ্টা আর করবেন না। আর তাছাড়া এটাও তো সত্যি যে বাংলাদেশের সামর্থবান ব্যক্তিরা টৃটমেন্টের জন্য ইনডিয়াতে যান। জাতির টৃটমেন্টের জন্য যেহেতু আপনার সামর্থ নেই সেহেতু মি. প্রণব মুখার্জি স্বতঃপ্রণোদিত এবং সদয় হয়ে আমাদের এয়ার এমবুলেন্স পাঠিয়েছেন। আমরা আশা করি জাতি সুস্থ হয়ে যাবে এবং পরবর্তীকালে কোলকাতা থেকে কোদাইকানাল পর্যন্ত বিভিন্ন স্কুল-কলেজে পড়তে পারবে। সেইন্ট জেভিয়ার্স স্কুল, হেয়ার স্কুল, মিত্র ইন্সটিটিউশন, প্রেসিডেন্সি কলেজ–এসব জায়গায় জাতি পড়াশোনা করার সুযোগ পাবে। সুতরাং আর দেরি করবেন না। আমাদের সঙ্গে কোঅপারেট করুন। (ক্রুদের প্রতি আঙুল দেখিয়ে) পেশেন্টকে খুব কেয়ারফুলি কপ্টারে ওঠাও।
অভিভাবক হতবাক হয়ে দেখতে লাগলেন এয়ার এমবুলেন্স ক্রুদের কার্যক্রম।
একটু পরেই হেলিকপ্টারের ব্লেডগুলো আবার চরকি খেতে শুরু করলো।
ঘড়ঘড়। ঘড়ঘড়।
প্রচণ্ড শব্দ শুরু হলো।
ধুলাবালি উড়তে লাগলো।
জোরে বাতাস বইতে লাগলো।
হেলিকপ্টার টেক অফ করলো।
১৬ আগস্ট ২০১০
(সম্পূর্ণ কাল্পনিক ঘটনা ও সংবাদ)

বিদেশ যাওয়ার সহজ উপায়…



shafik rehmanস্থান : ইমিগ্রেশন কাউন্টার ও ডিপারচার লাউঞ্জ, বঙ্গবন্ধু ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট, ত্রিশাল। এবং প্রধানমন্ত্রীর অফিস।
কাল : মে ২০১৪-র কোনো এক সকাল ন’টা।
চরিত্র : সাবেক পররাষ্ট্র মন্ত্রী ডা. দীপু মনি ও তার স্বামী এবং সাবেক পরিকল্পনা মন্ত্রী এ কে খন্দকার, ইমিগ্রেশন ক্লার্ক, ইমিগ্রেশন অফিসার, এমিরেটস এয়ারলাইন্স এয়ারপোর্ট ম্যানেজার, প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া ও তার মন্ত্রী সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী।

দৃশ্য : ১
ইমিগ্রেশন কাউন্টারের সামনে কিউ-তে দাড়িয়ে আছেন যথাক্রমে, সাবেক পররাষ্ট্র মন্ত্রী ডা. দীপু মনি ও তার স্বামী এবং সাবেক পরিকল্পনা মন্ত্রী এ কে খন্দকার।
ইমিগ্রেশন ক্লার্ক (সাবেক পররাষ্ট্র মন্ত্রী ডা. দীপু মনির পাসপোর্টের কয়েকটি পাতা উলটিয়ে দেখলেন। তার সামনে রাখা কমপিউটার স্কৃনে কিছু নাম দেখলেন। তারপর ডা. দীপু মনির দিকে তাকালেন) : এক্সকিউজি মি ম্যাডাম। আপনাকে একটু অপেক্ষা করতে হবে।
ডা. দীপু মনি : কেন? পাসপোর্টে কিছু গোলমাল আছে? অথবা ভিসাতে?
ইমিগ্রেশন ক্লার্ক (প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে নিচু গলায় ফোন করলেন তার ওপরওয়ালাকে) : স্যার। আই নিড ইয়োর হেল্প।
ইমিগ্রেশন অফিসার (ইমিগ্রেশন কাউন্টারে মিনিট খানেকের মধ্যে এসে) : কি হয়েছে?
ইমিগ্রেশন ক্লার্ক : স্যার। (ডা. দীপু মনিকে দেখিয়ে) এই পাসপোর্টটা ওনার।
ইমিগ্রেশন অফিসার (পাসপোর্টটা হাতে নিয়ে, নাম দেখে) : ওহ। আই সি। (তারপর ডা. দীপু মনির প্রতি বিনয়সূচক স্বরে) : ম্যাডাম। আপনি আমার সঙ্গে আসুন। (ডিপারচার লাউঞ্জের খালি চেয়ারগুলো দেখিয়ে) এখানে একটু অপেক্ষা করুন। আমি আসছি।
ডা. দীপু মনি (ইমিগ্রেশন কাউন্টার পেরিয়ে লাউঞ্জে ঢুকে) : কিন্তু আমার পাসপোর্ট?
ইমিগ্রেশন অফিসার : আমার কাছে।
ডা. দীপু মনি (ইমিগ্রেশন ক্লার্ককে দেখিয়ে) : ওখানে তো উনি চেকআউট সিল মারেননি।
ইমিগ্রেশন অফিসার (শান্ত ও বিনয়ী স্বরে) : সব ফর্মালিটিজ কমপ্লিট হলে চেকআউট সিল দেয়া হবে। আপনি দয়া করে এখানে একটু ওয়েইট করুন।
ইমিগ্রেশন অফিসার পাসপোর্ট হাতে নিয়ে গটগট করে চলে গেলেন।
ডা. দীপু মনি তার রিস্টওয়াচে সময় দেখলেন।
ঠিক একইভাবে ইমিগ্রেশন ক্লার্কের ফোন কল পেয়ে সেই অফিসার বারবার কাউন্টারে এলেন। অন্যান্য অপেক্ষমাণদের পাসপোর্ট নিলেন। এবং একে একে তাদের ডা. দীপু মনির পাশের চেয়ারগুলোতে তাদের বসিয়ে আবার গটগট করে হেটে উধাও হয়ে গেলেন।
ডা. দীপু মনির পাশে তার স্বামী এবং সাবেক পরিকল্পনা মন্ত্রী এ কে খন্দকার। তিনজনই কিছুটা উদ্বিগ্ন মুখে।
সাবেক পরিকল্পনা মন্ত্রী এ কে খন্দকার (চিন্তিত স্বরে) : আমাদের সবার পাসপোর্ট নিয়ে ওই ইমিগ্রেশন অফিসার কোথায় গেলেন? তাকে তো কোথাও দেখতে পাচ্ছি না।
ডা. দীপু মনি : নিশ্চয়ই ইমিগ্রেশন কনট্রোল রুমে গিয়েছেন তার ওপরওয়ালার সঙ্গে কথা বলতে। (ডা. দীপু মনি তার রিস্টওয়াচ দেখে) এখন সকাল সোয়া ন’টা। আমাদের ফ্লাইট সকাল এগারোটায়। আশা করি এর মধ্যে সব প্রবলেম সলভড হয়ে যাবে।
দৃশ্য : ২
ইমিগ্রেশন লাউঞ্জে অপেক্ষমাণ যাত্রীরা। ডা. দীপু মনি চেয়ারে বসে। বাকি দু’জন হাটাহাটি করছেন।
ডা. দীপু মনি (রিস্টওয়াচ দেখে) : এখন পৌনে দশটা। আধা ঘণ্টা হয়ে গেল। ওই অফিসারটা কোথায় নিখোজ হয়ে গেল? (উঠে দাড়িয়ে) চলুন। আমরা সবাই ইমিগ্রেশন কনট্রোল রুমে যাই। (এ কে খন্দকারের দিকে তাকিয়ে) ইমিগ্রেশন কনট্রোল রুমটা কোথায়?
এ কে খন্দকার : এই সুবিশাল এয়ারপোর্টে সেই রুমটা যে কোথায় তা আমি জানি না।
ডা. দীপু মনি : বলেন কি? পঞ্চাশ হাজার কোটি টাকা খরচ করে অন্য সব প্রায়রিটির আগে, এমনকি বাংলাদেশ বিমানের জন্য নতুন প্লেন কেনার আগে এই এয়ারপোর্ট বানানোর প্ল্যান যখন করেছিলেন তখন তো নিশ্চয়ই দেখেছিলেন। তখন দেখেননি কোথায় ইমিগ্রেশন কনট্রোল রুম হবে?
