মঙ্গলবার, ১৭ এপ্রিল, ২০১২

উই রিভোল্ট! আমরা বিদ্রোহ করলাম!


২০১২-০৪-০৮

গতকাল সাতটি বইয়ের মোড়ক উন্মোচন করেছেন বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল, বিএনপি-র চেয়ারপারসন ম্যাডাম খালেদা জিয়া। ইতিমধ্যে আপনারা জেনেছেন, এই প্রকাশনা উৎসব করতে ৰমতাসীন সরকার আরোপিত বিভিন্ন বাধা পেরোতে হয়েছে।
প্রথমে ম্যাডাম খালেদা জিয়ার পাচটি বইয়ের মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠান হওয়ার কথা ছিল ২৭ মার্চ ২০১২-তে সোনারগাও হোটেলের বলরম্নমে। এই অনুষ্ঠানের আয়োজক গ্রম্নপ ২০০৯, সংৰেপে জি-৯ এ জন্য এক মাস আগে ২৭ ফেব্রম্নয়ারিতে ওই হোটেলে অ্যাডভান্স পেমেন্ট করেছিল এবং প্রায় ১,০০০ অতিথির নামে কার্ড বিলি করেছিল। কিন্তু ১৮ মার্চে সোনারগাও হোটেল কর্তৃপৰ সেই বুকিং ক্যানসেল করে জানায়, প্রধানমন্ত্রীর অফিস ঠিক সেই দিন, সেই সময়ে বুকিং চেয়েছে। তাই বিরোধী দলীয় নেত্রীর অনুষ্ঠানের বুকিং ক্যানসেল করতে তারা বাধ্য হয়েছে।
এই বুকিং বাতিল হয়ে যাওয়ার পরে জি-৯ সাবেক শেরাটন, বর্তমানে রূপসী বাংলা হোটেলের উইন্টার গার্ডেন হল রম্নমটির বুকিং দেয়, দিন ও সময় অপরিবর্তিত রেখে । জি-নাইন নতুন কার্ড ছেপে আবারও বিলি করে।
অনুষ্ঠানের আগের রাতে। ২৬ মার্চ রাত সাড়ে দশটায় আমি রূপসী বাংলা হোটেলে যাই বিভিন্ন প্রস্তুতি কাজ সুসম্পন্ন হয়েছে কি না দেখার জন্য। তখন আমাকে বলা হয়, হোটেল কর্তৃপৰ ফোনে জানতে চেয়েছেন বইগুলোর বিষয়বস্তু কি এবং প্রকাশিত পাচটি বই তাদের কাছে পরদিন সকাল দশটায় জমা দিতে হবে। তারপর বইগুলো পরীৰা করে তারা জানাবেন, এই হোটেলে এ প্রকাশনা উৎসব করা যাবে কি না।
আমি অবাক হয়ে বললাম, পরদিন সকাল দশটায় যদি বলা হয় এই হোটেলে অনুষ্ঠান করা যাবে না তাহলে আমরা কিভাবে অতিথিদের জানাবো যে অনুষ্ঠানটি বাতিল হয়ে গিয়েছে?
অতিথিরা হোটেলে এসে যদি বাতিল হওয়ার সংবাদটি পান তাহলে সেটা হবে হোটেল কর্তৃপৰের জন্য নিন্দাজনক এবং আয়োজক জি-নাইনের জন্য বিব্রতজনক। সুতরাং রূপসী বাংলায় অনুষ্ঠান হতে পারবে কি না সেটা রাতের মধ্যে জানাতে হবে।

রূপসী নয়, কুরূপা কুশ্রী কুচরিত্র
এর আধা ঘণ্টা পরে জি-নাইনের কাছে ০১৭১৩ ০৪৭ ৬৮৭ নাম্বার থেকে আসে একটি এসএমএস। তাতে লেখা ছিল :
Dear Sir, as I had shared with you few minutes earlier over cell phone that we cannot organize your event tomorrow. I have been instructed to you from authority of national intelligent department of Bangladesh. Sorry for the inconvenience.
Thanks n regards Mosharrof Hossain, Catering sales executive, Ruposhi Bangla Hotel.
অর্থাৎ, সুধী, কয়েক মিনিট আগে সেলফোনে আমি জানিয়েছিলাম আগামীকাল আপনাদের অনুষ্ঠান আমরা করতে পারবো না। এ বিষয়ে বাংলাদেশের জাতীয় গোয়েন্দা বিভাগের কর্তৃপৰ আমাকে নির্দেশ দিয়েছেন। আপনাদের অসুবিধার জন্য আমরা দুঃখিত। ধন্যবাদ ও শ্রদ্ধানেৱ মোশাররফ হোসেন, কেটারিং সেলস একজিকিউটিভ, রম্নপসী বাংলা হোটেল।

