রবিবার, ১৫ জানুয়ারী, ২০১২

চট্টগ্রাম পোলো গ্রাউন্ড লুণ্ঠন


শফিক রেহমান


জানুয়ারী ১৫, ২০১২
shafik-rehman21111111111211112পোলো খেলা শুরু হয়েছিল ইরানে এখন থেকে প্রায় দুই অথবা আড়াই হাজার বছর আগে। তখন বাদশাহদের গার্ড অথবা এলিট সৈন্যদের নিয়ে গড়া অশ্বারোহী বাহিনীর সদস্যদের ট্রেইনিং দেয়ার জন্য পোলো খেলা চালু হয়েছিল। সেই সময়ে প্রতিটি দলে থাকত প্রায় এক শ’ প্লেয়ার এবং ঘোড়ার পিঠে চড়ে লাঠি পিটিয়ে গোল করার খেলাটি ছিল মিনি যুদ্ধের মতো। ইরানের ষষ্ঠ শতাব্দির ইতিহাসে জানা যায়, বাদশাহ দ্বিতীয় খসরু পারভেজ-এর সময়ে রানী ও তার বাদীরাও এই খেলায় অংশ নিতেন। ইরানের অভিজাত সম্প্রদায়ের পুরুষ ও নারীদের কাছে এই খেলা প্রিয় হয়ে ওঠে। ইরানি কবি ও ঐতিহাসিক ফেরদৌসি নবম শতাব্দিতে তার রিখ্যাত রচনা শাহানামা-তে একাধিক রাজকীয় পোলো টুর্নামেন্টের বর্ণনা ছিল। বর্তমানে ইরানের ইস্পাহান শহরে যে নকশ-ই-জাহান স্কোয়ার আছে, সেটি সপ্তদশ শতাব্দিতে বাদশাহ প্রথম আব্বাস বানিয়েছিলেন পোলো খেলার জন্য।
এই মুহূর্তে আপনার কি মনে পড়ছে বাংলাদেশের ইস্পাহানি পরিবারের কথা, যারা চা এবং অন্যান্য শিল্প-ব্যবসায়ে জড়িত।
হ্যাঁ, আপনার অনুমান সঠিক।
বাংলাদেশের ইস্পাহানি পরিবারের পূর্বসূরিরা এসেছিলেন ইরানের ইস্পাহান অঞ্চল থেকে। বাংলাদেশে আগত অন্যান্য অবাঙালি শিল্পপতি-ব্যবসায়ী পরিবার, যেমন আদমজী, দাউদ, বাওয়ানী, সেহগল প্রভৃতির তুলনায় ইস্পাহানি পরিবার ছিল ভিন্ন। তারা এই ভূখন্ডের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করেছিলেন প্রথম থেকেই। ইস্পাহানিরা এখনো আছেন। অন্যরা পাকিস্তানে চলে গিয়েছেন।
সে যা-ই হোক, ইনডিয়াতে প্রথম পোলো খেলা চালু করেন তুর্কি সুলতান কুতুবউদ্দিন আইবেক। তিনি উত্তর ভারতের সম্রাট রূপে শাসন করেছিলেন মাত্র চার বছর, ১২০৬ থেকে ১২১০-এ পোলো খেলায় দুর্ঘটনায় তার মৃত্যু পর্যন্ত।
মধ্যযুগে পোলো খেলা ইরান থেকে ছড়িয়ে পড়ে মধ্যপ্রাচ্যে, ইনডিয়া এবং চায়না ও জাপানসহ দূরপ্রাচ্যের অন্যান্য দেশে। পোলো আধুনিক পর্যায়ে নিয়ে আসে বৃটিশরা প্রায় পৌনে দুশ বছর আগে। মনিপুর (বর্তমানে ইনডিয়ার অঙ্গরাজ্য) নিবাসী বৃটিশ সাহেবরা ১৮৩৪-এ আসামের শিলচর শহরে প্রথম পোলো ক্লাব প্রতিষ্ঠা করে। ১৮৬২-তে দুজন বৃটিশ সেনা কলকাতায় প্রতিষ্ঠা করেন ক্যালকাটা পোলো ক্লাব। পরবর্তী কালে বৃটিশরা পোলো খেলার নিয়মকানুন স্থির করে এবং ইওরোপ, উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকায় খেলাটিকে ছড়িয়ে দেয়।
কিন্তু পোলো কখনোই সাধারণ মানুষের আয়ত্তের মধ্যে ছিল না। ঘোড়ার মালিকানা এবং খেলার সাজসরঞ্জাম কেনার ক্ষমতা ছিল শুধু বিত্তবানদের। তাই সূচনা থেকেই পোলো পরিচিত হয় রাজা-বাদশাহদের খেলা রূপে। তবে মনিপুরে সাধারণ মানুষরাও পোলো খেলত। মনিপুরের রাজা ও সম্ভ্রান্তরা খেলতেন রাজপ্রাসাদ বা দুর্গের মধ্যে, যেটাকে বলা হতো ইনার পোলো গ্রাউন্ড। আর প্রাসাদের বাইরে ছিল আউটার পোলো গ্রাউন্ড যেখানে খেলত সাধারণ মানুষ। মনিপুরেই আছে বিশ্বের সবচেয়ে পুরনো পোলো খেলার মাঠ, ইমফল পোলো গ্রাউন্ড।
ইরানে পোলো খেলার নাম ছিল চৌগান। মনিপুরে পোলো খেলার নাম ছিল সাগজ কাংজেই, কানজাই বাজি অথবা পুলু। পুলু একটি তিব্বতি শব্দ, যার মানে বল।
আধুনিক পোলো খেলার মাঠ হয় ৩০০ গজ লম্বা এবং ১৬০ গজ চওড়া। ঘাসের এই মাঠে চারটি ঘোড়ার পিঠে চড়ে চারজন প্লেয়ারের একটি দল তাদের হাতের লাঠি দিয়ে একটি বল প্রতিপক্ষের চার ঘোড়া ও প্লেয়ারের বিরুদ্ধে গোল করতে চান। লাঠি হয় বেতের এবং বলটি সাধারণত হয় শক্ত প্লাস্টিকের। খুব দ্রুতগতিতে এই খেলাটি হয়। বামহাতিরা এই খেলায় নিষিদ্ধ। অলিম্পিকে এই খেলাটি অন্তর্ভুক্ত নয়।
চট্টগ্রামে এসেছিল পোলো
শিলচর ও ইমফল থেকে চট্টগ্রামের দূরত্ব প্রায় সাড়ে তিন শ’ কিলোমিটার। বৃটিশ শাসন আমলে চট্টগ্রামেও পৌছে গিয়েছিল পোলো। তারা পাহাড়তলি রেলওয়ে লাইনের পাশে তৈরি করেছিল চিটাগাং পোলো গ্রাউন্ড। সেই ইতিহাস এখন হারিয়ে গেছে। শুধু কল্পনা করা যায় দেড় শ’ বছর আগে এই মাঠে শ্বেতাঙ্গ সাহেব-মেমসাহেবরা পোলো খেলার বিশেষ পোশাক পরে ঘোড়ার পিঠে চড়ে বেতের লাঠি দিয়ে সপাং সপাং শব্দে বল পিটিয়ে প্রতিপক্ষের গোলমুখে যেতেন। গোল দিতেন। সেই সময়ে বাশের কঠিন গুড়ি দিয়ে পোলো বল বানানো হতো। তাদের হয়তো দেখত সাধারণ মানুষ, সাহেবরা যাদের বলত নেটিভ। পোলো খেলার শেষে সাহেব-মেমসাহেবরা রেস্ট নিতে যেতেন গ্রাউন্ড থেকে প্রায় দেড় কিলোমিটার দূরে অবস্থিত ইওরোপিয়ান ক্লাবে। পান করতেন জিন অ্যান্ড টনিক।
এখন পোলো গ্রাউন্ডে পোলো নয় হাইস্কুলের ছেলেরা খেলে ফুটবল। আর বছরের বিভিন্ন সময়ে হয় শিল্প ও ব্যবসা মেলা।