এ কে খন্দকার (বিব্রতভাবে) : তখন কি আর জানতাম আজ এভাবে এখানে আটকে যাবো? তখন তো আমাদের প্ল্যান ছিল ২০২১ পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকার।
ডা. দীপু মনি : ২০২১ পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকার প্ল্যান কেন করা হয়েছিল? ২০২১-এর পর কি আমরা ক্ষমতা ছেড়ে চলে যেতাম?
এ কে খন্দকার : ওই যে! উনি ফিরে আসছেন কিন্তু ওনার হাতে আমাদের পাসপোর্ট তো দেখছি না।
ইমিগ্রেশন অফিসার (অপেক্ষমাণ যাত্রীদের সামনে এসে) : সরি ম্যাডাম। সরি স্যার। আপনাদের আরো কিছুক্ষণ ওয়েইট করতে হবে।
ডা. দীপু মনি : আমরা আধা ঘণ্টা ওয়েইট করেছি।
ইমিগ্রেশন অফিসার : জানি। কিন্তু আমার কিছু করার নেই। সবই ওপরের নির্দেশ। আপনারা চা-কফি খান। আমি আনিয়ে দিচ্ছি।
ডা. দীপু মনি : চা-কফির দামটা কে দেবে?
ইমিগ্রেশন অফিসার : কেন? আপনারাই দেবেন।
ডা. দীপু মনি : আমরা দেব কেন? আমরা তো চা-কফি খেতে এখানে আসিনি। আমরা সবাই নিউ ইয়র্কে যেতে এখানে এসেছি।
ইমিগ্রেশন অফিসার (হাসি মুখে) : তাহলে দামটা আমিই দিয়ে দেব।
ডা. দীপু মনি (দৃঢ় স্বরে) : না। সেটা হয় না। আপনি কেন আমাদের জন্য আপনার পকেটের টাকা খরচ করবেন? সেটা হয় না। দেখুন আমাদের এখন চা-কফি খাওয়ার কোনো দরকার নেই। প্লেনেই ওরা চা-কফি সার্ভ করবে। আমাদের দরকার পাসপোর্ট এবং বিদেশে যাওয়া।
ইমিগ্রেশন অফিসার (বিনীত ভঙ্গিতে) : অল রাইট ম্যাডাম। আপনারা তাহলে আরেকটু অপেক্ষা করুন।
ইমিগ্রেশন অফিসার আবার গটগট করে অদৃশ্য হয়ে গেলেন।
দৃশ্য : ৩
অপেক্ষমান যাত্রীরা সবাই উদ্বিগ্ন চেহারায়।
ডা. দীপু মনি (রিস্টওয়াচ দেখে) : এখন সোয়া দশটা। ঠিক এক ঘণ্টা হয়ে গেল আমরা অপেক্ষা করছি। আর পয়তাল্লিশ মিনিট পরে আমাদের ফ্লাইট।
এমিরেটস এয়ারলাইন্সের এয়ারপোর্ট ম্যানেজার সশব্যস্ত হয়ে এলেন।
এমিরেটস ম্যানেজার : আপনারা এখানে বসে আছেন কেন? সব প্যাসেঞ্জার তো সিকিউরিটি ক্লিয়ারেন্স করে এখন বোর্ডিং লাউঞ্জে বসে আছেন। শুধু আপনারা তিন জন ছাড়া। প্লিজ, বোর্ডিং গেইট নাম্বার থৃতে আপনারা সবাই আসুন। সিকিউরিটি ক্লিয়ারেন্স করিয়ে নিন। তা নাহলে আমাদের ফ্লাইট টাইমলি ছাড়তে পারবো না। প্লিজ।
ডা. দীপু মনি : আমরা তো যেতেই চাই। কিন্তু আমাদের কারো কাছে আমাদের পাসপোর্ট নেই। ইমিগ্রেশন অফিসার আমাদের সবার পাসপোর্ট নিয়ে গিয়েছেন।
এমিরেটস ম্যানেজার (সবিস্ময়ে) : সে কি! আপনারা তো সবাই মানীগুণী লোক! আপনাদের সবার লাগেজ তো প্লেনে উঠে গেছে। আপনাদের না নিয়ে তো প্লেন এখন টেক অফ করতে পারবে না। আর প্লেন দেরি করে ছাড়লে আপনারা দুবাইয়ে কানেকটিং ফ্লাইট মিস করবেন।
ডা. দীপু মনি : তাহলে দয়া করে আপনি ইমিগ্রেশন কনট্রোল রুমে যান। সেখানে আপনার সমস্যার কথা বলুন।
এমিরেটস ম্যানেজার : নিশ্চয়ই। আমি এখনি যাচ্ছি।
এমিরেটস ম্যানেজার দ্রুত চলে গেলেন।
এ কে খন্দকার (চিন্তিত মুখে) : সম্ভবত নতুন সরকার এসেই একটা ব্ল্যাক লিস্ট তৈরি করেছে। যারা দেশ ছেড়ে যেতে পারবেন না তেমন ব্যক্তিদের নাম ওই লিস্টে আছে।
ডা. দীপু মনি : সেটা হতে পারে। না-ও হতে পারে। এত তাড়াতাড়ি নতুন সরকার একটা ব্ল্যাক লিস্ট বানিয়ে ফেললো! আমাদের টাইমে কি হয়েছিল?
এ কে খন্দকার : আমাদের টাইমে দৈনিক সমকাল পত্রিকায় ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০০৯-এ ‘৬২ ভিআইপির দেশত্যাগ নিষেধ’ শীর্ষক রিপোর্টে প্রথম ব্ল্যাক লিস্টের সংবাদ বেরিয়েছিল। এই রিপোর্টের দ্বিতীয় শিরোনাম ছিল ‘বিমানবন্দরসহ সব ইমিগ্রেশনে তালিকা গেছে, কোনো আওয়ামী লীগ নেতার নাম নেই।’ এর পর দিন দৈনিক আমাদের সময় পত্রিকায় ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০০৯-এ ‘যারা বিদেশ পাড়ি দিতে পারবেন না’ শীর্ষক রিপোর্টে দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা আরোপের দ্বিতীয় সংবাদটি বেরিয়েছিল। তাতে ৪০ জন ভিআইপির নাম ছিল। অর্থাৎ আমরা ক্ষমতায় যাওয়ার দেড় মাস পরেই এসব লিস্টের সংবাদ প্রকাশিত হয়েছিল। তারপর দৈনিক সমকাল-এ ২৭ মার্চ ২০১০-এ সংবাদ বেরিয়েছিল ‘বিমানবন্দরে ২১ জনের তালিকা। বিদেশ ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা।’ আর তারপর দৈনিক আমার দেশ-এ ১৭ সেপ্টেম্বর ২০১০-এ প্রকাশিত সংবাদের শিরোনাম ছিল ‘বিরোধী দলের নেতা এমপি পেশাজীবীকে বিদেশ যেতে বাধা। ৭০ জনের তালিকা বিমানবন্দর ও ইমিগ্রেশন শাখায়।’
ডা. দীপু মনি : হুম। আমাদের টাইমে দেড় মাস পরে ব্ল্যাক লিস্টের খবর বেরিয়েছিল। আর এই নতুন সরকার… এক মাস পরেই…। আমাদের খুব বড় ভুল হয়েছিল। মাত্র ৭০ জনের ব্ল্যাক লিস্ট করা হয়েছিল। ডিসেম্বর ২০০৮-এর নির্বাচনে বিএনপি যাদের ভোট পেয়েছিল সেই প্রায় দুই কোটি ত্রিশ লক্ষ ভোটারদেরই যদি ব্ল্যাক লিস্ট করা হতো এবং তাদের সবাইকে যদি নিষ্ক্রিয় রাখা যেত, বিদেশ ভ্রমণে বাধা দেয়া যেত, তাহলে বিএনপি ২০১৪-এর নির্বাচনে বিজয়ী হতে পারতো না। ভুল হয়ে গেছে। ভুল হয়ে গেছে। ভুল হয়ে গেছে। (একটু চুপ থেকে) আরেকটা ভুল হয়েছে আপনার প্ল্যানিংয়ে এই নতুন এয়ারপোর্টে কোনো বিএলপি ওয়েটিং রুম বানাননি।
এ কে খন্দকার (জিজ্ঞাসু চোখে) : বিএলপি ওয়েটিং রুম?