এভাবেই কিছু অকালকুষ্মাণ্ড, অর্বাচীন ও অভদ্র সরকারি কর্মচারিদের কাছে রূপসী বাংলা হোটেলটি হয়ে গেল কুরূপা, কুশ্রী ও কুচরিত্র। ঠিক ওই কর্মচারীদের পেছনে ৰমতাসীন লোকজনের মতোই!

এখন সোচ্চার তখন অনুপস্থিত
এখানে আমি বিনীতভাবে জানাতে চাই, একাত্তরে যখন এটি ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেল ছিল তখন আমি ছিলাম চিফ অ্যাকাউন্টেন্ট এবং এক পর্যায়ে যুদ্ধভীত শেতাঙ্গ জেনারেল ম্যানেজার বার্নার্ড হোল্ট ইংল্যান্ডে চলে গেলে আমি ছিলাম অ্যাকটিং জেনারেল ম্যানেজার। এ হোটেল থেকে আমারই উদ্যোগে ১৭ মার্চ ১৯৭১-এ শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মদিনে বাংলাদেশের ম্যাপ ও ফ্যাগ খচিত বড় বার্থডে কেক পাঠানো হয়েছিল তার ৩২ নাম্বার রোডের বাড়িতে। এ হোটেলে সেই সময়ে অবস্থানরত পাকিসৱানি নেতা জুলফিকার আলি ভুট্টোকে লিফটে আটকে রেখে স্যানডাল পেটা করা হয়েছিল তদানীনৱন সিকিউরিটি অফিসার মি. করিমের পস্ন্যান অনুযায়ী। পরবর্তীকালে এ ঘটনাটি তিনি লাল গোলাপ টিভি অনুষ্ঠানে বর্ণনা করেন। এই ব্যক্তিগত কথাগুলো বললাম এই জন্য যে, বর্তমানে মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে সবচেয়ে বেশি সোচ্চার প্রধানমন্ত্রীকে তখন কোনো মুক্তি আন্দোলনে অংশ নিতে আমি দেখিনি।
আমার বইগুলো প্রকাশনার তৃতীয় প্রচেষ্টায় ন্যাশনাল প্রেস কাবের শরণাপন্ন হই। প্রেস কাব কর্তৃপৰ সদয় ও সাহসী অনুমতি দেন। জি-নাইন তৃতীয়বার কার্ড ছাপে ও বিলি করে। ধন্যবাদ ন্যাশনাল প্রেস কাব কর্তৃপৰ ও সদস্যদের।

