শুক্রবার, ২৭ জানুয়ারী, ২০১২


এয়ারপোর্ট, ঢাকা।
কাল : সকাল এগারোটা, ৬ জানুয়ারি ২০১০।
পাত্র : লন্ডন থেকে আগত একজন স্মার্ট, ইয়াং বাঙালি যাত্রী। পরনে নেভি ব্লু সুট, ডিপ ব্লু শার্ট, ব্রাইট রেড টাই। এয়ারপোর্টে নিযুক্ত মধ্যবয়সী ইমিগ্রেশন অফিসার, পরনে ইউনিফর্ম ও ব্যাজ। এবং একজন ড্রাইভার।
ইমিগ্রেশন অফিসার : আপনার পাসপোর্ট ঠিক আছে। ল্যান্ডিং ফর্ম, সোয়াইন ফ্লু ফর্ম এবং ব্যাগেজ ডিক্লারেশন ফর্মও ঠিক আছে। কিন্তু আপনার কন্সপিরেসি ডিক্লারেশন ফর্ম কই? ওই ফর্মটা কি আপনি ফিল আপ করেননি? প্লেন ল্যান্ড করার আগে ওই ফর্ম কি আপনাকে দেয়া হয়নি?
যাত্রী : হ্যা। দেয়া হয়েছিল।
অফিসার : তাহলে ফর্মটা ফিল আপ করেননি কেন?
যাত্রী : আমি ভেবেছিলাম এমিরেটস এয়ারলাইন একটা জোক করছে। তাই।
অফিসার (ভ্রূ কুচকে) : জোক?
যাত্রী : দেখুন, কোনো কন্সপিরেসি বা ষড়যন্ত্র করার সময় আমার নেই। আমি একজন বিজনেসম্যান। সারা বছর জুড়ে বিজনেস টৃপ দিই। বিভিন্ন দেশে যাই। কোথাও কন্সপিরেসি ফর্মের নাম শুনিনি। ফিল আপ তো দূরের কথা। তাই ওই ফর্মটা হাতে পেয়ে ভেবেছিলাম ওটা একটা জোক। আমি ওটাকে সিরিয়াসলি নিই নি।
অফিসার : কন্সপিরেসি একটা সিরিয়াস ম্যাটার। ভেরি সিরিয়াস ম্যাটার। ভেরি ভেরি সিরিয়াস ম্যাটার। বিশেষত বাংলাদেশে। আপনি কি সেটা জানেন না?
যাত্রী : কিছু কন্সপিরেসি সিরিয়াস ম্যাটার হতে পারে। কিন্তু সব ষড়যন্ত্রই কি সিরিয়াস হতে পারে? যেমন ধরুন, আমি যদি আমার ব্যাংকের চোখে ধুলা দিতে চাই? আমার পার্টনারকে পথে বসাতে চাই?
অফিসার : না, না। আমি বিজনেসের কথা বলছি না। আমি বলছি রাষ্ট্রবিরোধী কন্সপিরেসির কথা। সরকার বিরোধী চক্রান্তের কথা। এই ধরনের কন্সপিরেসি খুবই সিরিয়াস ম্যাটার হতে পারে। ১৯৬৯-এ আগরতলা ষড়যন্ত্র, ১৯৭৫-এর রাজনৈতিক হত্যাকান্ডের কন্সপিরেসি, ১৯৭৭-এ এই ঢাকা এয়ারপোর্টেই বাংলাদেশ এয়ার ফোর্সের কন্সপিরেসি, ১৯৮১-তে চিটাগংয়ে সার্কিট হাউজে হত্যাকান্ডের ষড়যন্ত্র, ১৯৮২-তে জেনারেল এরশাদের ক্ষমতা দখলের চক্রান্ত, এসব নিশ্চয়ই আপনি জানেন। তারপর যশোরে উদীচির সভায় বোমা, রমনার বটমূলে বোমা, কোটালিপাড়ায় হামলার প্ল্যান, চিটাগংয়ে বহির্নোঙ্গরে অস্ত্র খালাস, ঢাকায় শেখ হাসিনার জনসভায় গ্রেনেড হামলা, সারা দেশ জুড়ে চারশ স্থানে একই দিনে প্রায় একই সময়ে এক যোগে বোমা বিস্ফোরণ এবং গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে ঢাকায় পিলখানায় বিডিআর বিদ্রোহ – এসবই তো গভীর ষড়যন্ত্রের ফল। এসব কি আপনি জানেন না?
যাত্রী : জানি। এসব তো ইতিহাস। নতুন কোনো ষড়যন্ত্রের আভাস কি আপনারা পেয়েছেন যেজন্য সব আগত যাত্রীদের একটা ফর্ম ফিল আপ করতে বলছেন?
অফিসার : সরকার সতর্কতামূলক অগ্রিম ব্যবস্থা নিয়েছে। আমরা সেটা পালন করছি। বর্তমান সরকারের ক্ষমতায় থাকার প্রথম বছর পূর্তি হচ্ছে আজ। দ্বিতীয় ডিজিটাল বছর নামে আজকের দিনটি দেশ জুড়ে পালিত হচ্ছে। এই দিনটিকে পন্ড করার জন্য সরকার বিরোধীরা নাশকতামূলক কাজ করতে পারে। চারদিকে তাকিয়ে দেখুন কতো একস্ট্রা সিকিউরিটি ফোর্স মোতায়েন করা হয়েছে। সারা দেশে এখন একটা স্টেট অফ এলার্টনেস চলছে।
যাত্রী (চারিদিকে তাকিয়ে) : হ্যা। দেখছি। আনসার, পুলিশ, র‌্যাব-এর সব লোকজন! ওদের অনেকের হাতে অস্ত্র। প্যাসেঞ্জারের চাইতে সিকিউরিটির লোকের সংখ্যাই বেশি মনে হচ্ছে।
অফিসার : সরকার আর আমরা সবাই খুব টেনশনে আছি। কখন যে কোথায় কি ঘটে যায়!
যাত্রী : এভাবে তো আপনারা চক্রান্তকারীদের দমাতে পারবেন না। যারা চক্রান্ত করবে তারা তো প্ল্যান করেই করবে যাতে কেউ জানতে না পারে। তারা কি কেউ জানিয়ে চক্রান্ত করবে?

অফিসার : সেজন্যই তো চক্রান্তকারীদের একটা সুযোগ সরকার দিয়েছে ডিক্লেয়ার করার জন্য। সেজন্যই তো কন্সপিরেসি ডিক্লারেশন ফর্ম চালু করা হয়েছে। এই নিন একটা ফর্ম। চটপট ফিল আপ করে দিন।
যাত্রী (ফর্মটা হাতে নিয়ে ফর্মের দিকে দ্রুত চোখ বুলিয়ে) ; এখানে প্রশ্ন করা হয়েছে, আমার সঙ্গে কটা হাত বোমা, কটা গ্রেনেড, কটা মলোটভ ককটেল, কটা রিভলভার, ইত্যাদি আছে। এসব প্রশ্নের উত্তরে কেউ কি “হ্যা” লিখবে?

অফিসার : লিখতেও পারে। যারা নার্ভাস টাইপের চক্রান্তকারী তারা সব লিখে দিয়ে এখানেই সারেন্ডার করতে পারে।
যাত্রী : আর যারা দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ টাইপের চক্রান্তকারী, তারা?
অফিসার : তারা “না” লিখে বেরিয়ে যাবার চেষ্টা করবে। কিন্তু তারা ধরা পড়বে রেড চ্যানেলে অথবা গ্রীন চ্যানেলে। সকল যাত্রীকে উভয় চ্যানেলেই বডি সার্চ, লাগেজ সার্চ করা হচ্ছে।
যাত্রী : কিন্তু কন্সপিরেসি তো চিন্তা প্রসূত বিষয়। চিন্তার মধ্যেও তো চক্রান্ত থাকতে পারে। সেটা আপনারা চেক করবেন কি করে?
অফিসার (মৃদু হেসে) : সেটা চেক করার যন্ত্রও সরকার এয়ারপোর্টে বসিয়েছে। এক ধরনের লেটেস্ট সিটিস্ক্যানিং মেশিনে প্রতিটি যাত্রীর ব্রেইন স্ক্যান করা হচ্ছে। মেইড ইন ইসরেল। ইমপোর্টেড ভায়া ইনডিয়া। সব চক্রান্তই এই মেশিনে ধরা পড়ে যাবে।
যাত্রী : মনে হয় না। আই অ্যাম নট সো শিওর। চক্রান্ত বন্ধ করতে হলে অন্য কিছু করতে হবে।
অফিসার : কি করতে হবে?

যাত্রী : দেশে সন্দেহ এবং সাংঘর্ষিক রাজনীতি অনুসরণ না করে, সম্প্রীতি এবং সহঅবস্থানের রাজনীতি চালু করতে হবে। রিমান্ড, টর্চার ও মামলার রাজত্ব কায়েম না করে, কর্মসংস্থান, ন্যায্যমূল্য ও আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতিমূলক শাসন চালু করতে হবে। জনসাধারণের মনে বিরক্তি, ক্ষোভ ও ক্রোধ পুঞ্জিভূত হতে থাকলে, চক্রান্ত হতেই থাকবে। দয়া করে এই সহজ সত্যটা বোঝার চেষ্টা করুন। বিডিআরের ঘটনা কিন্তু সেই লেসনটাই সবাইকে দিয়েছিল। (ফর্মটা ফিরিয়ে দিয়ে) এই নিন আপনার ফর্ম। এটা আমি ফিল আপ করবো না।
অফিসার (কঠিন মুখে) : আপনার সমস্যা হবে।
যাত্রী : হতে পারে। আই ডোন্ট কেয়ার। দেখুন, যে কোনো দেশের প্রেসিডেন্ট, প্রাইম মিনিস্টারের প্রাণের ঝুকি সবসময়ই থাকে। ক্ষমতার আনন্দ ভোগের পাশাপাশি বিপদের সম্ভাবনা থাকে জেনেই পলিটিশিয়ানরা রাজনীতিতে আসেন। কিন্তু তার জন্য সাধারণ মানুষকে এত ভোগান্তির মধ্যে পড়তে হবে কেন? আমি ফর্ম ফিল আপ করবো না।
অফিসার : কন্সপিরেসি ডিক্লারেশন ফর্ম ফিল আপ করার শেষ সুযোগ আপনাকে দিচ্ছি।
যাত্রী : আইরিশ নাট্যকার অস্কার ওয়াইন্ড যখন নিউ ইয়র্কে গিয়েছিলেন, তখন তাকে এক কাস্টমস অফিসার প্রশ্ন করেছিলেন, হ্যাভ ইউ এনিথিং টু ডিক্লেয়ার? অস্কার ওয়াইন্ড উত্তরে বলেছিলেন, আই হ্যাভ নাথিং টু ডিক্লেয়ার একসেপটিং মাই জিনিয়াস (I have nothing to declare execpting my genius)। অস্কার ওয়াইন্ডের মতো জিনিয়াস আমার নেই। তাই আমি বলবো না, আমার জিনিয়াস ছাড়া আর কিছুই ডিক্লেয়ার করার নেই। তবে হ্যা, একটা জিনিস আমি ডিক্লেয়ার করতে চাই।
অফিসার : সেটা কি?
যাত্রী : (জ্যাকেটের পকেট থেকে একটা কালো চকচকে মোবাইল ফোন বের করে) : এটা। এটা অ্যাপলের লেটেস্ট আইফোন।
অফিসার (খুব কৌতূহলী হয়ে) : বাঃ। চমৎকার দেখতে তো! খুব বড় স্কৃন তো!
যাত্রী : এই মোবাইলে ফোন করা, ফটো তোলা, ভিডিও করা, ইমেইল করা, ইন্টারনেটে যাওয়া, সবকিছু সম্ভব। ইন্টারনেটে একটা পর্নো দেখবেন?
অফিসার (চারদিকে তাকিয়ে)। হ্যা। দেখবো। খুব তাড়াতাড়ি দেখান। কেউ যেন সন্দেহ না করে।
যাত্রী : নিশ্চয়ই।
এ কথা বলার পর যাত্রী কয়েকটা নাম্বার টিপে আই ফোনটা মুখের কাছে নিয়ে এসে বললেন, হ্যালো।  তুমি এখন একশনে যেতে পারো। রেডি, স্টেডি, গো।
সঙ্গে সঙ্গে বাইরে এক প্রচণ্ড বিস্ফোরণের শব্দ হলো।
এয়ারপোর্ট ভবনটা কেপে উঠলো।
কয়েকটা কাচের দেয়াল ভেঙে পড়লো।
অফিসার দৌড়ে পালালেন।
এয়ারপোর্ট ভবনের মধ্যে টহলরত আনসার, পুলিশ, র‌্যাব সবাই আতঙ্কিত হয়ে রাইফেল ফেলে ছোটাছুটি শুরু করলো। কেউ কেউ ফ্লোরে শুয়ে পড়লো।
অন্যান্য যাত্রী এবং সিভিল এভিয়েশন স্টাফরা আতংকে দিগবিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে পালাতে থাকলো।
সবাই নিরাপদ জায়গা খুজছিল।
কয়েকটা সিকিউরিটি এলার্ম বেল বিদঘুটে শব্দে বাজা শুরু করলো।
যাত্রী তার আইফোনটা পকেটে পুরে গটগট করে হেটে এয়ারপোর্ট ভবনের বাইরে এসে দাড়ালেন।
বাইরে সবাই আরো বেশি সন্ত্রস্ত হয়ে ছোটাছুটি করছিল।
কয়েকটা ভীত কাক ইলেকটৃক তারের ওপর জড়ো হয়ে কর্কশ স্বরে কা-কা করছিল।
একটা পাজেরো এসে যাত্রীর সামনে থামলো।
ড্রাইভার (পাজেরোর দরজা খুলে দিয়ে) : গুড মর্নিং স্যার।
যাত্রী : (গাড়িতে উঠে দরজা বন্ধ করে দিয়ে) সব কিছুই প্ল্যান মোতাবেক হলো দেখছি একসেলেন্ট। এ গুড জব হ্যাজ বিন ডান।
ড্রাইভার : হ্যা। সব কিছুই প্ল্যান মোতাবেক হয়েছে। (রিমোট কনট্রোলটা দেখিয়ে) তবে গ্যাস সিলিন্ডারটা বড় সাইজের কিনতে হয়েছিল। বেশি শব্দের জন্য। দামটা একটু বেশি পড়ে গিয়েছে।
যাত্রী : নেভার মাইন্ড। আমার আইফোনটা নিয়ে আমি বেরিয়ে আসতে পেরেছি। (পকেট থেকে আবার আইফোনটা বের করে পরম যত্নের সঙ্গে হাত বুলিয়ে) এখানেই সব সিক্রেট নাম্বারগুলো আছে!
২২ নভেম্বর ২০০৯

নাম রক্ষা করার সহজ উপায়


স্থান: লন্ডন
কাল: জুলাই ২০১০
চরিত্র: লন্ডন সফরকারী বাংলাদেশি বিজনেসম্যান আদিল, বৃটিশ ইমিগ্রেশন অফিসার জোনস, ট্যাক্সি ড্রাইভার টম, রানী এলিজাবেথের প্রাইভেট সেক্রেটারি ও রানী এলিজাবেথ।

দৃশ্য ১
এয়ারপোর্ট ইমিগ্রেশন কাউন্টার
বিজনেসম্যান আদিল (চিন্তিত চেহারায় পাসপোর্ট বাড়িয়ে দিয়ে): আচ্ছা, আমি কি সঠিক এয়ারপোর্টে এসেছি? চারদিকে নাম দেখছি সেইন্ট জর্জ (St. George) এয়ারপোর্ট। বিজ্ঞাপন দেখছি, ওয়েলকাম টু সেইন্ট জর্জ এয়ারপোর্ট, টেক এ ফাস্ট ট্রেন ফ্রম সেইন্ট জর্জ এয়ারপোর্ট টু সিটি সেন্টার, গেট ফর্টি পার্সেন্ট ডিসকাউন্ট অন ডিউটি ফ্রি গুডস অ্যাট সেইন্ট জর্জ এয়ারপোর্ট। এটা কি লন্ডনের হিথরো এয়ারপোর্ট নয়?
ইমিগ্রেশন অফিসার জোনস (পাসপোর্ট নিয়ে পাতা ওলটাতে ওলটাতে): স্যার, আপনি সঠিক এয়ারপোর্টেই ল্যান্ড করেছেন। এটাই হিথরো এয়ারপোর্ট। বৃটেনের সবচেয়ে বড় এয়ারপোর্ট তো বটেই — তাছাড়া বিশ্বের সবচেয়ে ব্যস্ত আন্তর্জাতিক এয়ারপোর্টও এটি। এই এয়ারপোর্ট দিয়ে বছরে প্রায় সাত কোটি প্যাসেঞ্জার এবং তের লাখ টন কার্গো চলাচল করে। লন্ডনের পশ্চিম দিকে ১৯৪৬-এ একটা তাবু খাটিয়ে এই এয়ারপোর্টের সূচনা হয়েছিল। এখন এই এয়ারপোর্টের চারটি টার্মিনাল ভবন আছে। টার্মিনাল ফাইভের উদ্বোধন হবে আগামী বছরে। আপনি এসেছেন টার্মিনাল থ্রিতে।
আদিল: তাহলে এখানে হিথরো এয়ারপোর্ট কোথাও লেখা নেই কেন? আগে তো ল্যান্ড করে সর্বত্রই দেখতাম, ওয়েলকাম টু হিথরো, সাইন। এখন সবখানেই দেখছি সেইন্ট জর্জ এয়ারপোর্ট সাইন! ব্যাপার কী?
জোনস: গত মাসে ইলেকশনে টোরি পার্টি বিরাট মেজরিটি নিয়ে জেতার পর নতুন প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন দলীয় নেতা ডেভিড ক্যামেরন। তারই অর্ডারে হিথরো এয়ারপোর্টের নাম বদলে গেছে। নতুন নাম হয়েছে সেইন্ট জর্জ এয়ারপোর্ট।
আদিল: সেইন্ট জর্জ? সেইন্ট জর্জ কে?
জোনস: সেইন্ট জর্জ হচ্ছেন ইংল্যান্ডের পেট্রন সেইন্ট। তার প্রতীক হচ্ছে একটি শাদা পটভূমিকায় একটি লাল ক্রস। এটাই ইংল্যান্ডের ফ্ল্যাগ এবং বৃটিশ ফ্ল্যাগেরও অংশ। ইউনিয়ন জ্যাক নামে যে বৃটিশ ফ্ল্যাগ আছে, সেটা মনোযোগ দিয়ে দেখুন। দেখবেন সেখানে একটি লাল ক্রস আছে। কথিত আছে, দ্বাদশ শতাব্দীতে ইংল্যান্ডের রাজা রিচার্ড দি লায়নহার্ট, যিনি ক্রুসেডের জন্য বিখ্যাত হয়েছিলেন, তিনি সেইন্ট জর্জের নামে লড়াই করতেন এবং পরবর্তী সময়ে তার নাম ইংল্যান্ডে প্রতিষ্ঠা করেন। এখন দেশের গভীর বিপদের সময়ে ইংল্যান্ডবাসীরা সেইন্ট জর্জের সাহায্য প্রার্থনা করে। কথিত আছে, সেইন্ট জর্জ ঘোড়ার পিঠে চড়ে, একটি লাল ক্রস আকা ঢাল নিয়ে, এক হিংস্র ড্রাগনের বিরুদ্ধে লড়াই করে বিজয়ী হয়েছিলেন। আসল সেইন্ট জর্জ ছিলেন একজন রোমান সৈন্য। ক্রিশ্চিয়ানদের যখন রোমানরা টর্চার করতো তখন সেইন্ট জর্জ তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন এবং তার ফলে তাকে মৃত্যুবরণ করতে হয়েছিল। আসল সেইন্ট জর্জ কখনোই কোনো ড্রাগনের বিরুদ্ধে লড়াই করেননি। সম্ভবত তিনি কখনো ইংল্যান্ডেও যাননি। তবু তিনি ইংল্যান্ডে নাম্বার ওয়ান পুণ্য ব্যক্তি রূপে গণ্য হন। তারই নামে এখন টোরি পার্টি হিথরোর নাম দিয়েছে সেইন্ট জর্জ এয়ারপোর্ট।
আদিল (বিস্মিত মুখে): হঠাৎ এ নাম বদল কেন হলো?
জোনস : জানি না স্যার। তবে মনে হয়, ইংল্যান্ডে বর্তমানে যে গভীর অর্থনৈতিক মন্দাবস্থা চলছে, সেটা থেকে উদ্ধার পাওয়ার আশায় নতুন প্রাইম মিনিস্টার ক্যামেরন এই সিদ্ধান্তটা নিয়েছেন। (গলার স্বর নামিয়ে) বিটউইন ইউ অ্যান্ড মি স্যার, এয়ারপোর্টের এই নাম বদলানোটা, আমরা, এয়ারপোর্টের কোনো স্টাফই পছন্দ করিনি। চৌষট্টি বছর ধরে এই এয়ারপোর্টকে আমরা হিথরো নামেই জানি। হঠাৎ বলা নেই কওয়া নেই, ডেভিড ক্যামেরন প্রাইম মিনিস্টার হয়েই নাম বদলে ফেলার আদেশ দিলেন। ইলেকশনের আগে টোরি পার্টি তাদের ম্যানিফেস্টোতেও বলেনি যে হিথরো এয়ারপোর্টের নাম তারা বদলে ফেলবে। ভেরি স্যাড স্যার, ভেরি স্যাড। জানি না গভর্নমেন্ট কোন দিকে যাচ্ছে। নাম বদলানোর চাইতে অনেক বেশি দরকার এই এয়ারপোর্টের ফ্যাসিলিটিগুলো সিঙ্গাপুর, ব্যাংকক, কুয়ালা লামপুর এয়ারপোর্টের মতো আরো উন্নত করা। তাতে যাত্রীরা উপকৃত হতো। (পাসপোর্টে সিল মেরে দিয়ে) হিয়ার ইউ আর স্যার। এনজয় ইয়োর ট্রিপ টু লন্ডন।
আদিল (পাসপোর্ট নিয়ে): থ্যাংক ইউ অফিসার।
দৃশ্য ২
এয়ারপোর্ট থেকে ট্যাক্সিতে সিটি সেন্টারে যাবার পথে।
আদিল: এটা ওয়েম্বলি স্টেডিয়াম না? এখানেই তো ১৯৬৬-এ ওয়ার্ল্ড কাপ ফুটবল ফাইনাল ম্যাচটি হয়েছিল।
ট্যাক্সি ড্রাইভার টম: হ্যা। তা ঠিক। এখানেই সব ইম্পরটেন্ট স্পোর্টিং ইভেন্টগুলো হয়। তবে এই স্টেডিয়ামের নাম পালটে গেছে। এর নাম হয়েছে স্যার উইনস্টন চার্চিল স্টেডিয়াম। সংক্ষেপে চার্চিল স্টেডিয়াম।
আদিল: কখন থেকে এই নতুন নাম হয়েছে?
টম: গত ইলেকশনে টোরি পার্টি জেতার পর থেকে। নতুন প্রাইম মিনিস্টার ডেভিড ক্যামেরনের অর্ডারে।
আদিল: কেন তিনি এই অর্ডার দিলেন?
টম: আপনি হয়তো জানেন দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময়ে উইনস্টন চার্চিল ছিলেন বৃটেনের প্রধানমন্ত্রী। তারই অনুপ্রেরণায় বৃটিশরা বিজয়ী হয়েছিল হিটলারের জার্মানির বিরুদ্ধে। চার্চিল ছিলেন টোরি নেতা। তাই তার নামে এখন টোরি পার্টি ওয়েম্বলি স্টেডিয়ামের নাম দিয়েছে চার্চিল স্টেডিয়াম।
আদিল: আপনার তথ্যে একটু ফাক আছে। সেপ্টেম্বর ১৯৩৯-এ যখন পোল্যান্ডের বিরুদ্ধে জার্মানি অভিযান চালায় তখন বৃটেন যুদ্ধ ঘোষণা করে। ওই সময়ে বৃটেনের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন নেভিল চেম্বারলেইন। ১০ মে ১৯৪০-এ জার্মানি যখন হল্যান্ড ও তার পাশের দেশগুলোর বিরুদ্ধে অভিযান চালায় তখন চেম্বারলেইন পদত্যাগ করেন। এরপর উইনস্টন চার্চিলের নেতৃত্বে টোরি, লেবার ও লিবারাল পার্টিকে মিলিয়ে, একটি অল পার্টি কোয়ালিশন বা সর্বদলীয় জোট সরকার গঠিত হয়। সেই সরকার ন্যাশনাল গভর্নমেন্ট বা জাতীয় সরকার নামে পরিচিত হয়েছিল। অর্থাৎ, দেশের ওই সঙ্কটের সময়ে চার্চিল কোনো দলীয় নেতা ছিলেন না — তিনি ছিলেন সর্বদলীয় সরকারের প্রধানমন্ত্রী। অথচ, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পয়ষট্টি বছর পরে চার্চিলকে ডিমোশন দেয়া হয়েছে। তাকে জাতীয় নেতা থেকে নামিয়ে দলীয় নেতা করা হয়েছে।
টম: এবার টোরি পার্টি ইলেকশনে জেতার পর থেকেই অনেক নাম বদলে ফেলছে। মনে হচ্ছে এটাই তাদের প্রধান কাজ। অথচ, তারা যে নাম বদলানোর কাজে এভাবে ঝাপিয়ে পড়বে তার বিন্দুমাত্র উল্লেখ ছিল না তাদের ইলেকশন ম্যানিফেস্টোতে।
আদিল: আর কোনো স্থাপনার নাম বদলানো হয়েছে?
টম: অনেক স্থাপনার নামই বদলানো হয়েছে। যেমন, লন্ডনের টপ হসপিটাল ওয়েলিংটন-হিউমানা-র নাম বদলে হয়েছে চার্চিল হসপিটাল, ম্যাডাম টুশো প্ল্যানেটারিয়ামের নাম বদলে হয়েছে চার্চিল নভোথিয়েটার, হাইড পার্কের নাম বদলে হয়েছে চার্চিল পার্ক। এমনকি কুইন এলিজাবেথ কনফারেন্স সেন্টারের নাম বদলে হয়েছে চার্চিল ইন্টারন্যাশনাল কনফারেন্স সেন্টার। এই যে, আমরা পৌছে গেছি চার্চিল হোটেলে।
আদিল (ট্যাক্সি থেকে নেমে): চার্চিল হোটেল! ভাগ্যিস নামটা আগে থেকেই ছিল।
টম (ট্যাক্সি থেকে আদিলের সুটকেস নামিয়ে): আপনি ভাড়া দেবেন কোন কারেন্সিতে?
আদিল: পাউন্ডেই দেব। এয়ারপোর্টে আমি কারেন্সি চেঞ্জ করে নিয়েছি। কিন্তু এই প্রশ্ন কেন?
টম: লক্ষ্য করে দেখুন, সব নোট বদলে গিয়েছে। আগে পাউন্ড নোটে রানীর ছবি ছিল। এখন সব নোটে শুধুই চার্চিলের ছবি ছাপা হয়েছে। টোরি পার্টি ক্ষমতায় এসেই এসব নতুন নোট ছেপেছে।
আদিল (মানিব্যাগ বের করে কয়েকটা নোট দেখে): আশ্চর্য! তাই তো!
দৃশ্য ৩
চার্চিল হোটেলে আদিলের রুম।
টেলিফোন বাজার শব্দ।
আদিল: হ্যালো। কে বলছেন?
অপর প্রান্ত থেকে টেলিফোন কলার: আমি মহামান্য রানীর প্রাইভেট সেক্রেটারি বলছি।
আদিল (চমকিত হয়ে): আপনি আমার সঙ্গে কথা বলতে চাইছেন?
প্রাইভেট সেক্রেটারি: বিশেষ জরুরি কারণে মহামান্য রানী চাইছেন আপনার সঙ্গে কিছু কথা বলতে। তিনি অনুরোধ করেছেন আমার সঙ্গে আপনাকে যেতে। আমি হোটেলের রিসেপশনে অপেক্ষা করছি। আপনি কি দয়া করে আসবেন? প্লিজ।
আদিল (অবাক হয়ে): মহামান্য রানী আমার সঙ্গে কথা বলতে চান! এ তো পরম সৌভাগ্য আমার। আমি আসছি। কিন্তু আমার সঙ্গে কেন কথা বলতে চান তিনি? তিনি কী করে জানলেন যে আমি এই হোটেলে আছি?
প্রাইভেট সেক্রেটারি: মহামান্য রানীর প্রাইভেট সিকিউরিটি নেটওয়ার্কের মাধ্যমে আমরা জেনেছি, আপনি লন্ডনে এসে নাম বদলের পালা দেখে কৌতূহল প্রকাশ করেছেন। আমরা এটাও জেনেছি যে আপনি উইনস্টন চার্চিল বিষয়ে জ্ঞান রাখেন। মহামান্য রানী এই বিষয়েই আলাপ করতে আগ্রহী।
দৃশ্য ৪
বাকিংহাম প্যালেস। দেয়ালে একটা স্কৃনের টিভি সাইলেন্টলি চলছে। কফি টেবিলের দুই দিকে মুখোমুখি আসনে আদিল এবং রানী এলিজাবেথ।
মহামান্য রানী এলিজাবেথ: বিনা নোটিশে আপনাকে ডেকে পাঠিয়েছি এ জন্য দুঃখিত। আপনি যে দয়া করে এসেছেন সে জন্য কৃতজ্ঞ।
আদিল: অ্যাট ইয়োর সার্ভিস, ইয়োর ম্যাজেস্টি।
রানী: আমি পত্রিকায় পড়েছি বৃটেনের আগে বাংলাদেশ নাম বদলের পালা শুরু করেছিল সেখানের নবনির্বাচিত সরকার। আমার নাম নিয়ে এখানের নবনির্বাচিত সরকার টানাহেচড়া করছে। আমাকে উপদেশ দিন, আমি বৃটেনে কীভাবে নিজের নাম রক্ষা করতে পারি।
আদিল: আমি কল্পনাও করতে পারিনি আমাকে এত বড় দায়িত্ব দেবেন। ইয়োর ম্যাজেস্টি, এক্ষেত্রে আপনার সামনে বোধহয় মাত্র দুটি পথই খোলা আছে। প্রথম পথটি হলো উইনস্টন চার্চিলকে জাতির রক্ষক ঘোষণা করুন। তার জন্ম ও মৃত্যু উভয় দিবসেই ছুটি দিন।
রানী: সে কী করে হয়? আমি তো ইংল্যান্ডের ডিফেন্ডার অফ দি ফেইথ বা ধর্মের রক্ষক। ১৫২১-এ পোপ দশম লিও এই টাইটেল দিয়েছিলেন রাজা অষ্টম হেনরিকে। তখন থেকে ইংল্যান্ডের সব রাজা বা রানী এই টাইটেল নিয়ে দেশ শাসন করেছেন। এখন চার্চিলকে যদি জাতির রক্ষক ঘোষণা করি এবং অন্যদিকে যদি আমি ধর্মের রক্ষক থাকি — তাহলে দেশবাসীর কাছে বিষয়টা খুব জটিল মনে হতে পারে। তাছাড়া চার্চিল তো আর জীবিত নেই। তিনি মারা গিয়েছেন পয়তাল্লিশ বছর আগে। তাকে নিয়ে টোরি পার্টি টানাহেচড়া করতে চায়, করুক। কিন্তু সেটা আমার রুচিতে বাধবে।
আদিল: তাহলে দ্বিতীয় পথে চেষ্টা করতে পারেন।
রানী: সেটা কী?
আদিল: আপনি বাংলাদেশের ব্যারিস্টার রফিক-উল হককে আপনার আইনজীবী নিযুক্ত করুন। তাকে লন্ডনে নিয়ে আসুন। সরকারের বিরুদ্ধে তাকে দিয়ে মামলা দায়ের করুন।
রানী: আমার দেশে এত বাঘা বাঘা সব কিউসি, ব্যারিস্টার থাকা সত্ত্বেও ব্যারিস্টার রফিক-উল হককে কেন?
আদিল: ব্যারিস্টার রফিক-উল হক সরকারের বিরুদ্ধে মামলা লড়তে এক্সপার্ট। তার সাকসেস রেট ভালো। ইংল্যান্ডেও তিনি সফল হতে পারেন।
টেলিভিশনে ব্রেকিং নিউজ স্ক্রল দেখে রানী তুলে নিলেন রিমোট কনট্রোল।
রানী: এক্সকিউজ মি। একটু নিউজটা শুনে নিই। আমার সম্পর্কেই ব্রেকিং নিউজ যাচ্ছে। বৃটেনের সব ডাকটিকেট থেকে আমার ছবি বাদ দিয়ে চার্চিলের ছবি ছাপার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। আমার ব্যক্তিগত সম্পত্তি বাকিংহাম প্যালেসেরও নতুন নাম দিয়েছে সরকার…।
আদিল: নিশ্চয়ই চার্চিল প্যালেস?
রানী (বিষণ্ন মুখে টিভি নিউজ দেখতে দেখতে): হ্যা। তাই। আমার মনে হচ্ছে, ইংল্যান্ডের নামও বদলিয়ে সরকার নতুন নাম দেবে চার্চিল্যান্ড।
নিউজ শেষের পর টিভি অফ করলেন রানী।
রানী: ঠিক আছে। আমি দ্বিতীয় পথেই যাবো। আমি তো সরকারকে এড়িয়ে ঢাকায় বৃটিশ হাই কমিশনারের মাধ্যমে ব্যারিস্টার রফিক-উল হকের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারবো না। আপনি কি এই দায়িত্বটা নিতে পারবেন? প্লিজ।
আদিল: নিশ্চয়ই ইয়োর ম্যাজেস্টি। ১৯৬৩-তে ইয়েন ফ্লেমিং লিখেছিলেন তার জেমস বন্ড সিরিজের একাদশতম উপন্যাস অন হার ম্যাজেস্টিস সিক্রেট সার্ভিস। সাতচল্লিশ বছর পরে আমি অন হার ম্যাজেস্টিস সিক্রেট লিগাল সার্ভিসের দায়িত্ব পেয়ে খুবই গর্বিত বোধ করছি। (হাটু গেড়ে বসে) আই অ্যাম অনার্ড। থ্যাংক ইউ, ইয়োর ম্যাজেস্টি।

৯ মার্চ ২০১০

রাষ্ট্রীয় সফর সফল করার সহজ উপায়


দৃশ্য ১.
স্থান : চায়নার রাজধানী বেইজিংয়ে গ্রেট হল অফ দি পিপল-এ রাষ্ট্রীয় মিটিং রুম।
কাল : ১৮ মার্চ ২০১০
চরিত্র : চায়নার প্রধানমন্ত্রী (চাপ্রম), বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী (বাপ্রম) এবং দুজন ইন্টারপ্রেটার বা দোভাষী।
চাপ্রম : চায়নায় আপনাকে স্বাগতম জানাচ্ছি। আমরা আন্তরিকভাবে আশা করি আপনার এই সফরের পর চায়না-বাংলাদেশ বন্ধুত্ব সম্পর্ক এক নতুন পর্যায়ে উন্নীত হবে।
বাপ্রম : আমরাও ঠিক সেই রকমটাই আশা করি।
চাপ্রম : পূর্ব অনুষ্ঠিত আলোচনা অনুযায়ী আমরা আজ এখানে উপস্থিত হয়েছি তিনটি অ্যাকর্ড বা চুক্তিপত্র এবং একটি এমওইউ বা সমঝোতাপত্রে স্বাক্ষর করতে।
বাপ্রম : হ্যা। এই তিনটি চুক্তিপত্র হবে, এক. অর্থনৈতিক ও কারিগরি খাতে সহযোগিতা যেখানে চায়না দেবে পর্যাপ্ত গ্রান্ট বা মঞ্জুরি, দুই. শাহজালাল ফার্টিলাইজার ফ্যাক্টরি নির্মাণের একটি কাঠামো প্রস্তুত এবং তিন. সপ্তম বাংলাদেশ-চায়না মৈত্রী সেতু নির্মাণ বিষয়ে। আর সমঝোতাপত্রটি হবে তেল ও গ্যাস খাতে বাংলাদেশ-চায়নার সহযোগিতা বিষয়ে।
চাপ্রম : চমৎকার। আপনি সবই জানেন দেখছি। বেইজিংয়ে আর কি করতে চান আপনি?
বাপ্রম : ২০০৮-এর অলিম্পিক গেমস উপলক্ষে নির্মিত বেইজিংয়ের স্টেডিয়ামটা দেখবো।
চাপ্রম : এই স্টেডিয়ামটা দর্শনীয় স্থানই বটে। ৪২৩ মিলিয়ন আমেরিকান ডলার খরচ করে এই স্টেডিয়ামটা আমরা বানিয়েছিলাম। এটিই হচ্ছে বিশ্বের সর্ববৃহৎ স্টিল স্ট্রাকচার। এর নাম স্টিলের খাচা হওয়াই সঙ্গত ছিল। তবে এর নাম আমরা দিয়েছি বার্ডস নেস্ট বা পাখির নীড়। কিন্তু এখনো চায়নার সবচেয়ে বড় দর্শনীয় স্থান হচ্ছে দি গ্রেট ওয়াল বা চায়নার বিশাল দেয়াল। এই গ্রেট ওয়াল বিষয়ে তথ্যগুলো জানলে আপনি অবাক হয়ে যাবেন।
বাপ্রম : দয়া করে কয়েকটি তথ্য আমাকে বলবেন কি?
চাপ্রম : অবশ্যই। আনন্দের সঙ্গে বলবো। যিশু খৃস্টের জন্মের পাচশ বছর আগে অর্থাৎ আজ থেকে প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে চায়নার উত্তর অঞ্চলে এই দেয়াল বানানোর কাজ শুরু হয়েছিল। তারপর প্রায় ২১০০ বছর জুড়ে এই দেয়াল নির্মাণ, মেরামতি, পুনঃনির্মাণ প্রভৃতি কাজ চলে ষোড়শ শতাব্দী পর্যন্ত। পাথরে তৈরি এই দেয়াল তৈরি করা হয়েছিল চায়নিজ সাম্রাজ্যের উত্তর সীমান্তকে রক্ষার জন্য। মিং বংশের রাজত্বের সময়ে এই দেয়ালের বেশিরভাগ তৈরি হয়েছিল। পূর্বে শানহাইগুয়ান থেকে পশ্চিমে লপ নুর পর্যন্ত বিস্তৃত এই দেয়ালটির তার শাখা-প্রশাখাসহ দৈর্ঘ ৮,৬৫১ কিলোমিটার বা ৫,৫০০ মাইল। এটি চওড়ায় সর্বোচ্চ ৯.১ মিটার বা ৩০ ফিট। চিন্তা করুন ৩০ ফিট চওড়া দেয়াল ৫,৫০০ মাইল জুড়ে চায়নাকে শতাব্দীর পর শতাব্দী সুরক্ষিত রেখেছে। (হাসি মুখে) পৃথিবীর সপ্তম আশ্চর্যের অন্যতম এই দি গ্রেট ওয়াল।
বাপ্রম : এই ওয়াল আমি দেখেছি। সত্যিই অতি আশ্চর্যজনক সৃষ্টি!
চাপ্রম : এই পাচ দিন সফরের শেষ দিনে আপনি যাবেন, কুনমিংয়ে। সেখানে আপনার সঙ্গে দেখা হবে ইউনান প্রদেশের গভর্নর মি. জিন গুয়াগং-য়ের সঙ্গে। যদিও আমরা আজকে তিনটি চুক্তিপত্র এবং একটি সমঝোতাপত্রে সই করবোÑ তবুও এসবই বাস্তবায়িত হবে একটি শর্ত সাপেক্ষে।
বাপ্রম (অবাক হয়ে) : একটি শর্ত! সেই শর্তটা কি? এ বিষয়ে আমার পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. দীপু মনি এবং পররাষ্ট্র দফতর তো কিছুই আমাকে বলেনি!
চাপ্রম : এটা ওরা কেউ জানেন না। আপনাকে এই শর্ত বিষয়ে জানাবেন গভর্নর জিন গুয়াগং। তার আগে আগামীকাল আপনার সঙ্গে দেখা হবে আমাদের প্রেসিডেন্ট হু জিনতাও-য়ের সঙ্গে। আশা করি আপনার এই সৌজন্য সাক্ষাৎ আনন্দদায়ক হবে।
দৃশ্য ২
স্থান : এমপার্ক গ্র্যান্ড হোটেল, কুনমিং
কাল : ২১ মার্চ ২০১০, লাঞ্চ আওয়ার
পাত্র : ইউনান প্রদেশের গভর্নর জিন গুয়াগং, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী, দুজন ইন্টারপ্রেটার এবং দুজন ফুড টেস্টার।
জিন গুয়াগং : অনেক ধন্যবাদ এই লাঞ্চে অতিথি হবার জন্য। আপনি জানেন কুনমিংয়ে কিছু বাংলাদেশি আছেন। বাংলাদেশি খাবারের জায়গা আছে। আমরা ইচ্ছা করলে আপনার জন্য বাংলাদেশি খাবারের আয়োজন করতে পারতাম। কিন্তু আমরা মনে করেছি চায়নাতে এসে আপনি চায়নিজ খাবারই খেতে পছন্দ করবেন। তাই আজকের লাঞ্চ মেনুতে সব চায়নিজ।
বাপ্রম : ঠিকই করেছেন। তবে দেখবেন সব যেন হালাল হয়। সাপ, ব্যাঙ, ইদুর, কুকুর যেন না থাকে।
জিন গুয়াগং : আমরা সে বিষয়ে কড়া নজর রেখেছি। সব হালাল এবং বিষমুক্ত খাবার ও পানীয় সার্ভ করা হবে। কোনো খাবার এবং পানীয়তে বিষ আছে কি না সেটা পরীক্ষা করার জন্য দুজন ফুড টেস্টার আমরা রেখেছি। প্রতিটি খাবার ও পানীয় সার্ভ হবার আগে ওরা দুজন (উপস্থিত দুই ফুড টেস্টারের দিকে আঙ্গুল দেখিয়ে) টেস্ট করে দেখবেন। তারপর সেটা আপনাকে সার্ভ করা হবে। আমরা জানি আপনি অভিযোগ করেছেন বাংলাদেশে সেনা-সমর্থিত গত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে যখন সাবজেলে বন্দি ছিলেন তখন আপনাকে স্লো ফুড পয়জনিং করা হয়েছিল। তাই চায়নাতে আপনাকে যেসব ফুড ও ড্রিংকস সার্ভ করা হয়েছে এবং হবে সেসব সম্পর্কে আমরা একস্ট্রা কেয়ারফুল আছি।
বাপ্রম : আপনাদের দূরদর্শিতার তারিফ করতেই হয়। কি খাওয়াবেন আজ?
জিন গুয়াগং : ট্রাডিশনাল চায়নিজ খাবার সাধারণত ছোট ছোট টুকরো বা পোর্শনে হয়, ফলে সেসব চপ স্টিকস দিয়ে খেতে সুবিধা হয়। সাধারণত চায়নিজ মেনু তৈরি হয় বিপরীত জাতীয় ফুডকে ব্যালান্স করে। যেমন হট ফুডকে ব্যালান্স করা হয় কোল্ড ফুড দিয়ে। পিকলড ফুড বা আচার জাতীয় সংরক্ষিত ফুড ব্যালান্স করা হয় ফ্রেশ ফুড দিয়ে। অনেক মশলাযুক্ত ফুড ব্যালান্স করা হয় কম মশলাযুক্ত ফুড দিয়ে। আমরা শুরু ও শেষ করবো চায়নিজ টি দিয়ে। আপনি বোধ হয় জানেন, চায়নিজরা মনে করে জীবন ধারণের সবচেয়ে প্রয়োজনীয় সাতটি বস্তু হচ্ছে, জ্বালানি কাঠ, চাল, তেল, লবণ, সয়া সস, ভিনিগার এবং চা।
বাপ্রম : এটা জানতাম না।
জিন গুয়াগং : আমরা টেবিলে ছুরি-কাটাচামচ রেখেছি। ইচ্ছা করলে সেসব ব্যবহার করতে পারেন। পাশেই চপ স্টিকসও রেখেছি। ৩,২০০ বছর আগেও আমরা চায়নিজরা চপ স্টিকস দিয়েই যে খেতাম তার প্রমাণ পাওয়া গেছে ইয়িন-এর ধ্বংসাবশেষে। সভ্য আচার-আচরণের বিকাশ যে প্রথম চায়নাতেই হয়েছিল তার প্রমাণ ৩,২০০ বছর আগেও চায়নিজরা আঙ্গুল দিয়ে নয়, চপ স্টিকস দিয়ে খেত।
বাপ্রম : চপ স্টিকস ধরা জানি না। তাই আমি আজ কাটাচামচ দিয়ে খাবো।
জিন গুয়াগং : শুরু করা যাক তাহলে।
ডাইনিং টেবিলে খাবার ও পানীয় সার্ভ শুরু হলো। ফুড টেস্টার দুজন সেসব চেখে দিলেন।
জিন গুয়াগং (খেতে খেতে) : আমাদের প্রধানমন্ত্রী মি. ওয়েন জিয়াবাও বিষয়ে আপনি কি জানেন?
বাপ্রম : তিনি গণপ্রজাতন্ত্রী চায়নার স্টেট কাউন্সিলের ষষ্ঠ এবং বর্তমান প্রধানমন্ত্রী। স্ট্যান্ডিং কমিটিরও সদস্য তিনি। দেশের প্রকৃত ক্ষমতার অধিকারী এই স্ট্যাডিং কমিটি এবং এর নয় সদস্যের মধ্যে তার স্থান তৃতীয়। (হেসে) অর্থাৎ, চায়নাতে তিনিই সবচেয়ে ক্ষমতাধর ব্যক্তি। একদিকে প্রধানমন্ত্রী এবং অন্যদিকে স্ট্যান্ডিং কমিটির তিন নাম্বার সদস্য।
জিন গুয়াগং : উত্তরাধিকার সূত্রে নয়, নিজের যোগ্যতা বলেই তিনি শীর্ষে পৌছেছেন। পেশাগতভাবে তিনি একজন জিওলজিস্ট ও ইঞ্জিনিয়ার। বেইজিং ইন্সটিটিউট অফ জিওলজি থেকে পোস্ট গ্র্যাজুয়েট ডিগ্রি নিয়েছেন। চায়নার কমিউনিস্ট পার্টিতে এখন যে চতুর্থ প্রজন্ম নেতৃত্ব দিচ্ছে, তিনি তার মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছেন।
বাপ্রম : তার সঙ্গে কথা বলে আমি মুগ্ধ হয়েছি। তবে সেই আলোচনার শেষে তিনি একটা রহস্য করেন। তিনি একটা শর্তের কথা বলেছিলেন, যেটা…
জিন গুয়াগং : হ্যা। সেটা আপনাকে অবশ্যই বলবো। তার আগে বলুন, আপনি কি মনে করেন, আপনার এই চায়না সফর সফল হয়েছে? আপনার সব আশা পূরণ করেছে?
বাপ্রম : আমার তো মনে হয় খুব সফল হয়েছে। অবশ্য শর্তটা জানলে আমি এই সাফল্য সম্পর্কে নিশ্চিত হতে পারতাম।
জিন গুয়াগং : আপনি কি ডিপ সিপোর্ট বা গভীর সমুদ্রবন্দর এবং চট্টগ্রাম থেকে মিয়ানমার হয়ে কুনমিং পর্যন্ত রোড ও রেল যোগাযোগ বিষয়ে আলোচনা করতে চান না? আপনাকে জানিয়ে রাখি আমরা মিয়ানমার, শ্রী লংকা এবং পাকিস্তানে ডিপ সিপোর্ট তৈরি করতে যাচ্ছি। আমাদের ইচ্ছা ছিল বাংলাদেশের সমুদ্রসীমায় একটা সিপোর্ট করে দেব।
বাপ্রম (চিন্তিত মুখে) : সেক্ষেত্রে এটা কি মনে হতে পারে না যে ইনডিয়াকে ঘিরে রাখার জন্য চারটি সিপোর্ট আপনারা করতে চান?
জিন গুয়াগং : সেটা ইনডিয়া মনে করতে পারে বৈকি। চট্টগ্রাম-কুনমিং রোড-রেল যোগাযোগ স্থাপিত হলে ইনডিয়া আরো মনে করতে পারে, বাংলাদেশ তাদের এড়িয়ে সরাসরি চায়নার সঙ্গে আরো ঘনিষ্ঠ স্ট্র্যাটেজিক সম্পর্ক স্থাপন করতে চাইছে। আমাদের প্রধানমন্ত্রী ওয়েন জিয়াবাও আশা করেছিলেন আপনি এই সেন্টিমেন্টের ঊর্ধে উঠে একটা দেয়াল নির্মাণ বিষয়েও আমাদের সাহায্য চাইবেন।
বাপ্রম : সেজন্যই কি তিনি দি গ্রেট ওয়াল সম্পর্কে এত তথ্য আমাকে দেন?
জিন গুয়াগং : হ্যা। আমরা জানি আপনার পার্টি ক্ষমতায় আসার পরে ফেব্রুয়ারি ২০০৯-এ ঢাকায় বিডিআর বিদ্রোহ হয়েছিল। তারপর থেকে বাংলাদেশের সীমান্ত প্রায় অরক্ষিত আছে। বিডিআর সদস্যদের নিরস্ত্র রাখা হয়েছে। আমরা অবশ্য এটাও জানি যে আপনি ফিরে গিয়ে কিছু অস্ত্র দেবেন। কিন্তু আমরা ভেবেছিলাম, ইনডিয়ার সঙ্গে সীমান্ত রক্ষা সমস্যাটির স্থায়ী সমাধানের জন্য দি গ্রেট ওয়ালের মডেলে একটা ওয়াল তৈরির জন্য আমাদের সাহায্য চাইবেন। ইনডিয়া কাটাতারের বেড়া দিচ্ছে। আপনারা পাথরের ওয়াল দিন। এতে দেশের সুরক্ষা হবে। চোরাচালান বন্ধ হবে। বিএসএফের গুলিতে আর বাংলাদেশি নিহত হবে না। চাই কি একটা টুরিস্ট এট্রাকশনও হতে পারে এই ওয়াল।
বাপ্রম : বিষয়টি নিয়ে ভেবে দেখতে হবে। এর সঙ্গে ইনডিয়া জড়িত। কিন্তু এখন বলুন সেই শর্তটা কি যার ওপরে নির্ভর করছে চুক্তিগুলোর বাস্তবায়ন।
জিন গুয়াগং : আপনি জানেন, আপনার পিতার শাসন আমলে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়নি চায়না। পাকিস্তানের সঙ্গে সুদীর্ঘকালের বন্ধু সম্পর্কের মূল্য দেয়ার কারণে আমরা একাত্তরে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে সমর্থন করিনি। তারপর বাংলাদেশ স্বাধীন হলেও আমরা স্বীকৃতি দেইনি। শেখ মুজিবুর রহমানের মৃত্যুর পরে আমরা স্বীকৃতি দিয়েছিলাম। তারপর জিয়াউর রহমান যখন বাংলাদেশের শাসক হন তখন চায়না-বাংলাদেশ সম্পর্কে নতুন মোড় নেয়। জিয়াউর রহমানের উদ্যোগে আমাদের দুই দেশের মধ্যে বন্ধু সম্পর্ক গড়ে ওঠে। তিনি প্রয়াত হলেও আমরা তাকে শ্রদ্ধা করি।
বাপ্রম (মুখে গভীর বিরক্তির চিহ্ন) : আপনি জিয়াউর রহমানের কথা টেনে আনছেন কেন? শর্তের সঙ্গে ওই অখ্যাত মেজরটার সম্পর্ক কি?
জিন গুয়াগং : সম্পর্ক আছে বলেই তো বলছি। আপনি জানেন আধুনিক চায়নার রূপকার ছিলেন আমাদের পরম শ্রদ্ধেয় নেতা দেং জিয়াও পিং। আপনি জানেন আমাদের প্রধানমন্ত্রী ওয়েন জিয়াবাও। আর কুনমিং এয়ারপোর্ট থেকে যখন দেশে ফিরবেন তখন লক্ষ্য করবেন চায়নার এই সপ্তম বৃহৎ এয়ারপোর্টের নাম কুনমিং উজিয়াবা এয়ারপোর্ট। আমরা জানি, জিয়া নামের প্রতি আপনার প্রচন্ড এলার্জি আছে। জিয়া নাম দেখলেই আপনি তা বদলে ফেলার নির্দেশ দেন। তাই আমাদের শর্ত থাকবে চায়না-বাংলাদেশের কোনো চুক্তিপত্র, সমঝোতাপত্র, স্মারকপত্র, সফরসূচি, কর্মসূচি প্রভৃতিতে দেং জিয়াও পিং, ওয়েন জিয়াবাও, উজিয়াবা এয়ারপোর্ট প্রভৃতি নাম বদলানো যাবে না, বাদও দেয়া যাবে না। বহু চায়নিজ নামের অচ্ছেদ্য অংশ জিয়া এবং সেটা বজায় রাখতে হবে। এটাই আমাদের একমাত্র পূর্বশর্ত।