ডা. দীপু মনি : বিএলপি মানে ব্ল্যাক লিস্টেড পারসন্স (Black listed persons) ওয়েটিং রুম। এখানে ভিভিআইপি, ভিআইপি, সিআইপি রুম আছে। কিন্তু আজকের ভিআইপি যে আগামীকাল বিএলপি হয়ে যেতে পারেন সেই দূরদর্শিতা আপনার ছিল না। তাই বিএলপি রুম নেই। আজ আমরা সবাই বিএলপি! ব্ল্যাক লিস্টেড পারসন! আমাদের জন্য আলাদা একটা রুম থাকলে কতো ভালো হতো!
এ কে খন্দকার : আমরা যদি দুই কোটি ত্রিশ লক্ষ মানুষের ব্ল্যাক লিস্ট বানাতাম আর তাদের যদি দেশত্যাগে বাধা দিতাম তাহলে এই এয়ারপোর্টের কোনো রুমে কি তাদের জায়গা দিতে পারতাম? দেশের বিশাল জায়গা জুড়েই বিএলপি রুম বানাতে হতো। সেটা কি সম্ভব হতো? তাছাড়া ক্ষমতায় যাবার পর থেকে আমাদের প্রতি ভোটারদের সমর্থন কমছিল। সেপ্টেম্বর ২০১০-এ ডেইলি স্টারে প্রকাশিত জনমত জরিপে সেটাই বলা হয়েছিল। তার পরের সোয়া তিন বছরে আওয়ামী লীগের প্রতি জনসমর্থন আরো কমেছিল। বিএনপির প্রতি জনসমর্থন বেড়েছিল। সেক্ষেত্রে দেশের প্রায় অর্ধেক জায়গা জুড়ে বিএলপি রুম বানাতে হতো। বিদেশিরা তখন বলতো আমরা অর্ধেক দেশকে জেলখানা করেছি। সেটা কি ভালো হতো? ওই যে! ইমিগ্রেশন অফিসার আবার আসছেন। তবে তার হাতে আমাদের পাসপোর্ট নেই।
ইমিগ্রেশন অফিসার : কিছু মনে করবেন না। কয়েকটি প্রশ্নের উত্তর দিলে বাধিত হবো। আপনারা সবাই যাচ্ছেন কোথায়?
ডা. দীপু মনি : নিউ ইয়র্কে।
ইমিগ্রেশন অফিসার : কেন?
ডা. দীপু মনি : এবিসি কনভেনশনে যোগ দিতে। এবিসি মানে আমেরিকা-বাংলাদেশ-কানাডা কনভেনশন।
ইমিগ্রেশন অফিসার : আপনি সেখানে কি করবেন?
ডা. দীপু মনি : ‘গণতন্ত্রের উন্নয়নে একদলীয় শাসনের অপরিহার্যতা’ শীর্ষক একটি কি-নোট স্পিচ দেয়ার জন্য আমাকে বলা হয়েছে।
ইমিগ্রেশন অফিসার (ডা. দীপু মনির স্বামীর দিকে ইঙ্গিত করে) : আর উনি?
ডা. দীপু মনি : উনি খুব ভালো বাশি বাজান। আজ প্রায় পঞ্চাশ বছর যাবৎ উনি বাশি বাজাচ্ছেন। এর আগে নিজের বাড়িতে কিছু বিশিষ্ট অতিথিদের সামনে বাশি বাজিয়ে শুনিয়েছেন। এই প্রথম তিনি পাবলিক ফাংশনে, নিউ ইয়র্কের এবিসি কনভেনশনে, বাশি বাজাবেন।
ইমিগ্রেশন অফিসার : আর স্যার, আপনি যাচ্ছেন কেন?
এ কে খন্দকার : আমি একজন মুক্তিযোদ্ধা। আমি ওই কনভেনশনে মুক্তিযোদ্ধাদের সম্পর্কে সত্য ইতিহাস বলার আমন্ত্রণ পেয়েছি। সেটা বলতেই যাচ্ছি।
ইমিগ্রেশন অফিসার (উৎসাহিত স্বরে) : খুব ভালো কথা স্যার। মুক্তিযুদ্ধের সময়ে আমরা খুব ছোট ছিলাম। কোন মুক্তিযোদ্ধা তখন কি করেছিলেন আমরা এই প্রজন্ম সে বিষয়ে সত্য কথাটা জানতে পারছি না। আপনারা যখন গত পাচ বছর ক্ষমতায় ছিলেন তখন জেনেছিলাম, বঙ্গবন্ধু নয় মাস পশ্চিম পাকিস্তানে বন্দি ছিলেন। সেজন্য তিনি পরবর্তী সময়ে নন্দিত হয়েছিলেন, যদিও তিনি মুক্তিযুদ্ধে অনুপস্থিত ছিলেন। আর উল্টো দিকে জিয়াউর রহমান নয় মাস বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধে উপস্থিত ছিলেন পাকিস্তানের চর হিসাবে। সে জন্য তিনি আপনাদের সময়ে গত পাচ বছরে নিন্দিত হয়েছিলেন। এবার আপনি সাহস করে সত্যটা বলবেন কি?
এ কে খন্দকার (প্রশ্নের উত্তর এড়িয়ে) : আমার যথেষ্ট বয়স হয়েছে। আসলে আমি এবিসি কনভেনশনে যাবার সুযোগটা নিচ্ছি নিউ ইয়র্কে একটা মেডিকাল চেকআপ করাতে।
ইমিগ্রেশন অফিসার : থ্যাংক ইউ ম্যাডাম। থ্যাংক ইউ স্যার। আপনারা দয়া করে আরেকটু অপেক্ষা করুন। বোঝেনই তো সবই ওপরের নির্দেশ।
এ কে খন্দকার (বিরক্ত মুখে) : ওপরের নির্দেশ! আপনার ওপরওয়ালা। তার ওপরওয়ালা। তার ওপরওয়ালা। তারপর স্বরাষ্ট্র সচিব। তারপর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী। তারপর প্রধানমন্ত্রী। সেই তো? এই তো চূড়ান্ত ওপরওয়ালা?
ইমিগ্রেশন অফিসার : আমি ছোট মানুষ। আমি সব জানি না। আপনি যা বললেন, তা হতে পারে। আপনাদের মতো ভিআইপিদের আসা-যাওয়ার সময়ে আমাদের অ্যালার্ট থাকার নির্দেশ দেয়া আছে। আমরা অ্যালার্ট থাকি। তারপর রিপোর্ট করি। এটুকুই আমাদের কাজ। ওপরে যারা আছেন তারাই ডিসিশন নেন। আমাদের কিছুই করার নেই। এটা নিশ্চয়ই আপনারা ভালো বোঝেন। আপনারা তো ক্ষমতায় ছিলেন এই সেদিন পর্যন্ত।
এ কে খন্দকার (বিষন্ন মুখে) : হ্যা। আর কতোক্ষণ লাগবে মনে হয় আপনার? এগারোটা তো প্রায় বাজতে চললো।
ইমিগ্রেশন অফিসার : উই আর ট্রাইয়িং আওয়ার বেস্ট। প্লিজ, আরেকটু ওয়েইট করুন।
ইমিগ্রেশন অফিসার গটগট করে হেটে অদৃশ্য হয়ে গেলেন।
দৃশ্য : ৪
প্রধানমন্ত্রীর অফিস
প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া : এয়ারপোর্ট ইমিগ্রেশন কনট্রোল তিনজনকে আটকে রেখেছে। ডা. দীপু মনি ও তার স্বামী এবং এ কে খন্দকারকে। ওরা জানিয়েছে আরো তিনজনকে আটকাতে যাচ্ছে। রিহ্যাবের সাবেক সভাপতি ও সাবেক এমপি নসরুল হামিদ, কবি নির্মলেন্দু গুণ এবং কবি মহাদেব সাহাকে। এসব কেন হচ্ছে ওখানে?
মন্ত্রী সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী : ম্যাডাম, আমি সঠিক জানি না কেন হচ্ছে। গত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে প্রায়ই নতুন নতুন ব্ল্যাক লিস্ট তৈরি করা হতো। সেই ব্ল্যাক লিস্টে যাদের নাম থাকতো তাদের বিদেশ যেতে দেয়া হতো না।
প্রধানমন্ত্রী খালেদা : আমি জানি। ওদের আগে আমরা যখন পাওয়ারে ছিলাম তখন কি হয়েছিল?