তা ছাড়া জনসমাগম খুব বেশি হবে ধারণা করলে লালদীঘির ময়দানের বদলে এই পোলো গ্রাউন্ডে হয় রাজনৈতিক জনসভা। যেমন, ১৯৭৩-এ শেখ মুজিবুর রহমান এখানে একটি বড় জনসভায় ভাষণ দিয়েছিলেন। তারপর ১৯৯৮-এ শেখ হাসিনা এখানে একটি জনসভায় ভাষণ দিয়েছিলেন। যদিও তিনি তখন প্রধানমন্ত্রী ছিলেন তবুও সেদিন তার জনসভায় পোলো গ্রাউন্ডে কিছু অংশ ফাকা ছিল।
পোলো গ্রাউন্ডের দক্ষিণ দিকে রয়েছে চট্টগ্রাম অ্যাপ্রোচিং একটার পর একটা রেলওয়ে লাইন। পশ্চিম দিকে রেলওয়ে স্টাফদের কলোনি। পূর্ব দিকে ওয়াজিউল্লাহ ইন্সটিটিউট ও একটি হাই স্কুল। উত্তর দিকে ইস্টার্ন জোন রেলওয়ের হেড কোয়ার্টার্স।
আর এই উত্তর দিকেই রয়েছে ওল্ড চিটাগাং সার্কিট হাউজ ও নিউ চিটাগাং সার্কিট হাউজ।
৩০ মে ১৯৮১-তে পুরনো চিটাগাং সার্কিট হাউজে একদল উচ্ছৃঙ্খল সেনাসদস্যদের গুলিতে নিহত হয়েছিলেন প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান।
রূপসী আনন্দমূখর চট্টগ্রাম
সেই ভবনটির পাশেই নতুন বানানো সার্কিট হাউজে রবিবার ৮ জানুয়ারি ২০১১-তে রাত এগারোটার কিছু পরে এসে ওঠেন জিয়ার স্ত্রী বিরোধীদলীয় নেত্রী বিএনপির চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া।
খালেদার নতুন রাজনৈতিক কর্মসূচির সর্বশেষ রোড মার্চটির গন্তব্যশহরটি ছিল চট্টগ্রামে এবং শেষ গন্তব্যস্থানটি ছিল চট্টগ্রাম পোলো গ্রাউন্ড।
সেই রাতে গোটা চট্টগ্রাম শহর ধারণ করেছিল অন্য রূপ। শত শত শাদা নিয়ন লাইট এবং হাজার হাজার রঙিন মরিচবাতিতে সাজানো পৌষালি শীতের রাতের চট্টগ্রাম হয়েছিল রূপসী ও আনন্দমুখর। প্রায় সারা রাত জুড়ে এদিকে-ওদিকে চলছিল জনসমাবেশ, আড্ডা, মেজবানি খাওয়া, চা খাওয়া। খালেদা, জিয়াউর রহমান, তারেক রহমান ও স্থানীয় বিএনপি নেতা ও তাদের পেট্রনদের ছবি সংবলিত বিশাল আকৃতির রঙিন বিলবোর্ড ও ব্যানার থেকে শুরু করে ছোট আকৃতির পোস্টারে ছেয়ে গিয়েছিল চট্টগ্রাম শহর, বিশেষত সিটি গেইট থেকে সার্কিট হাউজ এবং সার্কিট হাউজ থেকে পোলো গ্রাউন্ডের রুট দুটি। সবচেয়ে বেশি ব্যানার ছিল সার্কিট হাউজের সামনে।
সোমবার ৯ জানুয়ারি ২০১১-তে সকাল থেকে আরো মানুষ এসে পৌঁছাচ্ছিল চট্টগ্রাম শহরে। তাদের কেউ কেউ এসেছিল দূর থেকে, যেমন, পাবনা, বরিশাল, ফেনী থেকে। আবার কেউ কেউ এসেছিল কাছেই খাগড়াছড়ি, ফটিকছড়ি, রাউজান, পটিয়া রাঙ্গুনিয়া, মীরেরসরাই থেকে।
রোড মার্চে যোগদানকারী এবং পোলো গ্রাউন্ডমুখী কারো হাতে লাঠি-বৈঠা-লগি ছিল না। তাদের হাতে ছিল ব্যানার-প্ল্যাকার্ড-পোস্টার।
সমুদ্র তীরবর্তী জনসমুদ্র
ভালো অবস্থান নিশ্চিত করতে এদের অনেকেই বেশ সকালেই পৌছে গিয়েছিল পোলো গ্রাউন্ডে। বেলা তিনটায় জনসভা শুরু হবার কথা থাকলেও বেলা একটার মধ্যেই পোলো গ্রাউন্ড ও তার সংলগ্ন স্থানগুলো মানুষে ভর্তি হয়ে গিয়েছিল। বস্তুত, সমুদ্র-তীরবর্তী চট্টগ্রাম শহর পুরোটাই হয়েছিল জনসমুদ্র। স্থানীয় ও বহিরাগত মানুষে উপচে পড়ছিল চট্টগ্রাম। এদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল রোড মার্চের আট থেকে দশ হাজার প্রাইভেট কার, মাইক্রোবাস, বাস ইত্যাদি।
সার্কিট হাউজে দুপুর বেলায় দেখা হয়েছিল মেয়র মনজুর আলমের সঙ্গে। তিনি জানিয়েছিলেন, সেদিন সকালে তিনি সিটি করপোরেশনের দু’টি কাজ সেরে সিটি করপোরেশনের মালিকানাধীন প্রিমিয়ার ইউনিভার্সিটির একটি বোর্ড মিটিং অ্যাটেন্ড করে সার্কিট হাউজে এসেছেন। কিন্তু দৈনিক পত্রিকার সমালোচনার উর্ধ্বে তিনি থাকতে চেয়েছেন। সাম্প্রতিক রাজনৈতিক ক্যামপেইনে চট্টগ্রাম শহরের নতুন টেকনিকালার রূপ, বর্ধিত গুরুত্ব এবং সুদূরপ্রসারী তাৎপর্যে তিনি ছিলেন গর্বিত ও সন্তুষ্ট।
তিনি মাথায় যেসব সোনালি অথবা রূপালি জরির কাজ করা কালো গোল টুপি পরেন সে বিষয়ে আমি কৌতূহলী ছিলাম। আমার প্রশ্নের উত্তরে স্মিত হেসে জানালেন, তিনি টুপি সংগ্রহ করতে ভালোবাসেন এবং তার বেশির ভাগ টুপি মেইড ইন ইন্দোনেশিয়া অথবা মেইড ইন মালয়েশিয়া। এসব তিনি উপহার পান আত্মীয়-স্বজন ও শুভাকাক্সক্ষীদের কাছ থেকে। তিনি ধাবিত হলেন পোলো গ্রাউন্ডের দিকে।
পশ্চাদ্দেশ নয়, মানুষ দেখতে চায় সামনের দিক
বেলা আড়াইটায় সভামঞ্চ থেকে ঘোষণা করা হয় পোলো গ্রাউন্ড কানায় কানায় ভরে গেছে।
এই ঘোষণার প্রয়োজন ছিল না।
সবাই সেটা স্বচোখেই দেখছিল।
মানুষ আর মানুষ।
মানুষ আর মানুষ।
মানুষ আর মানুষ।
এদের অধিকাংশর বয়স মনে হয় পঁচিশের নিচে। প্রায় প্রত্যেকের পরনে জিন্স। অনেকের হাতে মোবাইল, যা দিয়ে তারা ছবি তুলে যাচ্ছিল।
কেউ কেউ প্রায়ই তুলে ধরছিল বড় বড় ব্যানার। ফলে তাদের পেছনের মানুষ দেখতে পাচ্ছিল না মঞ্চে উপবিষ্ট নেতাদের।
খালেদা তখনো এসে পৌছান নি।
যে ষোলটি সমমনা দল এই জনমাবেশে অংশ নিয়েছিল তাদের নেতারা একের পর এক সংক্ষিপ্ত ভাষণ দিচ্ছিলেন। মঞ্চ থেকে বারবার অনুরোধ করা হয় সভাস্থলের ব্যানারগুলো গুটিয়ে ফেলতে। তাই হয়। সভার চার পাশ জুড়ে ছিল বিভিন্ন সাইজের পাঁচশর বেশি ব্যানার। সার্কিট হাউজ থেকে পোলো গ্রাউন্ডে আসার পথে ছিল হাজারখানেক ব্যানার।