৫ এপ্রিল ২০১০

নিউ ইয়র্কে নেড়িকুকুরের ইন্টারভিউ



sr১৭ ও ১৮ জুলাই ২০১০-এ নিউ ইয়র্কে আমেরিকা-বাংলাদেশ-কানাডা কনভেনশন (সংক্ষেপে এবিসি কনভেনশন)-এ এবার নিমন্ত্রিত হয়েছিলেন নেড়িকুকুর।
সমবেত মানুষবৃন্দ,
প্রথমেই আমি এবিসি কনভেনশনের আয়োজকদের ধন্যবাদ জানাতে চাই এই রকম একটি বিরাট আন্তর্জাতিক সম্মেলনে বাংলাদেশের এক নেড়িকুকুরকে নিমন্ত্রণ করার জন্য।
থ্যাংক ইউ। ঘেউ ঘেউ।
আর তারপর ধন্যবাদ জানাতে চাই আপনাদের সবাইকে, যারা এখানে এসেছেন আমার কথা শুনতে।
থ্যাংক ইউ। ঘেউ ঘেউ।
এবিসি কনভেনশন আয়োজকরা যে আমাকে, নেড়িকুকুরকে, নিমন্ত্রণ করেছেন তাতে আনন্দিত হলেও, অবাক হইনি। কারণ, আমেরিকানরা কুকুর ভালোবাসে। আমেরিকায় সাড়ে ছয় কোটি কুকুর আছে। অর্থাৎ গড়ে প্রতি পাচজন আমেরিকানের একটি কুকুর আছে। ৮৩ শতাংশ আমেরিকান বলেন, তারা তাদের কুকুরের প্রাণ রক্ষায় নিজের জীবনের ঝুকি নিতে প্রস্তুত আছেন। আর ২৭ শতাংশ আমেরিকান উইল করে বলে যান মৃত্যুর পরে তাদের পোষা কুকুরটির দেখাশোনা কিভাবে করতে হবে। আমেরিকানদের এই কুকুরপ্রীতি সাধারণ মানুষ থেকে প্রেসিডেন্ট পর্যন্ত বিদ্যমান।
আপনারা জানেন, বারাক হুসেন ওবামা প্রেসিডেন্ট হবার পরে পূর্ব প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী একটি কুকুর তার দুই মেয়েকে উপহার দিয়েছেন যার নাম বি.ও অর্থাৎ বারাক ওবামা ইংরেজি বানানের দুটি আদ্যাক্ষর। লক্ষণীয় যে, তার কুকুরের নামকরণে হুসেন-এর আদ্যক্ষরটি বাদ পড়ে গিয়েছে। বস্তুত, প্রেসিডেন্ট পদে শপথ নেয়ার সময়ে একবার উচ্চারিত হুসেন শব্দটি, এখন আমেরিকায় প্রশাসন থেকে শুরু করে মিডিয়া পর্যন্ত হারিয়ে গিয়েছে। যারা এই কা-টি করেছেন, তারা হয়তো প্রেসিডেন্টের সঙ্গে জন্মসূত্রে ইসলামের সম্পৃক্ততার বিষয়টি মুছে দিতে চেয়েছেন। তাই তারা ওবামার পোষা কুকুরের নামে হুসেনের আদ্যক্ষর, এইচ, দিতে চাননি। এটা একটা কারণ হতে পারে।
আরেকটা কারণ হতে পারে একটি ইসলামি শব্দের সঙ্গে কুকুরের সম্পৃক্ততা তারা চাননি। কারণ ইসলামের সঙ্গে কুকুরের বরাবরই একটা দূরত্ব আছে।
আর তাই এবিসি কনভেনশনে যোগ দেয়ার জন্য এয়ার টিকেট পাওয়ার পরে আমি দুঃশ্চিন্তায় ছিলাম। ভাবছিলাম ঢাকায় জিয়া ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টের নতুন নাম হয়েছে হজরত শাহজালাল (রাঃ) ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট। এই পবিত্র নামধারী এয়ারপোর্টের মধ্য দিয়ে এক নেড়িকুকুরকে যেতে দেয়া হবে তো?
প্রশ্নটি আমার মনে ঘুরপাক খাচ্ছিল। যদি ইমিগ্রেশন অথরিটি অভিযোগ করে, আমি এয়ারপোর্টের পবিত্রতা লংঘন করেছি এবং সেই অভিযোগে যদি তারা আমাকে অ্যারেস্ট করে, রিমান্ডে নেয়? আর বাংলাদেশে, যেটা এখন মামলাদেশে রূপান্তরিত হয়েছে, সেখানে রিমান্ড মানেই তো টর্চার! আর এসব টর্চারে মানুষ মারাও যাচ্ছে। বিডিআর বিদ্রোহের মামলায় বিচারাধীন ৫৬ আসামির মৃত্যু হয়েছে।

শুধু টর্চারই না, মামলাদেশে ব্যক্তিবিশেষকে রিমান্ডে নিয়ে তাকে বিবস্ত্রও করা হয়। দৈনিক আমার দেশ পত্রিকার ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মাহমুদুর রহমানকে বিবস্ত্র করা হয়েছিল। কেন যে তারা রিমান্ডে নিয়ে মানুষকে বিবস্ত্র করে তা আমি জানি না। তবে ন্যাংটার যেমন বাটপাড়ের ভয় নেই, তেমনি নেড়িকুকুরের বিবস্ত্রকারী ডিবি পুলিশের ভয় নেই। কারণ আমরা তো সবসময়ই বিবস্ত্র আছি!
সে যাই হোক। হজরত শাহজালাল (রাঃ) এয়ারপোর্ট ইমিগ্রেশন অথরিটিকে ধন্যবাদ, তারা আমাকে যেতে দিয়েছেন।
So, here i come America. (সো, হিয়ার আই কাম আমেরিকা)।
আমেরিকা, আমি এসে পড়েছি।
ঘেউ ঘেউ।
নিউ ইয়র্কে গত কয়েক ঘণ্টা থাকার পর ঢাকার সঙ্গে কয়েকটি বড় মিল-গরমিল আমার চোখে পড়েছে।
নিউ ইয়র্কে মানুষ এবং কুকুর, দিনে এবং রাতে নির্ভয়ে চলাফেরা করতে পারে। পথে ছিনতাইকারীদের ভয় নেই। ঢাকনাবিহীন ম্যানহোলের মৃত্যুফাদ নেই। বিকলাঙ্গ ভিখারির হাতছানি নেই। ঢাকার পথে এ সবই আছে। প্লাস এখন যোগ হয়েছে পথে আচমকা গ্রেফতার হয়ে যাবার ভয়। যেমনটা হয়েছেন আমেরিকায় নিযুক্ত সাবেক রাষ্ট্রদূত শমসের মবিন চৌধুরী। তিনি এখন জেলে আছেন। ঢাকার পথে এখন আরেকটা ভয় হচ্ছে হঠাৎ নিখোজ হয়ে যাওয়া। কমিশনার চৌধুরী আলমকে পথ থেকে সবার সামনে ধরে নিয়ে গিয়েছে শাদা পোশাকের কিছু লোক। তার কোনো খোজ পাওয়া যাচ্ছে না।
নিউ ইয়র্কের সঙ্গে ঢাকার একটি ন্যাক্কারজনক মিল আমি দেখেছি। ঢাকার পথে মানুষ পেচ্ছাব-পায়খানা করে, বা বলা উচিত, পাবলিক টয়লেটের অভাবে করতে বাধ্য হয়। আর নিউ ইয়র্কের পথে সতর্কতামূলক নোটিশ থাকা সত্ত্বেও কুকুর পেচ্ছাব-পায়খানা করে।
আকাশছোয়া বিলডিং বা স্কাইস্ক্র্যাপারের শহর নিউ ইয়র্ক। এসব বিলডিং নির্মাণ সমাপ্তির পরে তা ভেঙ্গে ফেলার কথা ওঠেনি। ঢাকায় হাইরাইজ বিলডিং নির্মাণ সমাপ্তির পর তা ভেঙ্গে ফেলার কথা ওঠে। যেমন, সম্প্রতি গুলশানে ওয়েস্টিন হোটেল এবং জব্বার টাওয়ার যে অবৈধভাবে নির্মিত হয়েছে সে কথা উঠেছে। এই ধরনের অভিযোগে বছর দুয়েক আগে র‌্যাংগস টাওয়ার ভেঙ্গে ফেলা হয়েছে। তবে, একই অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও বিজিএমইএ বিলডিং ভাঙা হয়নি। আশ্চর্য লাগে ভেবে, যখন নির্মাণ কাজ শুরু হয়, তখন এই ধরনের অভিযোগ কেন ওঠে না?
আরেকটি তফাৎ চোখে পড়েছে। নিউ ইয়র্ক ও সংলগ্ন এলাকায় দুই কোটির বেশি মানুষ বসবাস করলেও এবং এত গাড়ি থাকলেও পথে জনযট নেই–যানজটও নেই। চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় প্লেনে পৌছাতে লাগে ৪৫ মিনিট। কিন্তু তারপর ঢাকা এয়ারপোর্ট থেকে ঢাকা সিটি সেন্টারে পৌছাতে সময় লাগতে পারে দুই ঘণ্টার বেশি।
আমি দেখেছি, নিউ ইয়র্কে, এয়ারপোর্ট থেকে সিটি সেন্টারে পৌছানো ত্বরান্বিত করতে এক্সপ্রেসওয়ে আছে, রেল সিসটেম আছে। বাংলাদেশের বর্তমান ডিজিটাল সরকারও বলছে, ঢাকায় এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে হবে, ইলেকট্রিক ট্রেন চলাচল করবে।
যেসব সময়ে এসব কথা সরকার বলেছে ঠিক সেই সময়েই ইলেকট্রিসিটির অভাবে সাধারণ মানুষ ওয়ার্ল্ড কাপ ফুটবল ম্যাচ দেখতে না পেরে বিদ্যুৎকেন্দ্র ঘেরাও করেছে, বিক্ষোভ মিছিল করেছে, ভাংচুর করেছে। বিদ্যুৎ ও গ্যাসের অভাবে পুজি বিনিয়োগ বন্ধ হয়ে গিয়েছে। বাংলাদেশের রাজধানীতে এখন বহু স্থানে প্রতি এক ঘণ্টা অন্তর বিদ্যুৎ সাপ্লাই বন্ধ হয়ে যায়, মফস্বল ও গ্রামের অবস্থা আরো করুণ। কোনো কোনো স্থানে রাতে-দিনে মাত্র দুই ঘণ্টা বিদ্যুৎ থাকছে।
পরিস্থিতিটা নিউইয়র্কে থেকে আপনাদের পক্ষে কল্পনা করা অসম্ভব। চিন্তা করে দেখুন, সম্মেলন চলার সময়ে কনভেনশন হলের বিদ্যুৎ যদি চলে যায়!
নিউ ইয়র্কের সঙ্গে ঢাকার আরেকটা তফাৎ দেখলাম। এখানে পথে পথে চমৎকার সব খাবার দোকান আছে এবং ভালো খাবার সাধারণ মানুষের খরচ করার সামর্থের মধ্যে। কিন্তু ঢাকা তথা বাংলাদেশে চাল, ডাল, পেয়াজ, শাকসবজি ও তেলের দাম বেড়েই চলেছে। আগামী রোজার মাসে আরো বাড়বে। মোটা চালের কেজি এখন হয়েছে ৩৬ টাকা। ১০ টাকা কেজি দরে চাল দেয়ার নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি হয়ে গিয়েছে নিখোঁজ। ঘরে ঘরে চাকরির প্রতিশ্রুতিও দেয়া হয়েছিল নির্বাচনী জনসমাবেশে। বরং এখন দেখা যাচ্ছে, বহু দেশে চাকরি হারিয়ে অনেক মানুষ বাংলাদেশে ফিরে আসতে বাধ্য হচ্ছে।
এই পরিস্থিতিতে আমি নেড়িকুকুর উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছি। সাধারণ মানুষেরই যদি খাবার না জোটে, তাহলে আমরা নেড়িকুকুররা তাদের উচ্ছিষ্ট কোথায় পাবো?
এসব চিন্তাভাবনা নিয়ে প্রতিবাদ জানাতে গেলে আরো বিপদ হতে পারে। সম্প্রতি বাংলাদেশে চালু হয়েছে গায়েবি গণসমন জারি। মাহমুদুর রহমানসহ আমার দেশ পত্রিকার আরো পাঁচজন নির্দিষ্ট সাংবাদিকের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়েছে। একই সঙ্গে ওই পত্রিকার আরো ১০০ জন অজ্ঞাত সাংবাদিকের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়েছে। এই ব্যবস্থায় সরকার ওই পত্রিকার যেকোনো ব্যক্তির নাম ওই মামলায় ঢুকিয়ে তাকে গ্রেফতার করতে পারে। অনেকটা শূন্যস্থান পূরণ করার মতো ব্যাপার আর কি!
একইভাবে আশুলিয়াতে গার্মেন্টস শ্রমিকদের অসন্তোষ প্রকাশের পর সেখানে অজ্ঞাত ৬০,০০০ ব্যক্তির বিরুদ্ধে গায়েবি গণসমন জারি করা হয়েছে। হ্যা। ৬০,০০০ সংখ্যাটি সঠিক। গিনেস বুক অফ রেকর্ডসে হয়তো এই উদ্ভট ব্যবস্থাটি স্থান পাবে।
বাংলাদেশে এসব চলমান সমস্যার ওপরে আরো এসে পড়েছে ইনডিয়ার সঙ্গে গত বছরে স্বাক্ষরিত বাংলাদেশের ৫০ দফা চুক্তির বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া। যদিও এই চুক্তি বিষয়ে পার্লামেন্টে কোনো আলোচনা হয়নি। তবুও বাংলাদেশে ইনডিয়ার করিডোর হচ্ছে। কিন্তু নেপালের ট্রানজিট হচ্ছে না। বাংলাদেশের পশ্চিমে ফারাক্কা বাঁধের মর্মান্তিক মরু অভিজ্ঞতার পরে, বাংলাদেশের পূর্বে বাঙালি মুখোমুখি হতে চলেছে টিপাইমুখ বাধ অভিজ্ঞতার।
বিডিআরের হাতে সেনা অফিসাররা আক্রান্ত হয়েছে। পরিণতিতে বিডিআর ও সেনা, এই দুটি বাহিনীই দুর্বল হয়ে গিয়েছে। আর তার পরিণতিতে সীমান্ত এলাকা প্রায় অরক্ষিত হয়ে পড়েছে। তাই বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার বিষয়ে অনেকেই এখন চিন্তিত।
সব মিলে বাংলাদেশের সংকট যে কতো গুরুতর আকার ধারণ করেছে সেটা হয়তো আপনারা বুঝবেন একটা ছোট গল্প যদি বলি।
আমেরিকার সাবেক প্রেসিডেন্ট জর্জ ডাবলিউ বুশের সময়ে সূচিত অর্থনৈতিক মন্দাবস্থা কবে কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হবে সেটা জানতে বর্তমান প্রেসিডেন্ট ওবামা গিয়েছিলেন গড-এর কাছে।
গড উত্তর দেন, আরো দশ বছর লাগবে।
উত্তর শুনে ওবামা কাদতে কাদতে বেরিয়ে যান।
এরপরে বৃটেনের প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন যান গডের কাছে এবং প্রশ্ন করেন বৃটেনের চলতি মন্দাবস্থা কাটিয়ে উঠতে কতো বছর লাগবে?
গড উত্তর দেন, আরো বিশ বছর লাগবে। উত্তর শুনে ক্যামেরন কাদতে কাদতে বেরিয়ে যান।
এরপরে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী যান গডের কাছে এবং তিনি জানতে চান গত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে সূচিত বাংলাদেশের দুরবস্থা কাটিয়ে উঠতে কতো বছর লাগবে? কোনো উত্তর না দিয়ে এবার গড-ই কাদতে কাদতে বেরিয়ে যান।
এটা নৈরাশ্যজনক রাজনৈতিক চুটকি।
কিন্তু এর বিপরীতে মনে রাখবেন বাংলাদেশ বিরোধী বহু প্রচারণা, স্বদেশে ও বিদেশে হওয়া সত্ত্বেও, আমেরিকার প্রভাবশালী টাইম ম্যাগাজিনের ১০ এপ্রিল ২০০৬-এ, অর্থাৎ গত বিএনপি সরকারের শেষ বছরে প্রকাশিত একটি খুবই আশাবাদী রিপোর্ট। টাইম ম্যাগাজিন তাদের কভার স্টোরি রিবিলডিং বাংলাদেশ শিরোনামে বাংলাদেশের চমৎকার অগ্রগতি ও অনুকরণীয় উন্নতির লম্বা ফিরিশতি দিয়েছিল। প্রশংসা করেছিল। মনে রাখবেন ২০০৫ সালে ক্যাটরিনা ঝড়ের পরে গত বিএনপি সরকারের আমলে বাংলাদেশ এক মিলিয়ন ডলার সাহায্য দিয়েছিল আমেরিকাকে, যার পরিমাণ ছিল অন্য দেশগুলোর তুলনায় পঞ্চম এবং জাপানের সমান।
সুতরাং শত বিপদ ও হাজার সমস্যা সত্ত্বেও বাংলাদেশ এখনো তার স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষা করে সসম্মানে ও সগর্বে সামনে এগিয়ে যেতে পারে। প্রয়োজন শুধু গভীর দেশপ্রেম ও ঐক্যবদ্ধ কর্মসূচি এবং সেটা বাস্তবায়নে অটল সাহস ও কঠোর শৃঙ্খলা। আর এসব গুণাবলী আয়ত্ত করার জন্য উচিত জীবনের সব ক্ষেত্রে শিক্ষার প্রসার।
আমি আশা করি, আপনারা, আমেরিকান বাঙালিরা সেই লক্ষ্যেই কাজ করবেন। তখন বাংলাদেশে সবাই ভালো থাকবে। তাহলে আমরা নেড়িকুকুররাও ভালো থাকবো।
সবাইকে ধন্যবাদ ও শুভেচ্ছা। ঘেউ ঘেউ।
এবিসি কনভেনশন, নিউ ইয়র্ক, ১৮ জুলাই ২০১০

জাতিকে noশিক্ষিত করার সহজ উপায়…



  • স্থান: বাংলাদেশ
  • কাল: বর্তমান সময়
  • চরিত্র: অভিভাবক, স্পাইনাল সার্জন, স্বাস্থ্যমন্ত্রী, শিক্ষামন্ত্রী এবং হেলিকপ্টার পাইলট তার ক্রুরা
প্রথম দৃশ্য: স্পাইনাল সার্জনের চেম্বার
অভিভাবক (উদ্বিগ্ন কণ্ঠে): স্যার, গভীর বিপদে পড়ে আজ এই সাত সকালেই আপনার কাছে আসতে বাধ্য হয়েছি। এত ভোরে ডিস্টার্ব করার জন্য মাইন্ড করবেন না স্যার।
স্পাইনাল সার্জন (শান্ত স্বরে): আপনিই কি পেশেন্ট? বলুন, কি হয়েছে।
অভিভাবক : না। আমি পেশেন্ট নই। আজ সকালে একটা একসিডেন্টে পড়ে তার অবস্থা এখন খুবই আশংকাজনক। খুব সম্ভবত তার মেরুদণ্ড ভেঙে গিয়েছে। সে আর দাড়াতে পারছে না। যন্ত্রণায় কাৎরাচ্ছে। তাই তাকে এখানে আনতে পারিনি। আপনাকেই তার কাছে যেতে হবে স্যার। প্লিজ।
সার্জন (কাগজ ও বলপয়েন্ট বের করে লিখতে উদ্যত হয়ে): পেশেন্টের নাম?
অভিভাবক: জাতি।
সার্জন: বয়স?
অভিভাবক: উনচল্লিশ।

সার্জন: পুরুষ, না নারী?
অভিভাবক: উভলিঙ্গ।
সার্জন (লেখা থামিয়ে অবাক চোখে): আপনার পেশেন্টের নাম অদ্ভুত এবং লিঙ্গও…
অভিভাবক: আমি সত্যি বলছি স্যার। একসিডেন্টের বিবরণ দিলেই বুঝতে পারবেন। আমার পেশেন্ট গোটা বাংলাদেশি জাতি, যার জন্ম হয়েছিল ঊনচল্লিশ বছর আগে এবং যার পুরুষ ও নারী উভয় লিঙ্গই আছে। শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড, এই সর্বজন স্বীকৃত বাক্যটি আপনি নিশ্চয়ই জানেন। আজ সকালে খবরের কাগজ পড়ে জাতি জানতে পারে অতি অপ্রত্যাশিতভাবে আওয়ামী লীগ সরকার যানজটসহ বিভিন্ন কারণে আগামীকাল শনিবার থেকে রাজধানীসহ সারা দেশের সরকারি ও বেসরকারি স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা, কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও সমমানের ইংলিশ মিডিয়াম শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছুটির ঘোষণা দিয়েছে। একই সঙ্গে আগামী সোমবার থেকে ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে দেশের সব প্রাইমারি স্কুলেও। ১৬ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছুটি থাকবে। এ আকস্মিক ঘোষণাটি পড়ার পরপরই জাতি কাৎ হয়ে পড়ে যায়। যন্ত্রণায় কাৎরাতে থাকে। মনে হয় জাতি তার মেরুদণ্ডে প্রচণ্ড ব্যথা পেয়েছে।
সার্জন (গুরুগম্ভীর মুখে ক্যালেন্ডারের দিকে তাকিয়ে): আজ শুক্রবার ১৩ আগস্ট। ফ্রাইডে দি থার্টিনথ! পশ্চিমের বহু দেশে মনে করা হয় যদি কোনো শুক্রবার মাসের তের তারিখে পড়ে যায় তাহলে সেদিন কিছু বিপদ ঘটতে পারে। ইন ফ্যাক্ট, এই বহুল প্রচলিত কুসংস্কারের ওপর ভিত্তি করে হলিউড এখন পর্যন্ত আটটি হরর মুভি বানিয়েছে যাদের নাম, ফ্রাইডে দি থার্টিনথ, ফ্রাইডে দি থার্টিনথ পার্ট টু, ফ্রাইডে দি থার্টিনথ পার্ট থ্রি, ইত্যাদি। আমি এই কুসংস্কারে বিশ্বাস করতাম না। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে, এর একটা ভিত্তি আছে। সত্যিই তো আজ শুক্রবার ১৩ আগস্ট জাতি তার মেরুদণ্ডে আঘাত পেয়েছে।
অভিভাবক (কাতর স্বরে): স্যার, একটা কিছু করুন। একটা পাগল সরকারের পাল্লায় পড়ে এভাবে একটা জাতির মেরুদণ্ড ভেঙে যাবে? সারা দেশের ছেলেমেয়েরা এক মাসেরও বেশি সময় জুড়ে শিক্ষা থেকে বঞ্চিত থাকবে?
সার্জন (চিন্তিত মুখে): দেখুন, আপনার পেশেন্টের যা হয়েছে, তাকে আমরা, স্পাইনাল সার্জনরা এবং নিউরো সার্জনরা সংক্ষেপে বলি এসসিআই (SCI)। অর্থাৎ স্পাইনাল কর্ড ইনজুরি (Spinal Chord Injury)। এর ফলে, আহত ব্যক্তির চলাফেরার ক্ষমতা অথবা সকল শারীরিক অনুভূতি সম্পূর্ণ তিরোহিত হতে পারে। কোনো ট্রমায়, যেমন কার একসিডেন্ট, বন্দুকের গুলি, হঠাৎ পড়ে যাওয়া অথবা কোনো রোগে, যেমন পোলিও, স্পাইনা বাইফিডা, ফ্রেডারিকস, ইত্যাদিতে স্পাইনাল কর্ড ইনজুরি হতে পারে। তবে ইনজুরি হলেই যে স্পাইনাল কর্ড ভেঙে যাবে, তেমনটা না-ও হতে পারে। স্পাইনাল কর্ড না ভাঙলেও ক্ষমতা ও অনুভূতি চলে যেতে পারে।
অভিভাবক (হতবাক মুখে): তাই?
সার্জন: বিষয়টা আমি আরেকটু বুঝিয়ে বলছি। মানবদেহের কোমর থেকে ঘাড় পর্যন্ত মেরুদণ্ড গঠিত হয় সাধারণত তেত্রিশটি হাড়ের বা ভারটিব্রা (Vertebra)-র সমন্বয়ে যার মধ্যে থাকে স্পাইনাল কর্ড। ভারটিব্রা অথবা স্পাইনাল কর্ড কোনো ইনজুরিতে সাময়িক অথবা স্থায়ীভাবে মানুষকে অবশ বা অচল করে দিতে পারে। জাতির সম্ভবত সেটাই হয়েছে। আজ ফ্রাইডে দি থার্টিনথ…
অভিভাবক: এসব তত্ত্ব কথা বুঝে আমার কি লাভ? আমার পেশেন্ট তো যন্ত্রণায় কাৎরাচ্ছে। একটা চিকিৎসার কথা বলুন তাড়াতাড়ি, প্লিজ।
সার্জন: বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় স্পাইনাল কর্ড সার্জন হচ্ছেন ড. এম. ইদ্রিস। কিন্তু স্ট্রোক হবার পর তিনি এখন কম কাজ করছেন। তাছাড়া যতদূর জাতি বর্তমান প্রশাসনের হয়রানির শিকারও তিনি হয়েছেন। শুধু তিনিই নন, পিজি হসপিটাল, যাকে এখন বলা হয় বিএসএমএমইউ হসপিটাল, তার উনপঞ্চাশজন ডাক্তারকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত বা চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। এদের মধ্যে ত্রিশজনেরও বেশি টিচিং ডাক্তার। এছাড়া বহু সরকারি ডাক্তারকে আচমকা বদলি করা হয়েছে। এমনকি এক বছরের মধ্যে একজনকে চারবার বদলি করা হয়েছে। এ পরিস্থিতিতে জাতির চিকিৎসার ভার কেউ নিতে চাইবেন না। কোনো কারণে এ সরকারের বিরাগভাজন হবার বুকের পাটা কোনো ডাক্তারেরই নেই। সরি। আমি কিছু করতে পারবো না।
অভিভাবক (হতাশ মুখে): তাহলে আমি কি করবো?
সার্জন: আপনি স্বাস্থ্যমন্ত্রী ড. রুহুল হক-এর কাছে যান। তার সাহায্য চান। তিনি নিজে ট্রমা সেন্টার-এর প্রতিষ্ঠাতা।
দ্বিতীয় দৃশ্য : স্বাস্থ্যমন্ত্রীর অফিস
অভিভাবক: শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড, এ কথায় আপনি বিশ্বাস করেন?
স্বাস্থ্যমন্ত্রী (বিরক্ত মুখে): দেখুন আমরা সবাই মহাব্যস্ত আছি ১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবস পালনের কর্মসূচি নিয়ে। প্রাসঙ্গিক কথা বলুন। অপ্রাসঙ্গিক কথা শোনার সময় আমার নেই।
অভিভাবক: আমি প্রাসঙ্গিক কথাই বলতে এসেছি। একটা ট্রমাতে আমার পেশেন্ট জাতির মেরুদণ্ড ভেঙে গিয়েছে। তার ইমিডিয়েট টৃটমেন্টের জন্য আপনার পরামর্শ ও সাহায্য দরকার। আপনিই তো ট্রমা সেন্টারের প্রতিষ্ঠাতা।
স্বাস্থ্যমন্ত্রী: জাতির কেইস খুব সিরিয়াস ও কমপ্লেক্স। এত জটিল কেইসের কোনো চিকিৎসা আমার একার পক্ষে করা সম্ভব নয়। হয়তো একটা মেডিকাল বোর্ড গঠন করতে হতে পারে যেখানে থাকবেন মন্ত্রিসভার অন্য কিছু সদস্য। কিন্তু তাতেও কোনো লাভ হবে না। আমারই কলিগ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন পিছলে পড়ে কোমর ভেঙেছিলেন। তিনি ভর্তি হয়েছিলেন আমারই ট্রমা সেন্টারে। কিন্তু সেখানে কিছুদিন থেকে চলে গিয়েছিলেন সিঙ্গাপুরে। সেখান থেকেই সুস্থ হয়ে তিনি দেশে ফিরে আসেন। তবে…
অভিভাবক (জিজ্ঞাসু চোখে): তবে কি?
স্বাস্থ্যমন্ত্রী: তবে একটি সাপ্তাহিক পত্রিকায় প্রকাশিত রিপোর্টে জানা যায়, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর অগাধ বিশ্বাস শামসু পাগলার ওপরে। এমপি হবার আগে তিনি দোয়া নিতে গিয়েছিলেন পীর শামসু পাগলার মাজারে। মন্ত্রী হবার পরেও তিনি দেখা করেছেন শামসু পাগলার সঙ্গে। জানি না, সিঙ্গাপুর ডাক্তারদের চিকিৎসায়, নাকি, শামসু পাগলার দোয়ায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সুস্থ হয়েছেন।
অভিভাবক: ধন্যবাদ এই ইনফর্মেশনের জন্য। জাতির ভবিষ্যৎ আমি কোনো পাগলের হাতে তুলে দিতে পারবো না। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে আমি যাবো না।
স্বাস্থ্যমন্ত্রী: তাহলে আপনি চলে যান শিক্ষামন্ত্রী মি. নুরুল ইসলাম নাহিদ-এর কাছে। তিনি সৎ লোক। আমরা দুজনই ছাত্র ইউনিয়ন এবং বামপন্থী রাজনীতি করতাম। তিনি নিশ্চয়ই জাতির চিকিৎসার একটা উপায় বাতলে দেবেন। আমি তাকে ফোন করে দিচ্ছি।
তৃতীয় দৃশ্য: শিক্ষামন্ত্রীর অফিস
অভিভাবক: আপনি তো শিক্ষামন্ত্রী। আপনি কি বিশ্বাস করেন শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড?
শিক্ষামন্ত্রী (হতাশ সুরে): আগে তাই জানতাম এবং বিশ্বাসও করতাম। এখন সাতপাকে বাধা পড়ে গিয়েছি। দৈনিক সমকাল-এর মালিক-প্রকাশক মি. এ কে আজাদ-এর একটি বক্তব্য আপনাকে পড়ে শোনাতে চাই। (ড্রয়ার থেকে ১ জুলাই ২০১০-এর দৈনিক সমকাল বের করে) এ কে আজাদ বলেছেন, গত অর্থবছরে ব্যবসায়ীরা সরকারকে ৬০ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব দিয়েছেন। বলা হয়, শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড। এখন বলার সময় এসেছে, ব্যবসায়ীরাই জাতির মেরুদণ্ড। আমাদের সরকারকে ব্যবসায়ীরা কন্ট্রোল করছেন কি না, অথবা ইনডিয়া কন্ট্রোল করছে কি না, অথবা ইনডিয়া অনুগ্রহীত ব্যবসায়ীরা কন্ট্রোল করছেন কি না, সেটা আমি জানি না। আমি শুধু জানি আমি খুব বিপদে আছি। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় চেয়েছিল ১০ রমজান থেকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখতে। কিন্তু এর আগে যানজট নিরসনে ব্যবসায়ী ও ঢাকা মহানগর পুলিশ রমজান মাসে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধের দাবি জানিয়েছিল।
অভিভাবক: আর তারপর আপনি ১২ আগস্টের ঘোষণায় বলেছেন, রমজান ও ঈদ উপলক্ষে প্রতিবারই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছুটি দেয়া হয়। এবার ছুটি কিছুটা এগিয়ে আনা হয়েছে। অনেক শিক্ষক রোজা রাখেন। শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরাও রোজা রাখেন। সবার সুবিধার্থে এই সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। আমার প্রশ্ন হচ্ছে–সবার সুবিধার্থে বলতে আপনি কি বোঝাতে চান? এ সবাইটা কারা? যানজটে আটকে যাওয়া মোটরকার সিএনজি ড্রাইভার অথবা রিকশাওয়ালারা? এ কে আজাদের মতো সুব্যবসায়ী কিন্তু নোশিক্ষিত মিডিয়া মালিক এবং তাদের বেতনভোগী সম্পাদক ও সাংবাদিকরা? নাকি আপনার মতো নোশিক্ষিত মন্ত্রী-পলিটিশিয়ানরা? এরা কারা? দেশের শিক্ষা ধ্বংস করার অধিকার এদের কে দিয়েছে? এই সরকারের এই সিদ্ধান্ত কোনো অভিভাবকের সুবিধার্থে হয়নি।
শিক্ষামন্ত্রী: নোশিক্ষিত?
অভিভাবক: হ্যা। নোশিক্ষিত। তবে এই নো ইংরেজি know নয়। এই নো ইংরেজি no। আপনারা সবাই noশিক্ষিত। কোনো এক সময়ে আপনারা কিছু শিক্ষা পেয়েছিলেন। সুতরাং আপনাদের অশিক্ষিত বলা যাবে না। এবং সেসব শিক্ষা নিশ্চয়ই ভালো ছিল, যার ফলে আপনারা সফল ব্যবসায়ী, সম্পাদক-সাংবাদিক ও মন্ত্রী-পলিটিশিয়ান হতে পেরেছেন। তাই আপনাদের কুশিক্ষিতও বলা যাবে না। তাহলে আপনারা কি? আপনারা সবাই নোশিক্ষিত। অর্থাৎ, আপনারা নিজেরা শিক্ষার সুবিধা পেয়ে এখন অন্যদের শিক্ষা দিতে চাইছেন না। শিক্ষা মানুষের অন্যতম মৌলিক অধিকার। আচমকা টেলিভিশন ও দৈনিক পত্রিকার মাধ্যমে একটি দুর্বোধ্য ঘোষণা দিয়ে দেশের সব স্কুল-কলেজ এক মাসের জন্য বন্ধ করে দিলেন! এমনকি প্রাইভেট শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো? এত সার্বিক ক্ষমতা আপনাদের কেউ দেয়নি। আপনারা যুদ্ধ অপরাধীর বিচার করতে চান। আর আমি চাই আপনার মতো শিক্ষা অনাগ্রহীদের বিচার করতে।
শিক্ষামন্ত্রী: আপনি খুব ইমোশনাল হয়ে পড়েছেন। নিজেকে সংযত করুন।
অভিভাবক: দেখুন নোশিক্ষামন্ত্রী, আমি কিছু সত্য কথা আপনাকে বলছি। যে সত্য কথা কেউ আপনাকে বলতে সাহস করবে না। তাছাড়া আপনার আশপাশে যারা আছেন তাদের শিক্ষা ও কর্মপরিধি এখন ব্যক্তি বন্দনা ও ব্যক্তি পূজায় সীমাবদ্ধ হয়ে গিয়েছে। তারা সবাই এখন নোশিক্ষিত। বৃটেনের প্রধানমন্ত্রী হবার আগে ১ অক্টোবর ১৯৯৬-এ লেবার পার্টির বার্ষিক কনফারেন্সে টনি ব্লেয়ার বলেছিলেন, আমার সরকারের তিনটি প্রধান অগ্রাধিকার কি হবে সেই প্রশ্নটি যদি করেন তাহলে তার উত্তর হবে, শিক্ষা, শিক্ষা এবং শিক্ষা (Ask me my three main priorities for Government and I tell you: education, education and education)। টনি ব্লেয়ার প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন এবং তার কথা অনুযায়ী কাজ করেছিলেন। তাই বৃটেন এখনও একটি শক্তিশালী রাষ্ট্র রূপে বিশ্ব রাজনীতিতে ভূমিকা রাখছে। একই আদর্শে দীক্ষিত ম্যাডাম খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রী থাকার সময়ে এপ্রিল ২০০৬-এ আমেরিকার প্রভাবশালী সাপ্তাহিক টাইম ম্যাগাজিনে একটি ইন্টারভিউ দিয়েছিলেন। সে বিষয়ে টাইম লিখেছিল, (বাংলাদেশে) শতভাগ শিশু স্কুলে ভর্তি হচ্ছে। শিক্ষায় মেয়েরা পাচ্ছে সমান অধিকার। প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার কাছে বিষয়টি অগ্রাধিকার পেয়েছে। একটি রক্ষণশীল মুসলিম দেশের নেত্রী হয়েও এগুলো তিনি লক্ষ্যমাত্রা হিসেবে নির্ধারণ করেছেন। খালেদা সরকারের আমলে চট্টগ্রামে এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ফর উইমেন-এর সূচনা থেকে শুরু করে বাংলাদেশে শিক্ষা ক্ষেত্রে সার্বিক অগ্রগতি ও উন্নতি বিদেশে বহুল প্রশংসিত হয়েছিল। আর আপনারা ডিজিটাল যুগে নিয়ে যাবার স্বপ্ন দেখিয়ে এখন আক্ষরিকভাবেই বাংলাদেশকে অন্ধকার যুগে নিয়ে গিয়েছেন। দেশের অধিকাংশ স্থান চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে বেশির ভাগ সময়ই বিদ্যুতের অভাবে অচল বা অন্ধকার থাকছে। আপনারা ব্যস্ত আছেন হামলা, মামলা, গ্রেফতার, রিমান্ড, টর্চার, জামিন, বিচার, ফাসি, তদন্ত, বদলি, সাসপেন্ড এবং সর্বোপরি ব্যক্তি বন্দনা ও ব্যক্তি পূজা নিয়ে। শিক্ষাকে শুধু অবহেলাই নয়, সর্বশেষ এই ঘোষণা দিয়ে শিক্ষাকে সাময়িক নির্বাসনে পাঠিয়েছেন।
শিক্ষামন্ত্রী (কাচুমাচুভাবে): আমি নিরুপায়।
অভিভাবক: আপনার ঘোষণাটি দুর্বোধ্য বলেছি এই কারণে যে, যদি যানজটের জন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করতে হয় তাহলে শুধু রাজধানীর শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ করলেই হতো। সারা দেশের কেন? আর যদি রোজা রাখার সুবিধায় করা হয় তাহলে সেটা যে আপনাদের সেকুলার নীতির বিরোধী সেটা কি বিবেচনা করেছেন? এখন যদি মেজর জেনারেল সি.আর দত্ত-র নেতৃত্বে হিন্দু-বৌদ্ধ-খৃস্টান ঐক্য পরিষদ তাদের ধর্মীয় উৎসব পালনের সুবিধার্থে আরো দীর্ঘ ছুটি চায় তাহলে আপনারা কি বলবেন? আপনারা কি বিবেচনা করছেন এই দীর্ঘ এক মাস ছুটিতে লক্ষ লক্ষ ছাত্রছাত্রীরা কিভাবে সময় কাটাবে? আর শিক্ষকদের বেতন আমরা অভিভাবকরাই বা কেন দেব? সে যাই হোক। আপনি হয়তো জানেন না, বহু স্কুল কর্তৃপক্ষ ইতিমধ্যেই বলেছেন, তাদের সন্তানদের নিয়ে স্কুলে এসে এক মাসের হোমওয়ার্ক বুঝে নিতে। তবে তারা এটাও বলে দিয়েছেন, ছাত্রছাত্রীদের স্কুল ড্রেস না পরিয়ে সাদা পোশাকে যেন স্কুলে আনা হয়। কাদো বাঙালি, কাদো পোস্টার প্রেরণায় ছাত্রছাত্রীদের কিছু কান্নাকাটি করার জন্য প্রস্তুত করে স্কুলে আনার উপদেশও দিয়েছেন। আশা করি বুঝতেই পারছেন, আওয়ামী ভীতি এখন কোন পর্যায়ে এসেছে।
শিক্ষামন্ত্রী: আই অ্যাম সরি।
অভিভাবক: সরি বললে আমার কোনো লাভ হবে না। আমার ছেলেমেয়ের জন্য বেতনটা ঠিকই স্কুলকে দিতে হবে। অথচ তারা কোনো শিক্ষা পাবে না। সুতরাং নোশিক্ষা মন্ত্রী, যদি আপনি আমার বক্তব্যের সঙ্গে একমত হন এবং যদি আপনি বিশ্বাস করেন শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড, তাহলে আপনি পদত্যাগ করুন।
শিক্ষামন্ত্রী: সেটা সম্ভব নয়। পদত্যাগ করার স্বাধীনতা আমার নেই। আপনি নিশ্চয়ই জানেন ইতিপূর্বে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মি. সোহেল তাজ, যিনি এখন আমেরিকায় আছেন, তার পদত্যাগ নিয়ে কেমন লম্বা নাটক হয়েছিল!
হঠাৎ বাইরের প্রচণ্ড গর্জন ঘরে শোনা গেল। ঘড়ঘড়। ঘড়ঘড়। শিক্ষামন্ত্রী ছুটে গেলেন জানালার দিকে।
শিক্ষামন্ত্রী (ডেস্কে ফিরে এসে সবিস্ময়ে): দেখছি একটা হেলিকপ্টার নেমেছে।
কিছুক্ষণ পরেই হেলিকপ্টারের পাইলট তার ক্রুদের নিয়ে শিক্ষামন্ত্রীর অফিসে এলেন।
হেলিপাইলট: এই দেখুন আমার আইডি কার্ড। আমি ইনডিয়ান এয়ার ফোর্সে কাজ করি। এয়ার এমবুলেন্স চালাই। আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মি. প্রণব মুখার্জি ইমার্জেন্সি কলে এখানে আসতে বলেছেন। আপনাদের পেশেন্ট জাতিকে টৃটমেন্টের জন্য ইনডিয়ান হসপিটালে ট্রান্সফার করার জন্য এয়ার এমবুলেন্স পাঠিয়েছেন।
শিক্ষামন্ত্রী (বিগলিত মুখে): থ্যাংক ইউ সো মাচ। থ্যাংক ইউ।
অভিভাবক (প্রচণ্ড রাগান্বিত মুখে): কি বলছেন আপনি? জাতিকে নিয়ে যাবেন ইনডিয়াতে?
হেলিপাইলট (স্মিত মুখে): আপনাদের বিডিআর তো ফিনিশড। বর্ডার তো আগেই উঠে গেছে। বাংলাদেশ আর ইনডিয়ার মধ্যে সীমারেখা টানার বৃথা চেষ্টা আর করবেন না। আর তাছাড়া এটাও তো সত্যি যে বাংলাদেশের সামর্থবান ব্যক্তিরা টৃটমেন্টের জন্য ইনডিয়াতে যান। জাতির টৃটমেন্টের জন্য যেহেতু আপনার সামর্থ নেই সেহেতু মি. প্রণব মুখার্জি স্বতঃপ্রণোদিত এবং সদয় হয়ে আমাদের এয়ার এমবুলেন্স পাঠিয়েছেন। আমরা আশা করি জাতি সুস্থ হয়ে যাবে এবং পরবর্তীকালে কোলকাতা থেকে কোদাইকানাল পর্যন্ত বিভিন্ন স্কুল-কলেজে পড়তে পারবে। সেইন্ট জেভিয়ার্স স্কুল, হেয়ার স্কুল, মিত্র ইন্সটিটিউশন, প্রেসিডেন্সি কলেজ–এসব জায়গায় জাতি পড়াশোনা করার সুযোগ পাবে। সুতরাং আর দেরি করবেন না। আমাদের সঙ্গে কোঅপারেট করুন। (ক্রুদের প্রতি আঙুল দেখিয়ে) পেশেন্টকে খুব কেয়ারফুলি কপ্টারে ওঠাও।
অভিভাবক হতবাক হয়ে দেখতে লাগলেন এয়ার এমবুলেন্স ক্রুদের কার্যক্রম।
একটু পরেই হেলিকপ্টারের ব্লেডগুলো আবার চরকি খেতে শুরু করলো।
ঘড়ঘড়। ঘড়ঘড়।
প্রচণ্ড শব্দ শুরু হলো।
ধুলাবালি উড়তে লাগলো।
জোরে বাতাস বইতে লাগলো।
হেলিকপ্টার টেক অফ করলো।
১৬ আগস্ট ২০১০
(সম্পূর্ণ কাল্পনিক ঘটনা ও সংবাদ)