সাকা চৌধুরী : ও রকম কোনো লিস্ট ছিল না। তবে আমাদের গত আমলে বড় জোর দশজনকে বিদেশে যেতে বাধা দেয়া হয়েছিল।
খালেদা : আওয়ামী লীগের আমলে কাদের যেতে বাধা দিয়ে লিস্ট বেরিয়েছিল?
সাকাচৌ : ১৭ সেপ্টেম্বর ২০১০-এর একটি লিস্টের নামগুলো আপনাকে পড়ে শোনাচ্ছি :
বিএনপি নেতাদের মধ্যে এই লিস্টে ছিলেন সাবেক পররাষ্ট্র সচিব ও বিএনপি উপদেষ্টা রিয়াজ রহমান, ড্যাব মহাসচিব ও চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ডা. এ জেড এম জাহিদ হোসেন, খালেদা জিয়ার ভাগ্নে ইঞ্জিনিয়ার শাহরীন ইসলাম তুহিন, সাবেক প্রতিমন্ত্রী ও যুগ্ম মহাসচিব আমানউল্লাহ আমান, সাবেক প্রতিমন্ত্রী ও যুগ্ম মহাসচিব সালাহউদ্দিন আহমেদ, সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর (তখন কারাবন্দি), সাবেক এমপি নাসিরউদ্দিন আহম্মেদ পিন্টু (তখন কারাবন্দি), সাবেক পররাষ্ট্র সচিব ও বিএনপি ভাইস চেয়ারম্যান শমসের মবিন চৌধুরী, সংরক্ষিত আসনের এমপি সৈয়দা আসিফা আশরাফি পাপিয়া, যুবদল সভাপতি সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল, জাগপা সভাপতি শফিউল আলম প্রধান, বিএনপি যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবীর রিজভী আহমেদ, স্বনির্ভর বিষয়ক সম্পাদক রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলু, ছাত্রদল সভাপতি সুলতান সালাউদ্দিন টুকু ও বিরোধীদলীয় চিফ হুইপ জয়নুল আবদিন ফারুক।
আইনজীবীদের মধ্যে ছিলেন সাবেক এমপি অ্যাডভোকেট শেখ আনসার আলী, ব্যারিস্টার আবদুর রাজ্জাক, ব্যারিস্টার মাহবুবউদ্দিন হোসেন, ঢাকা বার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি অ্যাডভোকেট সানাউল্লাহ মিয়া, ব্যারিস্টার নাসিরউদ্দিন আহমেদ অসীম, সুপ্রিম কোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন।
সাংবাদিকদের মধ্যে ছিলেন, সাবেক জ্বালানি উপদেষ্টা ও আমার দেশের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মাহমুদুর রহমান (তখন কারাবন্দি), বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ও জাতীয় প্রেসক্লাবের সভাপতি শওকত মাহমুদ, বিশিষ্ট সাংবাদিক আতাউস সামাদ, কলামিস্ট ফরহাদ মজহার এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি প্রফেসর ডা. এম মনিরুজ্জামান মিঞা।
অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তাদের মধ্যে ছিলেন, এনএসআইর সাবেক ডিজি মেজর জেনারেল (অব.) রেজ্জাকুল হায়দার চৌধুরী (তখন কারাবন্দি), আনসার এবং ডিজিএফআইর সাবেক ডিজি মেজর জেনারেল (অব.) এ টি এম আমিন, জামায়াতের সাবেক আমির গোলাম আযমের ছেলে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আবদুল্লাহ আমান আল আজমী, এনএসআইর সাবেক ডিজি ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আবদুর রহিম (তখন কারাবন্দি), খালেদা জিয়ার ভাই মেজর (অব.) সাঈদ এস্কান্দার, সাবেক মন্ত্রী এয়ার ভাইস মার্শাল (অব.) আলতাফ হোসেন চৌধুরী, ডিজিএফআইর সাবেক পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) চৌধুরী ফজলুল বারী।
ব্যবসায়ীদের মধ্যে ছিলেন, জামায়াতের ফরেন ফাইনান্স দেখাশোনার দায়িত্বে নিয়োজিত মো. জাকারিয়া, দিগন্ত টিভির মালিক মীর কাসেম আলী, চ্যানেল ওয়ানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক গিয়াসউদ্দিন আল মামুন, এনটিভির মালিক ও সাবেক এমপি মোসাদ্দেক আলী ফালু এবং চ্যানেল ওয়ানের পরিচালক প্রফেসর মাজেদুল ইসলাম প্রমুখ।
খালেদা (গম্ভীর মুখে) : হ্যা। ওই সময়ে আমাদের পার্টির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কেউ হলে অথবা পার্টির প্রতি কেউ সহানুভূতিশীল হলে তার এই রকম ব্ল্যাক লিস্টেড হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা ছিল। এখন বলুন। যে তিন জনকে এয়ারপোর্ট ইমিগ্রেশন আটকেছে এবং আরো যে তিনজনকে আটকাতে যাচ্ছে, তাদের বিষয়ে আমাদের কি ডিসিশন নেয়া উচিত?
সাকাচৌ : আওয়ামী লীগের আমলে আমাদের সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী রিয়াজ রহমানকে সস্ত্রীক দুই বার এয়ারপোর্ট থেকে ফিরিয়ে দেয়া হয়েছিল।
খালেদা : রিয়াজ রহমান ভুল করেছিলেন। তার উচিত ছিল প্রথমবার আটকে যাবার পর হাই কোর্টের রুলিং নিয়ে দ্বিতীয় বার এয়ারপোর্টে যাওয়া। সেটা তিনি করেননি। সাবেক রাষ্ট্রদূত শমসের মবিন চৌধুরী সেটা করেছিলেন। তাই সেপ্টেম্বর ২০১০-এ তিনি ওমরাহ করতে সউদি আরবে যেতে পেরেছিলেন।
সাকাচৌ : হ্যা। ওই সময়ে হাই কোর্টের রুলিং নিয়ে সেকেন্ড অ্যাটেম্পটে বিদেশ যাওয়াটা একটা সিসটেমে পরিণত হয়েছিল। ব্যারিস্টার মাহবুবউদ্দিন খোকন এমপিও তাই করেছিলেন। সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী রিয়াজ রহমানের মতো নির্বিবাদী ভদ্রলোক ভূ-ভারতে আর একজনও নেই! তাকেও সস্ত্রীক ঝামেলা পোহাতে হয়েছিল। এখন যদি আমরা সেই ঘটনার প্রতিশোধ নিতে চাই তাহলে সাবেক পররাষ্ট্র মন্ত্রী ডা. দীপু মনিকে তার স্বামীসহ আটকে দিতে পারি।
খালেদা : আপনি ভূ-ভারতে বললেন! হয়তো ভূ-পাকিস্তানে বলতে চেয়েছিলেন। ওরা তো আপনাকে পাকিস্তানের এজেন্ট বলে!