সরকার কেন বাধা দিল
সরকার কেন বই প্রকাশনা উৎসবে বাধা দিয়েছে তার কয়েকটি ব্যাখ্যা ইতিমধ্যে বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। এর একটি ব্যাখ্যা হলো, ২৭ মার্চ সোনারগাও ও রূপসী বাংলা হোটেলে বিদেশি কয়েক অতিথি ছিলেন। প্রকাশিতব্য পাচটি বইয়ের মধ্যে দুটি ইংরেজিতে।
সরকার চায়নি এ ইংরেজি বই দুটি বিদেশিদের হাতে পড়ুক। কারণ দুটি বই পড়লেই জানা যাবে স্বাধীনতার ঘোষণা ও মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে এই সরকার কি রকম মিথ্যাচার করেছে।
বস্তুত এ কারণেই আমি এসব বই লেখার তাড়না বোধ করেছিলাম।
আমি যখন দেখলাম এবং এখনো দেখছি, আমাদের ইতিহাস, বিশেষত স্বাধীনতার ঘোষণা ও স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস অবিরামভাবে বিকৃত করা হচ্ছে এবং অব্যাহতভাবে ভিন্নমত পোষণকারী প্রয়াত এবং জীবিত ব্যক্তিদের চরিত্র হনন করা হচ্ছে তখন আমি যন্ত্রণায় পড়ে যাই। আমি বাধ্য হই সেই যন্ত্রণায় বই লিখতে। আর তারই ফসল এ সাতটি বই ।
১৪ ফেব্রম্নয়ারি ২০১০-এ অর্থাৎ দুই বছর আগে টার্কির প্রেসিডেন্ট আবদুলস্নাহ গুল ঢাকায় এসেছিলেন। তার ঢাকা সফরের আগে টার্কিশ দূতাবাস ম্যাডাম জিয়ার কার্যালয়ে ফোন করে জানতে চান ম্যাডাম জিয়ার জীবনীমূলক প্রামাণ্য তথ্য। ওই তথ্য সরবরাহের দায়িত্ব আমার ওপর পড়ে। আমি অবাক হয়ে যাই দেখে যে, উইকিপিডিয়া থেকে শুরম্ন করে বিভিন্ন সূত্রে ম্যাডাম খালেদা সম্পর্কে তথ্যগুলো অসম্পূর্ণ, অসত্য অথবা অর্ধসত্য। এই সময়ে আমি ইংরেজিতে তার একটি সংৰিপ্ত জীবনী লিখি এবং সেটাই টার্কিশ দূতাবাসকে পাঠিয়ে দেয়া হয়। এরপরই ম্যাডাম খালেদার এ সংৰিপ্ত জীবনীর বাংলা ও ইংরেজি ভার্শন প্রকাশ করার কথা ভাবতে থাকি।

কে কখন কোথায়
কাজটি করতে গিয়ে আমি প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান-এর জীবন ও কর্মকাণ্ড সম্পর্কে কিছু রিসার্চে লৰ্য করি, তার সম্পর্কে অনেক অসত্য এবং অর্ধসত্য প্রচারিত হয়েছে। আরো দুঃখের বিষয় যে, এসব চালানো হচ্ছে সরকারিভাবে। শুধু তাই নয়, জিয়াউর রহমানের বিপরীতে আরেক ব্যক্তির স্তুতি ও বন্দনা একনিষ্ঠভাবে অহরহ চলছে। ফলে বিশেষত তরম্নণ প্রজন্মের পৰে বোঝা অসম্ভব হয়ে দাড়িয়েছে, স্বাধীনতা যুদ্ধের ঘোষণা কে বা কারা দিয়েছিলেন? কখন দিয়েছিলেন? স্বাধীনতা যুদ্ধে কে, কোথায় ছিলেন? প্রত্যৰ স্বাধীনতা যুদ্ধ কারা করেছিলেন?
এসব প্রশ্নের অনেক হাস্যকর উত্তর এখন পাওয়া যাচ্ছে। যেমন, একটি চাকরির ইন্টারভিউয়ের গল্প বললেই আপনারা সেটা বুঝবেন। গল্পটি হচ্ছে এ রকম :

সেনাবাহিনীতে নতুন সেনা নিয়োগ করা হচ্ছে। যুবকদের ইন্টারভিউ নিচ্ছেন জনৈক মেজর। তিনি প্রশ্ন করলেন, বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ তিনজন মুক্তিযোদ্ধা কে ছিলেন?
চাকরি পেতে ব্যগ্র যুবকটি উত্তর দিল : প্রথম জন ছিলেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। দ্বিতীয়জন ছিলেন গণতন্ত্রের মানসকন্যা জননেত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনা এবং স্যার, মাফ করবেন, আপনার নামটা জানি না, তৃতীয় জন ছিলেন আপনিই!