বিদেশ যাওয়ার সহজ উপায়…



shafik rehmanস্থান : ইমিগ্রেশন কাউন্টার ও ডিপারচার লাউঞ্জ, বঙ্গবন্ধু ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট, ত্রিশাল। এবং প্রধানমন্ত্রীর অফিস।
কাল : মে ২০১৪-র কোনো এক সকাল ন’টা।
চরিত্র : সাবেক পররাষ্ট্র মন্ত্রী ডা. দীপু মনি ও তার স্বামী এবং সাবেক পরিকল্পনা মন্ত্রী এ কে খন্দকার, ইমিগ্রেশন ক্লার্ক, ইমিগ্রেশন অফিসার, এমিরেটস এয়ারলাইন্স এয়ারপোর্ট ম্যানেজার, প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া ও তার মন্ত্রী সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী।

দৃশ্য : ১
ইমিগ্রেশন কাউন্টারের সামনে কিউ-তে দাড়িয়ে আছেন যথাক্রমে, সাবেক পররাষ্ট্র মন্ত্রী ডা. দীপু মনি ও তার স্বামী এবং সাবেক পরিকল্পনা মন্ত্রী এ কে খন্দকার।
ইমিগ্রেশন ক্লার্ক (সাবেক পররাষ্ট্র মন্ত্রী ডা. দীপু মনির পাসপোর্টের কয়েকটি পাতা উলটিয়ে দেখলেন। তার সামনে রাখা কমপিউটার স্কৃনে কিছু নাম দেখলেন। তারপর ডা. দীপু মনির দিকে তাকালেন) : এক্সকিউজি মি ম্যাডাম। আপনাকে একটু অপেক্ষা করতে হবে।
ডা. দীপু মনি : কেন? পাসপোর্টে কিছু গোলমাল আছে? অথবা ভিসাতে?
ইমিগ্রেশন ক্লার্ক (প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে নিচু গলায় ফোন করলেন তার ওপরওয়ালাকে) : স্যার। আই নিড ইয়োর হেল্প।
ইমিগ্রেশন অফিসার (ইমিগ্রেশন কাউন্টারে মিনিট খানেকের মধ্যে এসে) : কি হয়েছে?
ইমিগ্রেশন ক্লার্ক : স্যার। (ডা. দীপু মনিকে দেখিয়ে) এই পাসপোর্টটা ওনার।
ইমিগ্রেশন অফিসার (পাসপোর্টটা হাতে নিয়ে, নাম দেখে) : ওহ। আই সি। (তারপর ডা. দীপু মনির প্রতি বিনয়সূচক স্বরে) : ম্যাডাম। আপনি আমার সঙ্গে আসুন। (ডিপারচার লাউঞ্জের খালি চেয়ারগুলো দেখিয়ে) এখানে একটু অপেক্ষা করুন। আমি আসছি।
ডা. দীপু মনি (ইমিগ্রেশন কাউন্টার পেরিয়ে লাউঞ্জে ঢুকে) : কিন্তু আমার পাসপোর্ট?
ইমিগ্রেশন অফিসার : আমার কাছে।
ডা. দীপু মনি (ইমিগ্রেশন ক্লার্ককে দেখিয়ে) : ওখানে তো উনি চেকআউট সিল মারেননি।
ইমিগ্রেশন অফিসার (শান্ত ও বিনয়ী স্বরে) : সব ফর্মালিটিজ কমপ্লিট হলে চেকআউট সিল দেয়া হবে। আপনি দয়া করে এখানে একটু ওয়েইট করুন।
ইমিগ্রেশন অফিসার পাসপোর্ট হাতে নিয়ে গটগট করে চলে গেলেন।
ডা. দীপু মনি তার রিস্টওয়াচে সময় দেখলেন।
ঠিক একইভাবে ইমিগ্রেশন ক্লার্কের ফোন কল পেয়ে সেই অফিসার বারবার কাউন্টারে এলেন। অন্যান্য অপেক্ষমাণদের পাসপোর্ট নিলেন। এবং একে একে তাদের ডা. দীপু মনির পাশের চেয়ারগুলোতে তাদের বসিয়ে আবার গটগট করে হেটে উধাও হয়ে গেলেন।
ডা. দীপু মনির পাশে তার স্বামী এবং সাবেক পরিকল্পনা মন্ত্রী এ কে খন্দকার। তিনজনই কিছুটা উদ্বিগ্ন মুখে।
সাবেক পরিকল্পনা মন্ত্রী এ কে খন্দকার (চিন্তিত স্বরে) : আমাদের সবার পাসপোর্ট নিয়ে ওই ইমিগ্রেশন অফিসার কোথায় গেলেন? তাকে তো কোথাও দেখতে পাচ্ছি না।
ডা. দীপু মনি : নিশ্চয়ই ইমিগ্রেশন কনট্রোল রুমে গিয়েছেন তার ওপরওয়ালার সঙ্গে কথা বলতে। (ডা. দীপু মনি তার রিস্টওয়াচ দেখে) এখন সকাল সোয়া ন’টা। আমাদের ফ্লাইট সকাল এগারোটায়। আশা করি এর মধ্যে সব প্রবলেম সলভড হয়ে যাবে।
দৃশ্য : ২
ইমিগ্রেশন লাউঞ্জে অপেক্ষমাণ যাত্রীরা। ডা. দীপু মনি চেয়ারে বসে। বাকি দু’জন হাটাহাটি করছেন।
ডা. দীপু মনি (রিস্টওয়াচ দেখে) : এখন পৌনে দশটা। আধা ঘণ্টা হয়ে গেল। ওই অফিসারটা কোথায় নিখোজ হয়ে গেল? (উঠে দাড়িয়ে) চলুন। আমরা সবাই ইমিগ্রেশন কনট্রোল রুমে যাই। (এ কে খন্দকারের দিকে তাকিয়ে) ইমিগ্রেশন কনট্রোল রুমটা কোথায়?
এ কে খন্দকার : এই সুবিশাল এয়ারপোর্টে সেই রুমটা যে কোথায় তা আমি জানি না।
ডা. দীপু মনি : বলেন কি? পঞ্চাশ হাজার কোটি টাকা খরচ করে অন্য সব প্রায়রিটির আগে, এমনকি বাংলাদেশ বিমানের জন্য নতুন প্লেন কেনার আগে এই এয়ারপোর্ট বানানোর প্ল্যান যখন করেছিলেন তখন তো নিশ্চয়ই দেখেছিলেন। তখন দেখেননি কোথায় ইমিগ্রেশন কনট্রোল রুম হবে?
এ কে খন্দকার (বিব্রতভাবে) : তখন কি আর জানতাম আজ এভাবে এখানে আটকে যাবো? তখন তো আমাদের প্ল্যান ছিল ২০২১ পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকার।
ডা. দীপু মনি : ২০২১ পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকার প্ল্যান কেন করা হয়েছিল? ২০২১-এর পর কি আমরা ক্ষমতা ছেড়ে চলে যেতাম?
এ কে খন্দকার : ওই যে! উনি ফিরে আসছেন কিন্তু ওনার হাতে আমাদের পাসপোর্ট তো দেখছি না।
ইমিগ্রেশন অফিসার (অপেক্ষমাণ যাত্রীদের সামনে এসে) : সরি ম্যাডাম। সরি স্যার। আপনাদের আরো কিছুক্ষণ ওয়েইট করতে হবে।
ডা. দীপু মনি : আমরা আধা ঘণ্টা ওয়েইট করেছি।
ইমিগ্রেশন অফিসার : জানি। কিন্তু আমার কিছু করার নেই। সবই ওপরের নির্দেশ। আপনারা চা-কফি খান। আমি আনিয়ে দিচ্ছি।
ডা. দীপু মনি : চা-কফির দামটা কে দেবে?
ইমিগ্রেশন অফিসার : কেন? আপনারাই দেবেন।
ডা. দীপু মনি : আমরা দেব কেন? আমরা তো চা-কফি খেতে এখানে আসিনি। আমরা সবাই নিউ ইয়র্কে যেতে এখানে এসেছি।
ইমিগ্রেশন অফিসার (হাসি মুখে) : তাহলে দামটা আমিই দিয়ে দেব।
ডা. দীপু মনি (দৃঢ় স্বরে) : না। সেটা হয় না। আপনি কেন আমাদের জন্য আপনার পকেটের টাকা খরচ করবেন? সেটা হয় না। দেখুন আমাদের এখন চা-কফি খাওয়ার কোনো দরকার নেই। প্লেনেই ওরা চা-কফি সার্ভ করবে। আমাদের দরকার পাসপোর্ট এবং বিদেশে যাওয়া।
ইমিগ্রেশন অফিসার (বিনীত ভঙ্গিতে) : অল রাইট ম্যাডাম। আপনারা তাহলে আরেকটু অপেক্ষা করুন।
ইমিগ্রেশন অফিসার আবার গটগট করে অদৃশ্য হয়ে গেলেন।
দৃশ্য : ৩
অপেক্ষমান যাত্রীরা সবাই উদ্বিগ্ন চেহারায়।
ডা. দীপু মনি (রিস্টওয়াচ দেখে) : এখন সোয়া দশটা। ঠিক এক ঘণ্টা হয়ে গেল আমরা অপেক্ষা করছি। আর পয়তাল্লিশ মিনিট পরে আমাদের ফ্লাইট।
এমিরেটস এয়ারলাইন্সের এয়ারপোর্ট ম্যানেজার সশব্যস্ত হয়ে এলেন।
এমিরেটস ম্যানেজার : আপনারা এখানে বসে আছেন কেন? সব প্যাসেঞ্জার তো সিকিউরিটি ক্লিয়ারেন্স করে এখন বোর্ডিং লাউঞ্জে বসে আছেন। শুধু আপনারা তিন জন ছাড়া। প্লিজ, বোর্ডিং গেইট নাম্বার থৃতে আপনারা সবাই আসুন। সিকিউরিটি ক্লিয়ারেন্স করিয়ে নিন। তা নাহলে আমাদের ফ্লাইট টাইমলি ছাড়তে পারবো না। প্লিজ।
ডা. দীপু মনি : আমরা তো যেতেই চাই। কিন্তু আমাদের কারো কাছে আমাদের পাসপোর্ট নেই। ইমিগ্রেশন অফিসার আমাদের সবার পাসপোর্ট নিয়ে গিয়েছেন।
এমিরেটস ম্যানেজার (সবিস্ময়ে) : সে কি! আপনারা তো সবাই মানীগুণী লোক! আপনাদের সবার লাগেজ তো প্লেনে উঠে গেছে। আপনাদের না নিয়ে তো প্লেন এখন টেক অফ করতে পারবে না। আর প্লেন দেরি করে ছাড়লে আপনারা দুবাইয়ে কানেকটিং ফ্লাইট মিস করবেন।
ডা. দীপু মনি : তাহলে দয়া করে আপনি ইমিগ্রেশন কনট্রোল রুমে যান। সেখানে আপনার সমস্যার কথা বলুন।
এমিরেটস ম্যানেজার : নিশ্চয়ই। আমি এখনি যাচ্ছি।
এমিরেটস ম্যানেজার দ্রুত চলে গেলেন।
এ কে খন্দকার (চিন্তিত মুখে) : সম্ভবত নতুন সরকার এসেই একটা ব্ল্যাক লিস্ট তৈরি করেছে। যারা দেশ ছেড়ে যেতে পারবেন না তেমন ব্যক্তিদের নাম ওই লিস্টে আছে।
ডা. দীপু মনি : সেটা হতে পারে। না-ও হতে পারে। এত তাড়াতাড়ি নতুন সরকার একটা ব্ল্যাক লিস্ট বানিয়ে ফেললো! আমাদের টাইমে কি হয়েছিল?
এ কে খন্দকার : আমাদের টাইমে দৈনিক সমকাল পত্রিকায় ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০০৯-এ ‘৬২ ভিআইপির দেশত্যাগ নিষেধ’ শীর্ষক রিপোর্টে প্রথম ব্ল্যাক লিস্টের সংবাদ বেরিয়েছিল। এই রিপোর্টের দ্বিতীয় শিরোনাম ছিল ‘বিমানবন্দরসহ সব ইমিগ্রেশনে তালিকা গেছে, কোনো আওয়ামী লীগ নেতার নাম নেই।’ এর পর দিন দৈনিক আমাদের সময় পত্রিকায় ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০০৯-এ ‘যারা বিদেশ পাড়ি দিতে পারবেন না’ শীর্ষক রিপোর্টে দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা আরোপের দ্বিতীয় সংবাদটি বেরিয়েছিল। তাতে ৪০ জন ভিআইপির নাম ছিল। অর্থাৎ আমরা ক্ষমতায় যাওয়ার দেড় মাস পরেই এসব লিস্টের সংবাদ প্রকাশিত হয়েছিল। তারপর দৈনিক সমকাল-এ ২৭ মার্চ ২০১০-এ সংবাদ বেরিয়েছিল ‘বিমানবন্দরে ২১ জনের তালিকা। বিদেশ ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা।’ আর তারপর দৈনিক আমার দেশ-এ ১৭ সেপ্টেম্বর ২০১০-এ প্রকাশিত সংবাদের শিরোনাম ছিল ‘বিরোধী দলের নেতা এমপি পেশাজীবীকে বিদেশ যেতে বাধা। ৭০ জনের তালিকা বিমানবন্দর ও ইমিগ্রেশন শাখায়।’
ডা. দীপু মনি : হুম। আমাদের টাইমে দেড় মাস পরে ব্ল্যাক লিস্টের খবর বেরিয়েছিল। আর এই নতুন সরকার… এক মাস পরেই…। আমাদের খুব বড় ভুল হয়েছিল। মাত্র ৭০ জনের ব্ল্যাক লিস্ট করা হয়েছিল। ডিসেম্বর ২০০৮-এর নির্বাচনে বিএনপি যাদের ভোট পেয়েছিল সেই প্রায় দুই কোটি ত্রিশ লক্ষ ভোটারদেরই যদি ব্ল্যাক লিস্ট করা হতো এবং তাদের সবাইকে যদি নিষ্ক্রিয় রাখা যেত, বিদেশ ভ্রমণে বাধা দেয়া যেত, তাহলে বিএনপি ২০১৪-এর নির্বাচনে বিজয়ী হতে পারতো না। ভুল হয়ে গেছে। ভুল হয়ে গেছে। ভুল হয়ে গেছে। (একটু চুপ থেকে) আরেকটা ভুল হয়েছে আপনার প্ল্যানিংয়ে এই নতুন এয়ারপোর্টে কোনো বিএলপি ওয়েটিং রুম বানাননি।
এ কে খন্দকার (জিজ্ঞাসু চোখে) : বিএলপি ওয়েটিং রুম?
ডা. দীপু মনি : বিএলপি মানে ব্ল্যাক লিস্টেড পারসন্স (Black listed persons) ওয়েটিং রুম। এখানে ভিভিআইপি, ভিআইপি, সিআইপি রুম আছে। কিন্তু আজকের ভিআইপি যে আগামীকাল বিএলপি হয়ে যেতে পারেন সেই দূরদর্শিতা আপনার ছিল না। তাই বিএলপি রুম নেই। আজ আমরা সবাই বিএলপি! ব্ল্যাক লিস্টেড পারসন! আমাদের জন্য আলাদা একটা রুম থাকলে কতো ভালো হতো!
এ কে খন্দকার : আমরা যদি দুই কোটি ত্রিশ লক্ষ মানুষের ব্ল্যাক লিস্ট বানাতাম আর তাদের যদি দেশত্যাগে বাধা দিতাম তাহলে এই এয়ারপোর্টের কোনো রুমে কি তাদের জায়গা দিতে পারতাম? দেশের বিশাল জায়গা জুড়েই বিএলপি রুম বানাতে হতো। সেটা কি সম্ভব হতো? তাছাড়া ক্ষমতায় যাবার পর থেকে আমাদের প্রতি ভোটারদের সমর্থন কমছিল। সেপ্টেম্বর ২০১০-এ ডেইলি স্টারে প্রকাশিত জনমত জরিপে সেটাই বলা হয়েছিল। তার পরের সোয়া তিন বছরে আওয়ামী লীগের প্রতি জনসমর্থন আরো কমেছিল। বিএনপির প্রতি জনসমর্থন বেড়েছিল। সেক্ষেত্রে দেশের প্রায় অর্ধেক জায়গা জুড়ে বিএলপি রুম বানাতে হতো। বিদেশিরা তখন বলতো আমরা অর্ধেক দেশকে জেলখানা করেছি। সেটা কি ভালো হতো? ওই যে! ইমিগ্রেশন অফিসার আবার আসছেন। তবে তার হাতে আমাদের পাসপোর্ট নেই।
ইমিগ্রেশন অফিসার : কিছু মনে করবেন না। কয়েকটি প্রশ্নের উত্তর দিলে বাধিত হবো। আপনারা সবাই যাচ্ছেন কোথায়?
ডা. দীপু মনি : নিউ ইয়র্কে।
ইমিগ্রেশন অফিসার : কেন?
ডা. দীপু মনি : এবিসি কনভেনশনে যোগ দিতে। এবিসি মানে আমেরিকা-বাংলাদেশ-কানাডা কনভেনশন।
ইমিগ্রেশন অফিসার : আপনি সেখানে কি করবেন?
ডা. দীপু মনি : ‘গণতন্ত্রের উন্নয়নে একদলীয় শাসনের অপরিহার্যতা’ শীর্ষক একটি কি-নোট স্পিচ দেয়ার জন্য আমাকে বলা হয়েছে।
ইমিগ্রেশন অফিসার (ডা. দীপু মনির স্বামীর দিকে ইঙ্গিত করে) : আর উনি?
ডা. দীপু মনি : উনি খুব ভালো বাশি বাজান। আজ প্রায় পঞ্চাশ বছর যাবৎ উনি বাশি বাজাচ্ছেন। এর আগে নিজের বাড়িতে কিছু বিশিষ্ট অতিথিদের সামনে বাশি বাজিয়ে শুনিয়েছেন। এই প্রথম তিনি পাবলিক ফাংশনে, নিউ ইয়র্কের এবিসি কনভেনশনে, বাশি বাজাবেন।
ইমিগ্রেশন অফিসার : আর স্যার, আপনি যাচ্ছেন কেন?
এ কে খন্দকার : আমি একজন মুক্তিযোদ্ধা। আমি ওই কনভেনশনে মুক্তিযোদ্ধাদের সম্পর্কে সত্য ইতিহাস বলার আমন্ত্রণ পেয়েছি। সেটা বলতেই যাচ্ছি।
ইমিগ্রেশন অফিসার (উৎসাহিত স্বরে) : খুব ভালো কথা স্যার। মুক্তিযুদ্ধের সময়ে আমরা খুব ছোট ছিলাম। কোন মুক্তিযোদ্ধা তখন কি করেছিলেন আমরা এই প্রজন্ম সে বিষয়ে সত্য কথাটা জানতে পারছি না। আপনারা যখন গত পাচ বছর ক্ষমতায় ছিলেন তখন জেনেছিলাম, বঙ্গবন্ধু নয় মাস পশ্চিম পাকিস্তানে বন্দি ছিলেন। সেজন্য তিনি পরবর্তী সময়ে নন্দিত হয়েছিলেন, যদিও তিনি মুক্তিযুদ্ধে অনুপস্থিত ছিলেন। আর উল্টো দিকে জিয়াউর রহমান নয় মাস বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধে উপস্থিত ছিলেন পাকিস্তানের চর হিসাবে। সে জন্য তিনি আপনাদের সময়ে গত পাচ বছরে নিন্দিত হয়েছিলেন। এবার আপনি সাহস করে সত্যটা বলবেন কি?
এ কে খন্দকার (প্রশ্নের উত্তর এড়িয়ে) : আমার যথেষ্ট বয়স হয়েছে। আসলে আমি এবিসি কনভেনশনে যাবার সুযোগটা নিচ্ছি নিউ ইয়র্কে একটা মেডিকাল চেকআপ করাতে।
ইমিগ্রেশন অফিসার : থ্যাংক ইউ ম্যাডাম। থ্যাংক ইউ স্যার। আপনারা দয়া করে আরেকটু অপেক্ষা করুন। বোঝেনই তো সবই ওপরের নির্দেশ।
এ কে খন্দকার (বিরক্ত মুখে) : ওপরের নির্দেশ! আপনার ওপরওয়ালা। তার ওপরওয়ালা। তার ওপরওয়ালা। তারপর স্বরাষ্ট্র সচিব। তারপর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী। তারপর প্রধানমন্ত্রী। সেই তো? এই তো চূড়ান্ত ওপরওয়ালা?
ইমিগ্রেশন অফিসার : আমি ছোট মানুষ। আমি সব জানি না। আপনি যা বললেন, তা হতে পারে। আপনাদের মতো ভিআইপিদের আসা-যাওয়ার সময়ে আমাদের অ্যালার্ট থাকার নির্দেশ দেয়া আছে। আমরা অ্যালার্ট থাকি। তারপর রিপোর্ট করি। এটুকুই আমাদের কাজ। ওপরে যারা আছেন তারাই ডিসিশন নেন। আমাদের কিছুই করার নেই। এটা নিশ্চয়ই আপনারা ভালো বোঝেন। আপনারা তো ক্ষমতায় ছিলেন এই সেদিন পর্যন্ত।
এ কে খন্দকার (বিষন্ন মুখে) : হ্যা। আর কতোক্ষণ লাগবে মনে হয় আপনার? এগারোটা তো প্রায় বাজতে চললো।
ইমিগ্রেশন অফিসার : উই আর ট্রাইয়িং আওয়ার বেস্ট। প্লিজ, আরেকটু ওয়েইট করুন।
ইমিগ্রেশন অফিসার গটগট করে হেটে অদৃশ্য হয়ে গেলেন।
দৃশ্য : ৪
প্রধানমন্ত্রীর অফিস
প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া : এয়ারপোর্ট ইমিগ্রেশন কনট্রোল তিনজনকে আটকে রেখেছে। ডা. দীপু মনি ও তার স্বামী এবং এ কে খন্দকারকে। ওরা জানিয়েছে আরো তিনজনকে আটকাতে যাচ্ছে। রিহ্যাবের সাবেক সভাপতি ও সাবেক এমপি নসরুল হামিদ, কবি নির্মলেন্দু গুণ এবং কবি মহাদেব সাহাকে। এসব কেন হচ্ছে ওখানে?
মন্ত্রী সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী : ম্যাডাম, আমি সঠিক জানি না কেন হচ্ছে। গত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে প্রায়ই নতুন নতুন ব্ল্যাক লিস্ট তৈরি করা হতো। সেই ব্ল্যাক লিস্টে যাদের নাম থাকতো তাদের বিদেশ যেতে দেয়া হতো না।
প্রধানমন্ত্রী খালেদা : আমি জানি। ওদের আগে আমরা যখন পাওয়ারে ছিলাম তখন কি হয়েছিল?
সাকা চৌধুরী : ও রকম কোনো লিস্ট ছিল না। তবে আমাদের গত আমলে বড় জোর দশজনকে বিদেশে যেতে বাধা দেয়া হয়েছিল।
খালেদা : আওয়ামী লীগের আমলে কাদের যেতে বাধা দিয়ে লিস্ট বেরিয়েছিল?
সাকাচৌ : ১৭ সেপ্টেম্বর ২০১০-এর একটি লিস্টের নামগুলো আপনাকে পড়ে শোনাচ্ছি :
বিএনপি নেতাদের মধ্যে এই লিস্টে ছিলেন সাবেক পররাষ্ট্র সচিব ও বিএনপি উপদেষ্টা রিয়াজ রহমান, ড্যাব মহাসচিব ও চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ডা. এ জেড এম জাহিদ হোসেন, খালেদা জিয়ার ভাগ্নে ইঞ্জিনিয়ার শাহরীন ইসলাম তুহিন, সাবেক প্রতিমন্ত্রী ও যুগ্ম মহাসচিব আমানউল্লাহ আমান, সাবেক প্রতিমন্ত্রী ও যুগ্ম মহাসচিব সালাহউদ্দিন আহমেদ, সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর (তখন কারাবন্দি), সাবেক এমপি নাসিরউদ্দিন আহম্মেদ পিন্টু (তখন কারাবন্দি), সাবেক পররাষ্ট্র সচিব ও বিএনপি ভাইস চেয়ারম্যান শমসের মবিন চৌধুরী, সংরক্ষিত আসনের এমপি সৈয়দা আসিফা আশরাফি পাপিয়া, যুবদল সভাপতি সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল, জাগপা সভাপতি শফিউল আলম প্রধান, বিএনপি যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবীর রিজভী আহমেদ, স্বনির্ভর বিষয়ক সম্পাদক রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলু, ছাত্রদল সভাপতি সুলতান সালাউদ্দিন টুকু ও বিরোধীদলীয় চিফ হুইপ জয়নুল আবদিন ফারুক।
আইনজীবীদের মধ্যে ছিলেন সাবেক এমপি অ্যাডভোকেট শেখ আনসার আলী, ব্যারিস্টার আবদুর রাজ্জাক, ব্যারিস্টার মাহবুবউদ্দিন হোসেন, ঢাকা বার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি অ্যাডভোকেট সানাউল্লাহ মিয়া, ব্যারিস্টার নাসিরউদ্দিন আহমেদ অসীম, সুপ্রিম কোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন।
সাংবাদিকদের মধ্যে ছিলেন, সাবেক জ্বালানি উপদেষ্টা ও আমার দেশের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মাহমুদুর রহমান (তখন কারাবন্দি), বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ও জাতীয় প্রেসক্লাবের সভাপতি শওকত মাহমুদ, বিশিষ্ট সাংবাদিক আতাউস সামাদ, কলামিস্ট ফরহাদ মজহার এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি প্রফেসর ডা. এম মনিরুজ্জামান মিঞা।
অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তাদের মধ্যে ছিলেন, এনএসআইর সাবেক ডিজি মেজর জেনারেল (অব.) রেজ্জাকুল হায়দার চৌধুরী (তখন কারাবন্দি), আনসার এবং ডিজিএফআইর সাবেক ডিজি মেজর জেনারেল (অব.) এ টি এম আমিন, জামায়াতের সাবেক আমির গোলাম আযমের ছেলে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আবদুল্লাহ আমান আল আজমী, এনএসআইর সাবেক ডিজি ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আবদুর রহিম (তখন কারাবন্দি), খালেদা জিয়ার ভাই মেজর (অব.) সাঈদ এস্কান্দার, সাবেক মন্ত্রী এয়ার ভাইস মার্শাল (অব.) আলতাফ হোসেন চৌধুরী, ডিজিএফআইর সাবেক পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) চৌধুরী ফজলুল বারী।
ব্যবসায়ীদের মধ্যে ছিলেন, জামায়াতের ফরেন ফাইনান্স দেখাশোনার দায়িত্বে নিয়োজিত মো. জাকারিয়া, দিগন্ত টিভির মালিক মীর কাসেম আলী, চ্যানেল ওয়ানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক গিয়াসউদ্দিন আল মামুন, এনটিভির মালিক ও সাবেক এমপি মোসাদ্দেক আলী ফালু এবং চ্যানেল ওয়ানের পরিচালক প্রফেসর মাজেদুল ইসলাম প্রমুখ।
খালেদা (গম্ভীর মুখে) : হ্যা। ওই সময়ে আমাদের পার্টির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কেউ হলে অথবা পার্টির প্রতি কেউ সহানুভূতিশীল হলে তার এই রকম ব্ল্যাক লিস্টেড হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা ছিল। এখন বলুন। যে তিন জনকে এয়ারপোর্ট ইমিগ্রেশন আটকেছে এবং আরো যে তিনজনকে আটকাতে যাচ্ছে, তাদের বিষয়ে আমাদের কি ডিসিশন নেয়া উচিত?
সাকাচৌ : আওয়ামী লীগের আমলে আমাদের সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী রিয়াজ রহমানকে সস্ত্রীক দুই বার এয়ারপোর্ট থেকে ফিরিয়ে দেয়া হয়েছিল।
খালেদা : রিয়াজ রহমান ভুল করেছিলেন। তার উচিত ছিল প্রথমবার আটকে যাবার পর হাই কোর্টের রুলিং নিয়ে দ্বিতীয় বার এয়ারপোর্টে যাওয়া। সেটা তিনি করেননি। সাবেক রাষ্ট্রদূত শমসের মবিন চৌধুরী সেটা করেছিলেন। তাই সেপ্টেম্বর ২০১০-এ তিনি ওমরাহ করতে সউদি আরবে যেতে পেরেছিলেন।
সাকাচৌ : হ্যা। ওই সময়ে হাই কোর্টের রুলিং নিয়ে সেকেন্ড অ্যাটেম্পটে বিদেশ যাওয়াটা একটা সিসটেমে পরিণত হয়েছিল। ব্যারিস্টার মাহবুবউদ্দিন খোকন এমপিও তাই করেছিলেন। সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী রিয়াজ রহমানের মতো নির্বিবাদী ভদ্রলোক ভূ-ভারতে আর একজনও নেই! তাকেও সস্ত্রীক ঝামেলা পোহাতে হয়েছিল। এখন যদি আমরা সেই ঘটনার প্রতিশোধ নিতে চাই তাহলে সাবেক পররাষ্ট্র মন্ত্রী ডা. দীপু মনিকে তার স্বামীসহ আটকে দিতে পারি।
খালেদা : আপনি ভূ-ভারতে বললেন! হয়তো ভূ-পাকিস্তানে বলতে চেয়েছিলেন। ওরা তো আপনাকে পাকিস্তানের এজেন্ট বলে!
সাকাচৌ : শহীদ জিয়াকে যখন ওরা পাকিস্তানের চর বলে তখন আমার পাকিস্তানের এজেন্ট হতে কোনো আপত্তি নেই।
খালেদা : সে যাই হোক। এবার বলুন এ কে খন্দকার বিষয়ে। তিনি তো একজন মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন।
সাকাচৌ : তিনি অবশ্য এরশাদের উপদেষ্টাও ছিলেন। তার নৈতিকতা নিয়ে আমি কোনো কথা বলতে চাই না। তবে, তিনি মেডিকাল গ্রাউন্ডে নিউ ইয়র্কে যেতে চাইছেন। এখানে মনে করিয়ে দিতে পারি, শমসের মবিন চৌধুরীও মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। আমাদের গত আমলের সাবেক তথ্যমন্ত্রী শামসুল ইসলামকেও চিকিৎসার জন্য সিঙ্গাপুরে যেতে বাধা দেয়া হয়েছিল।
খালেদা : রিহ্যাবের সাবেক সভাপতি নসরুল হামিদ সম্পর্কে বলুন। তিনি নিউ ইয়র্কে গেলে নিশ্চয়ই হাউজিং সেক্টরে বাংলাদেশের উপকার হবে।
সাকাচৌ : তা হবে। তবে এখানে মনে করা যেতে পারে মাহমুদুর রহমান, যিনি লেখালেখি ও পত্রিকা সম্পাদনা ছাড়াও সিরামিক ইনডাস্টৃর সঙ্গে ওতোপ্রতোভাবে জড়িত, তাকেও ব্যবসায়িক টৃপে জার্মানিতে যেতে বাধা দিয়েছিল গত আওয়ামী সরকার। তাতে তার ব্যবসার এবং বাংলাদেশেরও বটে, বেশ ক্ষতি হয়েছিল।
খালেদা : কবি নির্মলেন্দু গুণ আর কবি মহাদেব সাহার কথা বলুন। এরা তো রাজনীতির বাইরে।
সাকাচৌ : আওয়ামী লীগের আমলে সেপ্টেম্বর ২০১০-এর ব্ল্যাক লিস্টে দুজন লেখক, আতাউস সামাদ এবং ফরহাদ মজহার-এর নাম ছিল। প্রতিশোধ নিতে চাইলে এখন দুজন কবিকে আটকে দেয়ার যুক্তিটা সঙ্গত মনে হতে পারে।
খালেদা : না। আমি মনে করি যুক্তিটা সঙ্গত হবে না। আমি মনে করি ইতিহাস থেকে আমাদের শিক্ষা নিতে হবে। আমরা ক্ষমতায় এসেছি মাসখানেক হয়। আমরা কোনো ব্ল্যাক লিস্ট করিনি। করবোও না। আমরা যদি এখন ব্ল্যাক লিস্ট করি তাহলে ভবিষ্যতে ডা. দীপু মনি আর এ কে খন্দকারের মতোই আপনিও বিপদে পড়তে পারেন।
সাকাচৌ : তা ঠিক ম্যাডাম। অবশ্য যদি পাচ বছর পরের নির্বাচনে আমরা হেরে যাই।
খালেদা : এয়ারপোর্ট ইমিগ্রেশন কনট্রোল নিজেরা অতি উৎসাহী হয়ে এসব করছে।
সাকাচৌ : ওদের দোষ দেবেন না ম্যাডাম। আওয়ামী আমলে ওরা ব্ল্যাক লিস্ট দেখে কাজ করতে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিল। ওরা মনে করছে আমরাও এখন নতুন একটা লিস্ট পাঠাবো।
খালেদা : না। আমরা কোনো লিস্ট করবো না। ফৃডম অফ মুভমেন্ট বা চলাফেরার স্বাধীনতা মানুষের একটা মৌলিক অধিকার। ওদের সবাইকে ছেড়ে দিতে এবং সসম্মানে প্লেনে উঠিয়ে দিতে বলুন। ইতিহাস থেকে আমাদের শিক্ষা নিতে হবে। নইলে বাংলাদেশ একইভাবে চলতে থাকবে। সেটা হয় না। এই ভিশাস সার্কল ভাংতে হবে। প্রতিশোধ ও প্রতিহিংসার রাজনীতির চাকা বন্ধ করতে হবে।
সাকাচৌ : আপনি যথার্থই বলেছেন ম্যাডাম। আমি এখনই এয়ারপোর্ট ইমিগ্রেশন কনট্রোলে ফোন করে দিচ্ছি।
দৃশ্য : ৫
এয়ারপোর্ট ডিপারচার লাউঞ্জ
ডা. দীপু মনি (রিস্টওয়াচ দেখে হতাশ স্বরে) : প্লেন টেক অফ করার আর মাত্র দশ মিনিট বাকি আছে। আমাদের যাওয়া বোধ হয় আর হলো না।
এ কে খন্দকার : ওই যে! এমিরেটসের ম্যানেজারের সঙ্গে ইমিগ্রেশন অফিসার আসছেন। তার হাতে পাসপোর্ট দেখছি।
ইমিগ্রেশন অফিসার (কাছে এসে) : সরি। অনেক দেরি হয়ে গেল। এই যে আপনাদের পাসপোর্ট। সব পাসপোর্টে ডিপারচার সিল দেয়া হয়েছে। আপনাদের যাত্রা শুভ হোক।
এমিরেটস ম্যানেজার (ব্যগ্র স্বরে) : চলুন সবাই তাড়াতাড়ি।
ডা. দীপু মনি (হাফ ছেড়ে) : চলুন সবাই। (এ কে খন্দকারের প্রতি) ইতিহাস থেকে আমাদের শিক্ষা নিতে হবে। বিএনপি আবার ভুল করলো এবং আরো ভুল করবে। এভাবে ওরা ভুল করলে আমরা অবশ্যই আবার ক্ষমতায় ফিরে আসবো। তখন আমাদের আর বিএলপি ওয়েটিং রুমের দরকার হবে না। সুতরাং ওই প্রসঙ্গটা ভুলে যান মি. খন্দকার।
এ কে খন্দকার (স্মিত মুখে) : ঠিকই বলেছেন। হিস্টৃ উইল রিপিট ইটসেলফ। ইতিহাসের চাকা একইভাবে ঘুরবে। আমরা আবার ক্ষমতায় ফিরে আসবো।
তারা তিনজন বোর্ডিং লাউঞ্জের দিকে দ্রুত হাটা শুরু করলেন।
১৮.০৯.২০১০
(সংলাপ, ঘটনা ও চরিত্র সম্পূর্ণ কাল্পনিক।)
(বানানরীতি লেখকের। বি. স.)