সাকাচৌ : শহীদ জিয়াকে যখন ওরা পাকিস্তানের চর বলে তখন আমার পাকিস্তানের এজেন্ট হতে কোনো আপত্তি নেই।
খালেদা : সে যাই হোক। এবার বলুন এ কে খন্দকার বিষয়ে। তিনি তো একজন মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন।
সাকাচৌ : তিনি অবশ্য এরশাদের উপদেষ্টাও ছিলেন। তার নৈতিকতা নিয়ে আমি কোনো কথা বলতে চাই না। তবে, তিনি মেডিকাল গ্রাউন্ডে নিউ ইয়র্কে যেতে চাইছেন। এখানে মনে করিয়ে দিতে পারি, শমসের মবিন চৌধুরীও মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। আমাদের গত আমলের সাবেক তথ্যমন্ত্রী শামসুল ইসলামকেও চিকিৎসার জন্য সিঙ্গাপুরে যেতে বাধা দেয়া হয়েছিল।
খালেদা : রিহ্যাবের সাবেক সভাপতি নসরুল হামিদ সম্পর্কে বলুন। তিনি নিউ ইয়র্কে গেলে নিশ্চয়ই হাউজিং সেক্টরে বাংলাদেশের উপকার হবে।
সাকাচৌ : তা হবে। তবে এখানে মনে করা যেতে পারে মাহমুদুর রহমান, যিনি লেখালেখি ও পত্রিকা সম্পাদনা ছাড়াও সিরামিক ইনডাস্টৃর সঙ্গে ওতোপ্রতোভাবে জড়িত, তাকেও ব্যবসায়িক টৃপে জার্মানিতে যেতে বাধা দিয়েছিল গত আওয়ামী সরকার। তাতে তার ব্যবসার এবং বাংলাদেশেরও বটে, বেশ ক্ষতি হয়েছিল।
খালেদা : কবি নির্মলেন্দু গুণ আর কবি মহাদেব সাহার কথা বলুন। এরা তো রাজনীতির বাইরে।
সাকাচৌ : আওয়ামী লীগের আমলে সেপ্টেম্বর ২০১০-এর ব্ল্যাক লিস্টে দুজন লেখক, আতাউস সামাদ এবং ফরহাদ মজহার-এর নাম ছিল। প্রতিশোধ নিতে চাইলে এখন দুজন কবিকে আটকে দেয়ার যুক্তিটা সঙ্গত মনে হতে পারে।
খালেদা : না। আমি মনে করি যুক্তিটা সঙ্গত হবে না। আমি মনে করি ইতিহাস থেকে আমাদের শিক্ষা নিতে হবে। আমরা ক্ষমতায় এসেছি মাসখানেক হয়। আমরা কোনো ব্ল্যাক লিস্ট করিনি। করবোও না। আমরা যদি এখন ব্ল্যাক লিস্ট করি তাহলে ভবিষ্যতে ডা. দীপু মনি আর এ কে খন্দকারের মতোই আপনিও বিপদে পড়তে পারেন।
সাকাচৌ : তা ঠিক ম্যাডাম। অবশ্য যদি পাচ বছর পরের নির্বাচনে আমরা হেরে যাই।
খালেদা : এয়ারপোর্ট ইমিগ্রেশন কনট্রোল নিজেরা অতি উৎসাহী হয়ে এসব করছে।
সাকাচৌ : ওদের দোষ দেবেন না ম্যাডাম। আওয়ামী আমলে ওরা ব্ল্যাক লিস্ট দেখে কাজ করতে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিল। ওরা মনে করছে আমরাও এখন নতুন একটা লিস্ট পাঠাবো।
খালেদা : না। আমরা কোনো লিস্ট করবো না। ফৃডম অফ মুভমেন্ট বা চলাফেরার স্বাধীনতা মানুষের একটা মৌলিক অধিকার। ওদের সবাইকে ছেড়ে দিতে এবং সসম্মানে প্লেনে উঠিয়ে দিতে বলুন। ইতিহাস থেকে আমাদের শিক্ষা নিতে হবে। নইলে বাংলাদেশ একইভাবে চলতে থাকবে। সেটা হয় না। এই ভিশাস সার্কল ভাংতে হবে। প্রতিশোধ ও প্রতিহিংসার রাজনীতির চাকা বন্ধ করতে হবে।
সাকাচৌ : আপনি যথার্থই বলেছেন ম্যাডাম। আমি এখনই এয়ারপোর্ট ইমিগ্রেশন কনট্রোলে ফোন করে দিচ্ছি।
দৃশ্য : ৫
এয়ারপোর্ট ডিপারচার লাউঞ্জ
ডা. দীপু মনি (রিস্টওয়াচ দেখে হতাশ স্বরে) : প্লেন টেক অফ করার আর মাত্র দশ মিনিট বাকি আছে। আমাদের যাওয়া বোধ হয় আর হলো না।
এ কে খন্দকার : ওই যে! এমিরেটসের ম্যানেজারের সঙ্গে ইমিগ্রেশন অফিসার আসছেন। তার হাতে পাসপোর্ট দেখছি।
ইমিগ্রেশন অফিসার (কাছে এসে) : সরি। অনেক দেরি হয়ে গেল। এই যে আপনাদের পাসপোর্ট। সব পাসপোর্টে ডিপারচার সিল দেয়া হয়েছে। আপনাদের যাত্রা শুভ হোক।
এমিরেটস ম্যানেজার (ব্যগ্র স্বরে) : চলুন সবাই তাড়াতাড়ি।
ডা. দীপু মনি (হাফ ছেড়ে) : চলুন সবাই। (এ কে খন্দকারের প্রতি) ইতিহাস থেকে আমাদের শিক্ষা নিতে হবে। বিএনপি আবার ভুল করলো এবং আরো ভুল করবে। এভাবে ওরা ভুল করলে আমরা অবশ্যই আবার ক্ষমতায় ফিরে আসবো। তখন আমাদের আর বিএলপি ওয়েটিং রুমের দরকার হবে না। সুতরাং ওই প্রসঙ্গটা ভুলে যান মি. খন্দকার।
এ কে খন্দকার (স্মিত মুখে) : ঠিকই বলেছেন। হিস্টৃ উইল রিপিট ইটসেলফ। ইতিহাসের চাকা একইভাবে ঘুরবে। আমরা আবার ক্ষমতায় ফিরে আসবো।
তারা তিনজন বোর্ডিং লাউঞ্জের দিকে দ্রুত হাটা শুরু করলেন।
১৮.০৯.২০১০
(সংলাপ, ঘটনা ও চরিত্র সম্পূর্ণ কাল্পনিক।)
(বানানরীতি লেখকের। বি. স.)

নেড়ি কুকুরের ভাষণ: অবিচার যখন হয় আইন



shafik-rehmanউপস্থিত মানুষবৃন্দ
এখানে স্যুট-টাই পরে এলেও আসলে আমি একটি নেড়ি কুকুর। সাধারণত আমি ইন্টারভিউ দিয়ে থাকি। কিন্তু কোনো গোলটেবিল আলোচনায় অংশ নেয়ার অভিজ্ঞতা এই প্রথম হচ্ছে আমার। আমার এই ধরনের অভূতপূর্ব উপস্থিতির জন্য সম্পূর্ণ কৃতিত্ব দাবি করতে পারেন, আজকের এই গোলটেবিল আলোচনার আয়োজক এনার্জি সলিউশন অফ বাংলাদেশ বা সংক্ষেপে ইএসবি নামের প্রতিষ্ঠান এবং কয়েকজন উদ্যমী সাংবাদিক। এরাই আমাকে নিয়ে এসেছেন আপনাদের মতো সুধী ও বিশিষ্ট মানুষজনের সামনে। আপনারা জানতে চাইতে পারেন, এমন অপ্রত্যাশিত ঘটনাটি কিভাবে ঘটল? কেন এমন একটি গুণী মানুষের সমাবেশে একটা নেড়ি কুকুরের আবির্ভাব ঘটলো?