উই রিভোল্ট! আমরা বিদ্রোহ করলাম!
ইতিহাস বিকৃতির ফলটা কি হচ্ছে সেটা আশা করি আপনারা বুঝবেন।
তবে সত্য ইতিহাস লেখায় বিপদ হতে পারে। বিশেষত আজকের মিডিয়ার অধিকাংশ যখন একদলদর্শী বা ৰমতাসীন দলদর্শী। আপনি সত্য ইতিহাস বললে বা লিখলে অভিযুক্ত হতে পারেন, আপনি স্বাধীনতা যুদ্ধ বিরোধী, মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী, সামপ্রদায়িক, অগণতান্ত্রিক, হয়তো বা যুদ্ধাপরাধী! ইত্যাদি ইত্যাদি।
এই ধরনের মাতাল প্রচার এখন এমন পর্যায়ে চলে এসেছে যে, বলা হচ্ছে, জিয়াউর রহমান, যিনি নয় মাস স্বদেশে থেকে মুক্তিযুদ্ধ করেছেন তিনি ছিলেন পাকিসৱানি গুপ্তচর। সেই হিসেবে জিয়া হচ্ছেন নিন্দিত। আর যে নেতা নয় মাস বিদেশে, পাকিসৱানে বন্দি ছিলেন তিনিই হচ্ছেন নন্দিত।
সত্যটা হচ্ছে এই যে, ২৫ মার্চ ১৯৭১-এ রাত একটা থেকে রাত সোয়া দুইটার মধ্যে জিয়াউর রহমান চট্টগ্রাম পোর্ট এরিয়াতে ঘোষণা করেন, উই রিভোল্ট! আমরা বিদ্রোহ করলাম!
এই বিদ্রোহের বিবরণ প্রকাশিত হয় তারই জবানীতে, দৈনিক বাংলায় ২৬ মার্চ ১৯৭২-এর স্বাধীনতা সংখ্যায়। দৈনিক বাংলা ছিল সরকারি পত্রিকা। অর্থাৎ জিয়ার এ লেখাটি ছিল শেখ মুজিবুর রহমানের আওয়ামী লীগ সরকার কর্তৃক অনুমোদিত ও প্রকাশিত। এটাই তাহলে সত্য যে, ২৫ মার্চ রাত একটা থেকে সোয়া দুটোর মধ্যে জিয়া বিদ্রোহ ঘোষণা করে অস্ত্র হাতে তুলে নেন। এরপর আরেক সময়ে আনুষ্ঠানিকভাবে কালুরঘাট ট্রান্সমিটিং স্টেশন থেকে প্রথমে নিজের তরফ থেকে এবং পরে শেখ মুজিবুর রহমানের নাম নিয়ে তার পৰে স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। আমরা ঢাকায় এই ঘোষণা শুনেছিলাম ২৭ মার্চ ১৯৭১-এ।
নিয়তির সেন্স অফ টাইমিং
এখন তরম্নণ প্রজন্ম প্রশ্ন করতে পারে, সেই সময়ে শেখ মুজিবুর রহমান কোথায় ছিলেন?
নিয়তির কি অবাক সেন্স অফ টাইমিং!
জিয়াউর রহমান যখন চট্টগ্রামে ২৫ মার্চ দিবাগত রাত একটা থেকে সোয়া দুটোর মধ্যে স্বাধীনতা সংগ্রামে আত্মনিয়োগ করছিলেন ঠিক সেই সময়ে ঢাকায় শেখ মুজিবুর রহমান পাকিসৱানিদের কাছে আত্মসমর্পণ করছিলেন।
এখানে মনে করিয়ে দিতে পারি গ্যারিবল্ডি, ম্যাজিনি, মাও, ক্যাসট্রো-র মতো বিপস্নবী নেতারা বিপস্নবের সময়ে নিজে উপস্থিত থেকে সংগ্রাম করেছেন।
সে রকম কিছু না করে শেখ মুজিবুর রহমানের আত্মসমর্পণের পেছনে নিশ্চয়ই তার নিজস্ব জোরালো যুক্তি ছিল। আজ আমি সেই প্রসঙ্গে যাবো না। তবে এটুকু বলতে পারি, ৭ মার্চে তার ভাষণে অনুপ্রাণিত হয়ে জিয়াও মুক্তিযুদ্ধ শুরম্ন করেছিলেন। ঠিক তেমনি আমিও ’৭১-এ মুক্তি আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলাম। কিন্তু ১৯৭১-এ মুক্তিযুদ্ধে জিয়ার বীরত্ব এবং আগস্ট ১৯৭৫-এর পরে দেশ পুনর্গঠনে জিয়ার সবল নেতৃত্বের ইতিহাস যখন অনুচ্চারিত থাকে তখন সচেতন ব্যক্তি ও লেখকের ওপর দায়িত্ব বর্তায় সত্য ইতিহাসটা তুলে ধরার।
বলতেই হবে, ইতিহাস লেখার সময়ে আমি ভাবিনি প্রকাশিত বইগুলোও আওয়ামী লীগ সরকারের স্বৈরাচারের ইতিহাসের একটি অংশ হবে।
যে সাতটি বইয়ের মোড়ক উন্মোচিত হলো তার মধ্যে চারটি বইয়ে রাষ্ট্রপতি জিয়া এবং ম্যাডাম খালেদা জিয়ার বিভিন্ন গঠনমূলক অবদানের সংৰিপ্ত টাইমলাইন তুলে ধরা হয়েছে।
রাষ্ট্রনায়ক জিয়াউর রহমান বইয়ে তার একটি আত্মকথন প্রকাশিত হয়েছে। তার জীবনের বিভিন্ন দিক বিষয়ে এ বইয়ের লেখকরা অনেক অজানা ইন্টারেস্টিং তথ্য জানিয়েয়েছেন। সব লেখককে জানাচ্ছি ধন্যবাদ।