নেড়ি কুকুরের ভাষণ: অবিচার যখন হয় আইন



shafik-rehmanউপস্থিত মানুষবৃন্দ
এখানে স্যুট-টাই পরে এলেও আসলে আমি একটি নেড়ি কুকুর। সাধারণত আমি ইন্টারভিউ দিয়ে থাকি। কিন্তু কোনো গোলটেবিল আলোচনায় অংশ নেয়ার অভিজ্ঞতা এই প্রথম হচ্ছে আমার। আমার এই ধরনের অভূতপূর্ব উপস্থিতির জন্য সম্পূর্ণ কৃতিত্ব দাবি করতে পারেন, আজকের এই গোলটেবিল আলোচনার আয়োজক এনার্জি সলিউশন অফ বাংলাদেশ বা সংক্ষেপে ইএসবি নামের প্রতিষ্ঠান এবং কয়েকজন উদ্যমী সাংবাদিক। এরাই আমাকে নিয়ে এসেছেন আপনাদের মতো সুধী ও বিশিষ্ট মানুষজনের সামনে। আপনারা জানতে চাইতে পারেন, এমন অপ্রত্যাশিত ঘটনাটি কিভাবে ঘটল? কেন এমন একটি গুণী মানুষের সমাবেশে একটা নেড়ি কুকুরের আবির্ভাব ঘটলো?
আপনাদের কৌতূহল নিবৃত্তির জন্য আমি এই ঘটনার পেছনের ঘটনাটির কথা বলছি।

দিন পাঁচেক আগে আমি আমার অভ্যাস মতো খাবারের খোঁজে ডাস্টবিনের পাশে ঘুরঘুর করছিলাম। হঠাৎ কয়েকজন সাংবাদিক আমাকে ঘেরাও করে বললেন, শুক্রবার, তেসরা ডিসেম্বরে, আপনাকে প্রেস ক্লাবে একটা প্রবন্ধ উপস্থাপন করতে হবে, যার টাইটেল হবে, গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতা।
আমি তাদের বললাম, কুকুর জাতির মধ্যে গণতন্ত্র বলে কিছু নেই, কুকুরাধিকার বলে কিছু নেই এবং আমাদের কোনো কুকুর মাধ্যম বা কুকুরমিডিয়া নেই। মোট কথা, এই বিষয়টি সম্পর্কে আমার কোনো জ্ঞান নেই। সুতরাং আমি প্রেস ক্লাবে যাবো না এবং কোনো প্রবন্ধ পাঠ করব না। ওই সাংবাদিকরা ছিলেন নাছোড়বান্দা। তারা খুব অনুনয়-বিনুনয় করতে থাকলেন। আমি তখন জানতে চাইলাম, কেন তারা কোনো মানুষকে দিয়ে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করাচ্ছেন না। তাদের উত্তর শুনে আমি অবাক হয়ে গেলাম।
তারা সবাই একবাক্যে বললেন, নির্দিষ্ট বিষয়টি নিয়ে মূল প্রবন্ধ লেখা ও পড়ার জন্য কোনো মানুষকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। কারণ ৩০ নভেম্বর বিরোধী দল বিএনপি আহূত হরতালের কারণে বহু বিশিষ্ট ও গুণী মানুষকে বাড়ির বাইরে কাটাতে হচ্ছে। যেকোনো সময় তাদের যেকোনো স্থানে পুলিশ গ্রেফতার করতে পারে এই আতঙ্কে তারা সবাই নিজের শহরেই পলাতক জীবনযাপন করছেন। বিএনপি’র নেতা মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের বাড়িতে পুলিশ আগেভাগেই হানা দিয়েছিল। তাকে তারা পায়নি। কিন্তু তার অভিজ্ঞতার পরে গণতন্ত্রকামী অথচ বিরোধী মতাবলম্বী অথবা ভিন্ন মতাবলম্বী মানুষরা নিজেদের বাড়ির বাইরে থাকছেন। তারা সবাই ঠিকানাবিহীন হয়ে গেছেন। সুতরাং তারা আমার পার্মানেন্ট ঠিকানা, অর্থাৎ প্রযত্নে ডাস্টবিনে এসেছেন এবং আমাকে পেয়েছেন।
তাদের এই দুর্গতি জেনে আমি রাজি হলাম। তবে আমি আমার দুর্বলতা অর্থাৎ গণতন্ত্র বিষয়ে আমার জ্ঞানের সীমাবদ্ধতার কথা বললাম। আমি আবারও বললাম, আমাদের কোনো কুকুরতন্ত্র নেই, কোনো কুকুরাধিকার নেই। আর বাকস্বাধীনতার প্রশ্নই ওঠে না। আমরা তো কথা বলতে পারি না। আমরা শুধু ঘেউ ঘেউ করতে পারি। সিনিয়র সাংবাদিক একজন নির্ভয় দিয়ে বললেন, আপনি আমেরিকার ষোড়শতম প্রেসিডেন্ট এব্রাহাম লিংকনের জীবনীটা পড়ে নেবেন। লিংকন ১৮৬১ থেকে ১৮৬৫ পর্যন্ত আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ছিলেন। তিনি এক সন্ধ্যায় থিয়েটার হলে নাটক দেখার সময় আততায়ীর গুলিতে নিহত হয়েছিলেন। বুঝলাম, প্রায় দেড় শ’ বছর আগে গণতন্ত্র আমেরিকায় যেমন বিপজ্জনক ছিল, ঠিক তেমনি এখন, প্রায় দেড় শ’ বছর পরে বাংলাদেশে গণতন্ত্র বিপজ্জনক অবস্থায় আছে।
গণতন্ত্র
বিষয়টি নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে আমার এই ধারণা বদ্ধমূল হলো। লিংকন গুলিতে মারা গিয়েছিলেন। কিন্তু বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক আন্দোলনে মানুষ মারা যাচ্ছে প্রাচীন অস্ত্র, লাঠি-বৈঠা-লগির আঘাতে এবং আধুনিক অস্ত্র মোটরসাইকেল হামলায়। মানুষ মারা যাচ্ছে রাজধানী ঢাকায়। মানুষ মারা যাচ্ছে মফস্বল শহর নাটোরে। এমনকি মানুষ মারা যাচ্ছে ট্রেনে কাটা পড়ে, যেমন সিরাজগঞ্জে। তাদের দুর্ভাগ্য, তারা বিরোধী দল বিএনপি’র আহূত একটি গণতান্ত্রিক সমাবেশের পাশ দিয়ে চলাচলকারী ট্রেনের কাছাকাছি ছিলেন।
মানুষ মারা যাচ্ছে, মানুষ পিটুনি খাচ্ছে, মানুষ বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে থাকছে। কেউ কেউ ধরা পড়ছে হাজতে থাকছে। রিমান্ডে নির্যাতিত অথবা বিবস্ত্র হচ্ছে, জেলে থাকছে। এই হলো বিরোধী মতাবলম্বী এবং ভিন্ন মতাবলম্বীদের অভিজ্ঞতা বর্তমানের গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশে।
এটাই কি গণতন্ত্র? তাহলে এব্রাহাম লিংকন কি বলেছিলেন, যার জন্য মানবজাতি এত আকুলি-বিকুলি করে গণতন্ত্র চায়?
খোঁজ নিয়ে জানলাম, ১৮৬৩ সালে গেটিসবার্গ শহরে এব্রাহাম লিংকন একটি অনুপ্রাণিত ভাষণে বলেছিলেন,
That this nation, under God, shall have a new birth of freedom : and that government of the people, by the people and for the people, shall not perish from the earth.
অর্থাৎ, ঈশ্বরের অধীনে, এই জাতি তার মুক্তির একটি নতুন জন্ম পাবে : সেখানে থাকবে জনগণের জন্য, জনগণের দ্বারা, জনগণের সরকার এবং এই জাতি পৃথিবীতে ধ্বংস হবে না।
কেউ কেউ মনে করেন লিংকনের এই উক্তিই গণতন্ত্রের ডেফিনেশন বা সংজ্ঞা।
এই সংজ্ঞায় আমি সন্তুষ্ট হতে পারলাম না। বাংলাদেশের অবস্থা লিংকনের ডেফিনেশনের সঙ্গে তো মিলছে না।
আরো খোঁজাখুঁজির পর বাংলাদেশের জন্য প্রযোজ্য হতে পারে গণতন্ত্রের এমন ডেফিনেশনটি পেলাম।
আইরিশ লেখক অস্কার ওয়াইল্ড, যার মৃত্যু হয়েছিল মাত্র ৪৬ বছর বয়সে ১৯০০ সালে। তিনি ১৮৯৫ সালে ”The soul of man under socialism’ নিবন্ধে লিখেছিলেন :
Democracy means simply the bludgeoning of the people by the people for the people.
অর্থাৎ, গণতন্ত্র মানে, সোজা কথায়, জনগণের জন্য জনগণের দ্বারা জনগণকে লাঠিপেটা করা।
অস্কার ওয়াইল্ড সেই ১১৫ বছর আগে জানলেন না যে, বাংলাদেশ নামে একটি রাষ্ট্রের অভ্যুদয় হবে এবং সেখানে থাকবে আওয়ামী লীগ নামে একটি রাজনৈতিক দল, যে দলটি সত্যিই লাঠিপেটানোর গণতন্ত্র চালু করবে। অস্কার ওয়াইল্ড জানতেন না যে, ৩০ নভেম্বর ২০১০-এ বিএনপি আহূত হরতালে তারই কথা আবারও বাংলাদেশে সত্য হবে পুলিশ বেধড়ক লাঠিপেটা করবে।
কিন্তু এমন অবস্থাতেও যখন পুলিশের নিয়ন্ত্রক আওয়ামী লীগ সরকার তথা আওয়ামী লীগ দাবি করে, দেশে গণতন্ত্র আছে এবং তাদের দলই গণতন্ত্রের ধারক-বাহক, তখন, আমি নেড়ি কুকুর, কনফিউসড হয়ে গেলাম। বিভ্রান্তিতে পড়লাম। আসলেই বাংলাদেশে গণতন্ত্র বলতে কি বোঝায়?
বাংলাদেশের ইতিহাস পড়ে জানলাম ২৫ জানুয়ারি ১৯৭৫-সালে সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে দেশে রাতারাতি সংসদীয় সরকার পদ্ধতির বদলে প্রেসিডেন্ট শাসিত সরকার পদ্ধতি চালু হয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান হন প্রেসিডেন্ট শেখ মুজিবুর রহমান। বহুদলীয় গণতন্ত্রের বদলে দেশে একদলীয় শাসন ব্যবস্থা চালু হয়। সব দলের অস্তিত্ব বিলুপ্ত করে বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ, সংক্ষেপে বাকশাল নামে একটি মাত্র দল গঠন করা হয়। চতুর্থ সংশোধনীতে আরো বলা হয়, জাতীয় দল <অর্থাৎ বাকশাল> গঠনের পর সব সংসদ সদস্যকে বাধ্যতামূলকভাবে এই দলের সদস্য হতে হবে।
কেউ সদস্য না হলে, সংসদে তার আসন শূন্য হবে এবং জাতীয় দলের প্রার্থী না হলে তিনি প্রেসিডেন্ট বা সংসদ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারবেন না।
১৯৭৫ থেকে ২০১০। আবারও আওয়ামী লীগ ৩৫ বছর পরে সেদিকেই এগিয়ে গেছে। কোনো বিরোধী মতামত গ্রাহ্য করা হচ্ছে না। বিরোধী দলের কর্মসূচি সহ্য করা হচ্ছে না। বস্তুত ঠিক ৩৫ বছর আগের মতোই প্রধান বিরোধী দলটিকে বিলুপ্ত করার চেষ্টা চলছে। তাই বিএনপি’র প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানকে বলা হয়েছে তিনি ছিলেন পাকিস্তানের চর। কি আশ্চর্য ইতিহাস! যিনি নয় মাস যুদ্ধ করেছিলেন পাকিস্তানের বিরুদ্ধে, তিনি হচ্ছেন নিন্দিত। আর যিনি পাকিস্তানে নয় মাস বন্দী ছিলেন, শুধু তিনিই হচ্ছেন নন্দিত। শুধু তাই নয়। এখন বলা হচ্ছে, বাকশালের একদলীয় শাসনও ছিল এক ধরনের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা।
আওয়ামী লীগেরই সহযাত্রী দল জেনারেল হুসাইন মুহম্মদ এরশাদও প্রায় একই ধারণা করেন। জাতীয় পার্টির প্রতিষ্ঠাতা জেনারেল এরশাদও মনে করেন, তিনিও ছিলেন গণতন্ত্রের একনিষ্ঠ সেবক। তাই ৬ ডিসেম্বর ১৯৯০ সালে তার স্বৈরাচারী সরকারের পতন দিবসটিকে তিনি ঘোষণা করেছেন সংবিধান রক্ষা দিবস হিসেবে।
অর্থাৎ, বাংলাদেশে জোর যার, গণতন্ত্রের ডেফিনেশন তার। ক্ষমতায় যিনি বা যারা থাকবেন তারাই ঠিক করে দেবেন গণতন্ত্র কি।
সম্পাদক ও লেখক মি. মাহমুদুর রহমান বিরোধী অবস্থানে থেকে গণতান্ত্রিক অধিকার চর্চা করতে গিয়ে বিপদে পড়েছেন। তার জন্য আমি দুঃখ বোধ করছি। একসময় তিনি ক্ষমতাসীন বিএনপি’র সঙ্গে ছিলেন। ভোল পালটে তিনি যদি ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সঙ্গে ভিড়ে যেতেন, তা হলে তার এই দুঃসময় হতো না। আওয়ামী লীগ মন্ত্রিসভার মধ্যেই ভোল পাল্টানো মানুষ আছেন, যারা একসময় অন্য দল করতেন অথবা এরশাদের মন্ত্রী ছিলেন।
সে যাই হোক। অন্যান্য দেশে গণতন্ত্রের কি অবস্থা জানার জন্য আরো কিছু খোঁজ-খবর নিলাম।
জানলাম বৃটিশ মডেল গণতন্ত্রে কোনো সংবিধান নেই। বৃটিশ প্রজাদের ভক্তি রাজতন্ত্রে। তাদের আসক্তি বিয়ারে এবং আবেগ ফুটবলতন্ত্রে যদিও তারা গতকাল খুব হতাশ হয়েছে। ২০১৮-এর ওয়ার্ল্ড কাপ ফুটবল তাদের দেশে করার প্রস্তাবটি ফিফা নাকচ করে দিয়েছে। বৃটিশ গণতন্ত্রের প্রকাশ পার্লামেন্টে।
আরো জানলাম আমেরিকান মডেল গণতন্ত্রে সংবিধান আছে। বস্তুত আমেরিকাই প্রথম সাংবিধানিক গণতন্ত্র চালু করেছিল। সংবিধানটি রচনা করেছিলেন টমাস জেফারসন যিনি ছিলেন আমেরিকার তৃতীয় প্রেসিডেন্ট। তবে বর্তমানে আমেরিকানদের শ্রদ্ধা ডলার ধনতন্ত্রে, লোভ মিডল ইস্ট তেলে এবং আসক্তি ফাস্ট ফুডে। তাদের গণতন্ত্রের প্রকাশ কংগ্রেসে।
এক দিকে বৃটিশ পার্লামেন্টারি ও প্রাইম মিনিস্টার ফর্ম ডেমক্রেসি এবং অন্য দিকে আমেরিকান কংগ্রেস ও প্রেসিডেনশিয়াল ফর্ম ডেমক্রেসির মধ্যে রয়েছে বিশ্বের প্রায় সোয়া শ’ দেশে একেক ধরনের গণতন্ত্র। কোনোটা স্ট্রং ডেমক্রেসি। কোনোটা উইক ডেমক্রেসি। কোনোটা লিবারাল ডেমক্রেসি। কোনোটা ইল-লিবারাল ডেমক্রেসি। এদেরই মধ্যে কোনো এক অবস্থানে আছে আজকের বাংলাদেশ। যেখানে মাহমুদুর রহমান আছেন কাশিমপুর জেলখানায়। তার দোষটা কি ছিল? তিনি কিছু সত্য প্রকাশ করেছিলেন ক্ষমতাসীন দলের দুর্নীতি সম্পর্কে এবং কিছু বহুল প্রচলিত মতামত প্রকাশ করেছিলেন ক্ষমতাসীন দলের সাজানো আদালত সম্পর্কে। এসব কথা প্রকাশের অধিকার কি মাহমুদুর রহমানের ছিল না?
মানবাধিকার
এই প্রশ্নের উত্তর পেতে আমি মানবাধিকার বিষয়ে খোঁজ-খবর নিলাম। পড়লাম ইউএনডিপি প্রকাশিত জাতিসঙ্ঘের সর্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণাপত্রটি।
আপনাদের হয়তো মনে পড়বে, ইউএনডিপি বাংলাদেশের এক সময়ের অধিকর্তা মিজ রেনেটা লক-এর সঙ্গে মাহমুদুর রহমানের আদা-কাঁচকলার সম্পর্ক ছিল। কিন্তু তার চাইতে ইন্টারেস্টিং বিষয় হচ্ছে, সাম্প্রতিক বাংলাদেশে ওই সর্বজনীন মানবাধিকারগুলোর অধিকাংশ কম-বেশি লংঘিত হচ্ছে।
বর্তমান বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে মানবাধিকার বলতে বোঝায়:
 ন্যায্য দামে খাবার অধিকার।
 নিরাপদে বেঁচে থাকার অধিকার।
 বিদ্যুৎ, গ্যাস, পানি ও সার পাওয়ার অধিকার।
 পড়াশোনার অধিকার।
 চাকরির অধিকার।
 চিকিৎসা পাওয়ার অধিকার।
 নিজের বাড়িতে নিরাপদে থাকার অধিকার।
 ব্যক্তিগত গোপনীয়তার অধিকার।
 ন্যায়বিচার পাওয়ার অধিকার।
এসব অধিকারই এখন হয়েছে খর্ব, উপেক্ষিত অথবা অপহৃত। যেমন :
 চালের দাম ঘুরছে ডেঞ্জার জোন পঁয়ত্রিশ টাকা কেজি থেকে চল্লিশ টাকার মধ্যে।
 আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ভয়াবহ অবনতি ঘটেছে। প্রমাণ, যেকোনো দৈনিক পত্রিকার প্রথম ও শেষ পৃষ্ঠা এবং মফস্বল সংবাদ পৃষ্ঠা।
 পল্লী বিদ্যুৎ নেই। শহর বিদ্যুৎ স্বল্প। চুলায় গ্যাসের চাপ কম। গ্যাস স্টেশনে সময় সীমিত এবং লম্বা গাড়ির লাইন। তবে বিচারপতিদের জন্য মাঝে মধ্যে দেখা যায় বিশেষ প্রেফারেনশিয়াল লাইন। শহরে পর্যাপ্ত পানির অভাব। গ্রামে প্রতিশ্রুত বিনামূল্যে সার নেই।
 স্কুলের সময় নিয়ে পরীক্ষা, ভর্তি নিয়ে বাণিজ্য ও লটারি এবং পাঠ্যবই পাওয়া নিয়ে অনিশ্চয়তা চলছে।
 ঘরে ঘরে প্রতিশ্রুত চাকরি হয়নি। বরং গতকালের একটি দৈনিক পত্রিকার হেডলাইন রিপোর্টের মতে, গত ১০ মাসে ৪০ হাজার শ্রমিক দেশে ফেরত এসেছেন। পাশাপাশি এটাও বলা হয়েছে, একমাত্র ক্ষমতাসীন দলের সমর্থকদের নতুন চাকরি পাওয়ার যোগ্যতা আছে।
 সরকারি চিকিৎসা ব্যবস্থা ভেঙে পড়ছে। সেখানেও ডাক্তারদের নিয়ে নিলর্জ্জ দলীয়করণ চলছে।
 ৪০ বছর থাকার পরে নিজের বাড়ির অধিকার হারিয়েছেন বিরোধী নেত্রী ম্যাডাম খালেদা জিয়া। তার বিরুদ্ধে সমালোচনা হচ্ছে, তিনি কেন তার উচ্ছেদের বিষয়ে সাংবাদিকদের কাছে বলতে গিয়ে কাঁদলেন? এই অভিযোগটি উঠছে তাদেরই কাছ থেকে, যারা ‘কাঁদো বাঙালি কাঁদো’ স্লোগানে অভ্যস্ত এবং যাদের নেত্রী ইন্সটান্ট কান্নাতে পারদর্শী!
 ব্যক্তিগত গোপনীয়তার অধিকার মানুষ হারিয়েছে। মোবাইল ফোন কোম্পানি, ব্যাংক, ইলেকশন কমিশন প্রভৃতির দৌরাত্ম্যে এই দেশের মানুষকে তাদের অনেক গোপনীয়তা বিসর্জন দিতে হয়েছে। এ বিষয়ে চূড়ান্ত ঘটনাটি ঘটেছে ম্যাডাম খালেদা জিয়াকে তার বাড়ি থেকে উচ্ছেদ করার পরে এবং উচ্ছেদকারীদের ভাষ্য অনুযায়ী সেই বাড়ি সিলগালা করার পরে। তাদের নির্বাচিত সাংবাদিকদের দেখানো হয়েছে ওয়াইন বটল, সফট ডৃংকস ক্যান, গার্লি ম্যাগাজিন ইত্যাদি। চেষ্টা করা হয়েছে এবং এখনো বিটিভিতে সেই চেষ্টা চলছে যে, বিরোধী নেত্রী বিলাসী এবং অসংযমী জীবনযাপন করতে অভ্যস্ত। নেড়ি কুকুর হিসেবে যেহেতু আমার যাতায়াত কিছুটা সহজ, এমনকি ক্যান্টনমেন্টেও, আমি শুনেছি, খালেদা জিয়া মিনারাল ওয়াটার দিয়ে গোসল করেন সেটা প্রতিষ্ঠার জন্য কয়েক ক্রেইট মামস মিনারাল ওয়াটার বটল তার বাড়িতে নেয়া হচ্ছিল। সেগুলো পথেই মিসিং হয়ে যায়। তারেক রহমানের ঘরে একটা বার ছিল, সেটা প্রতিষ্ঠার জন্য কয়েক বটল হুইস্কি-জিন এবং কয়েক ক্যান বিয়ার পাঠানো হচ্ছিল। সেগুলো পথিমধ্যে মিসিং হয়ে যায়। খালেদা জিয়াকে উচ্ছেদের পরপরই তার বেডরুম থেকে মিসিং হয়ে যায় বহু কসমেটিকস সামগ্রী, যেসব পূর্ব নির্দেশ অনুযায়ী পৌঁছে দেয়া হয় মন্ত্রিসভার একাধিক মহিলা মন্ত্রীদের কাছে। হয়তো তারা ভেবেছেন, ফেয়ার অ্যান্ড লাভলি হতে হলে ইউনিলিভারের নয়, খালেদা জিয়ার কসমেটিকসকেই নির্ভরযোগ্য মনে করতে হবে।
এ রকম বহু অপ্রকাশিত ঘটনার উল্লেখ আমি নেড়ি কুকুর করতে পারি। আপনারা হয়তো বলবেন, আমার এসব কথা মিথ্যা, এসব প্রপাগান্ডা। আমার উত্তর হবে আইএসপিআর যা বলেছে, বিটিভি এবং তার সহযোগী কিছু মিডিয়া যা প্রচার করে চলেছে সেগুলো কি? অকথ্য অশ্লীল এবং অসত্য অসভ্য প্রপাগান্ডা?
মানবাধিকার প্রসঙ্গে কথা হলো, মানুষ এখন ন্যায়বিচার পাওয়ার অধিকার হারিয়েছে। মাহমুদুর রহমান কি ন্যায়বিচার পেয়েছেন? যে অর্থদন্ড তার ওপর আরোপিত হয়েছে, সেটা কি সঠিক? তার জেলদন্ডের মেয়াদ কি? জেলে থাকার ছয় মাস তো আজ পূরণ হলো। তিনি কি মুক্ত হয়ে আমাদের মাঝখানে আসতে পেরেছেন?
ন্যায়বিচার প্রসঙ্গে আমি বিশেষত দু’টি দিকে আপনাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই।
এক. রিমান্ডে নিয়ে মানুষকে বিবস্ত্র করা, যেমনটা মাহমুদুর রহমানকে করা হয়েছিল এবং নৃশংস নির্যাতন করা এখন কালচারে পরিণত হয়েছে। যাকে বলা যায় টর্চার কালচার। এই কালচারের পরিণাম হচ্ছে মৃত্যু। গতকালও দৈনিক নয়া দিগন্ত পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে নরসিংদীর রায়পুরা থানা পুলিশের নির্যাতনে ৩০ বছর বয়স্ক আসামি সিরাজ মিয়ার মৃত্যু হয়েছে। এই টর্চার কালচার বিষয়ে বাংলাদেশের অতীতের সুশীল কিন্তু বর্তমানের কুশীল সমাজ নীরব আছে। আমার অনুরোধ, আপনারা সবাই টর্চার কালচারের বিরুদ্ধে সোচ্চার হোন। তবে কুকুর জাতির বিবস্ত্র হওয়ার সমস্যা নেই। মানুষের মতো সভ্য হয়ে আবার অসভ্য আমরা হইনি। আমরা সারাক্ষণই বিবস্ত্র থাকি। ন্যাংটার আবার ডিবি পুলিশের ভয় কি?
আর দ্বিতীয় বিষয়টি হচ্ছে, গণসমন জারি করা। ওয়ান-ইলেভেনের পর সেনা সমর্থিত সরকারের সময় টর্চার কালচার চালু হওয়ার পাশাপাশি গণসমন জারি শুরু হয়েছিল। সেই ধারাবাহিকতা এখনো চলছে। আমার দেশ পত্রিকার সাংবাদিকদের টাইট রাখার লক্ষ্যে প্রায় ১০০ অজ্ঞাতনামা সাংবাদিকের বিরুদ্ধে সমন জারি করা হয়েছে। অন্য এক্সটৃম বা মেরুতে সিরাজগঞ্জের কয়েক হাজার অজ্ঞাতনামা ব্যক্তির বিরুদ্ধে সমন জারি করা হয়েছে। এই গণসমন কালচারের বিরুদ্ধেও আপনারা সোচ্চার হোন।
বাকস্বাধীনতা
আমি গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের কথা এতক্ষণ বলেছি। তৃতীয় যে বিষয়টি নিয়ে আমাকে বলার জন্য অনুরোধ করা হয়েছিল, সেটা হচ্ছে বাকস্বাধীনতা।
এ বিষয়ে এখন যত কম বলা যায় ততই মঙ্গল। কারণ, বাকস্বাধীনতার অভাব হয়েছে বলেই মাহমুদুর রহমান কাশিমপুরে, বাংলাভিশনের উপস্থাপক কাজী জেসিন অদৃশ্য এবং দিগন্ত টিভির উপস্থাপক ড. রেজোয়ান সিদ্দিকী অনুপস্থিত।
সুতরাং বাকস্বাধীনতা বিষয়ে বেশি কিছু আর বলবো না। আপনারাই বুঝে নিন। আমি শুধু আমেরিকার সংবিধান রচয়িতা টমাস জেফারসনের একটি উক্তি আপনাদের মনে করিয়ে দিতে চাই।
টমাস জেফারসন বলেছিলেন,When injustice becomes law, Resistance becomes duty.
অর্থাৎ, অবিচার যখন হয় আইন, তখন প্রতিরোধ হয় কর্তব্য।
ধন্যবাদ সবাইকে এতক্ষণ শোনার জন্য।
ঘেউ ঘেউ।

৩ ডিসেম্বর ২০১০

বিভক্তি, মর্যাদাহানি ও চরিত্রহননের বছর


shafik-rehman1২০১০ সাল চলে গেল।
একবিংশ শতাব্দির প্রথম দশকটি শেষ হলো।
বাংলাদেশ ২০১০-এ কেমন ছিল?
সংক্ষেপে এর উত্তর হতে পারে, ২০১০-এ পূর্ণ রাজনৈতিক এবং আংশিক সামাজিকভাবে দেশ বিভক্ত হয়েছে। যার ফলে শান্তিপূর্ণ ও সমঝোতাপূর্ণ রাজনীতি থেকে দেশ হয়তো একটা পয়েন্ট অফ নো রিটার্নে চলে গিয়েছে এবং যার ফলে দেশ হয়তো এগিয়ে গিয়েছে ব্যাপক গৃহসংঘর্ষ এবং গভীর অনিশ্চয়তার দিকে। ২০১০-এ অবিরামভাবে ঘটেছে সংস্থা, গোষ্ঠি ও ব্যক্তির মর্যাদাহানি ও চরিত্র হনন।
২০১০-এর কোন সব ঘটনায় দেশ এই পরিস্থিতিতে পড়েছে?
নিচের ঘটনাগুলো আপনার ব্যক্তিগত ও পারিবারিক অভিজ্ঞতার সঙ্গে মিলিয়ে দেখুন।
বিবেচনা করুন ২০১০ সম্পর্কে আপনি কি রায় দেবেন?