আপনাদের কৌতূহল নিবৃত্তির জন্য আমি এই ঘটনার পেছনের ঘটনাটির কথা বলছি।

দিন পাঁচেক আগে আমি আমার অভ্যাস মতো খাবারের খোঁজে ডাস্টবিনের পাশে ঘুরঘুর করছিলাম। হঠাৎ কয়েকজন সাংবাদিক আমাকে ঘেরাও করে বললেন, শুক্রবার, তেসরা ডিসেম্বরে, আপনাকে প্রেস ক্লাবে একটা প্রবন্ধ উপস্থাপন করতে হবে, যার টাইটেল হবে, গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতা।
আমি তাদের বললাম, কুকুর জাতির মধ্যে গণতন্ত্র বলে কিছু নেই, কুকুরাধিকার বলে কিছু নেই এবং আমাদের কোনো কুকুর মাধ্যম বা কুকুরমিডিয়া নেই। মোট কথা, এই বিষয়টি সম্পর্কে আমার কোনো জ্ঞান নেই। সুতরাং আমি প্রেস ক্লাবে যাবো না এবং কোনো প্রবন্ধ পাঠ করব না। ওই সাংবাদিকরা ছিলেন নাছোড়বান্দা। তারা খুব অনুনয়-বিনুনয় করতে থাকলেন। আমি তখন জানতে চাইলাম, কেন তারা কোনো মানুষকে দিয়ে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করাচ্ছেন না। তাদের উত্তর শুনে আমি অবাক হয়ে গেলাম।
তারা সবাই একবাক্যে বললেন, নির্দিষ্ট বিষয়টি নিয়ে মূল প্রবন্ধ লেখা ও পড়ার জন্য কোনো মানুষকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। কারণ ৩০ নভেম্বর বিরোধী দল বিএনপি আহূত হরতালের কারণে বহু বিশিষ্ট ও গুণী মানুষকে বাড়ির বাইরে কাটাতে হচ্ছে। যেকোনো সময় তাদের যেকোনো স্থানে পুলিশ গ্রেফতার করতে পারে এই আতঙ্কে তারা সবাই নিজের শহরেই পলাতক জীবনযাপন করছেন। বিএনপি’র নেতা মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের বাড়িতে পুলিশ আগেভাগেই হানা দিয়েছিল। তাকে তারা পায়নি। কিন্তু তার অভিজ্ঞতার পরে গণতন্ত্রকামী অথচ বিরোধী মতাবলম্বী অথবা ভিন্ন মতাবলম্বী মানুষরা নিজেদের বাড়ির বাইরে থাকছেন। তারা সবাই ঠিকানাবিহীন হয়ে গেছেন। সুতরাং তারা আমার পার্মানেন্ট ঠিকানা, অর্থাৎ প্রযত্নে ডাস্টবিনে এসেছেন এবং আমাকে পেয়েছেন।
তাদের এই দুর্গতি জেনে আমি রাজি হলাম। তবে আমি আমার দুর্বলতা অর্থাৎ গণতন্ত্র বিষয়ে আমার জ্ঞানের সীমাবদ্ধতার কথা বললাম। আমি আবারও বললাম, আমাদের কোনো কুকুরতন্ত্র নেই, কোনো কুকুরাধিকার নেই। আর বাকস্বাধীনতার প্রশ্নই ওঠে না। আমরা তো কথা বলতে পারি না। আমরা শুধু ঘেউ ঘেউ করতে পারি। সিনিয়র সাংবাদিক একজন নির্ভয় দিয়ে বললেন, আপনি আমেরিকার ষোড়শতম প্রেসিডেন্ট এব্রাহাম লিংকনের জীবনীটা পড়ে নেবেন। লিংকন ১৮৬১ থেকে ১৮৬৫ পর্যন্ত আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ছিলেন। তিনি এক সন্ধ্যায় থিয়েটার হলে নাটক দেখার সময় আততায়ীর গুলিতে নিহত হয়েছিলেন। বুঝলাম, প্রায় দেড় শ’ বছর আগে গণতন্ত্র আমেরিকায় যেমন বিপজ্জনক ছিল, ঠিক তেমনি এখন, প্রায় দেড় শ’ বছর পরে বাংলাদেশে গণতন্ত্র বিপজ্জনক অবস্থায় আছে।
গণতন্ত্র
বিষয়টি নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে আমার এই ধারণা বদ্ধমূল হলো। লিংকন গুলিতে মারা গিয়েছিলেন। কিন্তু বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক আন্দোলনে মানুষ মারা যাচ্ছে প্রাচীন অস্ত্র, লাঠি-বৈঠা-লগির আঘাতে এবং আধুনিক অস্ত্র মোটরসাইকেল হামলায়। মানুষ মারা যাচ্ছে রাজধানী ঢাকায়। মানুষ মারা যাচ্ছে মফস্বল শহর নাটোরে। এমনকি মানুষ মারা যাচ্ছে ট্রেনে কাটা পড়ে, যেমন সিরাজগঞ্জে। তাদের দুর্ভাগ্য, তারা বিরোধী দল বিএনপি’র আহূত একটি গণতান্ত্রিক সমাবেশের পাশ দিয়ে চলাচলকারী ট্রেনের কাছাকাছি ছিলেন।
মানুষ মারা যাচ্ছে, মানুষ পিটুনি খাচ্ছে, মানুষ বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে থাকছে। কেউ কেউ ধরা পড়ছে হাজতে থাকছে। রিমান্ডে নির্যাতিত অথবা বিবস্ত্র হচ্ছে, জেলে থাকছে। এই হলো বিরোধী মতাবলম্বী এবং ভিন্ন মতাবলম্বীদের অভিজ্ঞতা বর্তমানের গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশে।
এটাই কি গণতন্ত্র? তাহলে এব্রাহাম লিংকন কি বলেছিলেন, যার জন্য মানবজাতি এত আকুলি-বিকুলি করে গণতন্ত্র চায়?
খোঁজ নিয়ে জানলাম, ১৮৬৩ সালে গেটিসবার্গ শহরে এব্রাহাম লিংকন একটি অনুপ্রাণিত ভাষণে বলেছিলেন,
That this nation, under God, shall have a new birth of freedom : and that government of the people, by the people and for the people, shall not perish from the earth.
অর্থাৎ, ঈশ্বরের অধীনে, এই জাতি তার মুক্তির একটি নতুন জন্ম পাবে : সেখানে থাকবে জনগণের জন্য, জনগণের দ্বারা, জনগণের সরকার এবং এই জাতি পৃথিবীতে ধ্বংস হবে না।
কেউ কেউ মনে করেন লিংকনের এই উক্তিই গণতন্ত্রের ডেফিনেশন বা সংজ্ঞা।
এই সংজ্ঞায় আমি সন্তুষ্ট হতে পারলাম না। বাংলাদেশের অবস্থা লিংকনের ডেফিনেশনের সঙ্গে তো মিলছে না।
আরো খোঁজাখুঁজির পর বাংলাদেশের জন্য প্রযোজ্য হতে পারে গণতন্ত্রের এমন ডেফিনেশনটি পেলাম।
আইরিশ লেখক অস্কার ওয়াইল্ড, যার মৃত্যু হয়েছিল মাত্র ৪৬ বছর বয়সে ১৯০০ সালে। তিনি ১৮৯৫ সালে ”The soul of man under socialism’ নিবন্ধে লিখেছিলেন :
Democracy means simply the bludgeoning of the people by the people for the people.
অর্থাৎ, গণতন্ত্র মানে, সোজা কথায়, জনগণের জন্য জনগণের দ্বারা জনগণকে লাঠিপেটা করা।
অস্কার ওয়াইল্ড সেই ১১৫ বছর আগে জানলেন না যে, বাংলাদেশ নামে একটি রাষ্ট্রের অভ্যুদয় হবে এবং সেখানে থাকবে আওয়ামী লীগ নামে একটি রাজনৈতিক দল, যে দলটি সত্যিই লাঠিপেটানোর গণতন্ত্র চালু করবে। অস্কার ওয়াইল্ড জানতেন না যে, ৩০ নভেম্বর ২০১০-এ বিএনপি আহূত হরতালে তারই কথা আবারও বাংলাদেশে সত্য হবে পুলিশ বেধড়ক লাঠিপেটা করবে।
কিন্তু এমন অবস্থাতেও যখন পুলিশের নিয়ন্ত্রক আওয়ামী লীগ সরকার তথা আওয়ামী লীগ দাবি করে, দেশে গণতন্ত্র আছে এবং তাদের দলই গণতন্ত্রের ধারক-বাহক, তখন, আমি নেড়ি কুকুর, কনফিউসড হয়ে গেলাম। বিভ্রান্তিতে পড়লাম। আসলেই বাংলাদেশে গণতন্ত্র বলতে কি বোঝায়?