বই কিনুন বই পড়ুন
কেউ কেউ বলেন, মাগনা পেলে বাঙালি বিষ খেতে রাজি হয়। এটা একটা অপবাদ। এই অপবাদ মিথ্যা প্রমাণ করার দায়িত্ব আপনাদের। বিশেষত বিএনপি নেতাদের। আপনাদের নিশ্চয়ই মনে আছে, ম্যাডাম জিয়ার প্রধানমন্ত্রিত্বের সময়ে তিনি একটা সেস্নাগান দিয়েছিলেন, প্রিয়জনকে বই উপহার দিন। তার সেই সুন্দর সেস্নাগানটি একটু পরিবর্ধিত করে আজ আমি বলতে চাই, বই কিনে প্রিয়জনকে বই উপহার দিন। বিএনপি নেতাদের অনুরোধ করতে চাই, বই কিনে আপনারা কর্মী, সমর্থক ও ভোটারদের উপহার দিন। না হলে প্রতিপৰের শক্তিশালী সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের মোকাবেলা আপনারা কিছুতেই করতে পারবেন না।
এসব কথা বলার আরেকটি কারণ হচ্ছে, আমাদের সামর্থ খুবই সীমিত। বিনামূল্যে বা মাগনা বই দেয়া আমাদের পৰে সম্ভব নয়। সরি ফোকস। আমরা মি. দুররানির অনুগ্রহে আইএসআই বা পাকিসৱান থেকে টাকা পাইনি। আর ইনডিয়ান ‘র’ যে আমাদের টাকা দেবে না সেটা বলা বাহুল্য।
এসব বই পড়া নেতা, কর্মী-সমর্থকদের জন্য অত্যনৱ জরম্নরি। আগেই আমি বলেছি, জিয়াউর রহমানের বিরম্নদ্ধে অপপ্রচার সভ্যতার মাত্রা ছাড়িয়ে গিয়েছে। তিনি প্রয়াত। তিনি তো আর কিছু বলতে পারবেন না। সে কাজটি আপনাদেরই করতে হবে। কারণ এখন ম্যাডাম খালেদা জিয়ার বিরম্নদ্ধেও অপ্রপ্রচার শুরম্ন হয়ে গিয়েছে। তিনি জীবিত থাকতেই! একেই বোধহয় হয় বলে, অসভ্যতার অগ্রগতি।