নতুন রাজধানী আড়িয়াল
বিদায়ী বছরের শেষ সপ্তাহ পর্যন্ত যে সম্ভাব্য নির্মাণ প্রকল্পটি সবচেয়ে বেশি আলোচিত হয়েছে তা ছিল বঙ্গবন্ধু এয়ারপোর্ট। প্রথমে খুব ছোট আকারে খবর প্রকাশিত হয়, পঞ্চাশ হাজার কোটি টাকা খরচে বাংলাদেশে একটি নতুন এয়ারপোর্ট বানানো হবে যার নাম হবে বঙ্গবন্ধু এয়ারপোর্ট এবং এর সম্ভাব্য লোকেশন হচ্ছে ফরিদপুর, যেন আসা-যাওয়ার পথে টুঙ্গিপাড়া ভিজিট অপশনাল হতে পারে। তারপর খবর প্রকাশিত হয়, সম্ভাব্য খরচ একশ হাজার কোটি টাকা হতে পারে অর্থাৎ একেবারে ডাবল! এরপর খবর প্রকাশিত হয়, ময়মনসিংহের ত্রিশাল-এর দুটি স্থান এবং টাঙ্গাইলের ভুয়াপুরে সম্ভাব্য লোকেশন হতে পারে। কিন্তু সেখানে এয়ারপোর্ট প্রতিষ্ঠায় বাংলাদেশ এয়ার ফোর্সের সদর দফতর আপত্তি জানিয়ে সরকারের কাছে দেশের দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলে করার প্রস্তাব দেয়। এবার সিভিল এভিয়েশন ও টুরিজম মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, মুন্সিগঞ্জের আড়িয়াল বিলে ২৫ হাজার একর জায়গা নিয়ে নির্মিত হতে যাচ্ছে বঙ্গবন্ধু ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট। একই সঙ্গে এ এয়ারপোর্ট ঘিরে তৈরি হবে অতি আধুনিক বঙ্গবন্ধু সিটি।
প্রথর্মে যে প্রস্তাবকে নিছক কল্পনাবিলাসী মনে করা হয়েছিল, বছর শেষে তা জাতির সামনে খুব সিরিয়াস হয়ে দেখা দেয়। কেউ কেউ সন্দেহ করেন, ঢাকা থেকে রাজধানী সরিয়ে নেয়ার চিন্তা করছে আওয়ামী সরকার।
নতুন রাজধানীর দুটি যৌক্তিকতা হবে, একটি বিশাল এয়ারপোর্ট এবং একটি যানজটমুক্ত নতুন শহর। আবার কেউ কেউ বলেন যেহেতু ভ্রমণে অভিজ্ঞ শেখ হাসিনার নজরে এসেছে বিশ্বের কয়েকটি সেরা এয়ারপোর্ট সেহেতু তিনি জাতিকে উপহার দিতে চান একটি অতি আধুনিক এয়ারপোর্ট।
কিন্তু নগর বিশেষজ্ঞরা এই সম্ভাবনাকে অবাস্তব বলে নাকচ করে দেন। তারা বলেন, ব্রাজিলের রাজধানী সমুদ্র তীরবর্তী রিও ডি জেনেরো থেকে সরিয়ে ১৯৬০-এ নিয়ে যাওয়া হয় দেশের কিছুটা মধ্যাঞ্চলে গড়ে তোলা নতুন একটি শহর ব্রাজিলিয়া-য়। এই শহরে অতি আধুনিক ও দৃষ্টিনন্দন ভবন এবং আর্কিটেকচার বানানো হয়। ফলে এটি এখন জাতিসংঘ ঘোষিত ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইটের অন্যতম। এই নতুন রাজধানীতে আছে ১১৯টি দুতাবাস এবং থাকেন ৩৬ লাখ অধিবাসী। কিন্তু রিও রয়ে গিয়েছে ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রাণকেন্দ্র রূপে। রাজধানী ব্রাজিলিয়া হয়েছে রাজধানী ও টুরিস্ট এট্রাকশনের শহর।
বঙ্গবন্ধু সিটি তেমনটা হতে পারবে না ৫০ হাজার কোটি টাকা খরচ করে। তা করতে হলে ব্রাজিলিয়ার মতোই আরো বেশি খরচ করতে হবে। সেই সামর্থটা বাংলাদেশের কোথায়?
সাম্প্রতিক কালে মাহাথির মোহাম্মদ মালয়শিয়ার রাজধানী কুয়ালা লামপুর থেকে সরিয়ে নেয়ার লক্ষ্যে কুয়ালা লামপুর থেকে নতুন ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টে যাওয়ার নতুন মোটরওয়ের কাছে একটি সম্পূর্ণ নতুন শহর বানান যার নাম হয়, পুত্রাজায়া। প্রায় ১৮ বর্গমাইল এলাকা জুড়ে এই নতুন শহরে ২০০১-এ মালয়শিয়ার প্রশাসনিক রাজধানী স্থাপিত হয়। মাত্র ৮৫,০০০ মানুষ এখন সেখানে থাকে যাদের প্রায় সবাই সরকারি কর্মচারী। কিন্তু পার্লামেন্ট এবং বাস্তব অর্থে রাজধানীর সব কিছুই রয়ে গিয়েছে কুয়ালা লামপুরে। পুত্রাজায়া বা গার্ডেন সিটি হয়েছে একটি ব্যর্থ শহর। তবে সফল টুরিস্ট এট্রাকশন। পুত্রাজায়ার সঙ্গে রাজধানী ও এয়ারপোর্টের হাই স্পিড ট্রেন লিংক সত্ত্বেও এটি কার্যকর রাজধানী না হয়ে, মাহাথির মোহাম্মদের কল্পনাবিলাস মেটানোর অর্থ অপচয়কারী প্রজেক্ট রূপে চিহ্নিত হয়েছে। মাহাথির তা করতে পেরেছিলেন, কারণ মালয়শিয়ার পেট্রোডলার ছিল।
বাংলাদেশের সেই সম্পদ নেই। বাংলাদেশের সিভিল এভিয়েশন এক্সপার্ট ও এয়ারলাইন পাইলটরা বলেন, বর্তমানে ঢাকার হয়রত শাহজালা এয়ারপোর্টের ইউটিলাইজেশন হচ্ছে ৩০%-এর কম। ভবিষ্যতে যাত্রী সংখ্যা বর্ধিত হবার সম্ভাবনা কম। তবে কার্গো ফ্লাইট বাড়তে পারে এবং সকাল ও সন্ধ্যার ব্যস্ত প্যাসেঞ্জার ফ্লাইট শেডিউল এড়িয়ে সারা দিন কার্গো ফ্লাইট চলাচল করতে পারে। তারা বলেন, শাহজালাল এয়ারপোর্টের যা দরকার তা হলো শুধু একটা বিকল্প সমান্তরাল রানওয়ে তৈরি করা। যদি কোনো কারণে পুরনো রানওয়েটি সাময়িকভাবে বন্ধ হয়ে যায় তাহলে নতুন রানওয়েতে প্লেন যেন ওঠানামা করতে পারে। অনেকের মতে, এটিই বাস্তবমুখী চিন্তা। জানা যায়, এই নতুন রানওয়ের বিপক্ষে রয়েছে এয়ার ফোর্স। কেননা সেক্ষেত্রে এয়ার ফোর্সের নিজেদের কিছু জায়গা ছেড়ে দিতে হবে নতুন রানওয়ের জন্য।
বাংলাদেশে আবাদি জমি প্রায় ৬০ লাখ হেক্টর। গ্রাম অঞ্চল উন্নত হওয়ায় ও নগরায়নের ফলে সাম্প্রতিক কালে আবাদি জমি বাংলাদেশে কমে গেছে। মানুষ তাদের আবাদি জমি ছেড়ে দিতে চাইবে না এমন আশংকা দুই মাস আগে বিবিসিখ্যাত কলামিস্ট সিরাজুর রহমান করেছিলেন।
ঠিক তাই হয়েছে। শ্রীনগর উপজেলায় ১০টি গ্রামের সমন্বয়ে শত বছরের ফসলি জমি ও বাপ-দাদার বসতভিটা রক্ষায় গঠিত হয়েছে আড়িয়াল বিল রক্ষা কমিটি। বছরের শেষ সপ্তাহে প্রায় ৩০,০০০ মানুষ এয়ারপোর্ট নির্মাণের বিরুদ্ধে অবরোধ, বিক্ষোভ মানববন্ধন করেছে। শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি আকা তোরণ ধ্বংস করেছে। এদের দমন করতে সরকারের পক্ষ থেকে পাল্টা অভিযান চালানো হয়েছে। প্রতিবাদী মানুষ মাথায় কাফনের কাপড় বেধে বিভিন্ন প্ল্যাকার্ড ও ফেস্টুন নিয়ে মহাসড়কে অবস্থান নেয়। তারা বলেন, এখানে এয়ারপোর্ট হলে অন্তত ১০ লাখ মানুষ বেকার হয়ে পথে বসবে।
এসব বিক্ষোভ, বিদ্রোহ আরো বড় আকারে রূপ নিতে পারে। তাই প্রধানমন্ত্রী একটি বিকল্প প্রস্তাব বিবেচনা করতে পারেন। পঞ্চাশ হাজার কোটি টাকা দিয়ে সারা দেশে অন্তত পঞ্চাশটি ভালো স্কুল তিনি বানাতে পারেন এবং ইচ্ছা করলে সব স্কুলের নামই বঙ্গবন্ধু স্কুল রাখতে পারেন। এতে কিছু সংখ্যক ইন্টারন্যাশনাল ট্রাভেলারের সাময়িক সুবিধার পরিবর্তে বহু হাজার ছাত্র চিরজীবনের জন্য উপকৃত হবে।
খবরে প্রকাশ, বঙ্গবন্ধু এয়ারপোর্ট অথরিটি নামে নবগঠিত সংস্থার চেয়ারম্যান হয়েছেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী এবং তিনি নিজে এর নির্মাণ কাজের তদারকি করবেন। সম্রাট শাহজাহান আগ্রা-য় প্রায় ২১ বছর তদারকি করেছিলেন তাজমহল নির্মাণে এবং তখন নিয়োজিত হয়েছিল কয়েক হাজার শ্রমিক। এখন ৩৫৮ বছর পর হয়তো আড়িয়াল বিলে ইতিহাসের একটা পুনরাবৃত্তি হবে এবং হযরত শাহজালাল এয়ারপোর্ট বাংলাদেশে তার এক নাম্বার পজিশন হারাবে।
বিদায়ী বছরেই অবশ্য হযরত শাহজালাল এয়ারপোর্টের মর্যাদাহানি হয়েছে। এটি (পঃ) বা পর্নোগ্রাফিক এয়ারপোর্ট হয়েছিল কিছু সময়ের জন্য। এয়ারপোর্টের বিভিন্ন স্কুলে বিজ্ঞাপন দেখানোর জন্য ইউনিকম নামে একটি প্রতিষ্ঠানকে লিজ দেয়া হয়েছিল। ইউনিকমের জনৈক কর্মচারীর অসতর্কতার ফলে হঠাৎ এয়ারপোর্টের সব বিজ্ঞাপনী স্কৃনে কাটপিস পর্নো প্রদশিত হয়।
আরো কিছু কারণে বছর জুড়ে শাহজালাল (রাঃ) এয়ারপোর্ট-এর মর্যাদাহানি হয়। বাংলাদেশ বিমানের পাইলটদের ৩৬ ঘণ্টাব্যাপী ধর্মঘটে কর্তৃপক্ষ বেসামাল হয় এবং যাত্রীদের হয়রানি হয়। বিরোধী দল বিএনপির মহাসচিব খোন্দকার দেলোয়ার হোসেনসহ দুইজন আইনজীবী, সানাউল্লাহ মিয়া ও নাসির উদ্দিন আহমেদ অসীমকে বিদেশ যেতে বাধা দেয়া হয়। পরে হাই কোর্ট বাধা না দিতে নির্দেশ দেয়।
বস্তুত সারা বছরই বহু নাগরিকের নাম শোনা গিয়েছে যাদের নাম এয়ারপোর্টের কম্পিউটারে আছে। তাদের হয়রানি করা হয়েছে। জুলাইয়ে আমি যখন নিউ ইয়র্কে যাচ্ছিলাম তখন প্রায় দুই ঘণ্টা আমাকে ইমিগ্রেশন কর্তৃপক্ষ অপেক্ষা করিয়েছিলেন। তবে তাদের আচরণ ছিল ভদ্র ও বিনয়ী। কিন্তু আমার ফ্লাইট মিস করার উপক্রম হয়েছিল।
গত বছর ইনডিয়ান যাত্রীরাও এই এয়ারপোর্টের মর্যাদাহানি করেছে। জিএমজি এয়ারলাইন্সের কলকাতা ঢাকা ব্যাংক রুটের ইনডিয়ান যাত্রীরা ঢাকায় ট্রানজিটে না থেকে সরাসরি ব্যাংকক এবং কলকাতায় নিয়ে যাওয়ার দাবিতে প্লেনে বসে থাকে। ফলে রানওয়ে অবরুদ্ধ থাকে। এই যাত্রীদের অধিকাংশই ব্যাগেজ পার্টির সদস্য বা চোরাচালানিতে রত বলে জানা যায়। কলকাতা ও ব্যাংকক এয়ারপোর্টে তাদের সহযোগীদের নির্দেশে তারা ফ্লাইটগুলো সরাসরি করার দাবি জানায়। শেষ পর্যন্ত অবৈধ ব্যবসায়ে জড়িত যাত্রীদের এই অবৈধ দাবি মেনে নেয় এয়ারপোর্ট কর্তৃপক্ষ। ইনডিয়া অনুগত সরকারের আমলে এই ক্ষতি স্বীকারে কেউ অবাক হয়নি।
তবে এসব ঘটনা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিদেশ সফরকে ব্যাহত করেনি। প্রথম মেয়াদে প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে পাচ বছরের মধ্যে প্রায় এক বছরই তিনি বিদেশে ছিলেন। তিনিই সম্ভবত বিশ্বে একমাত্র বিরোধী পলিটিশিয়ান যিনি গ্রেফতার হওয়া এবং না হওয়ার অবস্থানে থেকেও ব্যাপক বিদেশ ভ্রমণ করতে পেরেছেন। মনে আছে সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দুই বছরে তিনি আমেরিকা, বৃটেন, ফিনল্যান্ড প্রভৃতি দেশে ঘুরে বেড়িয়েছেন? সুতরাং এটা কোনো আশ্চর্যের বিষয় নয়, শেখ হাসিনা তার দ্বিতীয় মেয়াদের প্রধানমন্ত্রিত্বের সময়ে দ্বিতীয় বছরে তার ট্রাভেল শেডিউল ভালোভাবে চালু রেখেছেন।
বিদায়ী বছরে তিনি জানুয়ারিতে গিয়েছিলেন দিল্লিতে তিনটি চুক্তি ও দুটি এমওইউ-তে সই করতে। একই মাসে তিনি কলকাতায় যান সাবেক মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুর অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় যোগ দিতে। ফেব্রুয়ারিতে যান কুয়েতে। মার্চে যান চায়না, সফরসঙ্গী ছিলেন ৮৯ জন। এপ্রিলে যান ভুটানে সার্ক সম্মেলনে যোগ দিতে। মে মাসে যান সাউথ কোরিয়ায় এসকাপের অধিবেশনে। একই মাসে তিনি যান কুয়ালা লামপুরে বিশ্ব ইসলামিক অর্থনৈতিক সম্মেলনে। জুলাইয়ে যান নাইজেরিয়াতে ডি-এইট সম্মেলনে। সেপ্টেম্বরে যান নিউ ইয়র্কে জাতিসংঘ সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্য (এমডিজি) সম্মেলন ও জাতিসংঘ ৬৫তম অধিবেশনে যোগ দিতে। এরপর নভেম্বরে যান রাশিয়া, বেলজিয়াম ও জাপানে।
যে ব্যক্তি ভ্রমণে এত উৎসাহী তিনি তো স্বদেশে তার নিজের কল্পনা মতো একটা নতুন এয়ারপোর্ট বানাতে চাইতেই পারেন। তবে প্রশ্ন হচ্ছে, এসব বিদেশ ভ্রমণ তাকে কি দিয়েছে?
এক. বিদেশিদের সঙ্গে অব্যাহত জনসংযোগের ফল পেয়েছেন শেখ হাসিনা। বিদেশিদের আনুকূল্যে তিনি দ্বিতীয়বার প্রধানমন্ত্রী হতে পেরেছেন। তার প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়া স্বদেশ ভ্রমণে উৎসাহী। ২০০৮-এর নির্বাচন প্রাক্কালে তিনি মাত্র দুই সপ্তাহে দেশের প্রায় দশ হাজার মাইল ঘুরে ক্যাম্পেইন করেছিলেন। কিন্তু ধর্ম পালন ও চিকিৎসার জন্য সউদি আরব বাদে অন্য কোনো দেশে যেতে খালেদা জিয়া অনুৎসাহী। তবে বছরের শেষ মাসে খালেদা জিয়া চায়না সফর করেছেন। তিনি কি আগামী বছরে বিদেশের সমর্থন সংগ্রহের লক্ষ্যে আরো ভ্রমণ করবেন?
দুই. শেখ হাসিনা নিউ ইয়র্ক, আমেরিকায় পেয়েছেন প্রেসিডেন্ট ওবামা-র অভিনন্দন এবং রাশিয়ায় পেয়েছেন সেইন্ট পিন্টার্সবার্গ স্টেট ইউনিভার্সিটির অনারারি ডক্টরেট। আমেরিকার গ্ল্যামার ম্যাগাজিনের বর্ষ সেরা নারী তালিকায় এসেছে শেখ হাসিনার নাম। কংগ্রাচুলেশন্স। কিন্তু বিদেশ সফরে শেখ হাসিনার গ্ল্যামার অনেকটাই নিষ্প্রভ হয়েছে তিনটি কারণে।
এক. প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে নিউ ইয়র্ক গমনেচ্ছু ৬০ সফরসঙ্গীর ভিসা বাতিল করেছিল হল্যান্ডের দূতাবাস।
দুই. জাতিসংঘের একটা পুরস্কার শেখ হাসিনা নিউ ইয়র্কে পেয়েছিলেন বলে বহুল প্রচারিত হলেও পরে জানা যায়, সেটি জাতিসংঘের কোনো পুরস্কার ছিল না। তা ছিল একটি প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানের পুরস্কার এবং অনাড়ম্বরে প্রাইভেট অনুষ্ঠানে সেটি দেয়া হয়।
তিন. এই একই টৃপে প্রধানমন্ত্রীর ডিপিএস বা উপ-প্রেস সচিব মাহবুবুল হক শাকিল একটি লক্ষ্য প্রাইভেটলি পূরণ করতে গিয়ে পাবলিক হয়ে যান। গ্র্যান্ড হায়াত হোটেলে প্রধানমন্ত্রী ও তার সফরসঙ্গীরা ছিলেন। খবরে প্রকাশ, এক রাতে শাকিল কিছুটা মাতাল অবস্থায় জোর করে ঢোকার চেষ্টা করেন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা শাহনাজ গাজীর রুমে। শাহনাজ ও সেই সময়ে তার রুমে অবস্থানকারী জনৈক পুরুষ সহকর্মী বাধ্য হয়ে হোটেল সিকিউরিটির শরণাপন্ন হন। ফলে বিষয়টা প্রধানমন্ত্রীর নাগালের বাইরে চলে যায়। হোটেল কর্তৃপক্ষের চাপে শাকিলকে হোটেল ছেড়ে যেতে হয়। শাকিলকে দেশে ফেরত পাঠানো হয় এবং তিনি পরবর্তীকালে পদচ্যুত হন।
বঙ্গবন্ধু নামের মর্যাদা : আপ অ্যান্ড ডাউন
শুধু নির্মিতব্য এয়ারপোর্টই নয়, বঙ্গবন্ধুর নাম ও ছবির ব্যাপকতর ব্যবহার এবং অপব্যবহার দেখা গিয়েছে বিদায়ী বছরে। কিশোরগঞ্জে বাজিতপুরে খাল দখল করে বঙ্গবন্ধু পরিষদের নামে দোকান হয়েছে। বঙ্গবন্ধু বানানে ভুল হওয়ায় দুই প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা পিরোজপুরের পারভিন জাহান ও সাতক্ষীরার পঞ্চানন বালা বরখাস্ত হয়েছেন। বঙ্গবন্ধু (যমুনা) সেতুর ফাটল আরো বেড়েছে। বঙ্গবন্ধুর ছবিসহ ৩০ কোটি পিস দুই টাকার কয়েক বাজারে ছাড়া হয়েছে। বছর খানেক আগে বঙ্গবন্ধুর ছবি সংবলিত ১,০০০ টাকার নোট বাজারে ছাড়া হয়েছিল। এখন কয়েক হাজার কোটিপতির দেশ বাংলাদেশ হলেও অজ্ঞাত কারনে এই নোট বিদায়ী বছরেও জনপ্রিয়তা পায়নি। বিদায়ী বছরের শেষ সপ্তাহে আওয়ামী লীগের সভাপতিম-লীর সদস্য ওবায়দুল কাদের প্রস্তাব দিয়েছেন শেখ হাসিনাকে বঙ্গবন্ধু ইউনিভার্সিটি প্রতিষ্ঠার জন্য। একই ভাষণে তিনি এটিও বলেন, জাতীয় রাজনীতি অসুস্থ হয়ে পড়েছে।
তিনি ঠিকই বলেছেন। তবে এ রাজনীতির অন্তর্ভুক্ত তিনিই কি না তা বোঝা যায়নি।
বঙ্গবন্ধু সবচেয়ে বড় মরণোত্তর বিপাকে পড়েছেন বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা নিয়ে।
বিদায়ী বছরের ১৬ ডিসেম্বরে বিজয় দিবস উপলক্ষে তথ্য মন্ত্রণালয় কর্তৃক প্রচারিত বিভিন্ন দৈনিক পত্রিকায় বিশেষ ক্রোড়পত্রে স্বাধীনতার ঘোষণা শিরোনামে মুদ্রিত হয় :
স্বাধীনতার ঘোষণা
“এটাই হয়তো আমার শেষ বার্তা। আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন। বাংলাদেশের মানুষ যে যেখানে আছেন, আপনাদের যা কিছু আছে তা দিয়ে সেনাবাহিনীর দখলদারীর মোকাবিলা করার জন্যে আমি আহ্বান জানাচ্ছি। পাকিস্তানী দখলদার বাহিনীর শেষ সৈন্যটিকে বাংলাদেশের মাটি থেকে উৎখাত করা এবং চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত আপনাদেরকে সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হবে।”
[স্বাধীনতার ঘোষণা সংবলিত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বাণীটি সমগ্র বাংলাদেশে প্রচারের জন্যে ২৫শে মার্চ মধ্য রাত অর্থাৎ ২৬শে মার্চ ১৯৭১-এর প্রারম্ভে (তৎকালীন) ইপিআর ট্রান্সমিটারের মাধ্যমে চট্টগ্রামে প্রেরণ করা হয়েছিল।]
এর মাত্র ১০ দিন পর ২৬ ডিসেম্বরে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের মুখপত্র উওরণ (বানানটি হবে উত্তরণ)-এ প্রথম সংখ্যার প্রথম পৃষ্ঠায় মুদ্রিত হয় :
“… তারা অতর্কিতে ২৫ মার্চ তারিখে আমাদের আক্রমণ করলো। তখন বুঝতে পারলাম যে; আমাদের শেষ সংগ্রাম শুরু হয়ে গেছে। আমি অয়ারলেসে চট্টগ্রামে জানালাম বাংলাদেশ আজ থেকে স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র।”
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান
এখন প্রশ্ন উঠেছে, কোন ঘোষণাটি সঠিক। স্বাধীনতার ঘোষণা সম্পর্কিত মামলায় অভিজ্ঞ প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক হয়তো এই বিভ্রান্তির সমাধানে এগিয়ে আসবেন।
দুর্নীতি ধারণা সূচকে দ্বাদশ
বার্লিনভিত্তিক ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের (টিআই) সবচেয়ে বেশি দুর্নীতিগ্রস্ত দেশগুলোর লিস্টে বাংলাদেশের স্থান প্রায় একই রয়েছে। দুর্নীতি ধারণা সূচকে (করাপশন পারসেপশন ইনডেক্স বা সিপিআই) বাংলাদেশের স্থান হয়েছে দ্বাদশ। ২০০৯-এ বাংলাদেশের স্থান ছিল ত্রয়োদশ। ১০ নাম্বারের (স্কোর) বাংলাদেশ ২০১০-এ পেয়েছে মাত্র ২ দশমিক ৪। ২০০৯-এও তাই ছিল। তবে সেই বছরে অবস্থান ছিল ত্রয়োদশ।
বলা বাহুল্য, টিআইবি রিপোর্ট বাংলাদেশের এই ফলাফলে আওয়ামী সরকার খুশি হয়নি। বিশেষত সরকার যখন ফলাও করে পূর্ববর্তী সরকারগুলোর দুর্নীতি সম্পর্কে সোচ্চার রয়েছে তখন টিআইবির এ রিপোর্ট তাদের কাছে হয়েছে খুবই অনাকাক্সিক্ষত। টিআইবির বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, বাংলাদেশের এবারের স্কোর সমপর্যায়ে থাকাটা হতাশাজনক। বাংলাদেশের এখন যে সরকার তাদের নির্বাচনী ইশতেহারে দুর্নীতি বিরোধী দৃঢ় অবস্থান ছিল। আমরা ভেবেছিলাম অবস্থার উন্নতি হবে। সরকারের শুরুতেও সেই মনোভাব ছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেটি নেই। ভবিষ্যতে বাংলাদেশের অগ্রগতি হবে কি না তা নির্ভর করছে সরকারের রাজনৈতিক সদিচ্ছার ওপর। বিশেষ করে জাতীয় সংসদ, দুর্নীতি দমন কমিশন, নির্বাচন কমিশন, তথ্য কমিশন, বিচার বিভাগ, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, সরকারি প্রশাসন এবং মানবাধিকার প্রশাসনের মতো প্রতিষ্ঠানগুলো যদি স্বাধীন, নিরপেক্ষ ও সৎভাবে কাজ করতে পারে তাহলে সেটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
টিআইবি ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য মোজাফ্্ফর আহমদ বলেন, বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ক্ষমতায় এসে সংসদে দুর্নীতির বিরুদ্ধে কথা বলেছিলেন। সব এমপির হিসাব জমা দেয়ার কথা ছিল। কিন্তু অর্থমন্ত্রী ছাড়া কেউ এখন পর্যন্ত হিসাব দেননি। বার বার এই প্রক্রিয়া আটকে যাচ্ছে।
মোজাফ্্ফর আহমদ আরো বলেন, ভিন্ন নামে এখনো চাদাবাজি চলছে। বিভিন্ন সংসদীয় কমিটিতে ব্যবসায়ীরা আছেন। দুদক এখনো ঠিকভাবে কাজ করতে পারছে না। প্রতি বছরই কালো টাকা শাদা করার সুযোগ দেয়া হচ্ছে। এগুলো ভালো লক্ষণ নয়।
টিআইবি ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান এম হাফিজউদ্দিন খান বলেন, শুধু বক্তব্য বিবৃতি দিলে হবে না। সরকারকে দুর্নীতি দমনের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন করতে হবে। এ জন্য সবাইকে সম্মিলিতভাবে কাজ করতে হবে।
টিআইবির এ রিপোর্টে আওয়ামী সরকারকে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হওয়ার কারণ আছে। তাদের আগের মেয়াদে ২০০১-এ বাংলাদেশে অবস্থান ছিল প্রথম এবং দুর্নীতি বিরোধী প্রচারণার পরিণতিতে ২০০৭-এ ক্ষমতায় এসেছিল সেনা সমর্থিত সরকার। সুতরাং ধারণা করা হচ্ছিল, দুর্নীতি ধারনা সূচক প্রকাশ বন্ধ করার জন্য টিআইবি-র ওপর নেমে আসবে খ—গ হস্ত। ঠিক সেটিই হয়েছে বিদায়ী বছরের শেষ সপ্তাহে। টিআইবির তিন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে একটি মানহানির মামলা করা হয় কুমিল্লায়। তাদের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানাও জারি করেন ম্যাজিস্ট্রেট। তবে সেদিন সন্ধ্যায়ই তা তুলে নেয়া হয়। একই দিনে চট্টগ্রামে দুটি মানহানির মামলা করা হয়। টিআইবির কর্মকর্তারা বলেছেন, তারা এই মামলার বিরুদ্ধে লড়বেন।
সমালোচিত র‌্যাব
আওয়ামী লীগের ম্যানিফেস্টোতে লেখা ছিল, ক্ষমতায় গেলে বিচার বহির্ভূত হত্যাকা- বন্ধ করা হবে। কিন্তু বিদায়ী বছরে ক্রসফায়ার চলেছে। ২০১০-এর ১১ মাসে র‌্যাবের হেফাজতে নিহত হয়েছে ৬৯ জন। ফলে র‌্যাবের ছয় বছরের ইতিহাসে নিহতের সংখ্যা দাড়ায় ৬৯৩।
আওয়ামী সরকার ক্ষমতায় আসার পর ক্রসফায়ারে মৃত্যু কয়েক মাস বন্ধ ছিল। তারপর সরকারের একটি অংশ এর বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়। রাজনৈতিক সমর্থন পেয়ে অপরাধীরা মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে শুরু করে। তখন সরকারের নীতি-নির্ধারকরা ক্রসফায়ারের পক্ষে মত প্রকাশ শুরু করেন। ফিরে আসে ক্রসফায়ার।
বছরের শেষ দিকে র‌্যাব বিদেশে হয় সমালোচিত। উইকিলিকসের লিক করা গোপন আমেরিকান কূটনৈতিক বার্তায় বলা হয়, বৃটিশ সরকার ট্রেইনিং দিয়েছে র‌্যাবকে। কিন্তু র‌্যাবের বিরুদ্ধে মানবাধিকার লংঘনের অভিযোগ থাকায় আমেরিকান আইনের পরিপন্থী হবে, এই যুক্তিতে আমেরিকা তাদের ট্রেইনিং দিতে রাজি হয়নি। উইকিলিকস জানিয়েছে, ঢাকায় আমেরিকান দূতাবাসের কর্মকর্তারা মন্তব্য করেছিলেন, র‌্যাব রাখা উচিত। এ বিষয়ে আমেরিকান রাষ্ট্রদূত আলোচনা করেছিলেন ইনডিয়ান রাষ্ট্রদূত পিনাক রঞ্জন চক্রবর্তীর সঙ্গে। তখন আমেরিকান অবস্থান সমর্থন করেন ইনডিয়ান হাই কমিশনার। তবে আমেরিকান রাষ্ট্রদূত জেমস এফ মরিয়ার্টি মন্তব্য করেন, বাংলাদেশের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোর মধ্যে র‌্যাবেরই কোনো একদিন আমেরিকার এফবিআই (ঋইও) বা ফেডারেল ব্যুরো অফ ইনভেসটিগেশনের মতো গড়ে ওঠার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি।
র‌্যাব সম্পর্কে সবচেয়ে গুরুতর অভিযোগে বলা হয়েছে, গত বছর তারা তাদের কৌশল বদলে ফেলে ছদ্মবেশ পরে সন্দেহভাজনদের অপহরণ করছে। অপহরণের পর সন্দেহভাজনদের আর কোনো খোজ পাওয়া যায় না। অনেকের মতে, এমন দুজন গুম হয়ে যাওয়া ব্যক্তি হলেন কাউন্সিলর চৌধুরী আলম ও লিয়াকত হোসেন।
ক্রসফায়ারের ঘটনায় নিহত ব্যক্তিদের সব সময় সন্ত্রাসী বলা হলেও অনেক নিরীহ মানুষও এর শিকার হয়েছে। যেমন রামপুরার কায়সার বাপ্পী, খিলগাওয়ের সুমন। তাদের বিষয়ে তদন্তে নেমেছে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন।
বরাবরের মতো র‌্যাবের পক্ষ থেকে এসব অভিযোগ অস্বীকার করা হয়েছে।
র‌্যাব হয়তো কৌশল বদলেছে। আর আওয়ামী সরকার বদলে দিয়েছে ঐতিহ্যবাহী বাংলাদেশ রাইফেলস (বিডিআর)-এর নাম। নতুন নাম হয়েছে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)। ফেব্রুয়ারি ২০০৯-এ পিলখানায় বিডিআর বিদ্রোহের অন্যতম পরিণতি এই নাম বদল। এই প্রসঙ্গে সরকারের থেকে জানানো হয়েছে, বিডিআর বিদ্রোহের বিচার বিডিআর আইনেই চলবে বলে জানান মোহাম্মদ সামছুর রহমান। তিনি বলেন, ২৩ ডিসেম্বরের পর বিচার চলাকালে কোনো আসামি দলগত বা এককভাবে বিদ্রোহ সমতুল্য কোনো কাজ করলে তার কিংবা তাদের ক্ষেত্রে নতুন আইন কার্যকর হবে। বিডিআর আইনে বিদ্রোহের সর্বোচ্চ সাজা সাত বছর কারাদ- হলেও বিজিবি আইনে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদ- করা হয়েছে। নতুন আইনে বর্ডার গার্ড আদালত এবং বর্ডার গার্ড আপিল ট্রাইব্যুনালের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে প্রশ্ন উত্থাপন করা যাবে না।
আক্রান্ত ইনডিয়ান ডিপ্লম্যাট
গত বছরে বিভিন্ন অভিযোগে দেশের থানাগুলোয় ৮০,২৯৭টি মামলা রেকর্ড করা হয়। এর মধ্যে নারী নির্যাতনের অপরাধে সবচেয়ে বেশি – ১৪,৯১১টি মামলা করা হয়েছে। এতে রয়েছে ৩,১০০টি ধর্ষণের অপরাধ। খুনের অপরাধে ৩,৭০৬টি মামলা করা হয়। এর মধ্যে রাজনৈতিক খুনের ঘটনা ১৫টি এবং দাঙ্গায় ৪০টি।
এছাড়া রয়েছে ১,৮১৯টি গাড়ি চুরির অপরাধ। শিশু নির্যাতনের ঘটনা রয়েছে ১,৪২৯টি। তবে ছিনতাইয়ের ঘটনা রেকর্ডেড হয়েছে মাত্র ৯৩৩টি। অথচ ছিনতাই এখন নৈমিত্তিক ঘটনা, বিশেষত ঢাকায়। এই সংখ্যা কম হওয়ার কারণ হচ্ছে ছিনতাইয়ের জিডি করতে গেলে সাধারণত পুলিশ তা আমলে নিতে চায় না।
তবে অনুগতভাবে পুলিশ রেকর্ড করেছে দুই ইনডিয়ান কূটনীতিকের ক্ষতিগ্রস্ত হওযার ঘটনা। একজন কূটনীতিকের গুলশান ফ্ল্যাটে চুরি হয় এবং অপর কূটনীতিকের স্ত্রীর গলার নেকলেস ছিনতাই হয়।
ডিসেম্বরে দুটি রাজনৈতিক হত্যাকা- আলোচিত হয়েছে। এক. নাটোরের সিংড়া উপজেলায় বিএনপি নেতা আসলাম মোল্লার (৩৫) জবাই করা লাশ ভাসমান অবস্থায় পাওয়া যায়। এর আগে অক্টোবরে নাটোরেরই বনপাড়ায় বিএনপির মিছিলে আওয়ামী লীগের হামলায় নিহত হন বড়াইগ্রাম উপজেলা চেয়ারম্যান ও বিএনপি নেতা সানাউল্লাহ নূর বাবু (৪৫)। এ ঘটনার পর প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, ভিডিও ফুটেজ দেখে তদন্ত সাপেক্ষে আসামিদের গ্রেফতার করা হবে। ভিডিও ফুটেজে অন্তত ১১ হামলাকারী সরকার সমর্থক রাজনীতির সঙ্গে জড়িত রূপে চিহ্নিত হয়। এটি জানার পর সরকার পক্ষ থেকে প্রচার করা হয় বিএনপির অন্তর্দ্বন্দ্বের ফলে সানাউল্লাহ নূর বাবু নিহত হয়েছেন। বাবুর মৃত্যু উপলক্ষে নাটোরে আয়োজিত বড় জনসভায় গিয়েছিলেন বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়া। নাটোরে এখনো উত্তেজনা বিরাজ করছে।
গত দুই বছরে পুলিশের একটি বড় প্রচেষ্টা ছিল দশ ট্রাক অস্ত্র মামলায় অথবা ২১ আগস্ট ২০০৪-এ শেখ হাসিনার জনসভায় গ্রেনেড ছোড়ার মামলায় বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান (বর্তমানে ইংল্যান্ডে চিকিৎসারত) তারেক রহমানকে জড়ানো। এই লক্ষ্যে সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বাবরকে ২০১০ সালের ৫ নভেম্বর পর্যন্ত অন্ততপক্ষে দশবারে ৬৭ দিন রিমান্ডে নেয়া হয়। দশ ট্রাক অস্ত্র মামলায় এনএসআইর সাবেক মহাপরিচালক রিটায়ার্ড মেজর জেনারেল রেজ্জাকুল হায়দার চৌধুরীকে বহুবার রিমান্ডে নেয়া হয়। খালেদা জিয়ার ভাগ্নে ও প্রধানমন্ত্রীর সাবেক প্রাইভেট সেক্রেটারি সাইফুল ইসলাম ডিউককেও গ্রেফতার করে একাধিকবার রিমান্ডে নেয়া হয়। তারা সবাই জেলবন্দি আছেন। তারা কেউই স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেননি যদিও সরকার সমর্থক মিডিয়ায় বলা হয়েছিল, তারা স্বেচ্ছায় জবানবন্দি দেবেন।
এসব ঘটনা খুবই অশুভ দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। প্রতিশোধের আগুন যদি কখনো জ্বলে ওঠে তাহলে মানুষের নিষ্ঠুরতা কোনো পর্যায়ে যাবে?
শূন্যস্থান পূরণ কর
এজাহারে অজ্ঞাতনামা আসামি পুলিশি হয়রানি ও নির্যাতনের আরেক নাম হয়েছে গত বছরে। কোনো মামলায় আসামির নাম উল্লেখ না করে গণমামলা হলেই সংশ্লিষ্ট এলাকা বা প্রতিষ্ঠানের যে কাউকে হয়রানি ও নির্যাতনের সুযোগ পেয়ে যায় পুলিশ। অধিকাংশ ক্ষেত্রে গণঅপরাধমূলক কোনো ঘটনায় পুলিশ অজ্ঞাতনামা আসামি বলে মামলা করে। আসামি চিহ্নিত না থাকায় পুলিশ গণহারে গ্রেফতার, হয়রানি ও গ্রেফতার বাণিজ্য করার অবাধ সুযোগ পায়। একই সঙ্গে অন্য কোনো কারণে গ্রেফতারকৃত ব্যক্তিকেও ওইসব মামলায় অ্যারেস্ট দেখিয়ে চালান করা, এমনকি রিমান্ডে নেয়ার সুযোগ পেয়ে যাচ্ছে। পাশাপাশি অজ্ঞাতনামা আসামির বিষয়টি রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের শায়েস্তা করার ক্ষেত্রেও ব্যবহার করা হয়েছে।
যে ধরনেরই অপরাধ সংঘটিত হোক না কেন, পুলিশ অজ্ঞাতনামা আসামির উল্লেখ থাকায় ওই অপরাধে যে কাউকে গ্রেফতার করতে পারে। এমনও দেখা যায়, একটি হত্যা মামলায় আসামি গ্রেফতারে পুলিশি অভিযানে কয়েক গ্রাম পুরুষশূন্য হয়ে গিয়েছে। তারপরও পুলিশের গ্রেফতার অভিযান থামেনি।
এক সময় ছিল পুলিশ যেনতেনভাবে যে কোনো অপরাধেই ৫৪ ধারা প্রয়োগ করত। এ ধারা প্রয়োগ করে যে কোনো ব্যক্তিকেই সন্দেহভাজন আসামি হিসেবে পুলিশ গ্রেফতার করতে পারে। ওই ধারায় আসামিকে রিমান্ডে নিয়ে নির্যাতন অথবা দিনের পর দিন হয়রানি করার সুযোগ রয়েছে। ৫৪ ধারা নিয়ে উচ্চ আদালতে রিট, আদালতের নির্দেশনার মানবাধিকার কর্মীদের প্রতিবাদ ও সচেতন মানুষের সমালোচনার মুখে পড়ে এ ধারা। এ কারণে পুলিশ এখন ৫৪ ধারা প্রয়োগে সতর্ক। এখন ৫৪ ধারার বিকল্প হিসেবে ব্যবহার করছে এজাহারে অজ্ঞাতনামা আসামি। গণঅপরাধমূলক কোনো ঘটনা ঘটলে পুলিশ মামলায় অজ্ঞাত সংখ্যক আসামি ৩২,০০০-ঊর্ধ্ব পর্যন্ত অজ্ঞাত নারী-পুরুষ শব্দ মামলার এজাহারে ব্যবহার করেছে। যেমন :
ক্স সিরাজগঞ্জে ট্রেন হামলা মামলায় প্রায় ৫,০০০।
ক্স রূপগঞ্জে সেনা ক্যাম্পে হামলা মামলায় প্রায় ৪,০০০।
ক্স আশুলিয়ায় পুলিশের অস্ত্র লুট মামলায় প্রায় ১০,০০০।
ক্স চট্টগ্রাম ইপিজেড-এ গার্মেন্ট ফ্যাক্টরি হামলায় প্রায় ৩০,০০০।
শূন্যস্থান পূরণ করার মতোই পুলিশ এখন অজ্ঞাতনামা আসামিদের লিস্টে নিরপরাধ ব্যক্তির নাম পূরণ করে হয়রানি করছে।
এছাড়া পুলিশের কাজে বাধা দেয়া, এই অভিযোগে পুলিশ মিথ্যা মামলা করেছে বলে বিভিন্ন রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে।
পুলিশি হয়রানির আরেকটি অস্ত্র গত বছর ব্যবহৃত হয়েছে বিচারাধীন জেলবন্দিদের বেলায়। সাবেক শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী ও এমপি এহছানুল হক মিলনকে এক জেল থেকে আরেক জেলে বদলি করা হয়েছে বহুবার। ফলে আত্মীয়স্বজন ও আইনজীবীদের কাছ থেকে বন্দিদের সঙ্গে দূরতিক্রম্য ব্যবধান সৃষ্টি হয়।
আলোচিত ট্রান্সফার ও গ্রেফতার
পুলিশ প্রশাসনে গত বছর সবচেয়ে বেশি আলোচিত ট্রান্সফার ছিল পাবনার ডিসি ড. এএফএম মনজুর কাদির ও পুলিশ সুপার জামিল আহমদকে প্রত্যাহার করা। তাদের দোষ ছিল পাবনায় সেপ্টেম্বরে জেলা প্রশাসন কার্যালয়ে চাকরি নিয়োগ পরীক্ষা প- ও ভাংচুরের ঘটনায় জড়িত ৩৩ আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া। এরপর প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা এইচটি ইমাম ও স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শামসুল হক টুকু পাবনায় গিয়ে স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও প্রশাসনের সঙ্গে পৃথক সমঝোতা বৈঠক করেন। এর একদিন পরই ডিসি ও এসপিকে প্রত্যাহার করা হয়।
ইমাম-টুকু জুটি প্রতিষ্ঠা করতে পারেন বর্তমান বাস্তবতা, প্রশাসনের চেয়ে দল বড় এবং তারা বলি দেন মনজুর-জামিল জুটিকে। ফলে প্রশাসনের বিভিন্ন মানুষ এখন বুঝে গেছে চাকরি ঠিক রাখতে হলে সবার উপরে দলকে স্থান দিতে হবে এবং তারা নিজেদের স্বার্থে প্রশাসনকে দলীয়করণ করবেন। এর আগেই ড. মোদাসসের আলীসহ কিছু আওয়ামী নেতা নিঃসংকোচে বলেছিলেন, প্রশাসনে তাদের দলীয় লোকদেরকেই নিয়োগ দিতে হবে।
গত বছরের সবচেয়ে বেশি আলোচিত গ্রেফতারটি ছিল বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য এবং এমপি সালাউদ্দিন কাদের (সাকা) চৌধুরী সংক্রান্ত। তাকে পুলিশ যে কোনো সময়ে গ্রেফতার করতে পারে এমন গুজব বছরের দ্বিতীয়ার্ধে চালু ছিল। এক রাতে গুলশানের বিএনপি নেত্রীর অফিস ঘিরে ফেলেছিল। তবুও তারা ব্যর্থ হয় সাকা চৌধুরীকে ধরতে। শেষ পর্যন্ত বনানীতে (খুব সম্ভবত) একটি ফ্ল্যাটে সাকা চৌধুরী গ্রেফতার হন। সাকা চৌধুরীর স্ত্রী ফারহাত ও মেয়ে ফারজিন অভিযোগ করেন, সাকা চৌধুরীকে আটক করার পর পরই ওই ফ্ল্যাটেই তার মুখে আঘাত করা হয়, শরীরে ব্লেডের আচড় দেয়া হয় এবং পায়ের আঙুল কেটে নেয়া হয়। পরদিন পত্রিকায় প্রকাশিত কয়েকটি ছবিতে সাকা চৌধুরীর শার্টে রক্তের দাগ দেখা যায়। সাকাও আদালতে অভিযোগ করেন, তাকে নির্যাতন করা হয়েছে।
সাকা চৌধুরীকে কেন গ্রেফতার করা হয়েছে? যুদ্ধ অপরাধের জন্য, নাকি বিএনপি আহূত হরতালের দিনে মগবাজারে একটি গাড়ি পোড়ানোর জন্য? প্রকৃত উত্তরটা বোধহয় এই যে, আওয়ামী লীগের শীর্ষ পর্যায় থেকে অশালীন বক্তব্যের তাৎক্ষণিক কড়া উত্তর তিনি দিচ্ছিলেন। এখন তার মুখ বন্ধ করে দেয়া হলো।
গত বছরের শেষে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের চূড়ান্ত মর্যাদাহানি হয় দুটি সংবাদে।
এক. অধিকার ও নিউ ইয়র্ক ভিত্তিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটসওয়াচ এক রিপোর্টে জানায়, প্রতি চার দিনে একজন বাংলাদেশিকে গুলি করে হত্যা করেছে বিএসএফ।