বাংলাদেশের ইতিহাস পড়ে জানলাম ২৫ জানুয়ারি ১৯৭৫-সালে সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে দেশে রাতারাতি সংসদীয় সরকার পদ্ধতির বদলে প্রেসিডেন্ট শাসিত সরকার পদ্ধতি চালু হয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান হন প্রেসিডেন্ট শেখ মুজিবুর রহমান। বহুদলীয় গণতন্ত্রের বদলে দেশে একদলীয় শাসন ব্যবস্থা চালু হয়। সব দলের অস্তিত্ব বিলুপ্ত করে বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ, সংক্ষেপে বাকশাল নামে একটি মাত্র দল গঠন করা হয়। চতুর্থ সংশোধনীতে আরো বলা হয়, জাতীয় দল <অর্থাৎ বাকশাল> গঠনের পর সব সংসদ সদস্যকে বাধ্যতামূলকভাবে এই দলের সদস্য হতে হবে।
কেউ সদস্য না হলে, সংসদে তার আসন শূন্য হবে এবং জাতীয় দলের প্রার্থী না হলে তিনি প্রেসিডেন্ট বা সংসদ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারবেন না।
১৯৭৫ থেকে ২০১০। আবারও আওয়ামী লীগ ৩৫ বছর পরে সেদিকেই এগিয়ে গেছে। কোনো বিরোধী মতামত গ্রাহ্য করা হচ্ছে না। বিরোধী দলের কর্মসূচি সহ্য করা হচ্ছে না। বস্তুত ঠিক ৩৫ বছর আগের মতোই প্রধান বিরোধী দলটিকে বিলুপ্ত করার চেষ্টা চলছে। তাই বিএনপি’র প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানকে বলা হয়েছে তিনি ছিলেন পাকিস্তানের চর। কি আশ্চর্য ইতিহাস! যিনি নয় মাস যুদ্ধ করেছিলেন পাকিস্তানের বিরুদ্ধে, তিনি হচ্ছেন নিন্দিত। আর যিনি পাকিস্তানে নয় মাস বন্দী ছিলেন, শুধু তিনিই হচ্ছেন নন্দিত। শুধু তাই নয়। এখন বলা হচ্ছে, বাকশালের একদলীয় শাসনও ছিল এক ধরনের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা।
আওয়ামী লীগেরই সহযাত্রী দল জেনারেল হুসাইন মুহম্মদ এরশাদও প্রায় একই ধারণা করেন। জাতীয় পার্টির প্রতিষ্ঠাতা জেনারেল এরশাদও মনে করেন, তিনিও ছিলেন গণতন্ত্রের একনিষ্ঠ সেবক। তাই ৬ ডিসেম্বর ১৯৯০ সালে তার স্বৈরাচারী সরকারের পতন দিবসটিকে তিনি ঘোষণা করেছেন সংবিধান রক্ষা দিবস হিসেবে।
অর্থাৎ, বাংলাদেশে জোর যার, গণতন্ত্রের ডেফিনেশন তার। ক্ষমতায় যিনি বা যারা থাকবেন তারাই ঠিক করে দেবেন গণতন্ত্র কি।
সম্পাদক ও লেখক মি. মাহমুদুর রহমান বিরোধী অবস্থানে থেকে গণতান্ত্রিক অধিকার চর্চা করতে গিয়ে বিপদে পড়েছেন। তার জন্য আমি দুঃখ বোধ করছি। একসময় তিনি ক্ষমতাসীন বিএনপি’র সঙ্গে ছিলেন। ভোল পালটে তিনি যদি ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সঙ্গে ভিড়ে যেতেন, তা হলে তার এই দুঃসময় হতো না। আওয়ামী লীগ মন্ত্রিসভার মধ্যেই ভোল পাল্টানো মানুষ আছেন, যারা একসময় অন্য দল করতেন অথবা এরশাদের মন্ত্রী ছিলেন।
সে যাই হোক। অন্যান্য দেশে গণতন্ত্রের কি অবস্থা জানার জন্য আরো কিছু খোঁজ-খবর নিলাম।
জানলাম বৃটিশ মডেল গণতন্ত্রে কোনো সংবিধান নেই। বৃটিশ প্রজাদের ভক্তি রাজতন্ত্রে। তাদের আসক্তি বিয়ারে এবং আবেগ ফুটবলতন্ত্রে যদিও তারা গতকাল খুব হতাশ হয়েছে। ২০১৮-এর ওয়ার্ল্ড কাপ ফুটবল তাদের দেশে করার প্রস্তাবটি ফিফা নাকচ করে দিয়েছে। বৃটিশ গণতন্ত্রের প্রকাশ পার্লামেন্টে।
আরো জানলাম আমেরিকান মডেল গণতন্ত্রে সংবিধান আছে। বস্তুত আমেরিকাই প্রথম সাংবিধানিক গণতন্ত্র চালু করেছিল। সংবিধানটি রচনা করেছিলেন টমাস জেফারসন যিনি ছিলেন আমেরিকার তৃতীয় প্রেসিডেন্ট। তবে বর্তমানে আমেরিকানদের শ্রদ্ধা ডলার ধনতন্ত্রে, লোভ মিডল ইস্ট তেলে এবং আসক্তি ফাস্ট ফুডে। তাদের গণতন্ত্রের প্রকাশ কংগ্রেসে।
এক দিকে বৃটিশ পার্লামেন্টারি ও প্রাইম মিনিস্টার ফর্ম ডেমক্রেসি এবং অন্য দিকে আমেরিকান কংগ্রেস ও প্রেসিডেনশিয়াল ফর্ম ডেমক্রেসির মধ্যে রয়েছে বিশ্বের প্রায় সোয়া শ’ দেশে একেক ধরনের গণতন্ত্র। কোনোটা স্ট্রং ডেমক্রেসি। কোনোটা উইক ডেমক্রেসি। কোনোটা লিবারাল ডেমক্রেসি। কোনোটা ইল-লিবারাল ডেমক্রেসি। এদেরই মধ্যে কোনো এক অবস্থানে আছে আজকের বাংলাদেশ। যেখানে মাহমুদুর রহমান আছেন কাশিমপুর জেলখানায়। তার দোষটা কি ছিল? তিনি কিছু সত্য প্রকাশ করেছিলেন ক্ষমতাসীন দলের দুর্নীতি সম্পর্কে এবং কিছু বহুল প্রচলিত মতামত প্রকাশ করেছিলেন ক্ষমতাসীন দলের সাজানো আদালত সম্পর্কে। এসব কথা প্রকাশের অধিকার কি মাহমুদুর রহমানের ছিল না?
মানবাধিকার
এই প্রশ্নের উত্তর পেতে আমি মানবাধিকার বিষয়ে খোঁজ-খবর নিলাম। পড়লাম ইউএনডিপি প্রকাশিত জাতিসঙ্ঘের সর্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণাপত্রটি।
আপনাদের হয়তো মনে পড়বে, ইউএনডিপি বাংলাদেশের এক সময়ের অধিকর্তা মিজ রেনেটা লক-এর সঙ্গে মাহমুদুর রহমানের আদা-কাঁচকলার সম্পর্ক ছিল। কিন্তু তার চাইতে ইন্টারেস্টিং বিষয় হচ্ছে, সাম্প্রতিক বাংলাদেশে ওই সর্বজনীন মানবাধিকারগুলোর অধিকাংশ কম-বেশি লংঘিত হচ্ছে।
বর্তমান বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে মানবাধিকার বলতে বোঝায়:
 ন্যায্য দামে খাবার অধিকার।
 নিরাপদে বেঁচে থাকার অধিকার।
 বিদ্যুৎ, গ্যাস, পানি ও সার পাওয়ার অধিকার।
 পড়াশোনার অধিকার।
 চাকরির অধিকার।
 চিকিৎসা পাওয়ার অধিকার।
 নিজের বাড়িতে নিরাপদে থাকার অধিকার।
 ব্যক্তিগত গোপনীয়তার অধিকার।
 ন্যায়বিচার পাওয়ার অধিকার।
এসব অধিকারই এখন হয়েছে খর্ব, উপেক্ষিত অথবা অপহৃত। যেমন :
 চালের দাম ঘুরছে ডেঞ্জার জোন পঁয়ত্রিশ টাকা কেজি থেকে চল্লিশ টাকার মধ্যে।
 আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ভয়াবহ অবনতি ঘটেছে। প্রমাণ, যেকোনো দৈনিক পত্রিকার প্রথম ও শেষ পৃষ্ঠা এবং মফস্বল সংবাদ পৃষ্ঠা।
 পল্লী বিদ্যুৎ নেই। শহর বিদ্যুৎ স্বল্প। চুলায় গ্যাসের চাপ কম। গ্যাস স্টেশনে সময় সীমিত এবং লম্বা গাড়ির লাইন। তবে বিচারপতিদের জন্য মাঝে মধ্যে দেখা যায় বিশেষ প্রেফারেনশিয়াল লাইন। শহরে পর্যাপ্ত পানির অভাব। গ্রামে প্রতিশ্রুত বিনামূল্যে সার নেই।
 স্কুলের সময় নিয়ে পরীক্ষা, ভর্তি নিয়ে বাণিজ্য ও লটারি এবং পাঠ্যবই পাওয়া নিয়ে অনিশ্চয়তা চলছে।
 ঘরে ঘরে প্রতিশ্রুত চাকরি হয়নি। বরং গতকালের একটি দৈনিক পত্রিকার হেডলাইন রিপোর্টের মতে, গত ১০ মাসে ৪০ হাজার শ্রমিক দেশে ফেরত এসেছেন। পাশাপাশি এটাও বলা হয়েছে, একমাত্র ক্ষমতাসীন দলের সমর্থকদের নতুন চাকরি পাওয়ার যোগ্যতা আছে।
 সরকারি চিকিৎসা ব্যবস্থা ভেঙে পড়ছে। সেখানেও ডাক্তারদের নিয়ে নিলর্জ্জ দলীয়করণ চলছে।
 ৪০ বছর থাকার পরে নিজের বাড়ির অধিকার হারিয়েছেন বিরোধী নেত্রী ম্যাডাম খালেদা জিয়া। তার বিরুদ্ধে সমালোচনা হচ্ছে, তিনি কেন তার উচ্ছেদের বিষয়ে সাংবাদিকদের কাছে বলতে গিয়ে কাঁদলেন? এই অভিযোগটি উঠছে তাদেরই কাছ থেকে, যারা ‘কাঁদো বাঙালি কাঁদো’ স্লোগানে অভ্যস্ত এবং যাদের নেত্রী ইন্সটান্ট কান্নাতে পারদর্শী!