যেতে পারেন ইনডিয়া অথবা আমেরিকা
বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ও তার সৱাবকরা একাধিকবার বলেছেন, আইএসআই থেকে ১৯৯১-এ বিএনপি টাকা নিয়েছিল। তিনি অবশ্য ভুলে গিয়েছেন, মাত্র তিন বছর আগের নির্বাচনে তার পার্টি ব্যাগফুল অফ মানি ইনডিয়া থেকে যে পেয়েছিল সে বিষয়ে দি ইকনমিস্ট রিপোর্ট করেছিল। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী উপদেশ দিয়েছেন, বিরোধী নেত্রী খালেদা যেন পাকিসৱান চলে যান। খালেদা পাকিসৱান যাবেন কেন? তিনি তো আগেই বলেছেন, বাংলাদেশই তার একমাত্র ঠিকানা। বরং আমি প্রধানমন্ত্রীকে অনুরোধ করবো তিনি যেন ইনডিয়া অথবা আমেরিকায় চলে যান। ওই দুই দেশে দীর্ঘকাল থাকার অভ্যাস তার আছে।
প্রসঙ্গত. এশিয়ান কৃকেট কাপে সাম্প্রতিক ফাইনালে বাংলাদেশ-পাকিসৱানের ম্যাচে বিরোধী নেত্রীর উপস্থিতি নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর একাধিকবার অশালীন মনৱব্যের বিষয়টি বলতে চাই। তিনি বলতে চেয়েছেন, ম্যাডাম জিয়া স্টেডিয়ামে গিয়েছিলেন পাকিসৱান টিমকে সমর্থন করতে। এ তথ্যটি প্রমাণ করার জন্য প্রধানমন্ত্রী তার কাজের বুয়ার রেফারেন্সও দিয়েছেন।
প্রধানমন্ত্রীর স্ট্যান্ডার্ড যে আরো নিচে নেমে গিয়েছে সেটা আমি বলতে চাই না। সম্প্রতি বিএনপির সেক্রেটারি জেনারেল মির্জা ফখরম্নল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, তিনি একজন চপলমতি বালিকা। যা মনে আসে তাই বলে ফেলেন।
হয়তো তিনি তাই। আমি এখানে একটু যোগ করবো। দেশের বালক-বালিকাদের ইতিহাস পড়তে বলবো। ইতিহাস পড়লেই জানা যাবে ১৯৪৭ সালে এই প্রধানমন্ত্রীর পিতা পাকিসৱান আন্দোলনের একজন অগ্রণী কর্মী ছিলেন এবং ১৯৭১-এ তিনি পাকিসৱানেই চলে গিয়েছিলেন।
আবার ১৯৭২-এ স্বাধীন বাংলাদেশে ফিরে এসে পাকিসৱানের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তোলায় মনোযোগী হয়েছিলেন। এ কারণে তিনি তার পরম শত্রম্ন জুলফিকার আলি ভুট্টোকে ৰমা করে দিয়ে বাংলাদেশে সফরের আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন এবং ১৯৭৪-এ ভুট্টো এখানে এসেছিলেন।
এটি ছিল শেখ মুজিবুর রহমানের দূরদৃষ্টি সম্পন্ন পররাষ্ট্রনীতি যেটা পরবর্তীকালে জিয়াউর রহমান এবং খালেদা জিয়াও অনুসরণ করেন। এখানে মনে করিয়ে দিতে পারি যে, ভিয়েতনাম দশটি বছর আমেরিকার বিরম্নদ্ধে লড়েছিল। তারা এখন আমেরিকার সঙ্গে গভীর বন্ধু সম্পর্ক রেখে চলেছে। যে জাপানের বিরম্নদ্ধে মহাযুদ্ধে আমেরিকা লড়েছিল সেই জাপান এখন আমেরিকার সবচেয়ে বড় বন্ধু রাষ্ট্রের একটি।
বস্তুত বর্তমান প্রধানমন্ত্রী যদি সেই রকম দূরদর্শী হতেন তাহলে বাংলাদেশ-পাকিসৱান ফাইনাল ম্যাচের দিনে পাকিসৱানের প্রধানমন্ত্রী মি. গিলানিকে ঢাকায় এসে পাশাপাশি বসে খেলা দেখার আমন্ত্রণ জানাতে পারতেন। যেমনটা ভারত-পাকিসৱানের একটি ফাইনাল ম্যাচ পাশাপাশি বসে দেখেছিলেন মনমোহন সিং ও গিলানি। কিন্তু প্রতিহিংসা প্রতিশোধের হামলা-মামলার রাজনীতি যার অবলম্বন তার কাছে থেকে এ রকম সৌজন্যতা আশা করা অসম্ভব।
এরশাদের প্রশ্নের উত্তর :মুগুর
এখানে আমি প্রধানমন্ত্রীর দীর্ঘকালের বিশ্বসৱ ও অনৱরঙ্গ সহযাত্রী জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের একটি প্রশ্নের উত্তর দিতে চাই। সম্প্রতি জেনারেল এরশাদ পার্লামেন্টে মনে করিয়ে দিয়েছেন, ১৯৮৬-তে আমার সম্পাদিত সাপ্তাহিক যায়যায়দিন-এ সংসদের তৎকালীন নারী সদস্যদের টাইটেল দিয়েছিলাম সংসদের শোভা ত্রিশসেট অলংকার।
তারপর তিনি প্রশ্ন রাখেন, এখন আমি সংসদের নারী সদস্যদের কি টাইটেল দেবো? প্রশ্নটি তিনি করেন বিএনপির দুই নারী সদস্য রেহানা আখতার রানু ও সৈয়দা আসিফা আশরাফি পাপিয়া সম্প্রতি সংসদের প্রধানমন্ত্রীর যে সমালোচনা করেছেন সেই পরিপ্রেৰিতে।
জেনারেল এরশাদ অবশ্য সেদিন বলেননি ওই টাইটেল দেয়ার জন্য আমাকে ছয় বছর নির্বাসনে তিনি পাঠিয়ে দিয়েছিলেন।
সে যাই হোক। আমি পুলকিত হয়েছি জেনে যে, জেনারেল এরশাদের দুটি গুণ, এক. তার ভাষা শালীন আছে এবং দুই. নারীদের প্রতি তার নজর এখনো প্রখর। তিনি জানতে চেয়েছেন, এখন সংসদের নারী সদস্যদের টাইটেল কি হবে? উত্তরটা হচ্ছে, বিএনপির সাত নারী সদস্য হচ্ছেন বাঘা তেতুল অথবা মুগুর। আর বাকি সব নারী সদস্যদের টাইটেল দেয়া থেকে বিরত থাকলাম। কারণ ১৯৮৬-তে ওই টাইটেল দেয়ার জন্য আমার বিরম্নদ্ধে তিন কোটি টাকার মানহানির মামলা করা হয়েছিল। সেই ঘটনার পুনরাবৃত্তি আমি এখন চাই না।
কিন্তু সাতজনকে মুগুর টাইটেল কেন দিচ্ছি?
বাংলা ভাষায় দুটি বচন আছে, বুনো ওল বাঘা তেতুল এবং যেমন কুকুর তেমন মুগুর।