দুই. ডিসেম্বরের তৃতীয় সপ্তাহে রাজধানীর ফার্মগেইটে ইম্পিরিয়াল গেস্ট হাউসে অসামাজিক কার্যকলাপে জড়িত থাকার অভিযোগে ৩৯ জনকে গ্রেফতার করে র‌্যাব। গেস্ট হাউসটি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যাডভোকেট সাহারা খাতুনের পরিবার সদস্যদের বলে জানা যায়। এ ঘটনায় হোটেল ম্যানেজার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ভাই ইসরাইলকে আটকের পর ছেড়ে দেয়া হয়েছে বলে অভিযোগ ওঠে।
র‌্যাব সূত্র জানায়, গোপন সংবাদের ভিত্তিতে বেলা ১টায় র‌্যাব-২-এর একটি দল ফার্মগেইট ইম্পিরিয়াল গেস্ট হাউসে অভিযান চালায়। ওই সময় হোটেলের বিভিন্ন কক্ষে অসামাজিক কার্যকলাপে জড়িত থাকার অভিযোগে ১৯ নারী ও ২০ পুরুষকে আটক করা হয়। ম্যানেজার ইসরাইল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ভাই পরিচয় দিলে তাকে ছেড়ে দেয়া হয় বলে জানা যায়।
আটককৃত নারী-পুরুষকে তেজগাও থানায় হস্তান্তর করা হয়।
প্রদীপের নিচেই যে অন্ধকার থাকে, সেই সত্যতা আবারও প্রমাণিত হয়। তবে তেজগাও থানার ডিউটি অফিসার এএসআই রফিক বলেন, এমন কোনো ঘটনা ঘটেনি এবং থানায় এমন কোনো অভিযোগ নেই।
অভিযুক্ত বিচার বিভাগ
বাংলাদেশ এখন মামলাদেশ-এ পরিণত হয়েছে যার একটি পরিণতি বিদায়ী বছরে দেখা গেছে, খোদ বিচার বিভাগই অভিযুক্ত হয়েছে।
আদালত তথা বিচার বিভাগের মূল দায়িত্ব হলো অভিযোগের সত্য-মিথ্যা যাচাই করে বিচার করা। কিন্তু প্রতিষ্ঠিত এই ধারণাকে পাল্টে দিয়ে একটি লেখার জন্য আমার দেশ সম্পাদক মাহমুদুর রহমানকে বিচারের সময় বিচারপতি বলেন, আমরা সত্য-মিথ্যা যাচাই করতে বসিনি। আদালত অবমাননা হয়েছে কি না তা দেখার জন্য বসেছি।
গত বছরের শেষ মাসে প্রকাশিত টিআইবি-র রিপোর্টে অভিযোগ করা হয়েছে, সেবাধর্মী খাতের মধ্যে বিচার বিভাগই সবচেয়ে বেশি দুর্নীতিগ্রস্ত। এরপরই রয়েছে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা ও ভূমি প্রশাসন। সারা দেশের ছয় হাজার খানার ওপর জরিপ চালিয়ে টিআইবি এই রিপোর্ট তৈরি করেছে।
এখন প্রশ্ন উঠেছে এ রিপোর্টের ফলে গোটা বিচার বিভাগেরই মানহানি হয়েছে কি না? যদি মানহানি হয়ে থাকে তাহলে বিচারকদের প্রাথমিক কর্তব্য কি? এই রিপোর্টের সত্য-মিথ্যা যাচাই না করে টিআইবির কর্মকর্তাদের বিচার করা, নাকি বিচার বিভাগকে দুর্নীতিমুক্ত করার দায়িত্ব পালন করা?
ইতিমধ্যে টিআইবির তিন কর্মকর্তা এম হাফিজ উদ্দিন খান বলেছেন, বিচার বিভাগে দুর্নীতির বিষয় নিয়ে মানহানির মামলা দুর্ভাগ্যজনক। জাতি হিসেবে আমরা হতভাগা।
অন্যদিকে বিচার বিভাগ নথিপত্র চেয়ে পাঠিয়েছে টিআইবির কাছে।
ফুটবলে আর্জেনটিনা বনাম ব্রাজিল? ক্রিকেটে পাকিস্তান বনাম ইনডিয়া? সম্ভবত এই বছরে বিচার বিভাগ বনাম টিআইবি-র গ্র্যান্ড ম্যাচটিই দেশবাসীর নজর কেড়ে রাখবে, বিশেষত যারা মনে করেন তারা ন্যায়বিচার পাননি।
ভুক্তভোগী হাজার হাজার মানুষের মনে পড়বে কয়েকটি উক্তি :
ক্স তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ড. আকবর আলি খান : সরকারের প্রতিক্রিয়া থেকে দুটি জিনিস আমার উদ্বেগের কারণ হয়েছে। একটি হলো, প্রতিবেদন দেখার পর সরকার দুর্নীতি বন্ধ করার উদ্যোগ নেবে। কিন্তু তা না করে সবাই অস্বীকার করছে, প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে। দ্বিতীয় কারণটি হলো, একটা গণতান্ত্রিক দেশে এ ধরনের বিতর্ক থাকবে। স্বাধীন মত প্রকাশ করতে না পারলে গণতান্ত্রিক চর্চা থাকবে না। এভাবে ধরপাকড় করে কণ্ঠরোধ করার চেষ্টা করা হলে গণতন্ত্র বিপন্ন হবে। টিআইবির রিপোর্টে কোনো বিশেষ ব্যক্তির মানহানি হয়নি। এখানে একটি সামাজিক সমস্যা উপস্থাপন করা হয়েছে।
ক্স দুর্নীতি দমন কমিশনের চেয়ারম্যান গোলাম রহমান : যে কেউ মামলা করতেই পারেন। আমি আশা করব, তারা ন্যায়বিচার পাবেন। এই পুরো পরিস্থিতিটি দুর্নীতিবিরোধী কার্যক্রমে কোনো প্রভাব ফেলবে না, বাধার সৃষ্টি করবে না। আর এ থেকে দুর্নীতিবাজদের দুর্নীতি করতে উৎসাহিত হওয়ারও কিছু নেই।
ক্স রিটায়ার্ড বিচারপতি গোলাম রব্বানী : টিআইবির এ রিপোর্ট নিয়ে আমি উত্তেজনার কারণ দেখি না। কারণ বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলো দুর্নীতি থাকার কথা স্বীকার করে নির্বাচনী ইশতেহারে তা দূর করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে, বাংলাদেশে দুর্নীতির আগ্রাসন বেড়ে যাচ্ছে। তাই এটি অস্বীকার করার অর্থ হিমালয়ের সামনে দাড়িয়ে চোখ বন্ধ করে হিমালয়কে অস্বীকার করা। এতে হিমালয় না-ই হয়ে যাবে না। সরকারের ভূমিকা নিয়ে কিছু বলতে চাই না। সরকারের কাজ সরকার করুক। টিআইবির এ রিপোর্ট পুরোপুরি সঠিক নয়। কারণ এটি কয়েকজনের মতামতের ভিত্তিতে তৈরি, তথ্য অনুসন্ধানের ভিত্তিতে নয়। যাদের মতামতের ভিত্তিতে এটি করা হয়েছে তাদের যোগ্যতার মাপকাঠি নির্ধারণ করা হয়নি। আবার এ রিপোর্টকে একেবারে অগ্রাহ্য করা যাবে না যতক্ষণ না আমরা তথ্য ভিত্তিক ও সঠিক কোনো রিপোর্ট পাচ্ছি।
ক্স প্রফেসর মোজাফ্্ফর আহমদ : আইনের শাসন হুমকির মুখে।
ক্স তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা সুলতানা কামাল : বিচার বিভাগের ওপর মানুষের আস্থা নেই।
ক্স ব্যারিস্টার রফিক-উল হক : গণমাধ্যমের স্বাধীনতার কথা বলতে গিয়ে মাহমুদুর রহমানের আজ এ অবস্থা। আদালত অবমাননার এক মামলায় আদালত তাকে ছয় মাসের জেল এবং এক লাখ টাকা জরিমানা করেন। এক লাখ টাকা জরিমানা করার ক্ষমতাই নেই আদালতের। এ সাজা দেয়ার ক্ষেত্রে যে বিচারপতি সবচেয়ে বেশি তৎপর ছিলেন তিনি পরে প্রমোশন পেলেন না। তাকে সুপারসিড করে অন্য একজনকে প্রধান বিচারপতি করা হলো। সঙ্গে সঙ্গে তিনি এ ফাইল ফেরত দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, আমি এ রায় দেব না। মাহমুদুর রহমানকে জেল দেয়ার ব্যাপারে অন্য একজন বিচারপতি শাহ আবু নাঈম মোহাম্মদ মোমিনুর রহমান আপত্তি করেছিলেন। দ্বিতীয় আদালত অবমাননার মামলায় একই আদালত শুধু প্রধান বিচারপতি বদল হওয়ার পর মাহমুদুর রহমানকে ১০০ টাকা জরিমানা অনাদায়ে এক দিনের জেল দিলেন। বিচারপতিদের এ খামখেয়ালিপনা বন্ধ না হলে মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়। বিচারপতিদের অবস্থা হয়েছে, তারা হাওয়া দেখে রায় দেন। বিশ বছর ধরে দেখছি, রাজনৈতিক হাওয়া বদলের সঙ্গে সঙ্গে আদালতের রায়ও বদলে যায়। একই আদালতে একই মামলায় ভিন্ন রায় হয় যদি রাজনৈতিক পটপরিবর্তন হয়। এই যখন আদালতের অবস্থা তখন মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা হবে কিভাবে? মানবাধিকারের বিষয় নিয়ে আদালতে যাবেন, আদালত দেখবেন বিষয়টি কে নিয়ে আসছেন, সেই বিবেচনায় রায় হবে। আদালতের এ মনোভাব বদলাতে হবে। হাচি দিলেও নাকি আদালত অবমাননা হয়। কেউ কিছু বলল আর তাকে এনে দাড় করিয়ে রাখা হলো। আসাফউদ্দৌলাহ্র মতো মানুষকে পাচ ঘণ্টা দাড় করিয়ে রাখা হলো। তাই বার বার বলছি, আদালতের মনোভাব বদলাতে হবে। ১/১১-এর সময় সবচেয়ে বাজে ভূমিকা পালন করেছে আপিল বিভাগ। এর চেয়ে খারাপ আর হতে পারে না। তাই আমি বলব, যতক্ষণ না আদালত সত্যিকার অর্থে স্বাধীনভাবে আইনের শাসনের জন্য কাজ না করতে পারবেন ততক্ষণ পর্যন্ত মানবাধিকার প্রতিষ্ঠিত হবে না।… যে যাই বলুক, আমি মনে করি বর্তমান প্রধান বিচারপতি অনেকের চেয়ে ভালো।
২০১০-এ বাংলাদেশ তিনজন প্রধান বিচারপতি দেখেছে। এ সময় প্রধান বিচারপতি হিসেবে পর্যায়ক্রমে দায়িত্ব পালন করেছেন বিচারপতি মোহাম্মদ তাফাজ্জাল ইসলাম, মোহাম্মদ ফজলুল করিম ও এবিএম খায়রুল হক।
বর্তমান প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক-এর নিয়োগটি প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। ব্যারিস্টার রফিক-উল হক বলেন, অ্যাটর্নি জেনারেল বলেছেন, বর্তমান প্রধান বিচারপতিকে বিব্রত করার জন্য এসব করা হয়েছে যেন তিনি প্রধান উপদেষ্টা হতে না পারেন। তিনি (প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক) কেন প্রধান উপদেষ্টা হবেন? তার পরে তো বিচারপতি শাহ আবু নাঈম মোহাম্মদ মোমিনুর রহমান রয়েছেন। তিনি অবসরে যাবেন ডিসেম্বরে। বিচারপতি নাঈম প্রধান বিচারপতি হলে তো তিনিই প্রধান উপদেষ্টা হবেন। তাহলে কি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছেন বিচারপতি নাঈমকে প্রধান বিচারপতি করা হবে না। অ্যাটর্নি জেনারেলের বক্তব্য শুনলে তো তাই মনে হয়। আপিল বিভাগে উত্থাপিত হয়নি মর্মে খারিজ আবেদনগুলো বিরোধী দলীয় নেত্রী খালেদা জিয়া ভবিষ্যতে করতে পারবেন কি না, এমন প্রশ্নের উত্তরে ব্যারিস্টার রফিক-উল হক বলেন, সরকার পরিবর্তন হলে অনেক কিছুই হতে পারে, এখন যেমন হাজার হাজার মামলা প্রত্যাহার হয়ে যাচ্ছে। তবে তা আমার, আপনার, আমাদের কারো জন্যই মঙ্গলজনক নয়।
এবিএম খায়রুল হক প্রধান বিচারপতি হওয়া প্রসঙ্গে রিটায়ার্ড বিচারপতি মোহাম্মদ আবদুল মতিন বলেন, বৈধ কারণ ছাড়া জ্যেষ্ঠতা লংঘন ব্যক্তিগত ও প্রাতিষ্ঠানিকভাবে গুরুতর পরিণতি বয়ে আনে, ব্যক্তির বৈধ প্রত্যাশা খর্ব করে, তার মনোবল ভেঙে দেয় এবং অন্যের চোখে তাকে অপমানিত করা হয়। বিচার প্রতিষ্ঠানে নিয়োজিত বিচারকদের কাছে এটা একটা খারাপ সংকেত হয়ে থাকে। এর অর্থ আপনি নিরপেক্ষ বিচারক থাকবেন না। তিনি বলেন, এতে জর্জ বুশের সেই তত্ত্ব, আমাদের সঙ্গে থাক, নইলে ধরে নিতে হবে তুমি তাদের সঙ্গে-এর প্রতিফলন হয়। এটি একটি স্বাধীন বিচার ব্যবস্থার জন্য সুখকর নয়, পুরো জাতির জন্য ক্ষতিকর। … আজ সম্পূর্ণ বিচার ব্যবস্থা একটি ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে। সুপারসিশন তখন হতে পারে যখন যোগ্যতা, অভিজ্ঞতা বা অসুস্থতার প্রশ্ন থাকে। এসব প্রশ্ন আমার জন্য প্রযোজ্য নয়। কাউকে রাজনৈতিকভাবেও বিচারপতি নিয়োগ করা হলে বিচারপতির দায়িত্ব নেওয়ার পর তার আর দলমত থাকে না। … সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে প্রধান বিচারপতিকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান করার বিধানের কারণে বাংলাদেশে এ গুরুতর সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে। ভবিষ্যৎ প্রধান বিচারপতিদের নির্বাহী বিভাগের কাজে সম্পৃক্ত হওয়ার প্রক্রিয়া থেকে বিরত ও বিচ্ছিন্ন রাখতে প্রধান বিচারপতির পদক্ষেপ নেয়া উচিত।
উল্লেখ্য, বিচারপতি আবদুল মতিনকে ডিঙিয়ে বিচারপতি এবিএম খায়রুল হককে প্রধান বিচারপতি নিয়োগ দেয় সরকার। এরপর থেকে তিনি দুই মাস ছুটিতে ছিলেন।
একই প্রসঙ্গে ব্যারিস্টার রফিক-উল হক বলেন, কোনো কোনো বিচারপতি কথিত ওয়ান-ইলেভেনের পর সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দালালি করেছেন। আপিল বিভাগ থেকে সদ্য বিদায় নেয়া এক বিচারপতি ম্যাক্সিমাম দালালি করেছেন। তার বিদায়টাও সুখকর হয়নি। বর্তমান প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক শপথ নেয়ার পর এজলাসে বসে প্রথম দিনই ন্যায়বিচার ও সুশাসন সম্পর্কে যে অঙ্গীকার করেছিলেন এর ২৫% পূরণ করলেও দেশে কেউ অবিচারের শিকার হবে না। দেশ সত্যিকার অর্থেই একটি সোনার বাংলাদেশে পরিণত হবে।
টিআইবির রিপোর্টের আগেই এসব প্রাজ্ঞ ব্যক্তির এই ধরনের মন্তব্যে মানুষের মনে বিচার বিভাগের যোগ্যতা, নিষ্ঠা ও কার্যক্রম সম্পর্কে বহু প্রশ্নের জন্ম দিয়েছিল বিগত বছরে। তাই দেশের ১৯তম প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হকের ওপর পড়েছে অসীম দায়িত্ব।
প্রধান বিচারপতি হওয়ার পর খায়রুল হক কয়েকটি ব্যতিক্রমী ঘটনায় জড়িয়ে পড়েছেন।
এক. প্রধান বিচারপতি পদে যোগ দিয়ে তিনি তার ঘরে শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি টানিয়েছেন।
দুই. সবাইকে চমকে দিয়ে নিম্ন আদালত পরিদর্শনে তিনি তার দুটি পতাকা শোভিত গাড়ি, বডি গার্ড ও ব্যক্তিগত সহকারী প্রভৃতি প্রটোকল বাদ দিয়ে সাধারণ বেশে ১৫টি এজলাস ঘুরে দেখতে যান। বিচারক জেসমিন আরা বেগম তার এজলাসে না থাকায় তাকে প্রধান বিচারপতি মৃদু ভর্ৎসনা করেন।
তিন. নাজিরদের সঙ্গে টাকা-পয়সা লেনদেন না করার জন্য জেলা ও দায়রা জজদের প্রতি আহ্বান জানান। বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তাদের সম্মেলনে প্রধান বিচারপতি বলেন, আপনারা অনেকেই নাজিরদের সঙ্গে টাকা-পয়সা লেনদেন করেন। আমি স্ট্রেইট কাট কথা বলি। এ রকম অভিযোগ আমার হাতে আছে। অনেকেই বদলি হওয়ার সময় রিমান্ড করেন, ‘তোমরা তো আমাকে একটা কিছু দেবে, কোরআন শরিফ আর লাঠি না দিয়ে একটা ডিপ ফ্রিজ দিও’। আমার কাছে তথ্য আছে। নাম বলতে পারি, কে চেয়েছেন। তবে সবাই নেন না, কেউ কেউ নেন। নাজিরদের কাছ থেকে তোলা নেবেন না। … দেশের ১৬ কোটি মানুষ আমাদের নিয়োগ দিয়েছেন। তারা আমাদের ব্যাপারে সন্তুষ্ট নন। বিচার বিভাগ এখন জনগণের কাঠগড়ায়।
তিনি আরো বলেন, বিচারের সময় ব্যক্তির ঊর্ধ্বে উঠে নিজেকে বিচারক ভাবতে হবে। সামনে থাকবে আইন ও বিবেক। এর বাইরে যেতে পারেন না। বিলম্বে নথি আসার নজির তুলে ধরে এবিএম খায়রুল হক বলেন, রেকর্ড না আসার জন্য তদবির করা হয়। আজ আমি বলছি, কাল রাস্তার লোক বলবে। তার থেকে আমি বলাই ভালো। বছরের পর বছর সমন জারি না হয়ে পড়ে থাকে। সমন যাতে জারি না হয় সে জন্য তদবির হয়। এসব বিষয় তদারকির জন্য জেলা জজদের সপ্তাহে অন্তত একদিন আদালত পরিদর্শনের আহ্বান জানান তিনি।
জেলা জজদের উদ্দেশে প্রধান বিচারপতি বলেন, বাদীর জন্য সাক্ষী আনা কষ্টের। আজ যে সাক্ষী এসে ফিরে গেল সে পরবর্তী তারিখে না-ও আসতে পারে। এ জন্য ধার্য তারিখে সাক্ষী এসে যাতে ফিরে না যায় তা খেয়াল রাখতে হবে। স্বচ্ছতার স্বার্থে এজলাসেই তাৎক্ষণিক আদেশ দিতে হবে। নিজে কাজ করবেন, অন্যদের কাজে উৎসাহিত করবেন। সিআরও অনুসরণ করবেন। তাহলে মামলাজট কমে যাবে। দেখা যায়, একজন বিচার শুরু করেন, সপ্তম বিচারক এসে তা শেষ করেন। ৫০টি মামলা বিচারাধীন না রেখে পাচটি মামলা নিষ্পত্তি করে যান। কাজকে অর্থবহ করতে হবে। ন্যায়বিচার নিশ্চিতের দায়িত্ব আপনাদের।
লক্ষণীয় যে, প্রধান বিচারপতি খায়রুল হক যে কথা বলেছেন, প্রায় সেই একই কথা কলামিস্ট ও সাবেক আমলা এম আসাফউদ্দৌলাহ্্ বলেছিলেন। এ জন্য তিনি আদালত অবমাননার দায়ে অভিযুক্ত হয়েছিলেন। ক্ষমা চেয়ে অব্যাহতি পেয়েছিলেন। এই মামলায় হাইকোর্ট বেঞ্চের দুই বিচারপতি ছিলেন এএইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরী ও শেখ মোহাম্মদ জাকির হোসেন। আসাফউদ্দৌলাহ্্ যদি সেই সময় ক্ষমা না চেয়ে যুক্তি-তর্ক ও তথ্য দেখিয়ে তার বক্তব্যে অটল থাকতেন তাহলে বর্তমান প্রধান বিচারপতি এবং টিআইবির সমান্তরাল অবস্থানে তিনি থাকতে পারতেন।
বস্তুত ২০১০-এর প্রথম থেকেই বহু কারণে বিচার বিভাগ সমালোচিত হয়েছিল। বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায় বিচারিক প্রক্রিয়ার সমাপ্তি ঘটে ২০১০ সালের ২৭ জানুয়ারি। মৃত্যুদ-প্রাপ্ত পাচ আসামির রায় পুনর্বিবেচনার জন্য করা রিভিউ পিটিশন খারিজ করে দেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ। প্রধান বিচারপতি মোঃ তাফাজ্জাল ইসলামের নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগের চার বিচারপতির বেঞ্চ ওই আদেশ দিয়েছিলেন। ওই দিন রাতেই পাচ আসামি সাবেক সেনা কর্মকর্তা মেজর বজলুল হুদা, লে. কর্নেল এে কে মহিউদ্দিন আহমেদ (ল্যান্সার), মেজর মহিউদ্দিন আহমেদ (আর্টিলারি), লে. কর্নেল সৈয়দ ফারুক রহমান ও লে. কর্নেল সুলতান শাহরিয়ার রশিদের মৃত্যুদ- কার্যকর করা হয়।
গত বছরই সংবিধানের দুটি আলোচিত সংশোধনী বিষয়ে উচ্চ আদালত রায় দিয়েছে। পঞ্চম সংশোধনী বাতিলের রায় বহাল রাখেন সুপ্রিম কোর্ট। সপ্তম সংশোধনী বাতিল ঘোষণা করেন হাই কোর্ট। এ দুই রায়ে দেশের রাজনীতিকে আলোড়িত করেছে।
হাই কোর্টে দুই বিচারপতির শপথ কেন্দ্র করে উত্তপ্ত হয়েছিল আদালত অঙ্গন। বিএনপি সমর্থিত আইনজীবীদের নেতৃত্বাধীন সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতি এ নিয়ে তীব্র আন্দোলন গড়ে তোলে। আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ম্যানিফেস্টোতে অন্যতম প্রধান অঙ্গীকার ছিল যুদ্ধাপরাধের বিচার। এ বিচারের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। গঠন করা হয়েছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। গ্রেফতার করা হয়েছে শীর্ষ ছয় অভিযুক্তকে।
তবে এই বিচার প্রক্রিয়াকে কেন আন্তর্জাতিক টাইটেল দেয়া হয়েছে তা জনগণের কাছে স্পষ্ট হয়নি। কেউ কেউ বলেছেন, বিচার প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিদের আন্তর্জাতিক শব্দটির প্রতি দুর্বলতা বহু পুরনো। তারা মনে করিয়ে দিয়েছেন, বর্তমানে বিস্মৃত আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন জনৈক আইনজীবীর এই দুর্বলতার কথা।
গত বছর ২৫ মার্চ আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল স্থাপন করা হয় পুরনো হাই কোর্ট ভবনে। হাই কোর্টের বিচারপতি নিজামুল হকের নেতৃত্বে তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনাল গঠিত হয়। এ ট্রাইব্যুনালের অধীন তদন্ত সংস্থা ও প্রসিকিউশন টিমও রয়েছে। বর্তমানে দেশের বিভিন্ন স্থানে যুদ্ধাপরাধের তদন্ত চলছে। মানবতা বিরোধী অপরাধের অভিযোগে গত বছরে জামায়াতের শীর্ষ পাচ নেতা মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী, মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী, আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ, মুহাম্মদ কামারুজ্জামান ও আবদুল কাদের মোল্লাকে গ্রেফতার করা হয়।
এরপর বছর জুড়ে গুজব শোনা গেছে জামায়াতের সাবেক নেতা গোলাম আযমকে গ্রেফতার করা হবে। তবে গোলাম আজম গ্রেফতার না হলেও তার ছেলে সুযোগ্য ও কৃতী ব্রিগেডিয়ার আমান আল আযমীকে সেনাবাহিনী থেকে পদচ্যুত করা হয়। ঈসপের সেই গল্প, যার মর্মার্থ ছিল, অপরাধ তুই করিসনি, তোর বাপ করেছিল- অনেকেরই তখন মনে পড়ে যায়। গত বছরে আরো কিছু সেনা অফিসারকে পদচ্যুত করা হয় এবং পাচ সেনা অফিসারকে জেল দন্ড দেয়া হয়। প্রশ্ন ওঠে সেনাবাহিনী এখন কার বা কাদের নির্দেশে চলছে।
দুই বিচারপতি মোঃ রুহুল কুদ্দুস ও বিচারপতি মোহাম্মদ খসরুজ্জামানকে নিয়ে বছরের কিছু সময় উত্তপ্ত ছিল উচ্চ আদালত। নভেম্বরে প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক তাদের শপথ বাক্য পাঠ করালে উত্তেজনা চূড়ান্ত রূপ নেয়। ওই দিন বিএনপি সমর্থক আইনজীবীদের সঙ্গে পুলিশের ধস্তাধস্তি, দিনভর সভা, বিক্ষোভ মিছিলের মধ্যেই তাদের শপথ হয়। বিক্ষোভ চলাকালে আইনজীবীরা বিচারপতি মোঃ রুহুল কুদ্দুস ও বিচারপতি মোহাম্মদ খসরুজ্জামানের বিরুদ্ধে সেøাগান দেন। পুলিশ কর্ডনের মধ্য দিয়ে প্রধান বিচারপতি লাউঞ্জে ঢোকেন। এরপরেও এ দুই বিচারপতির বেঞ্চ বর্জন করে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতি। প্রেসিডেন্ট গত ১১ এপ্রিল হাই কোর্টে ১৭ বিচারপতি নিয়োগ দিয়েছিলেন। তাদের মধ্যে মোঃ রুহুল কুদ্দুস ও মোহাম্মদ খসরুজ্জামানকে তৎকালীন প্রধান বিচারপতি মোহাম্মদ ফজলুল করিম শপথ পড়াননি।
বিচার বিভাগের আরো কিছু ঘটনা বিতর্কের সৃষ্টি করেছিল। ২০৬ জনকে ডিঙিয়ে মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর হোসেন বাদলকে ঢাকার জেলা জজ পদে নিয়োগ দেয়া হয়। এর আগে তিনি দুদক-এর মহাপরিচালক (আইন) ছিলেন। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর বিচার বিভাগের সবচেয়ে বেশি ক্ষমতাবান বলে তাকে মনে করা হতো।
মোঃ জাহাঙ্গীর হোসেন বাদল কেন পদটি পেলেন তা বোঝা গেলেও গত বছর আইন কমিশনের চেয়ারম্যান বিচারপতি মোহাম্মদ আবদুর রশিদ কেন দায়িত্ব নেয়ার দেড় বছরের মাথায় পদত্যাগ করলেন সেটি জানা যায়নি। নভেম্বরে তার পদত্যাগপত্রে এর কোনো কারণ তিনি দর্শাননি।
সঙ্গত বিভিন্ন কারণেই মানুষের মনে প্রশ্ন উঠেছে, আদালত কোথায় যাচ্ছে? উত্তরটি হয়তো পাওয়া যাবে গত জানুয়ারিতে ব্যারিস্টার রফিক-উল হকের একটি মন্তব্যে। যমুনা টিভি-র পক্ষে একটি মামলায় তিনি বলেন, আল্লাহ অ্যাটর্নি জেনারেলকে বাচিয়ে রাখলে সুপ্রিম কোর্ট অবলুপ্ত হবে।
রফিক-উল হকের এই বক্তব্যে আদালত বলেন, আমরাও তাই মনে করি।
লাগামহীন দামের বছর
ডিজিটাল সরকারের দ্বিতীয় বছরে মসুর ডালের দাম টৃপল ডিজিটে পৌছেছে। নিচে দৈনিক যুগান্তর-এর সৌজন্যে তিন সরকারের আমলে পণ্যমূল্যের একটি তুলনামূলক ছবি দেয়া হলো :
দাম টাকা প্রতিকেজি/লিটার
পণ্য সেপ্টেম্বর ২০০৬ সেপ্টেম্বর ২০০৮ সেপ্টেম্বর ২০১০
মিনিকেট চাল ২৭.৫০ ৪১ ৪২
পারিজা, স্বর্ণা ১৯ ৩৫ ৩৭
খোলা আটা ২০ ৩৭.৪০ ৩২
মসুর ডাল (দেশি) ৬৬ ১০৮.৬ ৯৫-১০০
মসুর ডাল (আমদানিকৃত) ৬২ ৯২.৫ ১০০-১০৫
চিনি ৪৪ ৩৬.৫ ৫২
খোলা সয়াবিন (লিটার) ৫৬ ১০৮.৫ ৮০
খোলা পাম অয়েল (লিটার) ৫০ ৯৩.৫ ৭৫
ব্রয়লার মুরগি ৯০ ১১০ ১৭০
দেশি পেয়াজ ২৪ ৩০.৫ ৩৫
আমদানিকৃত পেয়াজ ১৮ ২৩ ৩৫
ডালের দাম দশ টাকা কেজিতে নামিয়ে আনা এবং অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম স্থিতিশীল রাখার নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি দিলেও আওয়ামী সরকার এক্ষেত্রে ব্যর্থ হয়েছে। ক্রেতা ও ভোক্তারা বছর জুড়ে অসহায় থেকেছে এবং বলেছে, আগামীতে যদি আরেকটা নির্বাচন হয় তাহলে এই প্রতারণার শাস্তি দেবে আওয়ামী লীগকে। এই সত্যটা জেনে বাণিজ্যমন্ত্রী রিটায়ার্ড কর্নেল ফারুক খান প্রাণান্ত চেষ্টা করেছেন দাম স্থিতিশীল রাখতে। ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে অভিযোগে তিনি জানতে চেয়েছেন, এটা কি মগের মুল্লুক?
ব্যবসায়ীরা গোপনে উত্তর দিয়েছেন : না, এটা মগের মুল্লুক নয়, এটা আওয়ামী মুল্লুক।
বছরের শেষ দিকে ভোজ্যতেলের দাম বেড়ে যাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে ফারুক খান বনাম ব্যবসায়ীদের দ্বন্দ্বে ফারুক খান তার উক্তিটি করেছিলেন। তবুও ভোজ্যতেলের দাম বেড়েছে।
আপামর ব্যবসায়ীরা বলেছেন, দেশে জবাবদিহিতাহীন বিদ্যুতের ব্যবসা ভালোই হচ্ছে, ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের গেইটের সামনে শীর্ষ বিদ্যুৎ প্রতিষ্ঠানের বিলবোর্ড স্থাপিত হয়েছে এবং বার বার জানা গেছে, শিগগিরই বিদ্যুতের দাম বাড়বে। ব্যবসায়ীরা প্রশ্ন রেখেছেন, তখন ফারুক খান কি করবেন?
বিদ্যুৎ পরের কথা। গত বছর মানুষ দুশ্চিন্তায় ছিল চাল নিয়ে। দেশে খাদ্য সংকট আছে কি নেই তার কোনো স্পষ্ট উত্তর পাওয়া যায়নি। শুধু দেখা গেছে, ওএমএসের ট্রাক থেকে চাল কিনতে গরিব মানুষের লাইন দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয়েছে এবং অল্প সময় পরই ওএমএস ট্রাক চলে গিয়েছে।
দামের সঙ্গে তাল মিলিয়ে যদি নিম্ন শ্রেণীর মানুষের আয় বাড়ত তাহলে সরকারের বিপদ ছিল না। কিন্তু নিম্ন শ্রেণীর মানুষের আয় বাড়েনি। তাই বছরের কিছু সময় শিল্প ক্ষেত্রে, বিশেষত গার্মেন্ট সেক্টরে দেখা গেছে প্রচ- অস্থিরতা। গার্মেন্ট শ্রমিকরা ন্যূনতম বেতন বাড়ানোর দাবি তুলেছেন এবং অনিচ্ছা সত্ত্বেও শেষ পর্যন্ত গার্মেন্ট মালিকরা তাদের কিছু দাবি মেনে নিতে বাধ্য হয়েছেন। কিন্তু প্রতিশ্রুত নতুন বেতন স্কেল কার্যকর না করা ও স্কেল অনুযায়ী বেতন সমন্বয় না করার কারণে সহিংস শ্রমিক বিক্ষোভ হয়েছে টঙ্গী, আশুলিয়া, রূপগঞ্জ এবং চট্টগ্রামে। বিক্ষোভে পুলিশ গুলি চালিয়েছে, ফ্যাক্টরি পুড়েছে এবং সাময়িকভাবে বন্ধ হয়েছে। শ্রমিকরা হতাহত হয়েছেন। ঢাকায় গাড়ি ভাংচুর হয়েছে। সরকার পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, ষড়যন্ত্র ও সাবোটাজের কারণে এসব হচ্ছে এবং গোয়েন্দারা নেমে পড়েছে গার্মেন্টস শ্রমিক আন্দোলনের নেত্রী-নেতাদের ধরতে। কিন্তু সত্যিই কি ষড়যন্ত্র হয়েছিল? সকাল-সন্ধ্যায় বস্তি থেকে ফ্যাক্টরিতে আসা-যাওয়ার পথে প্লাস্টিকের স্যানডাল পরা ধূলি ধূসরিত পায়ে, ময়লা থৃপিস গায়ে, ছোট টিফিন বক্স হাতে, শীর্ণকায় এবং ক্রমেই ক্ষুদ্রকায় হয়ে যাওয়া গার্মেন্ট নারী শ্রমিকদের দেখলে এই প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যায়।
গার্মেন্ট প্রসঙ্গে একটি ইম্পরটেন্ট প্রশ্নের কোনো উত্তর পাওয়া যায়নি। গত বছরে গার্মেন্ট কারখানায় অগ্নিকা-ের ফলে অনেক শ্রমিক নিহত হয়েছে। নিহতের সংখ্যা বেশি হবার একটি বড় কারণ হচ্ছে কাজের সময়ে কারখানায় তালা রাখা হয় এবং গার্মেন্ট শিল্পে সেইফটির বিষয়কে আমলে আনা হয়নি। কিছু গার্মেন্ট মালিক এই অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। তবে দেশের একজন শীর্ষ স্থানীয় সেইফটি এক্সপার্ট ও চিটাগাং ক্লাবের সাবেক প্রেসিডেন্ট আবুল আহসান খান (চট্টগ্রাম ক্লাবে কাল্লু খান নামে পরিচিত) জানিয়েছেন, দেশে ও বিদেশে শ্রমিকদের সেইফটি বিষয়ে বহু কাজ করলেও এবং স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে দেশের গার্মেন্টস শিল্পে কাজ করার প্রস্তাব দিলেও তার অফার গৃহিত হয়নি।
গার্মেন্ট শ্রমিকরা বলেন, সজ্জন শিল্পমন্ত্রী দিলীপ বড়–য়ার উচিত গার্মেন্টস মালিকদের বলয়ে দুর্জন হওয়া এবং অবিলম্বে তাদের সেইফটি চালুর নির্দেশ দেয়া।
গত বছরে মিডল ইস্ট এবং মালয়শিয়াতে শ্রম বাজার সম্প্রসারণের খবর পাওয়া যায়নি। বরং সংবাদ ছাপা হয়েছে মিডল ইস্ট থেকে কয়েক হাজার শ্রমিক দেশে ফিরে এসেছেন।
ডিসেম্বরে এফবিসিসিআইয়ের সঙ্গে সাংবাদিকদের একটি মতবিনিময় সভায় বলা হয়েছে, দেশের অর্থনীতি এখন খুবই ভঙ্গুর অবস্থায় আছে। মধ্য আয়ের দেশ হওয়া এখন কল্পনা বিলাস। বক্তারা বলেন, গ্যাস, বিদ্যুৎ ও অবকাঠামোগত সমস্যা, আইন-শৃঙ্খলার অবনতি, চাদাবাজি, পেশিশক্তি- এসব অর্থনৈতিক উন্নয়নে প্রতিবন্ধকতা হিসেবে কাজ করছে।
ইকনমিস্ট ড. দেবপ্রিয় ভট্টচার্য বলেন, বাংলাদেশের অর্থনীতিতে যেমন ঊষার আলো দেখা যাচ্ছে তেমনি দেখা যাচ্ছে ঈশান কোণে কালো মেঘ। অর্থনীতির সমস্যা বিষয়ে তিনি বলেন, বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) বাস্তবায়নের হার গত বছরের তুলনায় কমেছে। গত বছর এ সময়ে এডিপি ১৭ শতাংশ বাস্তবায়িত হলেও এ বছর একই সময়ে তা বাস্তবায়িত হয়েছে ১৩ শতাংশ। সরকারের কাছে টাকা আছে কিন্তু খরচ করতে পারছে না। সরকারের বিনিয়োগ ব্যক্তি বিনিয়োগকে আকৃষ্ট করে। কিন্তু এডিপি বাস্তবায়নে ধীরগতির কারণে সরকারের বিনিয়োগ কমে যাচ্ছে। বিদেশি সাহায্য থেকে আয় কমে আসছে।
ড. দেবপ্রিয়র এই উক্তির দুই সপ্তাহ পরেই ২৮ ডিসেম্বর জানা যায়, বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভে সর্বকালের রেকর্ড পরিমাণ ডলার জমা হয়েছে ১১শ’ কোটি ডলার!
কিন্তু অর্থমন্ত্রী আবুল মা’ল মুহিত এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আতিউর রহমানের জন্য এটা কোনো সুসংবাদ নয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের অক্টোবরের এক পরিসংখ্যানে জানা যায়, ব্যাংকিং খাতে ৩০ হাজার কোটি অলস টাকা পড়ে যায়। ব্যাংকাররা জানিয়েছেন, বিনিয়োগ করতে না পারায় তারা অলস টাকা নিয়ে বিপাকে রয়েছেন।
দেশকে বিভক্ত করার রাজনীতি, দলীয় স্বার্থসিদ্ধির লক্ষ্যে বিচার বিভাগকে সাজিয়ে অবিচার এবং সার্বক্ষণিক মামলা-রিমান্ড-নির্যাতন নীতি অনুসরণের ফলে যে সংঘাতময় অস্থিরতার সৃষ্টি হয়েছে সেটাই গত বছরে গড়ে তুলেছে অলস টাকার এভারেস্ট।
সম্ভবত এই কারণে নভেম্বরে বাংলাদেশ ব্যাংক ওয়েজ আর্নার্স ডেভেলপমেন্ট বন্ড, ইউএস ডলার ইনভেস্টমেন্ট বন্ড এবং ইউএস ডলার পৃমিয়াম বন্ডে পুনর্বিনিয়োগ বন্ধ করে দেয়। একই সঙ্গে ওয়েজ আর্নার্স বন্ডের সুদের হার ১২% থেকে কমিয়ে ১০.৫% করা হয়। এর ফলে রেমিটান্স প্রবাহে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে এবং প্রবাসীদের মধ্যে হতাশার সৃষ্টি হয়।
গত বছরে বাংলাদেশের এই উদ্বৃত্ত তারল্য সংকট মেটাতে এগিয়ে আসেন শাহরুখ খান, রানী মুখার্জিসহ বহু ইনডিয়ান শিল্পী। তারা অজ্ঞাত পরিমাণে ডলার নিয়ে বাংলাদেশকে সাহায্য করেছেন। থ্যাংক ইউ মি. খান, যদিও ঢাকায় আর্মি স্টেডিয়ামে আপনার শোতে রুচি, বুদ্ধি ও অভিনবত্বের ছাপ ছিল না এবং ওই শো-তে বঙ্গবন্ধুর পরিবারের সদস্যদের উপস্থিতিতে বঙ্গবন্ধুর প্রশস্তি আপনাকে গাইতে হয়েছিল।
বিদায়ী বছরে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক টার্গেট দিয়েছিল ২০০ কোটি টাকা। অক্টোবর পর্যন্ত আদায় করেছিল ২০ কোটি টাকার কম।
২০১০-এর দ্বিতীয়ার্ধ জুড়ে শেয়ারবাজারে ধস নামার সতর্ক গুজব চলেছে। ১২ ডিসেম্বরে শেয়ারবাজারে বড় ধরনের দরপতন ঘটে। এক দিনেই ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) সাধারণ মূল্যসূচক প্রায় ২৮৫ পয়েন্ট বা ৩ দশমিক ৩২ শতাংশ কমে আর চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জে (সিএসই) সার্বিক মূল্যসূচক এক দিনেই কমে ৭৪৬ পয়েন্ট।
ডিএসইর সাধারণ মূল্যসূচক কমে হয় আট হাজার ২৯৫ দশমিক ৪২ পয়েন্ট। আর সিএসইতে দিনশেষে সূচক দাড়ায় ২৩ হাজার ৩৭৪ দশমিক ৫২ পয়েন্ট।
দেশের পুজিবাজারের ইতিহাসে এভাবে সূচক পতনের ঘটনা আগে কখনো ঘটেনি। এর আগে ১৯৯৬ সালের ৫ নভেম্বর শেয়ার কেলেঙ্কারির সময় সর্বোচ্চ ২৩৩ পয়েন্ট সূচক কমেছিল। সেই হিসেবে ১২ ডিসেম্বরের সূচক পতনের ধারা ওই ঘটনাকেও হার মানায়।
ও হ্যা। ৫ নভেম্বর ১৯৯৬-এ কোন দল ক্ষমতায় ছিল? উত্তর : আওয়ামী লীগ।
শেয়ার বাজারে ঊর্ধ্বমুখী দাম এবং পিরামিড বিনিয়োগ জাতীয় একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের উত্তরোত্তর উন্নতি দেশের অর্থনৈতিক অবস্থাকে আরো নিম্নমুখী করতে পারে।
২০১০-এ সারা দেশ জুড়ে চলেছে গ্যাস সংকট। চুলা জ্বলেছে মিট মিট করে। সীমাহীন দুর্ভোগ হয়েছে গৃহিনীদের। ঢাকায় সিএনজি স্টেশনের সামনে গ্যাসের জন্য মোটরকারের লম্বা লাইন দেখা গেছে প্রতিদিন। সরকার সিএনজি স্টেশন খোলার সময়সীমা বেধে দিলেও অবস্থার পরিবর্তন হয়নি।
তবে মগবাজারের মোড়ে অনুদীপ সিএনজি স্টেশনে বিচারপতিদের গাড়ির জন্য প্রেফারেনশিয়াল লাইন ছিল। অন্তত এই গ্যাস স্টেশনে বিচারপতিদের দীর্ঘ সময় কিউ দিতে হয়নি।
বিদ্যুতের অবস্থাও ছিল তথৈবচ। জুন-জুলাইয়ে ওয়ার্ল্ড কাপ ফুটবল চলার সময়ে সরকার চেষ্টা করেছিল ফুটবল প্রেমিদের টিভি দেখার সময়ে বিদ্যুৎ সাপ্লাই অব্যাহত রাখার। কিন্তু সেই চেষ্টা সর্বাংশে সফল হয়নি। গোড়াতে যখন প্রতি এক ঘন্টা পরই বিদ্যুৎ চলে যেত তার তুলনায় বছরের শেষ দিকে অন্তত:পক্ষে রাজধানীতে বিদ্যুৎ সাপ্লাইয়ের উন্নতি হয়েছে। কিন্তু বছর জুড়ে বিদ্যুৎ ক্ষেত্রে বিঙ্খখলা ও সমন্বয়হীনতা সমালোচিত হয়েছে। জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ভাড়ার বিদ্যুৎ বা কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎ সাপ্লাইয়ে কোটি টাকা। ভবিষ্যতে বিদ্যুৎ গ্রাহককে অনেক বেশি দামে বিদ্যুৎ কিনতে হবে সেই হুশিয়ারি বারবার দেয়া হয়েছে।
অর্থমন্ত্রী হবার পর আবুল মা’ল মুহিতের মুখে সার্বক্ষণিক হাসি দেখা যেত। সম্ভবত এসব অশনি সংকেতের কারণে গত বছরের শেষ দিকে তার মুখে কদাচিৎ হাসি দেখা যায়।
মানসিক রোগে আক্রান্ত পাচ কোটি
আওয়ামী সরকারে স্বাস্থ্যমন্ত্রী পদে একজন প্রতিষ্ঠিত চিকিৎসক ও সক্রিয় রোটারিয়ান ড. আফম রুহুল হক-এর নিযুক্তিতে মানুষ আশাবাদী হয়েছিল। কিন্তু গত বছর স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে দুর্নীতি স্বজনপ্রীতি ও দলীয়করনের খবর প্রকাশিত হয়।
বিশেষত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকাল বিশ্ববিদ্যালয় (ইংরেজিতে সংক্ষেপিত BSMMU, অতীতে PG বা পোস্ট গ্র্যাজুয়েট হসপিটাল নামে বহুল পরিচিত) বছর জুড়ে অশান্ত ছিল। অক্টোবরে চারজন অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসর পদচ্যুত হন। তারা আদালতের শরনাপন্ন হন এবং এ বছরের স্টে অর্ডার পান। এদের অন্যতম হচ্ছেন লেখক সায়ন্থ সাখাওয়াৎ। ডিসেম্বরে ২৩৬ মেডিক্যাল অফিসার পদচ্যুত হন। এদের মধ্যে আছেন লেখক মুজাহিদুল ইসলাম আকাশ। এই ২৩৬ চিকিৎসকের পরিবার মানববন্ধন করে প্রতিবাদ জানিয়েছে। তার পরেও এই মাসেই উচ্চ আদালতে বিচারাধীন থাকা সত্ত্বেও, প্রফেসর, এসোসিয়েট প্রফেসর, অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসর ও অফিসারসহ ২৮ জনকে চাকরিচ্যুত করা হয়। সেই সাথে একই ধরনের পদমর্যাদার আরো ১৩ জনের পদাবনতি করা হয়।