 ব্যক্তিগত গোপনীয়তার অধিকার মানুষ হারিয়েছে। মোবাইল ফোন কোম্পানি, ব্যাংক, ইলেকশন কমিশন প্রভৃতির দৌরাত্ম্যে এই দেশের মানুষকে তাদের অনেক গোপনীয়তা বিসর্জন দিতে হয়েছে। এ বিষয়ে চূড়ান্ত ঘটনাটি ঘটেছে ম্যাডাম খালেদা জিয়াকে তার বাড়ি থেকে উচ্ছেদ করার পরে এবং উচ্ছেদকারীদের ভাষ্য অনুযায়ী সেই বাড়ি সিলগালা করার পরে। তাদের নির্বাচিত সাংবাদিকদের দেখানো হয়েছে ওয়াইন বটল, সফট ডৃংকস ক্যান, গার্লি ম্যাগাজিন ইত্যাদি। চেষ্টা করা হয়েছে এবং এখনো বিটিভিতে সেই চেষ্টা চলছে যে, বিরোধী নেত্রী বিলাসী এবং অসংযমী জীবনযাপন করতে অভ্যস্ত। নেড়ি কুকুর হিসেবে যেহেতু আমার যাতায়াত কিছুটা সহজ, এমনকি ক্যান্টনমেন্টেও, আমি শুনেছি, খালেদা জিয়া মিনারাল ওয়াটার দিয়ে গোসল করেন সেটা প্রতিষ্ঠার জন্য কয়েক ক্রেইট মামস মিনারাল ওয়াটার বটল তার বাড়িতে নেয়া হচ্ছিল। সেগুলো পথেই মিসিং হয়ে যায়। তারেক রহমানের ঘরে একটা বার ছিল, সেটা প্রতিষ্ঠার জন্য কয়েক বটল হুইস্কি-জিন এবং কয়েক ক্যান বিয়ার পাঠানো হচ্ছিল। সেগুলো পথিমধ্যে মিসিং হয়ে যায়। খালেদা জিয়াকে উচ্ছেদের পরপরই তার বেডরুম থেকে মিসিং হয়ে যায় বহু কসমেটিকস সামগ্রী, যেসব পূর্ব নির্দেশ অনুযায়ী পৌঁছে দেয়া হয় মন্ত্রিসভার একাধিক মহিলা মন্ত্রীদের কাছে। হয়তো তারা ভেবেছেন, ফেয়ার অ্যান্ড লাভলি হতে হলে ইউনিলিভারের নয়, খালেদা জিয়ার কসমেটিকসকেই নির্ভরযোগ্য মনে করতে হবে।
এ রকম বহু অপ্রকাশিত ঘটনার উল্লেখ আমি নেড়ি কুকুর করতে পারি। আপনারা হয়তো বলবেন, আমার এসব কথা মিথ্যা, এসব প্রপাগান্ডা। আমার উত্তর হবে আইএসপিআর যা বলেছে, বিটিভি এবং তার সহযোগী কিছু মিডিয়া যা প্রচার করে চলেছে সেগুলো কি? অকথ্য অশ্লীল এবং অসত্য অসভ্য প্রপাগান্ডা?
মানবাধিকার প্রসঙ্গে কথা হলো, মানুষ এখন ন্যায়বিচার পাওয়ার অধিকার হারিয়েছে। মাহমুদুর রহমান কি ন্যায়বিচার পেয়েছেন? যে অর্থদন্ড তার ওপর আরোপিত হয়েছে, সেটা কি সঠিক? তার জেলদন্ডের মেয়াদ কি? জেলে থাকার ছয় মাস তো আজ পূরণ হলো। তিনি কি মুক্ত হয়ে আমাদের মাঝখানে আসতে পেরেছেন?
ন্যায়বিচার প্রসঙ্গে আমি বিশেষত দু’টি দিকে আপনাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই।
এক. রিমান্ডে নিয়ে মানুষকে বিবস্ত্র করা, যেমনটা মাহমুদুর রহমানকে করা হয়েছিল এবং নৃশংস নির্যাতন করা এখন কালচারে পরিণত হয়েছে। যাকে বলা যায় টর্চার কালচার। এই কালচারের পরিণাম হচ্ছে মৃত্যু। গতকালও দৈনিক নয়া দিগন্ত পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে নরসিংদীর রায়পুরা থানা পুলিশের নির্যাতনে ৩০ বছর বয়স্ক আসামি সিরাজ মিয়ার মৃত্যু হয়েছে। এই টর্চার কালচার বিষয়ে বাংলাদেশের অতীতের সুশীল কিন্তু বর্তমানের কুশীল সমাজ নীরব আছে। আমার অনুরোধ, আপনারা সবাই টর্চার কালচারের বিরুদ্ধে সোচ্চার হোন। তবে কুকুর জাতির বিবস্ত্র হওয়ার সমস্যা নেই। মানুষের মতো সভ্য হয়ে আবার অসভ্য আমরা হইনি। আমরা সারাক্ষণই বিবস্ত্র থাকি। ন্যাংটার আবার ডিবি পুলিশের ভয় কি?
আর দ্বিতীয় বিষয়টি হচ্ছে, গণসমন জারি করা। ওয়ান-ইলেভেনের পর সেনা সমর্থিত সরকারের সময় টর্চার কালচার চালু হওয়ার পাশাপাশি গণসমন জারি শুরু হয়েছিল। সেই ধারাবাহিকতা এখনো চলছে। আমার দেশ পত্রিকার সাংবাদিকদের টাইট রাখার লক্ষ্যে প্রায় ১০০ অজ্ঞাতনামা সাংবাদিকের বিরুদ্ধে সমন জারি করা হয়েছে। অন্য এক্সটৃম বা মেরুতে সিরাজগঞ্জের কয়েক হাজার অজ্ঞাতনামা ব্যক্তির বিরুদ্ধে সমন জারি করা হয়েছে। এই গণসমন কালচারের বিরুদ্ধেও আপনারা সোচ্চার হোন।
বাকস্বাধীনতা
আমি গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের কথা এতক্ষণ বলেছি। তৃতীয় যে বিষয়টি নিয়ে আমাকে বলার জন্য অনুরোধ করা হয়েছিল, সেটা হচ্ছে বাকস্বাধীনতা।
এ বিষয়ে এখন যত কম বলা যায় ততই মঙ্গল। কারণ, বাকস্বাধীনতার অভাব হয়েছে বলেই মাহমুদুর রহমান কাশিমপুরে, বাংলাভিশনের উপস্থাপক কাজী জেসিন অদৃশ্য এবং দিগন্ত টিভির উপস্থাপক ড. রেজোয়ান সিদ্দিকী অনুপস্থিত।
সুতরাং বাকস্বাধীনতা বিষয়ে বেশি কিছু আর বলবো না। আপনারাই বুঝে নিন। আমি শুধু আমেরিকার সংবিধান রচয়িতা টমাস জেফারসনের একটি উক্তি আপনাদের মনে করিয়ে দিতে চাই।
টমাস জেফারসন বলেছিলেন,When injustice becomes law, Resistance becomes duty.
অর্থাৎ, অবিচার যখন হয় আইন, তখন প্রতিরোধ হয় কর্তব্য।
ধন্যবাদ সবাইকে এতক্ষণ শোনার জন্য।
ঘেউ ঘেউ।

৩ ডিসেম্বর ২০১০