সম্প্রতি সংসদের বিএনপি দুই এমপি রেহানা আক্তার রানু এবং সৈয়দা আশরাফি পাপিয়া কিছু সময়ের জন্য মুগুর চালিয়েছেন। এতেই সরকারি দল বিচলিত হয়েছে। তাদের এই সন্ত্রসৱ প্রতিক্রিয়া প্রমাণ করে দিয়েছে রানু ও পাপিয়ার মুগুর চালানোর প্রয়োজন ছিল।
তারপরও সেদিকে আমরা কাউকে যেতে বলবো না। আমরা এটাই বলবো, রাজনীতিতে শালীনভাবে কথা বলুন এবং ভদ্র ভাষায় সত্যটা লিখুন। ঠিক এ বইগুলোর মতোই। এ বইগুলোর উত্তর বইতেই অর্থাৎ শালীন লেখাতেই দেয়া হবে বলে আমি আশা করি। কাউকে চ্যাংদোলা করার, কোলে তোলার অথবা থুথু চেটে খাওয়ার উপদেশ দেবেন না। কাজের বুয়ার রেফারেন্স টেনে পাকিসৱানে চলে যেতে বলবেন না।
যে সাতটি বই প্রকাশ হলো তার মধ্যে দুটি ইংরেজি এবং পাচটি বাংলায়। ইংরেজি বই দুটির নাম হচ্ছে Statesman Ziaur Rahman এবং Democratic Leader Khaleda Zia. বাংলা বই পাচটির নাম রাষ্ট্রনায়ক জিয়া, সংগ্রামী নেত্রী খালেদা জিয়া, চট্টগ্রাম পোলো গ্রাউন্ড লুণ্ঠন, নেড়ি কুকুরের কান্ড ও নেড়িকুকুরের কীর্তি।