এসব ঘটনার ফলে বিএসএমএমইউয়ের তো বটেই, তার ভাইস চ্যান্সেলর ড. প্রান গোপাল দত্তেরও মর্যাদাহানি হয়েছে। মানববন্ধনে প্রতিবাদকারীরা বলেন, বিএসএমএমইউ হাসপাতালের সবচেয়ে নিম্ন ডিগ্রি নিয়ে ভিসি হয়েছেন প্রাণ গোপাল দত্ত। তার যে এমসিপিএস ডিগ্রি রয়েছে, তাতে একজন সহকারী অধ্যাপকও হওয়া যায় না। অথচ তিনি একজন অধ্যাপক। অধ্যাপকের পরিচয় দিয়ে তিনি রোগীদের সঙ্গে প্রতারণা করছেন বলে দাবি করা হয়। বর্তমান ভিসিকে অপসারণ করে বিএসএমএমইউ’র সুষ্ঠু পরিবেশে ভালো চিকিৎসা সেবার মান ফিরিযে আনতে রাষ্ট্রপতির হস্তক্ষেপ কামনা করেন চিকিৎসকরা।
চিকিৎসকরা আরও বলেন, যাদের চাকরিচ্যুত এবং পদাবনতি করা হয়েছে, তাদের সবার নিয়োগই ইউনিভার্সিটির নিয়োগবিধি অনুসরণ করেই সিন্ডিকেট নিয়োগ দিয়েছে। তাই এ নিয়োগে কোনো সমস্যা থাকতে পারে না। ইউনিভার্সিটির আইন অনুযায়ী সবাই তাদের নিবিড় পর্যবেক্ষণ সময় দক্ষতার সঙ্গে পার করার পর ইউনিভার্সিটির নিয়মানুযায়ী চাকরি স্থায়ী করা হয়। শুধু রাজনৈতিক প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার অসৎ উদ্দেশ্যেই বর্তমান ভিসি সিন্ডিকেটের দোহাই দিয়ে এ ব্যবস্থা নিয়েছেন।
অক্টোবরে ঢাকায় হেপাটোলজি সোসাইটি আয়োজিত প্রথম আন্তর্জাতিক হেপাটোলজি সম্মেলনে প্রফেসর মবিন খান জানান, বাংলাদেশে প্রায় সাড়ে তিন কোটি মানুষ লিভার রোগে আক্রান্ত। লিভার রোগে আক্রান্তদের মধ্যে বর্তমানে দেড় কোটি লোক লিভারের দীর্ঘস্থায়ী রোগ হেপাটাইটিস ‘বি’ ভাইরাসে ৮ লাখ লোক হেপাটাইটিস ‘সি’ ভাইরাসে আক্রান্ত। গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর প্রায় এক-তৃতীয়াংশ লোক জীবনের কোনো না কোনো এক সময় হেপাটাইটিস ‘বি’ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়। এছাড়াও লিভার সিরোসিস, লিভার ক্যান্সার, ফ্যাটি লিভার, ‘এ’ ও ‘ই’ ভাইরাসজনিত লিভার রোগ, পরজীবীজনিত লিভার, ফুড়ারোগসহ লিভারের অন্যান্য রোগে আক্রান্ত। লিভার রোগ এখন বাংলাদেশের অন্যতম স্বাস্থ্য সমস্যা।
স্বাস্থ্য সংক্রান্ত আরো কিছু দু:সংবাদ এসেছে গত বছরে।
বাংলাদেশ সার্ভিকাল ক্যান্সার ভ্যাকসিনেশন প্রোগ্রাম কমিটি’র সদস্য সচিব প্রফেসর সাবেরা খাতুন জরায়ু ক্যান্সার বিষয়ক একটি পাইলট গবেষনার ফল প্রকাশ অনুষ্ঠানে জানান, জরায়ু মুখের ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে প্রতিদিন ১৮ নারী জরায়ু ক্যান্সারে মারা যাচ্ছে। আলোচকরা জানান, মেয়েদের যৌন জীবন শুরুর আগেই এই ভ্যাকসিন নেয়া খুব কার্যকর।
জাতীয় পুষ্টি কার্যক্রম (এনএনপি) বাস্তবায়িত হচ্ছে মাত্র ১৭০ উপজেলায়।
ইউনিভার্সিটির পুষ্টি ও খাদ্য বিজ্ঞান ইনষ্টিটিউটের প্রফেসর ড. গোলাম মাওলা এ প্রসঙ্গে বলেন, দেশে খাদ্য মূল্যের অস্থিশীলতার কারণে একজন মানুষের যত কিলো ক্যালরি খাদ্যের প্রয়োজন, তা খেতে পারছে না। ফলে অপুষ্টির শিকার হচ্ছে। ড. মাওলা পুষ্টিহীনতা দুর করতে দেশে খাদ্যের বৈচিত্র্য বাড়ানোর তাগিদ দেন।
ওয়ার্ক ফর বেটার বাংলাদেশ পরিচালিত একটি সার্ভেতে জানা গেছে ঢাকাসহ বাংলাদেশের বড় শহরগুলোর অন্যতম প্রধান সমস্যা শব্দদূষন।ওয়ার্ক ফর বেটার বাংলাদেশের জরিপ জানিয়েছে সবচেয়ে বেশি শব্দদূষণ হয়, গাড়ির হর্ণ, মাইকিং, বেবিট্যাকসি ও কলকারখানার কারণে। পলিটিশিয়ানরা যে প্রতিনিয়ত শব্দদূষণ করছেন সে বিষয়ে এই সার্ভে কোনো তথ্য দেয়নি।
অক্টোবরে মানসিক স্বাস্থ্য দিবস পালনের সময়ে চিকিৎসকরা জানান পাচ কোটি মানুষ দেশে মানসিক রোগে আক্রান্ত। তারা অভিযোগ করেন, এই রোগের সুচিকিৎসা গড়ে তোলার ক্ষেত্রে নীতি নির্ধারক মহল কিংবা মন্ত্রণালয় ও অধিদফতর চরম ব্যর্থতার পরিচয় দিয়ে আসছে।
চিকিৎসকরা জানান ১৮ বছর থেকে ঊর্ধে ১৬%, এবং ১৮ বছরের নিচে (পাচ থেকে ১৮ বছরের শিশু কিশোরদের মধ্যে) ১৮% মানসিক সমস্যায় ভুগছে। দেশে প্রায় পাচ কোটি মানুষ মানসিক রোগে আক্রান্ত।
পাচ কোটি অর্থাৎ বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার প্রায এক-তৃতীয়াংশ। গড় হিসাব প্রয়োগ করলে বর্তমান মন্ত্রীসভার প্রায় এক-তৃতীয়াংশও মানসিক রোগে আক্রান্ত হয়ে থাকতে পারেন। বাংলাদেশে অসুস্থ রাজনীতির ড্রাইভিং সিটে কি তারাই বসে আছেন?
ইভটিজিং ভিডিওটিজিং মোবাইলটিজিং
চাইল্ড পার্লামেন্ট পরিচালিত ‘শিক্ষা ও সুশাসন শীর্ষক এক সার্ভে রিপোর্টে জানানো হয় দেশের স্কুলের ৬২% ছাত্রী ইভটিজিংয়ের শিকার হয়েছে। সেভ দি চিলড্রেন অস্ট্রেলিয়ার কান্ট্রি ডিরেক্টর সুলতান মাহমুদ জানান, এই জরিপ কাজে অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল ৬৪টি জেলার ৫১২টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান।
ইভটিজিংয়ের ব্যাপকতা ও ভয়াবহতা বিষয়ে জুন ২০১০-এ বাংলাভিশনে সম্প্রচারিত আর্ট শো লাল গোলাপ জনগনের দৃষ্টি আকর্ষন করে জুনে ঢাকার তিনটি অনুষ্ঠানের মাধ্যমে।
ইভটিজিং নিয়ন্ত্রনে আনার চেষ্টা করেছে সরকার কিন্তু সফল হয়নি। সরকার ভ্রাম্যমান আদালত প্রতিষ্ঠার কথাও ভেবেছে। কিন্তু দেশে কিছু মূল্যবোধ, বিশেষত গ্রামীন ও মফস্বল অঞ্চলে, প্রতিষ্ঠিত না হলে ইভটিজিং কমবে না। অতীতে এসব অঞ্চলের মুরুব্বিরা যাদের অধিকাংশ ধর্মপরায়ন মুসলিম এবং যাদের মুখে দাড়ি ও মাথায় টুপি আছে তাদের যে সামাজিক প্রভাব ছিল, সেটা সাম্প্রতিক কালে কমেছে। তারা ভীত আছেন রাজাকার অথবা যুদ্ধাপরাধী আখ্যায়িত হবার ভয়ে। তাই তারা ইভটিজিং দেখলেও তরুনদের বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ নেননা। ফলে মফস্বল ও গ্রামীন এলাকায় মেয়েরা আগের চাইতে বেশি সময় বোরখা পড়ছে।
মুরুব্বি জাতীয় ব্যক্তিদের দোষ দেয়া যাবে না। গত বছর তারা জেনেছেন ইভটিজিংয়ের বিরুদ্ধে নাটোরের লোকমান কলেজের প্রতিবাদকারী শিক্ষক মিজানুর রশিদ ১২ দিন পিজি হসপিটালে জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষনে থাকার পর মারা যান।
গত বছর বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরাম প্রকাশিত একটি সার্ভে রিপোর্ট জানায়, দেশে প্রতিদিন নানাভাবে যৌন হয়রানির শিকার হচ্ছে গড়ে ৩০ কিশোরী।
ইউনিসেফের একটি পরিসংখ্যানে দেখা যায়, বাংলাদেশে ১০ থেকে ১৪ বছর বয়সী কন্যাশিশু রয়েছে ৭৭ লাখ। এছাড়া মোট জনসংখ্যার ২ দশমিক ২৯ ভাগ হলো ১৫ থেকে ১৭ বছর বয়সী কিশোরী। জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে বিপুলসংখ্যক কিশোরী জন্মের পরপরই পরিচিত হচ্ছে নিদারুণ অবহেলা আর বৈষম্যের সঙ্গে। স্বাস্থ্য ও শিক্ষা ক্ষেত্রে বৈষম্যের পাশাপাশি পাচার, পতিতালয়ে বিক্রি, বাল্যবিয়ে, ধর্ষণ, এসিড সন্ত্রাস ও যৌণ হয়রানির শিকার হচ্ছে। অধিকাংশ দরিদ্র পরিবারে কিশোরীদের স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে চরম অবহেলা করা হয়।
পারিবারিক নির্যাতনের রিপোর্ট থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, শতকরা ৭০টির বেশি নির্যাতনের ঘটনায় ১৩ থেকে ১৮ বছর বয়সী কিশোরী বধূর মৃত্যু ঘটেছে স্বামীর হাতে। গৃহকাজে নিয়োজিত কন্যাশিশুদের ৫০ ভাগ যৌন হয়রানির শিকার হয়। পরিসংখ্যানবিহীন নির্যাতনের মধ্যে রয়েছে যৌণ হয়রানি, অশালীন মন্তব্য, ইঙ্গিত, প্রহার ও গালাগালি। সামাজিক ভয়, পারিবারিক লাঞ্ছনা বা চাকরি হারানোর ভয়ে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ঘটনাগুলো তারা প্রকাশ করে না।
ইউনিসেফের তথ্য অনুযায়ী, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, শ্রমসহ প্রতিটি ক্ষেত্রেই কিশোরীরা অবহেলার শিকার হচ্ছে। কিশোরদের তুলনায় কিশোরীদের অপুষ্টিতে ভোগার হার প্রায় তিন গুণ বেশি।
সহজলভ্য হওয়ায় আবারও বেড়েছে নারীদের প্রতি এসডি ছোড়ার ঘটনা। কেরানীগঞ্জে বারের চরে দশ মাসের কন্যা শিশু আফসানাও এসিড সন্ত্রাসের শিকার হয়েছে। তার বোন নাজমা (২৫)-কে বিয়ে করতে ব্যর্থ হয়ে সন্ত্রাসী সোহেল এসডি ছুড়েছিল আফসানা, নাজমা ও তার বড় বোন সুরাইয়া (২৮)-কে।
এসিড থ্রোয়িং এবং ইভটিজিংয়েই সন্ত্রাসী যুবকরা থেমে থাকেনি। ২০১০-এ বাংলাদেশে এসেছে ভিডিওটিজিং ও মোবাইলটিজিং। ভিডিও ক্যামেরা সুলভ হওয়ায় এবং মোবাইল ফোনে ভিডিও ছবি ধারণ করার সুযোগ নিয়ে এরা বহু নারীকে প্রচ- বিপদের মুখে ফেলে দিয়েছে। নারীর ঘর ভেঙ্গেছে। জনপ্রিয় টিভি অভিনেত্রী প্রভা-র নুড ছবি ডিভিডিতে প্রচারিত হবার পর তিনি আপাতত অভিনয় জীবন থেকে অবসর নিতে বাধ্য হয়েছেন।
প্রভা বলেন, জীবিত একজন মানুষকে মেরে ফেলা হয়েছে। অথচ আমার কি অপরাধ যে আমাকে এভাবে হেয় করা হচ্ছে? সাবেক প্রেমিক রাজিব প্রসঙ্গে বলেন, ও খুব ক্রেজি মানুষ, কখনোই আমাকে ভালবাসেনি। তার টার্গেট ছিল যেকোনো মুল্যে আমাকে বিয়ে করা। আমার মনে হয় রাজিবের সঙ্গে বিয়ে হলে ও আমাকে মেরেও ফেলতে পারত।
প্রভা আরো বলেন, অনেকটা চাপের মধ্যেই রাজিবের সঙ্গে আমার বাগদান হয়। যখন বুঝলাম ও আমাকে ভালোবাসে না। তখন কাজের মধ্যে ডুবে থাকার চেষ্টা করেছি। তিনি বলেন, আমি অন্য সব বাঙালি নারীর মতো স্বামীর সংসার নিয়ে ভালো থাকতে চেয়েছি। এটাই কি আমার অপরাধ?
ভিডিওটিজিংয়ের পাশাপাশি মোবাইল ফোনে টিজিং বা মোবাইলটিজিংও বেড়েছে। মোবাইল ফোনে কথা বলার খরচ কমে যাবার ফলে এবং ডিজুস কালচার প্রচারিত হবার কারণে মোবাইলটিজিং বেড়েছে।
ব্যর্থতা ও চুরি
২০১০-এ সারা বাংলাদেশ হুমড়ি খেয়ে পড়েছিল সাউথ আফ্রিকাতে অনুষ্ঠিত ওয়ার্ল্ড কাপ ফুটবল ম্যাচগুলো দেখতে। জুন মাসের গোড়া থেকেই বস্তি থেকে বিলডিংয়ে, কার থেকে কারখানায় উড়েছিল প্রধানত আর্জেনটিনা ও ব্রাজিলের ফ্ল্যাগ। এ দুই টিমের বিদায় বাঙালি দর্শকদের হতাশ করেছিল। একটি অনাকর্ষনীয় ফাইনালে স্পেন ১-০ গোলে নেদারল্যান্ডসকে হারিয়ে বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হয়।
কিন্তু ওয়ার্ল্ড কাপ ফুটবল ওয়ার্ল্ডে বাংলাদেশ কোথায় ছিল? বিব্রতকর এই প্রশ্নটি মিডিয়া তোলেনি। বাংলাদেশ ফুটবল কৃর্তপক্ষও কিছু বলেননি।
ওয়েল, উত্তরটা শুনতে খারাপ লাগলেও দিচ্ছি।
১৯৮৬ থেকে ২০১০ পর্যন্ত অনুষ্ঠিত প্রতিটি ওয়ার্ল্ড কাপ ফুটবলেই বাংলাদেশ টিম কোয়ালিফাইং রাউন্ডে খেলেছে, কিন্তু কখনোই ফাস্ট রাউন্ড পেরিয়ে কোয়ালিফাই করতে পারেনি। ২০১০-এর ওয়ার্ল্ড কাপে কোয়ালিফাইং ফার্স্ট রাউন্ডে বাংলাদেশ খেলেছিল তাজিকিস্তানের বিরুদ্ধে। একটি ম্যাচ তারা ১-১- গোলে ড্র করেছিল। দ্বিতীয় ম্যাচ তারা ৫-০ গোলে হেরেছিল। অর্থাৎ, মোট ৬-১ গোলে বাংলাদেশ হেরেছিল ২০১০-এর কোয়ালিফাইং রাউন্ডে।
তবে ২০১০-এর শুরুতে সাউথ এশিয়ান গেমসে বাংলাদেশ ৪-০ গোলে আফগানিস্তানকে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল।
ডিসেম্বর ২০১০-এ বিশ্বের ২০৩টি দেশের মধ্যে ফিফার র‌্যাংকিং লিস্টে বাংলাদেশের স্থান ছিল ১৫৯। এই র‌্যাংকিংয়ে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ স্থান ছিল এপ্রিল ১৯৯৬-এ, ১১০।
ল্যাপটপ চুরি
অভিযোগ হয় এশিয়ান গেমস কভার করতে এসে বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার (বাসস) সিনিয়র সাব এডিটর স্বপন বসু মিডিয়া সেন্টার থেকে একটি ল্যাপটপ সরিয়ে নেন। তার কারণে সারা দিন অন্য সাংবাদিকদের গেমস নিরাপত্তাকর্মীদের নজরদাবিতে থাকতে হয়। পরে ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরায় ধরা পড়ে যে স্বপন বসু চুরি করেছেন ল্যাপটপটি। এক সন্ধ্যায় এক চায়নিজ সাঙবাদিক নিজের আসন ছেড়ে ডিনারে যান। সেই সুযোগে ল্যাপটপটি নিয়ে সরে পড়েন স্বপন বসু। সকালে নিরাপত্তাকর্মীদের পক্ষ থেকে বাংলাদেশের ক্রীড়া সাংবাদিকদের ভিডিও ফুটেজ দেখানো হয়। এরপর ল্যাপটপ চুরি করার কথা স্বীকার করেন স্বপন বসু। তবে ল্যাপটপ ফিরিয়ে দেননি তিনি। আইনি জটিলতা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য তিনি ১৩০০ ডলার জরিমানা দেন।
ছাত্রলীগের ক্যাডার হিসেবে পরিচিত স্বপন বসু ১৯৯৮ সালে বাসসে যোগ দেন। ২০০১ সালে তাকে চাকরিচ্যুত করা হয়। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর স্বপন বসু আবার চাকরি ফিরে পান।
মশার কয়েল চুরি
এর পরপরই চায়নাতে আরেকটি মর্যাদাহানির খবর প্রকাশিত হয়। চুরির দায়ে বাংলাদেশ দলকে নভেম্বরে জরিমানা করে গোয়াং জু এশিয়ান গেমস কর্তৃপক্ষ। জরিমানার পরিমাণ ৩০ ইউয়ান অর্থাৎ ৩০০ টাকা। অর্থ হিসেবে এটা খুবই সামান্য হলেও চায়নাতে আসা পুরো বাংলাদেশ টিমকে লজ্জায় ডুবতে হয়েছে এ জন্য। বাংলাদেশ দলের ডেপুটি শেফ অফ মিশন আবদুল আউয়াল মজনু জানান, গেমস ভিলেজে বাংলাদেশ দলের কর্মকর্তা ফজলুর রহমান বাবুলের রুম থেকে একটি মশার কয়েল খোয়া গেছে। বাবুল রুম ছেড়ে যাওয়ার পর আয়োজকরা জানিয়েছেন ওই রুমের মশার কয়েল পায়নি আয়োজক কর্তৃপক্ষ। এরপরই বাংলাদেশকে ৩০ ইউয়ান জরিমানা করা হয়। মজনু জানান বাবুল দেশে ফেরার সময় বিষয়টি জেনে ওনাকে গোয়াং জু এয়ারপোর্টে ফোন করা হয়। উনি ফোনে বলেন, ওই মশার কয়েল সম্পর্কে তিনি কিছুই জানেন না। উল্লেখ্য, রুমে ওঠার সময় আয়োজক কর্তৃপক্ষ বলে দেয়, কোন কোন জিনিস নেয়া যাবে না। তারপরও এগুলো খোয়া যায়।
তথ্য, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী ইয়াফেস ওসমান ক্রিকেটে নিউ জিল্যান্ডের বিপক্ষে বাংলাদেশের বিজয়কে ছড়ার মাধ্যমে মন্ত্রীসভাকে জানান। ছড়া শুনে প্রধানমন্ত্রীসহ মন্ত্রীসভার সদস্যরা হাততালি দিয়ে অভিনন্দন জানান।
চায়নায় ওই দুটি চুরির ঘটনা বিষয়ে অবশ্য ইয়াফেস ওসমান কোনো ছড়া লেখেননি। এশিয়ান গেমসে মেডাল প্রাপ্ত ৪৫টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের স্থান ছিল ২৭। বাংলাদেশ একটি সোনা, একটি রূপা এবং একটি ব্রঞ্জ মেডাল পেয়েছিল।
দিল্লিতে অনুষ্ঠিত কমনওয়েলথ গেমসে মেডাল লিস্টে বাংলাদেশের স্থান ছিল সবচেয়ে নিচে ৩৪তম। সেখানে একটি মাত্র (ব্রঞ্জ) মেডাল পেয়েছিল বাংলাদেশ।
আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বাংলাদেশ কি অহংকার করতে পারবে?
দুর্ঘটনায় নিহতের সংখ্যা বাড়ছে
গত বছরে আইলা-সিডরের মতো কোনো বড় প্রাকৃতিক দুর্যোগ হয়নি। কিন্তু মানুষের তৈরি কয়েকটি বড় দুর্ঘটনায় অনেকে হতাহত হয়েছে।
স্থলপথে: বাংলাদেশ ইঞ্জিনিয়ারিং ইউনিভার্সিটির অ্যাকসিডেন্ট রিসার্চ ইন্সটিটিউটের (এআরআই) ডিরেক্টর জানিয়েছেন, সড়ক র্দুঘটনা নিয়ে আমাদের দেশে যেসব রিপোর্ট প্রকাশিত হয়, সেসব বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ এবং হসপিটাল ও পুলিশ রিপোর্টের ভিত্তিতে তৈরি। এসব রিপোর্টে অনেক দুর্ঘটনা ও হতাহতের খবর বাদ পড়ে যায়। তিনি বলেন, সারা দেশে জাতীয় ও আঞ্চলিক পর্যায়ে বেসরকারি হিসাবে বছরে প্রায় ১২,০০০ মানুষ সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারায়। আহত হয় প্রায় ৩৫,০০০।
মার্চে সপরিবারে গ্রামের বাড়ি যাওয়ার পথে কুমিল্লায় সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হন অতিরিক্ত সচিব সিদ্দিকুর রহমানের দুই মেয়ে, শ্যালক ও গাড়ি চালক। গুরুতর আহত হয়ে পঙ্গু হন তার স্ত্রী। চোখের সামনে সড়ক দুর্ঘটনায় এতগুলো প্রাণ ঝরে যেতে দেখে এ কর্মকর্তা নিরাপদ সড়কের দাবিতে সোচ্চার হন তিনি। নিহত বড় মেয়ের নামে ফাউন্ডেশন গঠনসহ রাজপথে বিভিন্ন কর্মসুচিও পালন করেন তিনি। ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে ৩১ জুলাই মানিকগঞ্জে এক সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান সিদ্দিকুর রহমান নিজেই। দুই মেয়ে আর স্বামীকে হারিয়ে পঙ্গু পারভীন তাহমিনা এখন শোকে নির্বাক।
বাংলাদেশে প্রতিদিন এভাবেই সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যাচ্ছে অনেক মানুষ। প্রতি বছর এর পরিমাণ আশংকাজনক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। গত অক্টোবরে সাভারে আমিন বাজারে ব্রিজের রেলিং ভেঙ্গে ৫০ জন যাত্রীসহ একটি বাস তুরাগ নদীতে পড়ে ডুবে যায়। এ দুর্ঘটনার পর মাত্র ১১ জনের লাশ উদ্ধার করা হলেও এখনো পর্যন্ত নিখোজ রয়েছেন অনেকেই।
রেলপথে: ডিসেম্বরে নরসিংদিতে দুই ট্রেনের সংঘর্ষে নিহত হয় অন্তত ১৩ জন। আহত হয় কমপক্ষে ১৫০ জন। জানুয়ারিতে সায়েদাবাদ রেল ক্রসিংয়ে দুটি বাসকে একটি ট্রেন ধাক্কা দেয়ার ফলে নিহত হয় ৬ জন এবং আহত হয় ১০ জন। অক্টোবরে সিরাজগঞ্জে বিএনপি আহূত জনসভার পাশে চলন্ত ট্রেনে কাটা পড়ে নিহত হয় ৫ জন।
জলপথে: ডিসেম্বরে সুনামগঞ্জে ধনু নদী রাত ৯টার দিকে বালুবাহী একটি নৌকার সঙ্গে যাত্রীবাহী ইঞ্জিনচালিত একটি নৌকার সংঘর্ষে নিহত হয় ৩৫ জন। এর আগে জুনে সুনামগঞ্জে মৈলচাপড়া হাওরে ঝড়ো আবহাওয়ায় ট্রলার ডুবে মারা যায় ১৩ জন।
আকাশ পথে: অক্টোবরে সিরাজগঞ্জ চৌহালী উপজেলার যমুনা নদীতে ফ্লাইং ক্লাবের প্লেন ক্র্যাশে নিহত হন পাইলট কামরুল হাসান। এর কয়েক সপ্তাহ পরে বরিশালে এয়ার ফোর্সের একটি ট্রেইনিং প্লেন ক্র্যাশে নিহত হন দুই পাইলট, মোহাম্মদ আশরাফ ও মোহাম্মদ মাহমুদ।
স্থলে: জুনে ঢাকায় বেগুনবাড়িতে একটি ভবন উপড়ে পড়লে নিহত হয় ২৫ জন। গার্মেন্ট শিল্পে আগুন লাগার ঘটনা অব্যাহত থেকেছে গত বছরে। ফলে ডিসেম্বরে আশুলিয়াতে হা-মীম গ্রুপের ফ্যাক্টরিতে নিহত হয় ৩১ শ্রমিক। এর আগে ফেব্রুয়ারিতে গাজীপুরে সোয়েটার ফ্যাক্টরিতে আগুনে নিহত হয় ১৭ শ্রমিক।
অক্টোবরে যাত্রাবাগিতে কেমিকাল সৃষ্ট আগুনে নিহত হয় ৭ জন। জুনে ট্রান্সফর্মার বিস্ফোরণ থেকে আগুনে ঢাকার নবাবকাটরার নিমতলিতে অন্ততপক্ষে ১২৫ জনের মৃত্যু হয়।
নিহত ব্যক্তিরা শুধু সংখ্যা রূপান্তরিত হন। আহতরা বেচে থাকেন পঙ্গু হয়ে এবং পরিবার ও সমাজের দায় হয়ে। সরকারের উচিত হবে সকল ধরনের দুর্ঘটনা বন্ধ করায় তৎপর হওয়া, দ্রুত চিকিৎসার ব্যবস্থা করা এবং আহতদের পুনর্বাসনের কর্মসুচি নেয়া। বঙ্গবন্ধু এয়ারপোর্ট নির্মাণের বদলে এসবই হতে পারে বর্তমান সময়ের অতি প্রয়োজনীয় প্রোগ্রাম।
জনপ্রিয় দাদাগিরি ও অবাঞ্ছিত দাদাগিরি
ইন্ডিয়ান টিভি চ্যানেল জি-বাংলা সম্প্রচারিত একটি নিয়মিত অনুষ্ঠান দাদাগিরি বাংলাদেশে খুব জনপ্রিয় হয়েছে। সাবেক ইন্ডিয়ান টেস্ট ক্রিকেট ক্যাপ্টেন সৌরভ গাঙ্গুলি এই অনুষ্ঠানের সফল উপস্থাপক।
কিন্তু তার দেশ ইন্ডিয়ার, সরকার ও ব্যবসায়ীদের দাদাগিরি বাংলাদেশের নাগরিকদের কাছে কখনোই বাঞ্ছিত ছিল না। গত বছরে বাংলাদেশ সরকারের ওপর ইন্ডিয়ান সরকারের দাদাগিরির একটি চরম বহি:প্রকাশ হয় ৭ আগস্টে অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখ্যর্জির আকস্মিক স্বল্প সময়ের ঢাকা সফরে।
প্রণব মুখার্জি জানান, বাংলাদেশ সফরকালে ঢাকা ও দিল্লির মধ্যে ঋণচুক্তি সই হয়েছে। ভারত থেকে বিদ্যুৎ আমদানির জন্য গ্রিড লাইনের আন্ত:সংযোগ স্থাপন, রেলওয়ের অবকাঠামো উন্নয়ন, আশুগঞ্জ নৌবন্দরকে কনটেইনার টার্মিনালে রূপান্তর, রেলয়ের জন্য ইঞ্জিন, কোচ ও বাস আমদানিসহ ১৪টি প্রকল্প বাস্তবায়নে ঋণের অর্থ ব্যয় করবে বাংলাদেশ। ঋণের একটি অংশ আশুগঞ্জ-আখাউড়া রুটে ট্রানজিট এবং চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দর ব্যবহারে ইন্ডিয়াকে দেয়া সুবিধা বাড়ানোর জন্য ব্যয় করা হবে।
বাংলাদেশের সাথে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য সম্প্রসারণে নেপাল ও ভুটানকে ট্রানজিট সুবিধা দিতে রাজি হয়েছে ইন্ডিয়া। একই সাথে দেশটি দুই লাখ টন চাল ও এক লাখ টন গম বাংলাদেশে রফতানির অনুমোদনের কথা জানিয়েছে।
চুক্তি অনুযায়ী ঋণের বিপরীতে সুদের হার নির্ধারণ করা হয়েছে ১ দশমিক ৭৫ শতাংশ। সুদের বাইরে এ ঋণের বিপরীতে কমিটমেন্ট চার্জ ধরা হয়েছে শূন্য দশমিক ২৫ শতাংশ। পাচ বছর গ্রেস পিরিয়ডসহ ঋণ পরিশোধের সময় নির্ধারণ করা হয়েছে ২৫ বছর। নির্ধারিত সময়ে প্রকল্প বাস্তবায়ন বা সুদসহ ঋণ পরিশোধ করতে না পারলে বাংলাদেশকে মোটা অঙ্কের জরিমানা গুনতে হবে।
বাংলাদেশের অনেক অর্থনীতিবিদ ও বিরোধী দলের নেতারা ঋণের এসব শর্তকে কঠিন, ইন্ডিয়ার স্বার্থরক্ষাকারী ও জাতির জন্য অবমাননাকর হিসেবে আখ্যায়িত করেন। তবে এয়ারপোর্টে সাংবাদিকদের সাথে আলাপকালে প্রণব মুখার্জি দাবি করেন, ইন্ডিয়ার দেয়া ঋণের শর্ত বাংলাদেশের জন্য খুবই অনুকুল। এটি কোন দেশকে ভারতের দেয়া একক সর্ববৃহৎ ঋণ।
পরে এক যৌথ সংবাদ সম্মেলনে প্রণব মুখার্জি বলেন, সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের সাথে একযোগে কাজ করবে ইন্ডিয়া। একই সাথে বাংলাদেশের সাথে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য সম্প্রসারণে নেপাল ও ভুটনাকে ট্রানজিট সুবিধা দেবে ইন্ডিয়া।
বিভিন্ন সূত্রে জানা যায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে প্রণব মুখার্জি যখন দেখা করেন তখন তিনি বাংলাদেশের সঙ্গে চায়নার সম্পর্ক উন্নয়নে আওয়ামী লীগ সরকারের উৎসাহ বিষয়ে আলোচনা করেন। অন্যভাবে বলা যায প্রণব মুখার্জি সম্ভবত এই সম্পর্কোন্নয়নের উদ্যোগকে নিরুৎসাহিত করেন। হাসিনা সরকার যেন বিভিন্ন বিষয়ে ইন্ডিয়ান সরকারের নিয়ন্ত্রনে (বা দাদাগিরিতে) থাকে সে বিষয়ে সতর্কবাণী রূপে প্রণব মুখার্জি হাসিনা দ্বারা উপেক্ষিত আওয়ামী লীগের চার সংস্কারপন্থী সাবেক নেতার সঙ্গে দেখা করেন। সংস্কারপন্থীদের সঙ্গে প্রণব মুখার্জির এই মিটিং হাসিনার সঙ্গে মিটিংয়ের চাইতে দীর্ঘস্থায়ী ছিল।
ইন্ডিয়ার চলমান দাদাগিরিতে বাংলাদেশের মানুষের অবাক হবার কিছু ছিল না। বাংলাদেশের মানুষ বোঝে ইন্ডিয়ার কাছে আওয়ামী লীগের ঋণ পরিশোধ করতেই হবে। গত বছরের শেষ দিকে আলোড়ন সৃষ্টিকারী উইকিলিকসের তথ্যে বলা হয়, ২৯ ডিসেম্বর ২০০৮-এ অনুষ্ঠিত সংসদীয় নির্বাচনে নয়া দিল্লির সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রক্ষাকারী আওয়ামী লীগ নিরংকুশ বিজয় অর্জন করায় ঢাকায় নিযুক্ত ইন্ডিয়ান হাই কমিশনার পিনাক রঞ্জন চক্রবর্তী খুশি হয়েছিলেন।
এর তাৎপর্য হয়তো এই যে, প্রণব মুখার্জি জানিয়ে যান শেখ হাসিনাকে, যে তার বিকল্প রূপে উপেক্ষিত এই চার নেতা, ইন্ডিয়ান সরকারের কাছে আদৃত হতে পারেন ভবিষ্যতে। বছর জুড়ে বাংলাদেশ-ইন্ডিয়ার বহুমুখী সম্পর্কের কয়েকটি ছবি ছিল নিম্নরূপ:
ক্স ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে জানা যায় ইন্ডিয়া থেকে পাচ লক্ষ টন খাদ্যশস্য আমদানি অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। প্রতি টনে পাচ ডলার ভর্তুকি দিয়ে বাংলাদেশকে এ পরিমাণ খাদ্যশস্য সাপ্লাই করার কথা ছিল ইন্ডিয়ার।
ক্স ইন্ডিয়ার ঋণের টাকা খরচ হবে ইন্ডিয়ারই প্রকল্পে। প্রকল্পের চুড়ান্ত অনুমোদন নিতে হবে ইন্ডিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে। ৮৫% পন্য ও সেবা কিনতে হবে ইন্ডিয়া থেকে। বাকি ১৫% কিনতে হবে ইন্ডিয়ার পরামর্শে। ইট-বালুও ইন্ডিয়া থেকে আনতে হবে।
ইন্ডিয়ার ঋণে রেলের ১৫০টি যাত্রীবাহী বগি কেনা হবে।
ক্স টেলিকম সেক্টরে ইন্ডিয়ান কম্পানি জোরালোভাবে এসেছে। বাংলাদেশের তৃতীয় বৃহত্তম মোবাইল ফোন অপারেটর একটেল-এর ৭০% মালিকানা কিনে নেয় ইন্ডিয়ান কম্পানি আজিয়াটা। একটেলের নতুন নাম হয় রবি। বিশাল মিডিয়া ক্যামপেইনে নেমে পড়ে রবি। এরপর ওয়ারিদ টেলিকমের ৭০% মালিকানা কিনে নেয় ভারতীয় এয়ারটেল মাত্র এক লক্ষ আমেরিকান ডলারে। আরেক দফা মিডিয়া ক্যামপেইন হয়। এয়ারটেল বিভিন্ন সংবাদপত্রে ঢাউশ বিজ্ঞাপন দিলেও দৈনিক আমার দেশ অবহেলিত হয়। অথচ আমার দেশের সম্পাদক, বর্তমানে জেলবন্দি, মাহমুদুর রহমানই ওয়ারিদ টেলিকমকে বাংলাদেশে পূজি বিনিয়োগে উৎসাহিত করেছিলেন। এয়ারটেলের সেøাগান ভালোবাসার টানে, পাশে আনে হলেও তারা আমার দেশকে দুরে রেখেছে। এর কারণে বোধহয় দৈনিক আমার দেশ এয়ারটেলের টেকওভারের সমালোচনা করে পরপর কয়েকটি রিপোর্ট করেছিল। এসব ইন্ডিয়ান টেকওভারে বেশ কিছু ঊর্ধতন কর্মকর্তা চাকরি হারাতে পারেন বলে আশংকা প্রকাশিত হয়। আশা করি এ বিষয়ে টেলিযোগাযোগমন্ত্রী রাজিউদ্দিন আহম্মেদ রাজু উচিত পদক্ষেপ নেবেন।
ক্স উত্তর-পূর্ব ইন্ডিয়ার বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন ইউনাইটেড লিবারেশন ফ্রন্ট অফ আসাম (উলফা)-এর ১৯ নেতাকে বাংলাদেশ থেকে ইন্ডিয়ার কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে।
ক্স অধিকার ও হিউম্যান রাইটস ওয়াচ-এর টৃগার হ্যাপি: একসেসিভ ইউজ অফ ফোর্স বাই ইন্ডিয়ান ট্রুপস অ্যাট দি বাংলাদেশ বর্ডার (বন্দুক চালাতে খুশি: বাংলাদেশ সীমান্তে ইন্ডিয়ান সৈন্যদের অতিরিক্ত শক্তি প্রয়োগ) শীর্ষক ৮১ পৃষ্ঠার রিপোর্টে জানানো হয় গত এক দশকে বিএসএফ নয় শতাধিক বাংলাদেশীকে হত্যা করেছে।
ক্স টিপাইমুখ ও সুবনশিরিসহ ইন্ডিয়ার উত্তর-পূর্বাঞ্চলে নির্মীয়মান বৃহৎ নদী বাধ প্রকল্প বরাক-ব্রহ্মপুত্র উপত্যকা ও বাংলাদেশের জন্য হিরোশিমা-নাগাসাকি ধ্বংসকারী আণবিক বোমার সমান এক জলবোমা বলে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন ইন্ডিয়ার পানি বিশেষজ্ঞ, পরিবেশ বিজ্ঞানী, প্রকৌশলী এবং সমাজকর্মীরা।
ক্স ২২ ডিসেম্বরে জানা যায় ইন্ডিয়াতে ছাপা বিনা মূল্যের পাঠ্যবইয়ের অর্ধেকও আসেনি।
ক্স ২০১১তে বাংলাদেশ ও ইন্ডিয়া যৌথভাবে পালন করবে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মের দেড়শত বর্ষ। এ জন্য দুই দেশের প্রতিনিধিরা যৌথ বৈঠক করে একটি অনুষ্ঠানসূচি চূড়ান্ত করেছেন। এর মধ্যে যে মাসে ঢাকা ও দিল্লিতে অনুষ্ঠান আয়োজনে দুই দেশের রাষ্ট্রপতি অথবা প্রধানমন্ত্রী একত্রে হবেন।
দুই দেশের শীর্ষপর্যায়ের বৈঠকে অনুষ্ঠানসুচি চুড়ান্ত করতে ১৯ ডিসেম্বর ইন্ডিযার ৯ সদস্যের প্রতিনিধি দল ঢাকায় আসে।
ক্স বাংলাদেশ ও পশ্চিম বঙ্গের যৌথ উদ্যোগে কক্সবাজারে তৈরি হবে চার একর জুড়ে দেশের বৃহত্তম বিনোদন উদ্যান নিক্কো পার্ক।
ক্স ইন্ডিয়ান মুভি আমদানির ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়ার সংবাদ প্রকাশের পর বাংলাদেশের চলচ্চিত্র শিল্পী ও কুশলীরা আন্দোলনের ডাক দেয়। সরকার পিছু হটে যায়।
ক্স ইন্ডিয়াতে টেলিকমিউনিকেশন সেক্টরে বিশাল দুর্নীতি, মানব অধিকার কর্মী বিনায়ক সেনের যাবজ্জীবন শাস্তি এবং টাইম ম্যাগাজিনের রিপোর্ট (গোটা ইন্ডিয়ার প্রায় এক-তৃতীয়াংশে মাওবাদীদের তৎপরতা চলছে) বাংলাদেশকে, যথাক্রমে, কৌতুহলী, সচকিত ও উদ্বিগ্ন করেছে।
ক্স আমেরিকার ইয়েল ইউনিভার্সিটির ছাত্রী ইন্ডিয়া-বাংলাদেশ বর্ডার দেখে অবাক হয়েছেন। তার চোখে সীমান্তে কাটাতারের বেড়া হলো দি গ্রেট ওয়াল অফ ইন্ডিয়া। এই মহাপ্রাচীর ভবিষ্যতে কি প্রভাব ফেলতে পারে সেটা বিশ্লেষন করে অনলাইন ম্যাগাজিন গ্লেট-এ তিনি লিখেছেন।
ট্রানজিট চুক্তির অস্পষ্টতা নিয়ে বছর জুড়ে বিশিষ্টজনরা উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। এভিবির হিসাবে বলা হয়েছিল ট্রানজিটে বছরে রাজস্ব আসবে ১৮০০ কোটি টাকা। বিআইডিএসের হিসাবে বলা হয় ৪০০ কোটি টাকা। খবর প্রকাশিত হয় ১. ইন্ডিয়ার কাছ থেকে ট্রানজিট ফি আদায় আপাতত স্থগিত থাকছে। ২. বিনা মাশুল পন্য পরিবহনে ইন্ডিয়ার সাথে চুক্তি স্বাক্ষর হয়েছে। ৩. আশুগঞ্জ বন্দর দ্রুত আধুনিকায়নের তাগিদ দিয়েছে ইন্ডিয়া।
ক্স কুনমিং সড়কে ইন্ডিয়াকে সংযুক্ত করার প্রস্তাব দিয়েছে বাংলাদেশ।
ক্স উত্তর-পূর্ব ইন্ডিয়াকে সংযুক্ত করতে বাংলাদেশ হয়ে নতুন সিল্ক রুট নির্মানের উদ্যোগ নিয়েছে ইন্ডিয়া।
ক্স ইমিগ্রেশন জটিলতায় প্রত্যাশিত সাড়া পায়নি মৈত্রী এক্সপ্রেস। গত বছর জানানো হয়েছে এখন থেকে মৈত্রী এক্সপ্রেসের ভেতরেই লাগেজ চেকিং হবে।
ওপরের এসব সংবাদ শিরোনাম থেকে যা বোঝা যায় তা হলো ১. ইন্ডিয়ান ব্যবসায়ীরা বিশেষত টেলিকম কম্পানিতে জেকে বসেছে বাংলাদেশে। ২. কাটাতারের মহাপ্রাচীরে বন্দী থাকবে বাংলাদেশের নাগরিক ৩. কিন্তু বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে অবাধে চলাচল করবে ইন্ডিয়ান পণ্য এবং ৪. ইন্ডিয়ান মনমানসিকতার পরিবর্তন না হলে উভয় দেশের মধ্যে যাত্রী চলাচল বাড়বে না।
সহিংসতা, লটারি ও বিতর্কিত শিক্ষানীতি
বছর জুড়ে চাদাবাজি, টেন্ডারবাজি, ভর্তি বাণিজ্য ও আধিপত্য বিস্তার নিয়ে ছাত্রলীগের কারণে বহু সন্ত্রাসী ঘটনা ঘটেছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে। ঢাকা ইউনিভার্সিটির মেধাবী ছাত্র আবু বকর সিদ্দিকসহ নিহত হয়েছে কিছু ছাত্র। আহত হয়েছে অনেকে। দা-কিরিচ হাতে ছাত্ররা কুপিয়ে মারছে প্রতিপক্ষকে এমন ছবি কয়েকবার প্রকাশিত হয়েছে। ইডেনে ছাত্রীদের দিয়ে দেহ ব্যবসা করানোর অভিযোগ ওঠে। তাদের আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগ নেতাদের নিয়ে যাওয়ার অভিযোগের পর প্রতিবাদে ইডেনে তুমুল সংঘর্ষ হয়।
ক্লাস ওয়ানে ভর্তি হবার জন্য ডিসেম্বরে ভিকারুন নিসা স্কুলসহ বিভিন্ন সরকারি স্কুলে লটারি পদ্ধতি চালু হয়। সরকারের এই সিদ্ধান্তের তীব্র সমালোচনা করেন শিক্ষাবিদরা। কিন্তু সরকারি প্রভাবে মিডিয়ার একাংশ লটারি ড্রয়ের প্রশংসা করে। যদি লাইগ্যা যায়-এর দেশ বাংলাদেশে ছাত্রছাত্রীরা এখন শিক্ষা জীবনের গোড়া থেকেই ভাগ্যবাদী হতে বাধ্য হবে। তারা পড়াশোনা করে প্রস্তুত হয়ে এবং মেধাবী হওয়া সত্ত্বেও জীবনের শুরুতেই ভাগ্যের কাছে পরাজিত হয়ে অনাকাংঙ্খিত স্কুলে ভর্তি হবে। ক্লাস ওয়ানে লটারি পদ্ধতিতে ভর্তি হওয়া বাংলাদেশের শিক্ষার মান বিশালভাবে কমে যাওয়ার সূচনা করেছে।
৭ ডিসেম্বরে জাতীয় শিক্ষানীতি সংসদে পাস হওয়া ছিল আরেকটি বিতর্কিত ঘটনা। সরকার বলেছে, এটি সর্বজনীন একটি শিক্ষানীতি। দলীয় মতের ঊর্ধ্বে উঠে এ শিক্ষানীতি প্রণয়ন করা হয়েছে। তবে একটি অংশ এ শিক্ষানীতিকে পক্ষপাতিত্ব ও ধর্মবিরোধী শিক্ষানীতি বলেছে। শিক্ষানীতি সংশোধনের দাবিতে ইসলামিক মতাদর্শে বিশ্বাসী কয়েকটি দল হরতাল ডেকেছিল।
উইকিলিক্স জানিয়েছে মাদ্রাসার পাঠক্রম পরিবর্তনে সক্রিয় ছিল বৃটেন ও আমেরিকা। গত বছরে ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে দশটি বিষয়ে মাদাসা শিক্ষার্থীরা ভর্তি হতে পারেননি। এসব বিষয় ব্যাপকভাবে আলোচিত হওযায় মাদ্রাসায় পড়তে আগ্রহী ছাত্রছাত্রীরা হয়তো বুঝেছেন ভবিষ্যতে ভালো চাকরি পেতে হলে ভালো ইংরেজি জানতে হবে এবং সেজন্য যেসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বাংলা ও ইংরেজি ভাষায় বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হয় সেখানেই ভর্তি হতে হবে।
২০১০-এ শিক্ষা ব্যবস্থায় একটা নতুন ধারা এসেছে। ক্লাস এইটের অধীনে জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট (জেএসসি) ও জুনিয়র দাখিল সার্টিফিকেট (জেডিসি) পরীক্ষা। সারা দেশে অভিন্ন প্রশ্নপত্রে ৪ নভেম্বর থেকে ২২ নভেম্বর পর্যন্ত পরীক্ষা চলে। ৩১ ডিসেম্বরে সব বোর্ডের রেজাল্ট একযোগে প্রকাশিত হয়। পাস করা ছাত্রছাত্রীরা নিজ নিজ বোর্ডের সনদপত্র পাবে।
আগস্টে বিনা নোটিশে টেলিভিশনে এক ঘোষনার মাধ্যমে ঢাকার স্কুলের সময়সূচী বদলে দেয়া হয়। পরে অভিভাবক ও শিক্ষকদের প্রতিবাদের মুখে সরকার পিছু সরে যায়। স্কুলে পুরনো সময়সূচী আবার বহাল হয়। প্রসঙ্গত মনে করা যেতে পারে ২০১০-এ ডে-লাইট সেভিং টাইম সরকার আর ফিরিয়ে আনেনি। এ বিষয়ে সরকার একেবারেই চুপ মেরে যায়।