সেদিন সকালে খবর এসেছিল ঢাকায় তুমুল বৃষ্টি হচ্ছে। এই জনসমাবেশের আয়োজকরা উদ্বিগ্ন ছিলেন চট্টগ্রামে সম্ভাব্য বৃষ্টি নিয়ে।
কিন্তু প্রকৃতি সদয় ছিল।
চট্টগ্রামে সেদিন এক ফোটা বৃষ্টি হয়নি।
মানুষের পায়ের চাপে মাঠে ধুলা উড়ছিল। একটু বৃষ্টি হলে হয়তো ভালোই হতো। শহরের বিশটি পয়েন্টে জায়ান্ট স্কৃনে পোলো গ্রাউন্ডের কর্মকান্ড সরাসরি দেখানো সত্ত্বেও মিনিটে মিনিটে আরো মানুষ মাঠে আসছিল।
তাদের অনেকেই বিরক্তি ও ক্ষোভ প্রকাশ করছিল টেলিভিশন ও রেডিও ক্রুদের জন্য স্থাপিত দুটি মঞ্চের বিরুদ্ধে। এই দুটি মঞ্চের কারণে পোলো গ্রাউন্ডে উপস্থিত জনতার একটি বৃহৎ অংশ দেখতে পাচ্ছিল না মঞ্চে উপবিষ্ট নেতাদের। তারা শুধু দেখছিল টিভি-রেডিও ক্রু মঞ্চে দন্ডায়মান ক্যামেরামেনদের বিভিন্ন সাইজের পশ্চাদ্দেশ। বলা বাহুল্য, এমন দৃশ্যে সে দিন কেউ আনন্দিত হয়নি। কৃক্রেট ম্যাচ, ফুটবল ম্যাচ প্রভৃতির মতোই ভবিষ্যতে টিভি ক্যামেরাম্যানদের মাঠের সাইডে মঞ্চ করে দেয়া উচিত হবে। স্থানটি দূরে হলেও তাদের টেলিফটো লেন্সে মঞ্চের দৃশ্য ও বক্তব্য ধারণ সম্ভব হবে এবং তার ফলে সাধারণ মানুষদের বক্তৃতা শোনা ও দেখা সম্ভব হবে। বক্তারা আসেন মানুষের জন্য। ক্যামেরামেনদের জন্য নন।
শ্রোতারা আসেন বক্তাদের দেখতে। ক্যামেরামেনদের পশ্চাদ্দেশ দেখতে নয়।
এত টিভি ক্রু থাকলেও শুধু এই অভূতপূর্ব জনসমাবেশের সরাসরি সম্প্রচার করছিল মাত্র তিনটি টিভি চ্যানেল, বাংলাভিশন, ইটিভি ও এনটিভি।
স্ট্যামপিড উদ্বেগ
আয়োজকদের উদ্বিগ্ন হবার আরেকটি বড় কারণ ছিল সভাস্থলে স্ট্যামপিড (Stampede) হয়ে বা পদতলে পিষ্ট হয়ে বহু মানুষের হতাহত হবার সম্ভাবনা। অনেকেই মঞ্চের সামনের দিকে যেতে চাইছিল। স্বেচ্ছাসেবকরা সবাইকে নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রাখতে চাইলেও ব্যর্থ হচ্ছিল। বাইরে কার পার্কিংয়ে ও রাস্তায় কিছু পুলিশ থাকলেও জনসভায় তাদের উপস্থিতি ছিল নগণ্য। অরাজনৈতিক কারণে, যেমন পকেটমার ধরা পড়ায় হঠাৎ গোলমাল বেধে গেলে অথবা উত্তপ্ত কথা কটাকাটি হলে, হঠাৎ জনসভার কোনো অংশে মারপিট শুরু হয়ে সেটা বিস্তৃত হতে পারত অন্য অংশে। মানুষ মারা যেতে পারত। সে ক্ষেত্রে একটি সামান্য ঘটনা আয়োজকদের এত দিনের প্ল্যান ও শ্রম এবং এত অর্থব্যয় পন্ড করতে পারত। সুতরাং ভবিষ্যতে ক্রাউড কনট্রোল (Crowd Control) বিষয়ে আয়োজকদের অগ্রিম উপযুক্ত ব্যবস্থা অবশ্যই নিতে হবে। এই লেখার সময়েই আল জাজিরা টিভি নিউজ খুলে জানলাম আজই মধ্য ইনডিয়াতে একটি জনসমাবেশে পদতলে পিষ্ট হয়ে আটজন মারা গিয়েছে।
পুন: প্রতিষ্ঠিত জনপ্রিয়তা ও এত মানুষ
অস্বীকার করা সম্ভব নয়

পোলো গ্রাউন্ডে উড়ছিল খালেদার ছবিসহ নয়টি বড় বেলুন।
খালেদাকে দেখা ও শোনার প্রতীক্ষারত মানুষ ক্রমেই চঞ্চল হয়ে উঠছিল।
লাল ও শাদা গ্ল্যাডিওলি ফুলে সাজানো মঞ্চে চলছিল প্রটোকল মোতাবেক নেতাদের বক্তৃতা।
এদের মধ্যে জামায়াতে ইসলামীর ভারপ্রাপ্ত আমির মকবুল আহমাদ বলেন, স্বাধীনতা যুদ্ধের পর আটক পাকিস্তানি সেনাসদস্যদের শেখ মুজিব মুক্তি দিয়ে যুদ্ধাপরাধ ইসু নিষ্পত্তি করেছিলেন। কিন্তু দীর্ঘ চল্লিশ বছর পর এই বিষয়টি আবার সামনে এনে ও জাতীয় নেতাদের আটক রেখে আওয়ামী লীগ আজীবন ক্ষমতায় থাকতে চায়।
বাংলাদেশ জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান আন্দালিব রহমান পার্থ এমপি বলেন, শেখ হাসিনা বলেছেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার এলে নাকি দেশনেত্রী খালেদা জিয়াকে জেলে যেতে হবে। আমি আগেই বলেছি, এখনো বলছি, বাংলাদেশে এমন কোনো কারাগার নেই, যে কারাগারে তারা কোটি কোটি মানুষের নেত্রী বেগম জিয়াকে আটক করে রাখতে পারে।
আন্দালিব পার্থর এই চ্যালেঞ্জে মাঠের মানুষ বিপুল হর্ষধ্বনি তোলে। বক্তা হিসেবে পার্থর নাম যখন ঘোষণা করা হয়েছিল, তখনো মানুষ হর্ষধ্বনি তুলেছিল।
কিছুকাল আগে সংসদের একটি অধিবেশনে বারো নিমিটের একটি জ্বালাময়ী ভাষণে তিনি স্টক এক্সচেঞ্জে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষদের পক্ষে বলে জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। তার ওই ভাষণটি এখনো বহু মোবাইল ফোন ইউজারদের ফোনে সংরক্ষিত আছে। কেউ সেটা এখনো শুনে না থাকলে শোনা উচিত হবে। পোলো গ্রাউন্ডে আবার বোঝা গেল তরুণ আন্দালিব পার্থ বোঝেন মানুষ কী শুনতে চায়।
সত্যিই তো।
২৭ সেপ্টেম্বর ২০১১তে ঢাকায় নয়া পল্টনে জনসভার পর চারটি রোর্ড মার্চ এবং বিভিন্ন পথ ও জনসভায় খালেদার যে জনপ্রিয়তা পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়েছে সেটা অস্বীকার করে তাকে কি আবার জেলবন্দী করা সম্ভব হবে?