ও হ্যা। রাষ্ট্রনায়ক জিয়াউর রহমান নামে একটি বই লিখেছি খবরটি প্রকাশিত হবার পর গত ৪ এপৃল থেকে সারা ঢাকা শহরে আওয়ামী লীগ ব্যানার ছেড়েছে যেখানে তাদের নেত্রীর নতুন বিশেষণ হয়েছে রাষ্ট্রনায়ক। লেখা হয়েছে রাষ্ট্রনায়ক হাসিনা। স্বাধীনতার ঘোষক বিশেষণটি যেমন হা্‌ইজ্যাক হয়েছে, ঠিক তেমনি রাষ্ট্রনায়ক বিশেষণটিও হাইজ্যাক হয়ে গেলো।
এই বইগুলো প্রকাশের পেছনে যারা কাজ করেছেন তাদের আনৱরিক ধন্যবাদ জানাই। এই বইগুলো প্রকাশনা উৎসবের আয়োজন যারা করেছেন সেই গ্রম্নপ ২০০৯ তথা জি-নাইনের সদস্যদের জানাই অশেষ কৃতজ্ঞতা। ম্যাডামকেও ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা। অনুষ্ঠানে এসে মোড়ক উন্মোচন করার জন্য।

নিরপেৰ থাকা অনৈতিক
কেউ কেউ আমাকে সমালোচনা করতে পারেন। আমি একটি বিশেষ দলের বা বিশেষ ব্যক্তির পৰে লিখেছি। অর্থাৎ আমি পৰপাতিত্ব করছি। অন্যভাবে তারা বলতে পারেন, আমি নিরপেৰ নই।
এই সমালোচনার উত্তরে ম্যাডাম খালেদা জিয়ারই একটি বানী আমি আপনাদের মনে করিয়ে দিতে চাই। তিনি বলেছিলেন, পাগল ও শিশু ছাড়া কেউ নিরপেৰ নয়।
তার সেই কথা আমি একটু সমপ্রসারিত করে আজ বলতে চাই, পাগল, শিশু ও সুবিধাবাদী ছাড়া কেউ নিরপেৰ নয়। আমি সমালোচিত হতে পারি জেনেও সত্য প্রতিষ্ঠার জন্য বিবেকের তাড়নায় এই বইগুলো লিখেছি। আমি মুক্তিযুদ্ধের সময়ে নিরপেৰ ছিলাম না। মুক্তির পৰে অবস্থান নিয়েছিলাম। আমি স্বৈরশাসক এরশাদের সময়ে নিরপেৰ ছিলাম না। আমি গণতন্ত্রের পৰে অবস্থান নিয়েছিলাম।
জার্মান কবি দানেৱ বলেছিলেন,

The hottest places in hell are reserved for those who, in a time of great moral crisis maintain their neutrality.

অর্থাৎ খুব বড় নৈতিক সংকটের সময়ে যারা তাদের নিরপেৰতা বজায় রাখেন তাদের জন্য নরকের সবচেয়ে বেশি গরম জায়গা রিজার্ভ করা আছে।
দানেৱর এই অমর বাণী পুনঃউচ্চারণ করেছিলেন আমেরিকান প্রেসিডেন্ট জন কেনেডি। আজ আমিও সেই আপ্তবাক্যটি পুনঃউচ্চারণ করলাম। প্রাবন্ধিক বদরম্নদ্দীন উমর-এর উদ্ধৃতি দিয়ে বলতে হয়, বাংলাদেশে এখন উম্মাদ ও বিকারগ্রসৱ শাসকের সময় চলছে।
এই সংকটের সময়ে নৈতিক বোধ সম্পন্ন কোনো ব্যক্তির পৰে নিরপেৰ থাকা সম্ভব নয়। যেমনটা সম্ভব ছিল না মুক্তিযুদ্ধ ও গণতন্ত্র যুদ্ধের সময়ে।
৭ এপৃল ২০১২