দেশে প্রাইভেট ইউনিভার্সিটির অনিয়ন্ত্রিত প্রসার রোধ করতে চেয়েছেন শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ। তিনি জানিয়েছেন, কিছু প্রাইভেট ইউনিভার্সিটি তাদের প্রতিষ্ঠার শর্ত মানছে না। নিয়ম অনুযায়ী ইউনিভার্সিটি প্রতিষ্ঠার পাচ বছরের মধ্যে স্থায়ী ক্যাম্পাসে যেতে হবে। ডিসেম্বরে শিক্ষামন্ত্রী বলেন, দেশের ৫৪টি প্রাইভেট ইউনিভার্সিটির মধ্যে ৪৩টিরই স্থায়ী ক্যাম্পাস নেই। নিয়ম ভঙ্গকারী ইউনিভার্সিটিগুলো আগামী সেপ্টেম্বর থেকে নতুন করে আর ছাত্র ভর্তি করতে পারবে না। নির্দিষ্ট সময়ে স্থায়ী ক্যাম্পাসে যেতে ব্যর্থ ইউনিভার্সিটিগুলো বন্ধ করে দেয়া হবে।
শিক্ষামন্ত্রী তার এই সাহসী বক্তব্যের জন্য প্রশংসা পেয়েছেন। তবে শিক্ষা বাণিজ্যে উৎসাহীদের সত্যিই তিনি উৎখাত করতে পারবেন কিনা সে বিষয়ে গভীর সন্দেহ আছে। ইতিমধ্যে তার এই কথার পরপরই পত্রিকায় ভুমি ব্যবসায়ীরা ঢাকা শহরের আশপাশের ভুমি বিক্রির ছবিসহ বিজ্ঞাপন দিয়েছেন। অন্যদিকে কমপক্ষে আরো ত্রিশটি প্রাইভেট ইউনিভার্সিটি প্রতিষ্ঠার অনুমতি চাওয়া হয়েছে।
প্রবলেম?
নো চিন্তা, ডু লটারি।
যারা ইউনিভার্সিটি প্রতিষ্ঠা করতে চাইছেন তাদের মধ্যে লটারি করুন এবং স্থায়ী ক্যাম্পাসের জমি লটারির মাধ্যমে বিক্রি করতে ভূমি ব্যবসায়ীদের নির্দেশ দিন।
বছরের শেষ মাসে ইউনিভার্সিটির মর্যাদা হানি হয়েছে চুরির কারণে। সিনেট ভবনে অংশ নিতে আসা আমেরিকার একটি ইউনিভার্সিটির দুইজন প্রফেসরের ব্যাগ চুরি হয়েছে। এই দুটি ব্যাগে প্রফেসরদের দুই হাজর ডলার, ছয়শ থাই বাথ, এক হাজার টাকা, ক্যামেরা, ড্রাইভিং লাইসেন্স ও পাসপোর্ট ছিল।
রেকমন্ডেশন: এত ছাত্র যখন সন্ত্রাসী ও চুরির পথ ধরেছে তখন সন্ত্রাস ও চুরি বিশ্ববিদ্যালয় (University of Violence and Theft) প্রতিষ্ঠার অনুমতি দেয়া যেতে পারে কোনো শিক্ষা ব্যবসায়ীকে।
মুক্ত গণমাধ্যম সূচকে অধোগতি
গত বছরের শুরুতে বসুন্ধরা গ্রুপ প্রায় একযোগে প্রকাশ করে দুটি বাংলা দৈনিক পত্রিকা। একটির আট টাকা দামে ৩২ পৃষ্ঠার প্লাস সাপ্লিমেন্ট ও ম্যাগাজিন এবং আরেকটি তিন টাকা দামে ১২ পৃষ্ঠা কিন্তু নো ম্যাগাজিন। প্রথমটির নাম কালের কন্ঠ এবং দ্বিতীয়টির নাম বাংলাদেশ প্রতিদিন।
প্রকাশের পর থেকেই পত্রিকা দুটি ট্রান্সকম গ্রুপের মালিকানাধীন দুই দৈনিক প্রথম আলো (বাংলা) এবং স্টার (ইংরেজি)-এর বিরুদ্ধে, বিশেষত প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমানের বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করে। উল্লেখ্য, মতিউর রহমান ও স্টার সম্পাদক মাহফুজ আনামকে গন্য করা হয় ওয়ান ইলেভেন ঘটনার অন্যতম স্রষ্টা রূপে। এই ওয়ান-ইলেভেন ঘটনায় গভীর বিপাকে পড়েছিল বসুন্ধরা গ্রুপ।
জেহাদ ঘোষনার কদিন পরেই ঢাকা তথা সারা বাংলাদেশ মতিউর রহমান এবং ট্রান্সকম মালিক লতিফুর রহমানের ফাসির দাবিতে তাদের রঙিন ছবিসহ পোস্টার ছেয়ে যায়। কিছু পোস্টারে মতিউর রহমানের চোখ কানা করে দেয়া হয়। ব্যবসায়িক ডিফেন্স মেকানিজম এবং আর্টিস্টিক (?) প্রতিভার সম্মিলন ঘটে এই দুই গ্রুপের অশালীন পাবলিক লড়াইয়ে। প্রথম আলো এবং স্টার উত্তর দেয় তাদের লেখায়। ঘটনা আদালত পর্যন্ত গড়ায়। আপাতত মনে হচ্ছে তাদের ম্যাচ ড্র হয়েছে অথবা পরিত্যক্ত হয়েছে। তবে সার্কুলেশনের ক্ষেত্রে বসুন্ধরা গ্রুপ দাবি করতে পারে যে তারা বিজয়ী হয়েছে। প্রকাশের নয় মাস পরে ডিসেম্বরে বাংলাদেশ প্রতিদিন দেশের সর্বোচ্চ সার্কুলেটেড পত্রিকা (প্রিন্ট অর্ডার সোয়া চার লক্ষ) হলে ভদ্র ও বিনয়ী ভাষায় তাদের এই কৃতিত্ব ঘোষনা করে। তাদের দাবি সত্য এবং কৃতিত্ব প্রশংসনীয়। কংগ্রাচুলেশন্স সম্পাদক শাহজাহান সরকারকে।
মজার কথা এই যে বাংলাদেশ প্রতিদিন সার্কুলেশনের লোয়ার এন্ড মার্কেট ধরার জন্য কম পৃষ্ঠা ও কম দামের হলেও পত্রিকাটির মেকআপ গেটআপ হয়েছে আপার এন্ড মার্কেটের মতো। ইন ফ্যাক্ট, আপার এন্ড মার্কেট ধরার লক্ষ্যে প্রকাশিত বেশি পৃষ্ঠার ও বেশি দামের কালের কন্ঠকে তারা ফ্রন্ট ও ব্যাক পেজ মেকআপে হারিয়ে দিয়েছে। ফলে বাংলাদেশ প্রতিদিন, লোয়ার এন্ড মার্কেটের আমাদের সময়, ভোরের ডাক প্রভৃতির সার্কুলেশন যেমন খেয়েছে, তেমনি আপার এন্ড মার্কেটের প্রথম আলো, সমকাল এবং নিজেদেরই সহযোগী কালের কন্ঠ-র সার্কুলেশনও খেয়েছে।
তাই আমাদের সময় পত্রিকার মালিকানা বদল সংক্রান্ত খবর শোনা গেছে। তবে বছরের শেষে এসে মনে হয়েছে আমাদের সময় তাদের প্রাথমিক বিপর্যয় কাটিয়ে উঠেছে।
বছরের শেষ দিকে বেক্সিমকো গ্রুপের সালমান রহমানের নাম শোনা গেছে মিডিয়ার বিভিন্ন দিকে তার সক্রিয় অবস্থানের কারণে। দৈনিক দি ইনডিডেনডেন্ট নতুন চেহারায় প্রকাশিত হয়েছে। একটি নতুন নিউজ টিভি চ্যানেল প্রতিষ্ঠায় সালমান জড়িত আছেন বলে শোনা গেছে। বস্তুত ২০১০-এ সবচেয়ে বেশি উদ্যমী এন্টারপ্রেনিউয়ার হিসেবে তারই নাম শোনা গেছে। জিএমজি এয়ারলাইন্স, স্কলাসটিকা স্কুল, ওয়েস্টিন হোটেল, আর্টিজান সিরামিক্স, প্রভৃতি ক্যাশ ক্রাইসিসে পড়ে যাওয়া প্রতিষ্ঠানগুলোর মালিকানার পুরো অথবা আংশিক চলে গেছে সালমান রহমানের কাছে, এমন গুজব বছর ধরে চালু ছিল। প্রশ্ন ছিল যদি গুজব সত্যি হয়ে থাকে তাহলে সালমান রহমান নিজে এত ক্যাশ পেলেন কোথা থেকে?
বাংলাদেশ পতিদিনের সাফল্যের পর বসুন্ধরা গ্রুপের কর্ণধার শাহ আলম আরেক ধাপ এগিযে এসেছেন। ইংরেজি দৈনিক সান প্রকাশিত হয়েছে প্রফেসর আনোয়ার হোসেনের সম্পাদনায়। তবে সান ও ইনডিপেনডেন্টের মাস্টহেড প্রায একই ফন্টের হওয়ায় বিভ্রান্তি হয়েছে।
গত বছরে দৈনিক ইত্তেফাকের মালিকানা হারিয়েছেন ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন।
টেলিভিশনের ক্ষেত্রে নতুনভাবে লঞ্চ করা হয়েছে বৈশাখী-কে যার দায়িত্ব নিয়েছেন প্রখ্যাত সাংবাদিক মনজুরুল আহসান বুলবুল যিনি এটিএন বাংলা’র সংবাদ পরিবেশনাকে সবচেয়ে বেশি গ্রহণযোগ্য করাতে পেরেছিলেন। এটিএন কর্তৃপক্ষ রিপোর্টার মুন্নী সাহাকে দিয়ে এটিএন নিউজ চ্যানের শুরু করেছে। তবে এই চ্যানেলের মান সাকা চৌধুরীর সিএসবি’র মতো হয়নি। সেনা-সমর্থিত সরকারের সময়ে সিএসবি বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। গত বছরে সরকারি নির্দেশে বন্ধ হয়ে যায় চ্যানেল ওয়ান যার সঙ্গে তারেক রহমানের নাম সম্পৃক্ত ছিল।
গত বছরে বাংলাভিশন চালু করেছে বিটিভিতে বন্ধ হয়ে যাওযা জনপ্রিয় অনুষ্ঠান লাল গোলাপ। অন্যদিকে দিগন্ত টেলিভিশনে লাইভ টক শো বন্ধ হয়ে গিয়েছে। টেলিভিশন থেকে অদৃশ্য হয়েছে বিএনপি ঘরানার দুজন জনপ্রিয় উপস্থাপক ড. রেজোয়ান সিদ্দিকী ও কাজি জিসান।
গত বছরে শুরু হয়েছে মাই টিভি ও মোহনা নামে দুটি চ্যানেল। এ দুটি চ্যানেল কোনো দাগ কাটতে পারেনি।
টিভিতে বিজ্ঞাপনের উৎপাত আরো বেড়েছে গত বছরে। বিদেশী মালিকানাধীন গ্রামীন ফোন ও বাংলালিংক বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে দেশবাসীকে শেখাতে চেয়েছে দেশপ্রেম। ইন্ডিয়ান রবি চ্যানেল ব্যক্তিকে শেখাতে চেয়েছে আত্মবিশ্বাস। আর নবাগত ইন্ডিয়ান এয়ারটেল শেখাতে এসেছে ভালোবাসা।
এয়ারটেল কর্তৃপক্ষ জেনে রাখুন, ইন্ডিয়ার বেশ আগেই আমি ১৯৯৩-এ এই উপমহাদেশে সর্বপ্রথম ভালোবাসা দিনের ঘোষক হয়েছিলাম। এ বিসয়ে প্রধান বিচারপতি খায়রুল হকও দ্বিমত প্রকাশ করবেন না আশা করি। সুতরাং, প্লিজ এয়ারটেল, চুটিয়ে বিজনেস করুন, কিন্তু, ভালোবাসা দিনের ঘোষক রূপে নিজেদের কখনোই দাবি করবেন না।
অক্টোবরে জানা যায় আন্তর্জাতিক সংস্থা রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারের মুক্ত গণমাধ্যম সূচকে পাচ ধাপ অবনতি ঘটেছে বাংলাদেশের। প্রকাশিত চলতি বছরের সূচকে বাংলাদেশকে দেখানো হয়েছে ১২৬তম অবস্থানে। ১৭৮টি দেশের এ তালিকায় ২০০৯-এ বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১২১ নাম্বারে।
গত বছরে বাংলাদেশে মিডিয়ার সবচেয়ে বড় ঘটনা ছিল আমার দেশ সম্পাদক মাহমুদুর রহমান ও রিপোর্টার অলিউল্লাহ নোমানকে আদালত অবমাননার দায়ে জেলদন্ড দেয়া এবং পত্রিকাটি সাময়িকভাবে বন্ধ করে দেয়া। অলিউল্লাহ মুক্তি পেয়েছেন। কিন্তু মাহমুদুর রহমানকে আরো কতদিন, মাস বা বছর জেলে থাকতে হবে সেটা স্পষ্ট হয়নি। জানা গেছে তার মনোবল শক্ত আছে এবং তিনি জেলে আইন বিষয়ে পড়াশোনা করছেন।
আওয়ামী লীগের নির্বাচন ভীতি
ত জুনে চট্টগ্রাম মেয়র নির্বাচনে বিএনপি ও জামায়াত সমর্থিত প্রার্থী এম মনজুর আলমের কাছে আওয়ামীলীগ সমর্থিত প্রার্থী এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরীর প্রায় এক লক্ষ ভোটে হেরে যাবার পর থেকে আওয়ামীলীগ ইলেকশনফোবিয়া-তে ভুগেছে। ঢাকার মেয়র নির্বাচন স্থগিত হয়ে গেছে। ঢাকা সিটিকে দুই, এমনকি চার ভাগে বিভক্ত করার চিন্তাভাবনা হয়েছে।
আওয়ামী লীগ টের পেয়েছে নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি পূরণ না করতে পারলে সামনে তাদের জন্য চট্টগ্রামের মতোই বড় বিপর্যয় অপেক্ষা করছে। উচ্ছৃংখল, অসংযমী ও সহিংস ছাত্রলীগ বাড়িয়েছে দলের সমস্যা।
তাই আওয়ামী সরকার যুদ্ধ অপরাধীদের বিচার ইসু তুলে দেশবাসীর নজর অন্য দিকে ফেরানোর চেষ্টা করেছে। গ্রেফতার, রিমান্ড, টর্চার, মামলা প্রভৃতির ভয় দেখিয়েছে প্রতিপক্ষকে। বিএনপি দেশের যেখানে যখন জনসভা ডেকেছে প্রায় সেখানেই সরকার ১৪৪ ধারা জারী করেছে অথবা একই দিনে আওয়ামী লীগ পাল্টা মিটিং ডেকেছে। ভোলার উপনির্বাচনে আওয়ামী লীগ প্রায় বিজয়ী হলেও নতুন এমপি শাওনের কুর্কীতিতে চমবিক হয়েছেন অনেকে, বিশেষত ডিপ্লম্যাটরা।
প্রধান বিরোধী নেত্রী খালেদা জিয়াকে তার প্রায় চল্লিশ বছরের বাসস্থান থেকে উচ্ছেদ করার পর শেখ হাসিনা বিএনপির সঙ্গে সমঝোতার দরজা সিলগালা করে দিয়েছেন। এর আগে জামায়াতের শীর্ষ নেতাদের গ্রেফতার করার ফলে অতীতের মতো জামায়াতের সঙ্গে শেখ হাসিনার সমঝোতার পথ বন্ধ হয়ে গিয়েছে।
দেশ এখন দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে গিয়েছে। অতীতের মুসলিম-হিন্দু এবং বাঙালি-অবাঙালির মতোই এখন বাংলাদেশ বিএনপি ও তার সমর্থক এবং আওয়ামী লীগ ও তার সমর্থকে বিভক্ত হয়ে গিয়েছে। মুসলিম-হিন্দু বিভক্তির পরিণতি হয়েছিল রক্তাক্ত সংঘর্ষ। বাঙালি-অবাঙালির বিভক্তির পরিণত হয়েছিল রক্তাক্ত যুদ্ধ। এবার কি হবে সেই আশংকায় ভুগেছে বাংলাদেশের মানুষ।
শেখ হাসিনা স্বয়ং বারবার এই ধরনের অনিশ্চিত সংঘাতময় সম্ভাব্য পরিস্থিতির উল্লেখ করে দেশবাসীকে প্রস্তুত ও সতর্ক থাকার হুশিয়ারি দিয়েছেন। বছরের দ্বিতীয়ার্ধে নাশকতার আতংকে থেকেছে সরকার।
শেখ হাসিনা যদি রাজনৈতিক মঞ্চ থেকে সরে যান বা বিদায় নেন তাহলে কে আওয়ামী লীগের হাল ধরবেন? কেউ কেউ মনে করেন সেই ব্যক্তিটি হতে পারেন মতিয়া চৌধুরী যিনি কৃষিমন্ত্রী রূপে গত মেয়াদে এবং এবারও প্রভূত সাফল্যের পরিচয় দিয়েছেন। চাষীদের কাছে সার, ডিজেল ও বিদ্যুৎ পৌছে দেয়ার সুব্যবস্থা করেছেন। গত বছরের শেষে কৃষিক্ষেত্রে আওযামীলীগ সরকারের এই দৃঢ় অবস্থানটিই ছিল তাদের প্রধান শক্তি।
বিএনপির ঘুরে দাড়ানোর বছর
ওযান-ইলেভেনের পরে সেনাসমর্থিত সরকারের প্রধান টার্গেট ছিল বিএনপি। সিনিয়র জয়েন্ট সেক্রেটারি তারেক রহমান থেকে শুরু করে বহু প্রবীন ও নবীন নেতা হয়েছিলেন গ্রেফতার ও নির্যাতিত। তাদের বিরুদ্ধে দেয়া হয়েছিল বহু মামলা যেগুলোর অধিকাংশ তাদের মাথায় এখনো ঝুলছে। ইতিমধ্যে আওয়ামী লীগের বিভিন্ন নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে দাযের করা ৬,৩৯২-টি মামলা আওয়ামী সরকার প্রত্যাহার করেছে। বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে দায়ের করা মাত্র দুটি মামলা সরকার প্রত্যাহার করেছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন বলেছেন, পক্ষপাতিত্বের প্রশ্নই আসে না।
তারপরেও ২০১০-এ বিএনপি ঘুরে দাড়িয়েছে। নতুন স্ট্যান্ডিং কমিটি গঠিত হয়েছে। চট্টগ্রাম শহরে বিএনপি সমর্থিত প্রার্থী মনজুর বিপুল ভোটে নির্বাচিত হয়েছেন। বছরের শেষ দিকে বিএনপি আহূত সারা দেশে তিনটি হরতাল সফল হয়েছে। কিন্তু নভেম্বরে নেত্রী খালেদা জিয়াকে তার বাসস্থান থেকে উচ্ছেদ এবং স্ট্যান্ডিং কমিটি সদস্য সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে গ্রেফতার করার ফলে বিএনপির অগ্রগতি কিছু সময়ের জন্য ব্যাহত হয়েছে।
তবে বিএনপিতে নতুন নেতা রূপে আবির্ভুত সিনিয়র জয়েন্ট সেক্রেটারি মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ভোটারদের ইমপ্রেস করেছেন, বিশেষত টিভিতে জড়তাবিহীন শুদ্ধ বাংলায় তেজস্বী বক্তৃতা দিয়ে। দলের সেক্রেটারি জেনারেল প্রবীন নেতা খোন্দকার দেলোয়ার হোসেনও বছরের শেষ দিকে তার টিভি ইমেজ কিছুটা প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছেন আবেগী কিন্তু যুক্তিসঙ্গত ভাষা প্রয়োগে।
দলীয় স্বার্থ বিরোধী অসংযত ভাষা প্রয়োগের কারণে বিএনপি থেকে ব্যারিষ্টার নাজমুল হুদা গত বছরে পদচ্রুত হলেও তিনি সেটা মেনে নেননি।
আর ঢাকার মেয়র খোকা সারা বছরই ঢাকা মহানগর কমিটি পুনর্গঠন বিষয়ে নেত্রীর সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় ঝুলে থেকেছেন। মেয়র পদেও তিনি ঝুলে আছেন ঢাকা সিটি কর্পরেশনের নির্বাচন কবে হবে সেই ঘোষনার অপেক্ষায়।
জামায়াত নির্যাতিত
১৯৯৬-এ আওয়ামী লীগের সহযাত্রী জামায়াত ইসলাম ২০১০-এ আওয়ামী সরকার দ্বারা নির্যাতিত হযেছে। তাদের পার্টির শীর্ষ নেতাদের গ্রেফতার করা হয়েছে। নেতারা যে কবে মুক্তি পাবেন সেটা অনিশ্চিত। জামায়াত কর্মীদের ওপরও প্রচন্ড চাপ রেখেছে সরকার। তাই ২০১০-এ জামায়াত প্রায় নিস্ক্রিয় হয়ে গিয়েছে।
বাড়ি থেকে উচ্ছেদ ও চরিত্র হনন
নি:সন্দেহে বিদায়ী বছরের সবচেয়ে বড় ঘটনাটি খালেদা জিয়া ও তার পরিবারের কাছে ছিল অকল্পনীয়, তার পার্টি বিএনপির কাছে ছিল অভাবনীয় এবং দেশবাসীর কাছে ছিল অপ্রত্যাশিত। তা সত্ত্বেও ১৩ নভেম্বরে আদালতে একটি শুনানির অপেক্ষায় থাকার সময়ে অচিমকা সরকারি নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা ৬ মইনুল রোডে খালেদা জিয়ার প্রায় ৪০ বছরের বসবাসের বাড়িতে সকালে হানা দিয়ে, সামনের দরজা ভেঙ্গে, বাড়িতে ঢোকে। তাকে সেদিনই বেলা সাড়ে তিনটায় উচ্ছেদ করে। বিধ্বস্ত অবস্থায় কিছুটা আলুথালু বেশে খালেদা আসেন তার গুলশানের অফিসে। যদিও সেনাবাহিনীর জনসংযোগ বিভাগ আইএসপিআর এবং অন্যান্য সরকারি মুখপাত্র টিভিতে সম্পূর্ণ মিথ্যা কথা বলতে থাকেন। তারা বলেন, খালেদা স্বেচ্ছায় তার বাড়ি ছেড়ে গিয়েছেন।
অন্যদিকে পুরানা পল্টনে বিএনপি অফিস থেকে খোন্দকার দেলোয়ার হোসেন টিভিতে বলেন, বেগম খালেদা জিয়াকে জোর করে বাড়ি থেকে বের করা হয়েছে। বিকেল পাচটায় তিনি জানান এর প্রতিবাদে পরদিন সকাল-সন্ধ্যা হরতাল ডাকা হয়েছে।
দেশের মানুষ সংশয়ে পড়ে যায়। কে মিথ্যা বলছে? সরকার? নাকি বিএনপির সেক্রেটারি জেনারেল?
এই সংশয় নিরসনের জন্য বিএনপি নেত্রী রাত আটটার দিকে তার অফিসে প্রেস কনফারেন্সে প্রকৃত সত্যটা সংক্ষিপ্তভাবে বলেন। এক পর্যায়ে তিনি ভেঙ্গে পড়েন এবং তার চোখে পানি দেখা যায়। তবে, তিনি ভেঙ্গে পড়েন গৃহচ্যুত হবার জন্য নয়- অপমানিত ও লাঞ্ছিত হবার জন্য। তাই তার লাঞ্ছনার কথা বলতে গিয়ে তিনি কেদে ফেলেন। এই নিয়ে বাংলাদেশের মানুষ তাকে চারবার কাদতে দেখলো- স্বামীর মৃত্যুর পরে, মায়ের মৃত্যুর পরে, তারেক বন্দি অবস্থায় আহত হবার পরে এবং সবশেষে তার গৃহচ্যুতির পরে। প্রমানিত হলো আপসহীন নেত্রী আবেগহীন নন।
কিন্তু রাজনীতি যারা করেন তারা জানেন ইংরেজিতে একটা কথা আছে, রাজনীতি হচ্ছে আপসের একটা আর্ট (Politics is an art of compromise)।
ধারনা করা যেতে পারে স্বামী, পুত্র, পুত্রবধু, নাতনিদের স্মৃতি মন্ডিত বাড়িটি হারানোর পর কোনো কম্প্রোমাইজে, ইচ্ছা করলেও তিনি আর কখনোই যেতে পারবেন না। তার দলই তাকে বাধা দেবে। কারণ এই উচ্ছেদের ঘটনাটি ছিল রাজনৈতিক প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার চরম নির্দর্শন। তাছাড়া এতে খালেদা জিয়ারই শুধু নয়, প্রয়াত জিয়াউর রহমানের প্রতি অশ্রদ্ধা প্রকাশ করা হয়েছে। তার মানে দাড়ায় ১৯৮১-তে নিহত রাষ্ট্রপতিকে যারা শেষ সম্মান জানিয়েছিলেন, তাদেরও সবাইকে অসম্মান করা হয়েছে।
কিন্তু সরকারি অশ্লীলতা সেখানেই থেমে থাকেনি। সরকারি কর্মকর্তারা ফ্রিজটিজিংয়ের আশ্রয় নেন। তারা খালেদার বেডরুমের পাশে ছোট একটা ফ্রিজে রাখা দুই বোতল ওয়াইন এবং সফট ড্রিংকস ক্যানের ছবি টিভিতে দেখান। খালেদার ড্রয়ারের মধ্যে গার্লি ম্যাগাজিনও দেখান। তারপর তারা এটাও প্রচার করেন যে বাসভবন ছেড়ে যাবার আগে দুই ঘন্টা ধরে খালেদা মেকআপ নেন।
তাদের এই প্রপাগান্ডায় ভুল হয়েছিল। প্রতমত ওয়াইনের বোতল সাধারণত রুম টেমপারেচারে রাখতে হয় হরাইজন্টালি বা আড়াআড়িভাবে। কেউ কেউ খাবার আগে হোয়াইট ওয়ইনের বোতল ফ্রিজে স্বল্পক্ষন রেখে চিলড (Chilled) করে নেন। নিয়মিত যারা ওয়াইন খান তারা খাড়াখাড়িভাবে ফ্রিজে ওয়াইনের বোতল রাখেন না। দ্বিতীয়ত, খালেদা কালেভদ্রে শুধু ডায়েট কোক অথবা ডায়েট পেপসি খান। আইএসপিআরের জানা উচিত ছিল খালেদা পেপের জুস খান এবং হার্ড ড্রিংকসের মধ্যে শুধু বিয়ারই ফ্রিজে ঠান্ডা রাখা হয়।
বছরের শেষে রাজধানীর পথে পথে খালেদার বাড়ির বিভিন্ন রুমের ছবির পোস্টার ছাড়া হয়েছে। বিটিভিতে বারবার দেখান হয়েছে তার আসবাবপত্র ইত্যাদি।
এ সবই ছিল চরিত্র হননের নিকৃষ্টতম দৃষ্টান্ত এবং ব্যক্তিগত গোপনীয়তা লুণ্ঠনের অশ্লীলতম উদাহরণ।
নোবেল প্রাইজ ছিনতাই ও চরিত্রহনন
বছরের দ্বিতীয় বড় আলোচিত ঘটনাটি ছিল একই মাস নভেম্বরে গ্রামীন ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনুস সম্পর্কে ঢালাও অপপ্রচার এবং তাকে গ্রামীন ব্যাংক থেকে উচ্ছেদের সরকারি প্রচেষ্টা।
নরওয়ের টেলিভিশনে সম্প্রচারিত একটি টিভি অনুষ্ঠানকে অজুহাত করে আওয়ামী সরকারের প্রত্যক্ষ উস্কানিতে মিডিয়ার বড় অংশ ঝাপিয়ে পড়ে ড. ইউনুসের বিরুদ্ধে। নরওয়ের অনুষ্ঠানে প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছিল দারিদ্র বিমোচনে ক্ষুদ্র ঋণের সাফল্যের দাবি। কিন্তু বাংলাদেশে সেটিকে ঘুরিয়ে ড. ইউনুসের নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তিকেই প্রশ্নবিদ্ধ করা হয়। ছাত্রলীগের কেউ কেউ বলেন ড. ইউনুসের নোবেল প্রাইজ কেড়ে নেয়া হবে।
তারপর?
তারপর সেই ছিনতাই করা নোবেল মেডাল কোথায় রাখা হবে? কাকে দেয়া হবে?
এই প্রশ্নের উত্তরের জন্য বেশি দিন অপেক্ষা করতে হয়নি। ৮ ডিসেম্বরে সংসদে আলোচনায অংশ নিয়ে আওয়ামী লীগের জুনায়েদ আহমেদ পলক বলেন, আগামীতে যেন শেখ হাসিনাকে নোবেল পুরস্কার দেয়ার জন্য মনোনীত করা হয় আমরা সেই প্রত্যাশায় রইলাম। দলের আরেক সদস্য মঞ্জুর কাদের কোরাইশিও বলেন, আমাদের প্রধানমন্ত্রী কবে নোবেল পুরস্কার পাবেন এখন আমরা সেই অপেক্ষায় আছি।
তাই বছরের শেষে মনে হয়েছে ড. ইউনূস ও তার পরিবারের কাছে অকল্পনীয়, গ্রামীন ব্যাংকের কর্মীদের কাছে অভাবনীয় এবং দেশবাসীর কাছে অপ্রত্যাশিত আরেকটি ঘটনা ঘটতে পারে। সত্যিই গ্রামীন ব্যাংক থেকে ড. ইউনূসকে উচ্ছেদ করা হতে পারে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নরওয়ের টিভি অনুষ্ঠান সম্পর্কে তার বক্তব্যে ড. ইউনূসের বিচার করে রায় দিয়েই ফেলেছেন! সুতরাং মন্ত্রীসভার দু’একজন সদস্য প্রথমে ইতস্তত করলেও তারাও (রিটায়ার্ড বিচারপতি এম এ মতিনের ভাষায়) বিড়ালের মতোই থেকেছেন।
তবে ড. ইউনূস নোবেল প্রাইজ হারাবেন না। নরওয়েতে সম্প্রচারিত ওই টিভি অনুষ্ঠান রয়টার্স, এপি, এএফপি, বিবিস, সিএনএন, আলজাজিরা প্রমুখ, পিক করেনি। তারা এ বিষয়টিকে আমলে নেয়নি। কারণ আওয়ামী এমপিরা যেটা জানেন না, সেটা তারা জানেন। অনারারি ডক্টরেট সুলভ হলেও, নোবেল প্রাইজ দুর্লভ। অনেক চিন্তাভাবনা করে এবং খোজ খবর নিয়ে নোবেল প্রাইজ দেয়া হয় যোগ্য ব্যক্তিকে। ড. ইউনূসের বিষয়ে বাংলাদেশে এই ধরনের অসম্মানজনক প্রতিক্রিযা জানার পর নরওয়েতে নোবেল প্রাইজ কর্তৃপক্ষ বলেন, যেহেতু ক্ষুদ্র ঋণের তাত্ত্বিক বিষয়টি বিতর্কিত, সেহেতু তারা সবচাইতে বেশি খোজখবর নিয়ে ড. ইউনূসকে পুরস্কারটি দিয়েছিলেন।
২০১০-এ একটি বহুল আলোচিত ভাষণের শিরোনাম ছিল দেশ আজ বাজিকরদের হাতে। এই ভাষণটি দিয়েছিলেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রধান বিচারপতি হাবিবুর রহমান। এতে তিনি অভিযোগ করেন দেশ আজ চাদাবাজ থেকে শুরু করে টেন্ডারবাজ পর্যন্ত বিভিন্ন বাজিকরদের হাতে পড়ে গিয়েছে। এই ভাষণ প্রচারিত হওয়ার পর হাবিবুর রহমানেরও চরিত্র হনন শুরু হয়। বছরের শেষ মাসে রাজশাহীর জনৈক শিক্ষক মরণোত্তর চরিত্র হননের চেষ্টায় বলেন মাওলানা ভাসানী ছিলেন বিকৃত মস্তিস্ক।
হিংসা এবং হিংসা
অনেকের মতে খালেদা জিয়ার দুর্ভাগ্য যে তার সৌন্দর্য অসাধারণ, ব্যক্তিত্ব গাম্ভীর্যপূর্ণ এবং জনপ্রিয়তা অতুলনীয়। তিনি মোট ছয়টি সাধারণ নির্বাচনে দেশের ২৬টি ভিন্ন আসন থেকে বিপুল ভোটে নির্বাচিত হয়েছেন। এসবই তার দুর্ভাগ্য।
আর ড. ইউনুসের দুর্ভাগ্য যে তিনি পেয়েছেন গ্রামীন ব্যাংকের বিরাট সাফল্য, দুর্লভ প্রাইজ এবং ব্যাপক আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি।
ফলে দু’জনাই হয়েছেন হিংসার শিকার।
বাংলাদেশে গণতন্ত্র নয়, ২০১০-এ শুরু হয়ছে ক্ষুদ্র মনের ক্ষুদ্রতন্ত্র।
ছোট হয়ে এসেছে বাঘ
বিটিভির সাবেক সুদর্শন বাংলা সংবাদ পাঠক এবং ব্র্যাকের সাবেক কর্মকর্তা তাজুল ইসলাম যখন বাংলাদেশ বিমানের জনসংযোগ বিষয়ক ডিরেক্টর ছিলেন তখন আমাদের ন্যাশনাল এয়ারলাইনের জন্য তিনি সেøাগান প্রচার করেছিলেন, ছোট হয়ে আসছে পৃথিবী। তার দ্বিতীয় সেøাগানটি ছিল, ভিজিট বাংলাদেশ বিফোর দি টুরিস্ট কামস (Visit Bangladesh before the tourist comes) অর্থাৎ পর্যটকরা আসার আগেই বাংলাদেশে আসুন। এ সেøাগানসহ একটি পোস্টার ছাপা হয়েছিল। তাতে ছিল রয়াল বেঙ্গল টাইগারের মুখ। তখন প্রশ্ন উঠেছিল, টুরিস্টদের আগে কে বা কারা আসবেন এবং পৃথিবীটা কি সত্যিই ছোট হয়ে আসছে!
এখন ওই দুটি প্রশ্নের উত্তর পাওয়া গেছে টুরিস্টদের আগে বাংলাদেশে আসছেন দল বেধে সব ইনডিয়ান বিজনেসম্যান এবং টপ একজিকিউটিভ (তারা সবাই কি আয়কর বিভাগের আওতায় আছেন?)। স্বাধীনতার আগে বড় বড় কম্পানির বড় কর্মকর্তারা ছিলেন পশ্চিম পাকিস্তানি অথবা শ্বেতাঙ্গরা। আরো জানা গেছে, পৃথিবীটা ছোট না হলেও বাংলাদেশের বাঘ ছোট হয়ে গিয়েছে।
ওয়াইল্ড লাইফ ট্রাস্ট একটি রিপোর্টে জানিয়েছে, সুন্দরবন পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ বন হলেও সেখানে বসবাসকারী বাঘগুলো শারীরিক দিক দিয়ে সবচেয়ে ছোট। বর্তমানে সুন্দরবনের বাঘের গড় ওজন ৭৬ কেজি ৭০০ গ্রাম এবং বিশ্বে বাঘের যে নয়টি প্রজাতি আছে তার মধ্যে সবচেয়ে কম ওজন। বাঘের সবচেয়ে বড় প্রজাতির ওজনের তুলনায় রয়াল বেঙ্গল টাইগারের ওজন প্রায় অর্ধেক। বলা যায়, বাঘের আকৃতিহানি তার মর্যাদাও হানি করেছে। তাই উদ্বিগ্ন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গিয়েছিলেন ২১ নভেম্বর ২০১০-এ মস্কোতে গ্লোবাল টাইগার সামিটে। বিলুপ্তপ্রায় বাঘ কিভাবে বাচানো যায় এবং ২০১১ সালের মধ্যে এর সংখ্যা দ্বিগুণ তথা ভালোভাবে বাচানোর কৌশলপত্র তৈরি করা ছিল এই শীর্ষ সম্মেলনের উদ্দেশ্য। লক্ষ্য করুন, টার্গেট বছরটি আওয়ামী লীগের প্রিয় ২০২১ নয়। এটা কি প্রধানমন্ত্রীর ব্যর্থতা? তবুও তিনি ধন্যবাদ পাবেন বাঘ রক্ষায় উদ্যোগী হওয়ায়। একাত্তরের সূচনায় অনেকের কাছে তার পিতার ইমেজ ছিল বাঘের মতোই শক্তিমান ও সাহসী।
শেখ হাসিনার প্রাণী মমতার আরেকটি প্রকাশ ঘটেছিল তার প্রথম প্রধানমন্ত্রিত্বের সময়। তখন তিনি চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ে জনসভা শেষে উপকূলীয় বন পরিদর্শনে গিয়ে ২৭টি হরিণ শাবক অবমুক্ত করেন। কিন্তু পরবর্তীকালে বনদস্যুদের তা-বে ২৫ কিলোমিটার উপকূলীয় বনের অনেকাংশই উজাড় হয়ে গিয়েছে। ফলে গত বছরে ওই হরিণ এবং তাদের বংশধর দেখা যায়নি।
তবে ডগ স্কোয়াডের কুকুররা পালিয়ে যায়নি। ভাগ্যিস! জানা গেছে, আসন্ন বিশ্বকাপ ক্রিকেটে নিরাপত্তায় নিয়োজিত ডগ স্কোয়াডের জন্য কেনা হচ্ছে দুটি নতুন ডগ ভ্যান বা কুকুর গাড়ি। বিশ্বকাপ শুরুর আগ থেকেই রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ স্থানে ডগ স্কোয়াড দিয়ে তল্লাশি করা হবে। বিশ্বকাপ চলার সময় সন্দেহভাজন ব্যক্তিদের ডগ স্কোয়াড দিয়ে তল্লাশি করে স্টেডিয়ামের ভেতরে ঢোকানো হবে। আমি নিজে কুকুর ভালোবাসি এবং নেড়িকুকুরদের বিষয়ে লিখে থাকি। কিন্তু বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ বিভিন্ন আন্দোলনে বুকের রক্ত দিতে সাহসী হলেও কুকুরের কামড় খুব ভয় করে। সুতরাং আসন্ন বিশ্বকাপ ক্রিকেটে কুকুর হইতে সাবধান নোটিশ রাজধানী ও স্টেডিয়ামে দেয়ার বিষয়টি বিবেচনা করতে পারেন।
পশুকুলের মধ্যে গত বছর সবচেয়ে বেশি বিপদে পড়েছিল গরু। অ্যানথ্রাক্স রোগ কবলিত বহু গরুর অকাল মৃত্যু হয়েছিল। তবে গরু প্রজাতির পক্ষ থেকে বিবেচনা করলে হয়তো অ্যানথ্রাক্স তাদের জন্য আশীর্বাদ হয়ে এসেছিল। কারণ গরুকুলের মধ্যে এ রোগটি শুরু হয়েছিল কোরবানি ঈদের কয়েক সপ্তাহ আগে। তখন অনেকেই গরু ও খাসির মাংস খাওয়া ছেড়ে দেন। গরু-খাসি কম জবাই হয় সেই সময়। কম কোরবানি হয় ঈদুল আজহার সময়। ফলে এবার ঈদুল আজহায় গরুর হাটে নব্যধনীদের বিত্ত প্রদর্শনের অশ্লীল প্রতিযোগিতা দেখা যায়নি। গরুর দাম ঈদুল আজহায় কম থেকেছে। কিন্তু গরুর বিপদ এসেছে অপ্রত্যাশিতভাবে অন্য কোয়ার্টার থেকে। কুষ্টিয়ার দৌলতপুর সীমান্তে ১১৬টি গরুর ও ৭০টি ভেড়া নিয়ে গিয়েছে বিএসএফ। সীমান্তে মানুষ হত্যায় অভ্যস্ত বিএসএফ সেখানে হত্যার জন্য নিরীহ চাষিদের না পেয়ে শেষ পর্যন্ত অবলা গরু-ছাগলে মনোযোগী হয়েছে।
গাভী অবলা হলেও ষাড় হতে পারে বলীয়ান। গত বছর নেত্রকোনার মদন উপজেলার নায়েবপুর ইউনিয়নে পৃথক দুটি ষাড়ের লড়াই হয়। লড়াইয়ের একটিতে ২২০,০০০ এবং অন্যটিতে ১০০,০০০ টাকার বাজি ধরা হয়। লড়াইয়ের সময় ষাড়ের গুতায় কমপক্ষে ১৫ দর্শক আহত হন। সেদিন মাঠে ছোট-বড় ৩০টি ষাড়ের লড়াই হয়। আয়োজকরা জানান, ষাড় পালকরা বাজির টাকা জমা দিয়ে লড়াইয়ে অংশ নেন। ষাড়ের লড়াইয়ে বাজি ধরাটা এই অঞ্চলে নিয়মে পরিণত হয়েছে।
কারো পৌষ মাস কারো সর্বনাশ। অ্যানথ্রাক্স আতংকে কোরবানিতে বহু গরুর প্রাণ বেচে গেলেও মুরগি জবাই হয় বেশি। অ্যানথ্রাক্স যে গবাদিপশুর মধ্যে মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়েনি এ জন্য সংশ্লিষ্ট সরকারি কর্মকর্তারা এবং ব্যবসায়ীরা গরুদের কৃতজ্ঞতা দাবি করতে পারেন। কিন্তু মৎস্য ও প্রাণী সম্পদ মন্ত্রী আবদুল লতিফ হয়তো মুরগিদের অভিশাপ কুড়িয়েছেন। অক্টোবরে তিন মুরগির দাম কমানোর নির্দেশ দেন।
অন্য প্রাণীর তুলনায় গত বছর হাতির মর্যাদা বেড়েছে। বাংলাদেশ থেকে এক জোড়া বাচ্চা হাতি নিতে আগ্রহ জানিয়েছিল সাইপ্রাসের পাফোস বার্ডস অ্যান্ড অ্যানিমাল পার্ক। আর স্বদেশে মৌলভীবাজারে কুলাউড়া উপজেলার টিলাগাও ইউনিয়নের মিয়ারপাড়া গ্রামের মবশ্বির আলীর ছেলে দুবাই প্রবাসী বিজনেসম্যান শহিদুল ইসলামের বিয়েতে বরযাত্রায় ছিল ২৫টি হাতি! সেখানে হাতিরা সভ্য আচরণ করলেও কক্সবাজারে রামু উপজেলায় খুনিয়া পালংয়ে একটি বুনোহাতি তা-বলীলা চালিয়ে ২০টি বসতবাড়ি ভাংচুর করেছিল। ঢাকায় পুরানা পল্টনে বিএনপির অফিসের সামনে হরতালের দিন পুলিশ জলকামানের বদলে এই হাতিটিকে নিয়োগ করে হাতির শুড়ে জল প্রয়োগের কথা ভাবতে পারে।
হাতির ভাগ্য প্রসন্ন হলেও বানরের হয়েছে দুর্ভাগ্য। ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়া উপজেলায় সদর থেকে ২০ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে সন্তোষপুরে শতাধিক বানর খাদ্যের অভাবে ধুকেছে। তারা ক্ষিধের তাড়নায় গৃহস্থের রান্নাঘরে ঢুকে খাবার চুরি করেছে। চুরি করার সময় মাঝে মধ্যে ধরা পড়ে গৃহস্থের পিটুনি খেয়ে রক্তাক্ত হয়েছে। ওএমএস চালের লাইন দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে। তবুও পশুপ্রেমীরা নিশ্চয়ই প্রাণী সম্পদ মন্ত্রীকে অনুরোধ করতে পারেন বানরদের খাবার সাপ্লাইয়ের একটা লাইন তৈরি করার। আফটার অল, ডারউইনের তত্ত্ব মোতাবেক মানবকুলের পূর্বসূরি তো বানরকুলই। বানরদের জন্য মানবদের অবশ্যই কিছু করা উচিত।
মন্ত্রী আবদুল লতিফ বিশ্বাস সাপের বেলায় উদ্যোগী হয়েছেন। দেশের অবহেলিত সাপুড়ে সম্প্রদায়কে পুনর্বাসনের পাশাপাশি তাদের মাধ্যমে উৎপাদিত সাপের বিষ সংগ্রহ করে স্বদেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশে রফতানির বিষয়কটি বিবেচনা করেছে তার মন্ত্রণালয়। বিশ্ব বাজারে সাপের এক তোলা বিষের দাম প্রায় ১,২০০ ডলার। বাংলাদেশের রাজনৈতিক নেত্রীনেতাদের কথার বিষের দাম কত জানা যায়নি। এ মন্ত্রী নিশ্চয়ই জানেন, বিশেষত তার দলের নেত্রীনেতার কথার বিষ অতি উত্তম মানের। সেই বিষ রফতানি করতে পারলে দেশের রাজনৈতিক পরিবেশ ভালো হতো। এটি একটি সিরিয়াস সাজেশন। একটি সংবাদে জানা গেছে, জয়পুরহাটে ৬০ বছর বয়স্ক ফজলুর রহমানের বাড়িতে একই ঘরে সাপ ও বেজি থাকছে। তাই যদি হয় তাহলে সংসদে আওয়ামী-বিএনপি এমপিদের সমাবেশের লক্ষ্যে পলিটিশিয়ানদের কথায় বিষ রফতানি করাটা হবে গণতন্ত্রের জন্য একটি শুভ পদক্ষেপ।
স্থলজ প্রাণীকুলের পাশাপাশি গত বছর এসেছে জলজ প্রাণীকুলের সংবাদ। হিংস্র বাঙালি পিটিয়ে মেরেছে কুমির, ডলফিন এবং হাঙর। এসব প্রাণী আটকে গেলেও ইলিশ খুজে পেয়েছে পালানোর পথ। বাংলাদেশের মৎস্য গবেষণা ইন্সটিটিউটের সিনিয়র সায়েন্টিফিক অফিসার জানিয়েছেন, পদ্মার ইলিশ এবার ছেড়ে যাচ্ছে বাংলাদেশের জলসীমা। তাদের নতুন গন্তব্য এখন ইনডিয়ার নর্মদা ও তপবতী নদী। তবে বাংলাদেশে কয়েক বছর ঘাটতির পর গত বছর বেশি ইলিশ চোখে পড়েছে। কিন্তু ইলিশ খাওয়ার আনন্দ বাংলাদেশিদের ক্ষণস্থায়ী হতে পারে। জানা গেছে, গত বছর শুধু পূজার কয়েকদিন বাংলাদেশ থেকে ইনডিয়ায় রফতানি হয়েছে প্রায় সাড়ে ১০ কোটি টাকার ইলিশ। দুর্গোৎসবে আতিথেয়তার মর্যাদা বাড়াতে গত বছর প্রচুর ইলিশ নিয়েছে পশ্চিম বাংলা। শেষ পর্যন্ত ইনডিয়ান গরু আমদানি বনাম বাংলাদেশি ইলিশ রফতানি, কোনটাকে বেছে নেবে এই দেশের মানুষ?
বাংলাদেশের আকাশে পাখিরা কেমন ছিল? ছোটবেলায় পড়েছিলাম জীবনানন্দ দাশের হায় চিল! কবিতাটি। পরিণত বয়সে হায় চিল! বাক্যটি উচ্চারণ করি যখন ঢাকার আকাশে আর কোনো চিলকে ঘুরপাক খেতে দেখি না। চিলগুলো কোথায় গেল? রাজধানীতে খাবারের অভাব বলেই কি তারা অন্য কোথাও এখন ঘুরপাক খাচ্ছে? চিল রক্ষার জন্য এগিয়ে না এলেও গত বছরে শকুন রক্ষার জন্য এগিয়ে এসেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। অক্টোবরে মন্ত্রিসভার এক বৈঠকে নীতিগতভাবে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়, বিলুপ্তির হাত থেকে শকুন রক্ষা করতে ডাইক্লোফেনাক উৎপাদন বন্ধ করা হবে। তবে বিরোধী নেত্রী খালেদা জিয়া লক্ষ্য করেছেন বাংলাদেশে শকুনের আনাগোনা বেড়ে গেছে। তিনি হুশিয়ারি দিয়ে বলেছেন, ওই শকুনদের ঐক্যবদ্ধভাবে রুখতে হবে। দেশের স্বার্থবিরোধী চুক্তি করলেই শকুনদের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু হবে।
আপনার রায়
তাহলে ভালোমন্দ মিলিয়ে এই ছিল বিগত বছর ২০১০।
বছরের শেষে শোনা গেছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার সরকারের দ্বিতীয় বছর পূর্তি উপলক্ষে জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে টিভি ভাষণ দেবেন। এটা নি:সন্দেহে বলা চলে যে ২০১০-এ তার সরকার যে খুব সফলভাবে দায়িত্ব পালন করেছে সেটা তিনি দাবি করবেন এবং সরকার অনুগৃহীত ও পৃষ্ঠপোষিত অথবা সরকারের ভয়ে ভীত মিডিয়া সেটাই আগামী বছর জুড়ে সমস্বরে প্রচার করতে থাকবে।
কিন্তু আপনি কি মনে করেন?
আপনি কি রায় দেবেন?
নির্মোহভাবে ভেবে দেখুন।
গুডবাই ২০১০।
ওয়েলকাম ২০১১।
৩১ ডিসেম্বর ২০১০

৩১ ডিসেম্বর ২০১০