এই যে রোর্ড মার্চের দুই পাশে দাড়ানো এত মানুষ, এই সভায় এত মানুষ, জনসভায় এত মানুষ এদের অগ্রাহ্য করে একদলীয় নির্বাচনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ কি ২০২১ (তাদের ক্যালেন্ডার অনুযায়ী) পর্যন্ত ক্ষমতায় টিকে থাকতে পারবে?
তাহলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কেন হুমকি দিয়েছেন খালেদা জিয়া গ্রেফতার হতে পারেন? কেন ৭ জানুয়ারি ২০১২তে ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে হাসিনা বলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার এলেই যে তারা আপনাকে (খালেদাকে) চ্যাংদোলা করে ক্ষমতায় বসিয়ে দেবে তার গ্যারান্টি কী? বরং জেলেও যেতে হতে পারে। খাল কেটে কুমির আনার দরকার কী?
চ্যাংদোলা! কী সুন্দর, ভদ্র ও শালীন শব্দচয়ন-ক্ষমতা!
আওয়ামী লীগের মতোই পশ্চাদমুখিতা
তবে এটা ঠিক যে ইতিমধ্যে বিএনপির স্ট্যান্ডিং কমিটির সদস্য চট্টগ্রামের সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী এমপিকে গ্রেফতার করা সম্ভব হয়েছে। এক পর্যায়ে মঞ্চে ভাষণ দিতে আসেন তার স্ত্রী ফারহাত ও পুত্র হুম্মাম কাদের চৌধুরী। ফারহাত বলেন, আমি এখানে আপনাদের সহানুভূতির জন্য আসিনি। আপনারা আমাদের সাহস যোগাবেন। আমি শেখ হাসিনাকে বলে দিতে চাই, চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী পরিবার ফজলুল কাদের চৌধুরী পরিবার। তারই গর্বিত সন্তান সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে গ্রেফতার করে বেগম জিয়াকে দুর্বল করতে চান শেখ হাসিনা। কিন্তু আমরা তাতে ভীত নই। আমরা শেখ হাসিনাকে ভয় পাই না। আমি একজন গৃহবধূ। দীর্ঘ ছত্রিশ বছর ঘর থেকে বের হইনি। কিন্তু আজ একজন দেশপ্রেমিককে মুক্ত করতে মহাসমাবেশে উপস্থিত হয়েছি।
ফারহাতের এই আবেগময় ভাষণের পর তার ছেলে হুম্মাম সংক্ষিপ্ত বক্তৃতা রাখেন। তিনি তার বক্তৃতা শেষ করেন নারায়ে তকবির আল্লাহু আকবর ধ্বনি দিয়ে।
একটি রাজনৈতিক সভায় একটি ধর্মীয় স্লোগান মানুষকে অনুপ্রাণিত করতে পারেনি। তাই বক্তার নারায়ে তকবির-এর প্রতি উত্তরে দর্শক-শ্রোতাদের আল্লাহু আকবর ধ্বনিটি ছিল মৃদু। সাউন্ড ডেসিবেল ছিল কম।
১৯৪৭-এ ইনডিয়া পার্টিশনের আগে হিন্দু সম্প্রদায়ের ‘বন্দে মাতরম’ স্লোগানের বিপরীতে মুসলিম সম্প্রদায়ের স্লোগান ছিল ‘নারায়ে তকবির, আল্লাহু আকবর’। ১৯৪৭-এর পর পূর্ব পাকিস্তান ও পরবর্তী কালে বাংলাদেশের রাজনীতিতে এই স্লোগান হয়ে পড়েছে অব্যবহৃত। কারণ বাংলাদেশের অন্ততপক্ষে পচাশি শতাংশ অধিবাসী মুসলিম। বস্তুত এখন রাজনৈতিক সভায় নারায়ে তকবির আল্লাহু আকবর’ স্লোগানটি আওয়ামী লীগের কালো জওহর কোটের মতোই পশ্চাৎমুখী। ১৯৪৭-এর আগে কংগ্রেস নেতা জওয়াহেরলাল নেহরু পরতেন এই কোর্তা। তার অনুকরণে তাবৎ কংগ্রেস নেতাকর্মীরাও পরতেন এই কোর্তা।
বেলা চারটার কিছু পরে মুহুর্মুহু আকাশ ফাটানো স্লোগানের মধ্যে খালেদা জিয়া সভাস্থলে এসে পৌছান। তাকে মঞ্চে উঠতে সাহায্য করেন মহাসমাবেশের সভাপতি আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী। এম মোরশেদ খান ও মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।
যেহেতু খালেদার ভাষণ শুরু হওয়ার কথা ছিল সাড়ে চারটায়, সেহেতু সভা পরিচালকরা এরপর তাগাদা দিতে থাকেন বক্তারা যেন অতি দ্রুত তাদের বক্তব্য শেষ করেন। তখনো আরো কিছু টপ নেতাদের ভাষণ দেয়া বাকি ছিল। ফলে খালেদার ভাষণ দেরি হয়ে যেতে থাকে।
মাঠে দর্শক-শ্রোতারা অধৈর্য হয়ে ওঠে।
মানুষের ঢেউ বারবার এসে আছড়ে পড়তে থাকে মঞ্চের পাদদেশে।
আমার নিরাপত্তার জন্য টিভি ক্যামেরামেনরা আমাকে টেনে তোলেন তাদের মঞ্চে।
থ্যাংকস ফোকস।
মারদাঙ্গা ইমেজ বিএনপির নয়, নেতারও নয়
এক পর্যায়ে মির্জা আব্বাস তার সংক্ষিপ্ত ভাষণের শেষে নতুন একটি স্লোগান দেন শেখ হাসিনার দিন শেষ, খালেদা জিয়ার বাংলাদেশ।
মির্জা আব্বাসের এই স্লোগানে মানুষ জোরে সাড়া দেয়। কিন্তু তার নেত্রী খালেদা তখন অন্য কথা ভাবেন।
জনসমাবেশে সংক্ষিপ্ততম বক্তব্য রাখেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তার নাম ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে সারা মাঠে ধ্বনি ওঠে। তালি পড়ে। সাউন্ড ডেসিবেল ছিল এই সময় পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি। বোঝা যায় অতি অল্প সময়ে মির্জা আলমগীর কত বেশি জনপ্রিয় হয়েছেন।
সম্ভবত সেই কারণে বিএনপির কিছু সিনিয়র নেতা মহাসচিব পদে আলমগীরের নিযুক্তিকে এখনো মেনে নিতে পারছেন না এবং তাকে অনির্দিষ্ট কালের জন্য ভারপ্রাপ্তই রাখতে চান। এই সব সিনিয়র এবং কিছু জুনিয়র নেতারা চাইলেও মির্জা আলমগীর কখনোই মারদাঙ্গা নেতার ইমেজ প্রতিষ্ঠা করতে পারবেন না। কারণ তিনি ভদ্র, তিনি মার্জিত, তিনি শিক্ষিত ও দুর্নীতিমুক্ত এবং নেত্রীর প্রতি একশ শতাংশ অনুগত।
বিএনপি সমর্থকরা এই পাঁচটি গুণের প্রতিফলন দেখতে চায় তাদের নেতাদের মধ্যে। তাদের দলের মধ্যে।
মির্জা আলমগীরের যেসব সিনিয়র-জুনিয়র সমালোচক দলের মধ্যে আছেন, তাদের উচিত হবে বিবেচনা করা এই পাঁচটি গুণের কত পরিমাণ তাদের নিজেদের মধ্যে আছে।
পায়জামা ও ঘিয়ে রংয়ের পাঞ্জাবি পরিহিত মির্জা আলমগীর উপস্থিত জনতার প্রতি প্রশ্ন রেখে বলেন, আপনারা কি আওয়ামী দুঃশাসন থেকে মুক্তি চান? তাহলে আর ঘরে বসে থাকার সময় নেই। দেশনেত্রী যে আন্দোলনের ডাক দেবেন তাতে শরিক হয়ে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের মাধ্যমে এ সরকারের পতন ঘটাতে হবে।
উন্নততর স্টাইলের ভাষণ
এর কিছু পরে খালেদা তার ভাষণ দেয়া শুরু করেন।
ঘড়িতে তখন পৌনে পাঁচটা।
শাদা শাড়ি পরিহিতা খালেদার হাতে কোনো নোট ছিল না।
সাম্প্রতিক কালে জনসভায় তিনি কোনো নোট ছাড়া ভাষণ দিচ্ছেন। তিনি তার ভাষণে স্ট্যাটিসটিকস খুব কম ব্যবহার করছেন। প্রবৃদ্ধি-ফ্রবৃদ্ধি শতাংশ-ফতাংশ কম বলছেন।
জনসভায় এসবের প্রয়োজন নেই।
বরং মানুষ তার ডাইরেক্ট ইন্টারঅ্যাকশন, যেমন জনতাকে সরাসরি প্রশ্ন করা, পছন্দ করছে। যেমন, তিনি প্রশ্ন করেন, প্রতিনিয়ত সীমান্তে ভারতীয়রা বাংলাদেশের মানুষ গুলি করে হত্যা করছে। ফেলানিকে হত্যা করে তার লাশ কাটাতারে ঝুলিয়ে রেখেছে। এই সরকার তার প্রতিবাদ করতে পারে না। এদের কি আপনারা দেশপ্রেমিক সরকার বলবেন?
মানুষ সজোরে উত্তর দেয় না, না।
এখন তারা খারাপ হয়ে গেছে !
খালেদা তার সাম্প্রতিক ভাষণ ইলাসট্রেটেড করছেন এবং সেটা মানুষ গ্রহণ করছে। যেমন, ১৯ ডিসেম্বর ১৯৯৫-এর একটি দৈনিক পত্রিকার ল্যামিনেটেড প্রথম পৃষ্ঠা জনতাকে দেখিয়ে বলেন, এ পত্রিকায় লেখা রয়েছে ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া কোনো নির্বাচন জনগণ মেনে নেবে না : শেখ হাসিনা’। এই ছিল তার দাবি। তাহলে এখন আমরা তত্ত্বাবধায়ক সরকার চাচ্ছি তাতে দোষের কী আছে! এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের জন্য শেখ হাসিনা জামায়াতকে নিয়ে বিএনপির বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছিল। তখন জামায়াত যুদ্ধাপরাধী ছিল না, ভালো ছিল। এখন তারা খারাপ হয়ে গেছে।
এরশাদকে বিরোধীদলীয় নেতা বানানোর পরিকল্পনা সফল হবে না উল্লেখ করে তিনি বলেন, ১৯৮৬ সালে লালদীঘির ময়দানে শেখ হাসিনা ঘোষণা দিয়েছিলেন, যারা নির্বাচনে যাবে তারা জাতীয় বেঈমান। তার কয়েক ঘণ্টা পরই ঢাকায় গিয়ে নির্বাচনে যাওয়ার ঘোষণা দেন। সেই নির্বাচনেও জামায়াতকে সঙ্গে নিয়েছিল। তখন এরশাদ ক্ষমতায় গিয়েছিল আর হাসিনা ছিল বিরোধী দলে। এখন আবার পরিকল্পনা করছে হাসিনা ক্ষমতায় যাবে আর এরশাদকে বিরোধী দলের নেতা বানাবে। এরশাদের ঋণ পরিশোধ করবে।
জনসভায় এই ধরনের ইলাসট্রেটেড ফ্যাক্টস খালেদার ভাষণকে বিশ্বাসযোগ্য করছে।
এই প্রথম হাসুদি মমতাদি
খালেদার এই সর্বশেষ ভাষণে এই প্রথম তিনি তার প্রতিদ্বন্দ্বী নেত্রী শেখ হাসিনার প্রতি কিছুটা সরাসরি ব্যঙ্গাত্মক মন্তব্য করেন। যেমন, পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ও শেখ হাসিনার মধ্যে মধুর সম্পর্ক থাকলেও তিস্তার পানি দেয়নি উল্লেখ করে খালেদা জিয়া বলেন, হাসুদির সঙ্গে মমতাদির এত সম্পর্ক তারপরও তিস্তার পানি পেলেন না কেন?
এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, পররাষ্ট্রমন্ত্রী প্রটোকল ভেঙে ভারতে গেলেন। মমতাদির জন্য ইলিশ মাছ, মিষ্টি, জামদানি শাড়ি নিয়ে গেলেন। তারপর তারা বলল বর্ষাকালে পানি দেবে। কিন্তু বর্ষাকালে আমাদের তো পানির দরকার নেই।
প্রতিপক্ষের প্রতি এই ধরনের ব্যঙ্গাত্মক মন্তব্য সাধারণ মানুষ পছন্দ করে। তবে খালেদাকে সতর্ক থাকতে হবে কোনো মন্তব্য যেন তাকে হাসিনার পর্যায়ে নামিয়ে না দেয়। মানুষের কাছে খালেদার সংযমী, ভদ্র ও শালীন ইমেজটাই প্রতিষ্ঠিত ও কাম্য।
পিন্ডির শৃঙ্খল ভেঙ্গে দিল্লির শৃঙ্খল নয়
পোলো গ্রাউন্ডের ভাষণে খালেদা বিভিন্ন ইসুতে ইনডিয়ার আরো সমালোচনা করেন। যেমন, ট্রানজিটের নামে করিডোর দেয়ার অভিযোগ করে খালেদা বলেন, ক্ষমতায় আসার জন্য ভারতীয়দের যেসব কথা দিয়েছিল সব তারা (আওয়ামী সরকার) রক্ষা করেছে। নদীর ওপর বাধ দিয়ে ভারতের গাড়ি চলার ব্যবস্থা করেছে। আমাদের রাস্তায় আমাদের গাড়ি চলতে পারবে না। সেখানে ভারতের গাড়ি চলবে। তিতাস নদীতে বাধ দিয়ে ভারতের গাড়ি চলার জন্য রাস্তা বানিয়েছে। এতে কৃষি ও পরিবেশের ক্ষতি হয়েছে। সেখানের মানুষ প্রতিবাদ করায় তাদের ওপর নির্যাতন চালাচ্ছে।
তিনি বলেন, এ সরকার জনগণের সরকার নয়। এরা ভারতের পুতুল সরকার। এরা বিডিআরকে ধ্বংস করেছে। সেখানে সেনাবাহিনীর ৫৭ জন দক্ষ ও চৌকস অফিসারকে হত্যা করেছে। এখন সাজানো বিচার করছে। বিডিআর হত্যাকান্ডের বিচার একদিন হবে। বিএনপি ক্ষমতায় এলে প্রকৃত দোষীদের বিচার করা হবে।
খালেদা বলেন, স্বাধীনতার পরে ভারতীয়রা বলেছিল বাংলাদেশের নিজস্ব কোনো সেনাবাহিনীর দরকার নেই। ৭১-৭৫ সালে বাংলাদেশের সেনাবাহিনী ছিল ছোট আকারে। তখন মাত্র চারটি বৃগেড ছিল। তখন তাদের ইউনিফরম ছিল না। থাকার জায়গা ছিল না। অথচ রক্ষীবাহিনীর জন্য সুন্দর সুন্দর ইউনিফরম দিয়েছিল। তাদের উদ্দেশ্য ছিল নামমাত্র সেনাবাহিনী থাকবে আর নিয়ন্ত্রণ করবে ভারত।
তিনি বলেন, আমরা পিন্ডির শৃঙ্খল ভেঙে দিল্লির শৃঙ্খলে আবদ্ধ হওয়ার জন্য দেশ স্বাধীন করিনি। ভারতের সঙ্গে আমাদের কোনো বিরোধিতা নেই। তাদের সঙ্গে আমরাও বন্ধুত্ব চাই। তবে তা হবে সমমর্যাদার ভিত্তিতে। সব তাদের দিয়ে দেব, বিনিময়ে কিছু পাব না, তা হবে না। তারা প্রতিটি নদীতে বাধ দিয়ে পানি নিয়ে যাচ্ছে। আমাদের দেশকে মরুভূমিতে পরিণত করেছে। এসব ঠেকাতে হবে।
অবশেষে বাধ্য হলো ইনডিয়া
খালেদা যখন পোলো গ্রাউন্ডে সাধারণ মানুষের কাছে এই আবেদন করছিলেন ঠিক প্রায় সেই সময়ে আখাউড়াতে ইনডিয়ার কম্পানি তিতাস নদীতে অবৈধভাবে দেয়া বাধ কাটা শুরু করেছিল। তার পর থেকে ধীরগতিতে হলেও ইনডিয়ানরা আশুগঞ্জ থেকে আখাউড়া পর্যন্ত রুটে ষোলটি কালভার্টের পাশে ও তিতাস নদীতে যে দুটি বাধ দিয়েছিল, সেসব কেটে ফেলা হচ্ছে বলে জানিয়েছে।
পোলো গ্রাউন্ডে খালেদা ইনডিয়া প্রসঙ্গে ইতিবাচক কথাও বলেন। তিনি বলেন, বিদেশের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তোলা হবে। ইনডিয়ার উদ্দেশে তিনি বলেন, আওয়ামী লীগের সঙ্গে সম্পর্ক করে লাভ নেই। এদেশের জনগণের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তুলতে হবে। তাহলে জনগণের সরকার ক্ষমতায় এলে তারাও আপনাদের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক রাখবে। পারস্পরিক আলোচনা ও লেনদেনের মাধ্যমে সম্পর্ক থাকবে। তবে কেবল দেবে আর বাংলাদেশ কিছুই পাবে না, এটা চলবে না।
খালেদা জিয়া যেটা বলেন নি সেটা হলো, গত তিন বছরে বাংলাদেশের মানুষ যতো ইনডিয়াবিমুখ হয়েছে, তেমনটা বাংলাদেশের চল্লিশ বছরের ইতিহাসে ঘটেনি।
এর জন্য দায়ী শুধু বাংলাদেশ সরকার ও আওয়ামী লীগ নয় এর জন্য দায়ী ইনডিয়ার মুনাফালোভী শিল্পপতি-ব্যবসায়ী, অহংকারী আমলা ও সেনাতন্ত্র, চক্রান্তকারী গোয়েন্দা সংস্থা র (RAW) এবং বাংলাদেশ সম্পর্কে অগভীর ও অস্বচ্ছ ধারণা পোষণকারী দিল্লির পলিটিশিয়ানরা।
তরুণদের প্রতি আবেদন
অক্টোবরে সিলেটের রোড মার্চ থেকে খালেদা জিয়া তার ভাষণে বলা শুরু করছেন, ভবিষ্যতে সরকারের বিভিন্ন কর্মকান্ডে তরুণদের অগ্রাধিকার দেয়া এবং বিভিন্ন কাজে তাদের শরিক করা হবে। সর্বশেষ রোড মার্চে ফেনীর জনসভায় খালেদা বিষয়টি আরো পরিষ্কার করে বলেন, ভবিষ্যতে নবীন ও প্রবীণদের সমন্বয়ে দেশ চালাতে তিনি আগ্রহী। ফেনীতে তিনি বলেন, এক সময়ে প্রবীণরা পেছনে সরে যাবেন এবং নবীনদের গাইড করবেন।
পোলো গ্রাউন্ডে একই ধারায় যুবকদের উদ্দেশে খালেদা বলেন, আমরা ক্ষমতায় গেলে তোমাদের জন্য কাজ করব। তোমাদের জন্য কর্মসংস্থান ও ব্যবসা-বাণিজ্যের ব্যবস্থা করব। আমরা নবীন-প্রবীণের সমন্বয়ে একটি সুন্দর দেশ গড়ে তুলব। বেকারদের চাকরি দেব। শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে তরুণদের কর্মসংস্থান করে দেয়া হবে। সুশাসন নিশ্চিত করব। নিরপেক্ষ ও শক্তিশালী প্রশাসন গড়ে তুলব। তিনি আরো বলেন, সেনাবাহিনী, পুলিশ ও প্রশাসনের যেসব মেধাবীকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে, তাদের পুনর্বহাল করা হবে।
তরুণ ও নবীনদের সম্পর্কে খালেদার এসব উক্তিতে অনেকের ধারণা হয় তিনি হয়তো নির্বাচনের পর তার স্থানে তারেক রহমানকে বসিয়ে দেয়ার ইঙ্গিত দিচ্ছেন। না। সেটা নয়। খালেদার বয়স এখন সাতষট্টি এবং একজন অভিজ্ঞ ও সফল পলিটিশিয়ান রূপে তিনি জানেন আগামী নির্বাচনে এ দেশের তরুণ ভোটারদের ভোটেই তাকে বিজয়ী হতে হবে। পোলো গ্রাউন্ডে তরুণদেরই আধিক্য ছিল। তাদের উদ্দেশ্যেই তিনি এ কথা বলেন। তিনি জানেন, তারেক রহমান এখনো লন্ডনে চিকিৎসাধীন এবং ভবিষ্যতে মানুষ যদি চায় তাহলে নির্বাচনী প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই তারেক ক্ষমতাপ্রার্থী হতে পারেন।
প্রতারনার শাসন
নির্বাচনে বিজয়ী হলে তার সরকার আরো কী করবে সে বিষয়ে খালেদা বলেন, চট্টগ্রামে আওয়ামী লীগ কোনো উন্নয়ন করেনি, যা উন্নয়ন হয়েছে সব আমাদের সময় হয়েছে। এখানে একজন মেয়র ছিল যার জন্য কোনো কাজ করা যায়নি। কর্ণফুলী সেতুর ভিত্তিপ্রস্তর করার দিনও হরতাল দিয়েছিল।
তিনি বলেন, কর্ণফুলী সেতু, গোমতী সেতু, ভৈরব সেতু, যমুনা সেতু, লালন সেতুসহ সব বড় বড় সেতু আমরাই করেছি। তারা শুধু উদ্বোধন করতে পারে। কোনো কাজ করতে পারে না। বলেছিল পদ্মা সেতু করবে, তখন মনে করেছিলাম এবার মনে হয় আওয়ামী লীগ কিছু করে দেখাবে। কিন্তু দুর্নীতির কারণে তাও পারেনি। এই পদ্মা সেতু একটি নয়। আমরা মাওয়া ও দৌলতদিয়ায় দুটি পদ্মা সেতু করব। তিনি বলেন, বিএনপি সব সময় জনকল্যাণের জন্য কাজ করে। আওয়ামী লীগ শুধু দেশকে ধ্বংস করেছে। এ দেশকে আবার নতুন করে গড়ে তুলতে হবে।
খালেদা বলেন, এ সরকার চাকরি দেয়ার কথা বলে ঘরে ঘরে বেকার বাড়িয়েছে। চালসহ নিত্যপণ্যের মূল্য বৃদ্ধি করেছে। আমরা ক্ষমতায় এলে চাল, কৃষি উপকরণ, সারসহ সব কিছুর দাম কমাব।
সরকারের তিন বছরের শাসনকে ‘প্রতারণার শাসন’ অভিহিত করে খালেদা বলেন, আওয়ামী লীগ সরকার তিন বছরে দেশের মানুষের জন্য কিছু করতে পারেনি। নির্বাচনের সময় যে ওয়াদা তারা করেছিল তার কিছুই রক্ষা করেনি। কেবল ভারতকে দেয়া ওয়াদা পূরণের মাধ্যমে ক্ষমতা পাকাপোক্ত করার কাজ করেছে। তিনি বলেন, চারদলীয় জোট সরকারের সময়ে দেশে দারিদ্র্য কমেছিল। আর এ সরকার জনগণকে না খাইয়ে মারছে। সারা দেশে কোথাও উন্নয়নের ছোয়া নেই। এই সরকারের বয়স তিন বছর। মইনউদ্দিন-ফখরুদ্দীনের সময় চাল, ডাল ও তেলের দাম বেড়েছিল। তখন তারা ওয়াদা করেছিল দাম কমাবে; কিন্তু কমায়নি। এখন ডাল ১২০ টাকা, তেল দেড়শ টাকা, মোটা চাল এক কেজি ৩৫ থেকে ৪০ টাকা। মানুষ খেতে পায় না। দশ টাকা কেজি চাল, ঘরে ঘরে চাকরি দেয়ার ওয়াদা করেছিল; কিন্তু দিতে পারেনি।… এখন বিদেশে তাদের কোনো বন্ধু নেই। মধ্যপ্রাচ্যে শ্রমিক যাচ্ছে না।
মালয়শিয়াতেও শ্রমিক নেয়া বন্ধ।
প্রতিনিয়ত বিদেশ থেকে মানুষ ফিরে আসছে।
তাই উন্নয়নের কথা আওয়ামী লীগের মুখে শোভা পায় না। ফখরুদ্দীন-মইনউদ্দিনের সময় ব্যাপক দুর্নীতি হয়েছে। আর আমাদের নামে মিথ্যা মামলা দিয়েছে। আজকে সারা দেশে দুর্নীতি ছড়িয়ে পড়েছে। ওপর থেকে নিচ পর্যন্ত সবাই দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত। বিনা টেন্ডারের কুইক রেন্টাল পাওয়ার প্লান্ট নিজেদের দলের লোকদের দিয়েছে। এই খাত থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা লুটে নিয়ে গেছে। বিদ্যুতের এ ভর্তুকির জন্য দফায় দফায় বিদ্যুতের দাম বাড়িয়েছে। … এখন অনেক শিল্পকারখানা বন্ধ হয়ে গেছে।
সরকারের পরিকল্পনা হলো, আমাদের শিল্পকারখানা বন্ধ হবে আর ভারতের লোকেরা এসব কিনে নেবে। তিনি বলেন, যারা ফ্ল্যাটের ব্যবসা করেন তারা ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে ফ্ল্যাট বানিয়েছেন; কিন্তু বিদ্যুতের জন্য ফ্ল্যাট বিক্রি করতে পারছেন না, ভাড়া দিতে পারছেন না। …বাংলাদেশ একটি সম্ভাবনাময় দেশ। সম্পদ ও জনশক্তিকে কাজে লাগাতে পারলে এ দেশ গরিব থাকবে না। দুর্নীতি দূর, দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ, যানজটমুক্ত শহর, কৃষকের পণ্যের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করবো।
ভবিষ্যতে এই ধরনের অঙ্গীকার করার সময়ে খালেদাকে খুব সতর্ক থাকতে হবে যেন এসব বিশ্বাসযোগ্য ও বাস্তবায়নযোগ্য হয়। ম্যানিফেস্টোতে অবাস্তব অঙ্গীকার করে আওয়ামী লীগ মিথ্যা কথনের দোষে দুষ্ট হয়েছে।
ম্যানিফেস্টো এখন হয়ে গেছে মিথ্যাচারের দলিল মিথ্যাফেস্টো।
খালেদা যেন একই অভিযোগে অভিযুক্ত না হন সেটি মনে রাখতে হবে।
দরকার গণতান্ত্রিক আন্দোলন
কিন্তু কীভাবে বর্তমান সরকারের বিদায় ঘটবে?
খালেদা বলেন, দেশ এখন মহাসঙ্কটে। আমরা নৈরাজ্য ও ধ্বংসাত্মক কর্মসূচিতে বিশ্বাস করি না। গণতান্ত্রিক আন্দোলনেই জনতার চাপে এ সরকারকে বিদায় করা হবে।
খালেদা জানেন, বিএনপি একটি অহিংস দল। লাঠি-বৈঠা-লগি নিয়ে রাজপথে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে জয়ী হবার সম্ভাবনা বিএনপির কম। সুতরাং বিএনপিকে শান্তিপূর্ণ নিয়মতান্ত্রিক পথেই নির্বাচনের দিকে যেতে হবে। পোলো গ্রাউন্ডে এ কথাই তিনি বলেন।
চাই তত্ত্বাবধায়ক সরকার
তবে নির্বাচন হবে কোন ভাবে?
সে বিষয়ে খালেদা সুস্পষ্ট মত দেন।
খালেদা বলেন, আওয়ামী লীগ নিজেদের অধীনে নির্বাচন করতে চায়। তাদের অধীনে কখনো ফেয়ার ইলেকশন হয়নি। ৭৩ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ প্রায় সব সিট পাওয়ার পরও কয়েকটি সিটের জন্য হেলিকপ্টারে করে ব্যালট নিয়ে এসে নিজেদের দলের লোকদের জিতিয়েছিল। যারা হেলিকপ্টারে ব্যালট আনে তাদের অধীনে নির্বাচন সুষ্ঠু হতে পারে না।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন সুষ্ঠু হয় দাবি করে খালেদা জিয়া বলেন, বিচারপতি সাহাবুদ্দীন, মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান ও লতিফুর রহমানের সময় নির্বাচন নিরপেক্ষ হয়েছে। তারা ফখরুদ্দীনের সরকারের কথা বলে। আমরা ফখরুদ্দীন সরকারকে কোনো তত্ত্বাবধায়ক সরকার বলি না। তারা ছিল একটি অবৈধ অসাংবিধানিক সরকার। ২২ জানুয়ারি ২০০৭ আওয়ামী লীগ নির্বাচনে না যাওয়ার কারণেই দেশে তখন ওই অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল। এ জন্য আওয়ামী লীগের একদিন বিচার হবে।
খালেদা বলেন, আওয়ামী লীগের ইতিহাস একদলীয় শাসনের ইতিহাস, গণতন্ত্র ধ্বংসের ইতিহাস। আওয়ামী লীগের ইতিহাস মানুষ হত্যার ইতিহাস, দুর্ভিক্ষের ইতিহাস। স্বাধীনতার পরে লালবাহিনী, নীলবাহিনী, রক্ষীবাহিনী গঠন করে তারা ৪০ হাজার রাজনৈতিক নেতাকর্মীকে হত্যা করেছিল। সিরাজ সিকদারকে হত্যা করেছে। এক দিকে হত্যাকারীদের বিচার করবেন অন্য দিকে ফাঁসির দন্ড প্রাপ্তদের ছেড়ে দেবেন, তা হবে না। এই দ্বৈত নীতি পরিহার করতে হবে। … এখন প্রতিনিয়ত মানুষ গুম হচ্ছে। সেনাবাহিনীর অফিসারও গুম হচ্ছে। লাশ পাওয়া যাচ্ছে না।
খালেদা বলেন, কোনো দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন সুষ্ঠু হবে না। সরকার সিটি করপোরেশনের নির্বাচনের উদাহরণ দেয়। এগুলো কোনো বিষয় নয়।
জনগণের বাংলাদেশ
এক পর্যায়ে খালেদা বলেন, আপনারা স্লোগান দিয়েছেন খালেদা জিয়ার সরকার। আমি বলবো, এই মুহূর্তে দরকার জনগণের সরকার। আমি বলবো, শেখ হাসিনার দিন শেষ, জনগণের বাংলাদেশ।
খালেদার এই উক্তিতে বোঝা যায় মির্জা আব্বাস যখন স্লোগান দিচ্ছিলেন তখন খালেদা কী ভাবছিলেন। এই ধরনের তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া খালেদার পোলো গ্রাউন্ডের ভাষণকে করেছিল আরো সমৃদ্ধ, আকর্ষণীয়।
বস্তুত, অনেকের মতে নোটবিহীন খালেদার এই ভাষণ ছিল সাবলীল, সুন্দর ও সময়োপযোগী এবং সব পয়েন্টই কভার করেছিল। শুধু একটি বাদে। সেটি হলো তিনি তথাকথিত যুদ্ধাপরাধীদের বিচার সম্পর্কে এই ভাষণে কিছু বলেন নি। হতে পারে এটা ছিল অনিচ্ছাকৃত অমিশন। আর তাই যদি হয় তাহলে ভবিষ্যতে এ ধরনের ভাষণের জন্য নোটস নয়, কিছু বুলেট পয়েন্ট লিখে রাখতে পারেন।
সবশেষে তিনি ১২ মার্চ ২০১২ – তে সবাইকে ‘ঢাকা চলো’- র ডাক দেন।
সাড়ে পাঁচটায় খালেদা তার পয়তাল্লিশ মিনিটব্যাপী ভাষণ শেষ করেন।
চট্টগ্রাম পোলো গ্রাউন্ড লুণ্ঠন
তখন গোধূলি বেলা।
মানুষ দেখছিল মঞ্চে একজন আশাবাদী মানুষকে যিনি তরুণদের আশার কথা শোনাচ্ছেন ও বাংলাদেশের কিছু ভবিষ্যৎ রূপরেখা দিচ্ছেন।
মানুষ দেখছিল মঞ্চে একজন সাহসী নারীকে যিনি জীবনের পড়ন্ত বেলায়, সব ঝুকি অগ্রাহ্য করে বাংলাদেশে চলমান দুরবস্থা, ইনডিয়ার হস্তক্ষেপ, সেনাবাহিনীতে বিশৃঙ্খলা প্রভৃতি বিষয়ে নিঃশঙ্কচিত্তে বলছেন।
মানুষের মনে পড়ছিল এই চট্টগ্রামেরই আরেক দুঃসাহসিক মানুষ সূর্য সেনের কথা। তাদের মনে পড়ছিল এই পোলো গ্রাউন্ড থেকে মাত্র দেড় কিলোমিটার দূরে দামপাড়ায় অবস্থিত চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের ঘটনাটি।
আজ থেকে প্রায় বিরাশি বছর আগে ১৮ এপ্রিল ১৯৩০-এ দামপাড়ায় অবস্থিত পুলিশ আর্মারি ও অকজিলিয়ারি ফোর্স আর্মারি লুট করেছিল। সূর্য সেনের নেতৃত্বে প্রায় পঞ্চাশ তরুণ সেখানের সব রিভলভার, রাইফেল ও একটি লুইস গান (Lewis Gun) লুট করেছিল।
তারপর তারা টেলিগ্রাফ অফিস দখল করেছিল এবং সূর্য সেনকে প্রেসিডেন্ট করে ইনডিয়া একটি অন্তবর্তীকালীন সরকার প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দিয়েছিল।
তারা এই অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের পর ইওরোপিয়ান ক্লাবে গিয়ে বৃটিশদের বন্দী করেছিল। কিন্তু তাদের মধ্যে ছিল বিশ্বাসঘাতক যাদের সাহায্যে এই বিদ্রোহের পতন ঘটায় বৃটিশরা। বিদ্রোহীরা কেউ পালিয়ে যায়। কেউ ধরা পড়ে। চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন মামলা শেষ হয় ১৯৩২-এ। সূর্য সেন ধরা পড়েন ফেব্রুয়ারি ১৯৩৩-এ এবং তার ফাঁসি হয়।
কিন্তু তিনি এই দেশকে স্বাধীন করার যে মন্ত্র দিয়ে যান সেটা বৃটিশরা বন্ধ করতে পারেনি।
বিরাশি বছর পরে খালেদা জিয়া বাংলাদেশকে স্বাধীন ও সার্বভৌম রাখার যে মন্ত্র পোলো গ্রাউন্ডে দিয়েছেন সেটা কারো পক্ষেই বন্ধ রাখা সম্ভব হবে না, ইনডিয়ারও না।
চুরি, ডাকাতি, লুণ্ঠন কোনো ভালো কাজ নয়। সুস্থমনা কোনো নাগরিক এসব সহিংসতা সমর্থন করতে পারেন না।
কিন্তু বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার পুকুরচুরি থেকে শুরু করে পদ্মা সেতু ডাকাতি যখন করছে তখন বিরাশি বছর আগের সেই অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের আর কোনো বিকল্প আছে কি?
খালেদা সেদিকে যান নি। সে রকম কথা তিনি বলেন নি।
কিন্তু তিনি গত ৯ জানুয়ারি ২০১২-তে তার ভাষণে চট্টগ্রাম পোলো গ্রাউন্ডে সমবেত কয়েক লক্ষ মানুষের হৃদয় লুট করেছেন।
খালেদা জিয়া চট্টগ্রাম পোলো গ্রাউন্ডে লুণ্ঠন সেরে সেদিন রাতেই ঢাকায় ফিরে যান।

১৪ জানুয়ারি ২০১২
শফিক রেহমান : প্রবীণ সাংবাদিক ও জনপ্রিয় টিভি অনুষ্ঠান উপস্থাপক।
সংশোধনী
‘রাজনীতিতে নতুন কালচার রোড মার্চ’ শীর্ষক গত শুক্রবার ১৩ জানুয়ারিতে প্রকাশিত রচনাটির প্রথম লাইনে একটি ছাপার ভুল ছিল। চায়নাতে লং মার্চ শেষ হয়েছিল ২২ অক্টোবর ১৯৩৫-এ, ১৯৬৫-তে নয়।
সম্পাদক

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন