শুক্রবার, ২৭ জানুয়ারী, ২০১২

ভাষা আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছিল ছাত্ররা


shafik-rehman11111শহীদ মিনার, শহীদ মিনার চত্বর ও সেখানে যাবার পথগুলো মিলিয়ে এখন যে শহীদ মিনার এলাকাটি গড়ে উঠেছে, ১৯৫২-তে তার রূপ ছিল সম্পূর্ণ অন্যরকম।
এখন শহীদ মিনার এলাকা সরগরম হয়ে ওঠে প্রতি বছর ফেব্রুয়ারির সূচনায় ভাষা দিবস পালনের সরকারি ও বেসরকারি প্রস্তুতিতে। ২১ ফেব্রুয়ারির পরে এলাকাটি ঝিমিয়ে পড়ে। মাঝে মধ্যে জেগে ওঠে ছোটখাটো আলোচনা ও ভাষণ সভায় অথবা কোনো বরেণ্য ব্যক্তির অন্তিম যাত্রা উপলক্ষে শোক মিছিলে। বছরের অন্য সব দিনে শহীদ মিনার এলাকায় প্রাণচাঞ্চল্য থাকে অনুপস্থিত। কোলাহল থাকে কিঞ্চিৎ।
১৯৫০-এর শুরু থেকে এই এলাকাটি প্রতিদিনই, বিশেষত সন্ধ্যার পর থেকে হয়ে উঠতো প্রাণচাঞ্চল্যে ভরপুর এবং কোলাহল মুখরিত।
এখানে ছিল মেডিকাল কলেজ হস্টেলের সারি সারি টিনশেডের একতলা আবাস যার দেয়ালগুলোর নিচের অংশ ছিল ইটের এবং ওপরের অংশ ছিল চাটাইয়ের। রোকেয়া হলে যাবার পথে এই হস্টেলগুলোর উল্টো দিকে অনেক আম গাছের ফাকে ফাকে ছিল একটার পর একটা রেস্টুরেন্ট যাদের সামনে আঙিনাগুলো ছিল চাটাইয়ের বেড়া দিয়ে ঘেরা। খোলা আকাশের নিচে আঙিনায় পাতা ছিল কাঠের চেয়ার ও টেবিল। ইট-চাটাই-টিনশেডের মূল রেস্টুরেন্ট ও কিচেন ছিল অল্প জায়গায়।
স্লো ফুড ও ফাস্ট আলোচনা
এসব রেস্টুরেন্টে দিনের বেলায় মেডিকাল কলেজের ছাত্ররা সকালের নাশতা ও দুপুরের খাবার খেত। সন্ধ্যার পর থেকে জমে উঠতো সবগুলো রেস্টুরেন্ট। ওয়েটারদের বলা হতো ‘বয়’। ময়লা ও আধা ভেজা গামছা কাধে হন্তদন্ত হয়ে চা আর খাবার সার্ভ করতো অল্পবয়সী সেই বয়রা। সেই সময়ে কোকাকোলা ও পেপসি ছিল না। ফ্রায়েড চিকেন, ফ্রেঞ্চ ফ্রাই বা চিপস এবং কফিও ছিল না। খাবার বলতে সকালে ছিল পরটা, হালুয়া ও অমলেট। দুপুরে ছিল ভাত, মাছ ও গরুর মাংসের তরকারি এবং ডাল ও শবজি ভাজি। তখন পোল্ট্রি শিল্প ছিল না। তাই মুরগির মাংস ছিল কম। সন্ধ্যার মূল মেনু ছিল পরটা, গরুর মাংসের ঝাল তরকারি এবং শিক কাবাব, সমুচা, সিঙ্গাড়া।

সন্ধ্যায় এসব রেস্টুরেন্টের আরেকটি আকর্ষণ ছিল মিউজিক। তখন সিডি, ক্যাসেট প্লেয়ার ছিল না। সেভেনটিএইট আরপিএম-এর রেকর্ড বাজানো হতো গ্রামোফোনে। বাজতো লতা মঙ্গেশকর, শমসাদ বেগম, মোহাম্মদ রফি, মুকেশের হিন্দি এবং হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, শ্যামল মিত্র, সতীনাথ মুখোপাধ্যায়, উৎপলা সেন প্রমুখের বাংলা গান। এদের গানের ভিড়ে লাইভ মিউজিকের একমাত্র পরিবেশক ছিলেন মুসলেহউদ্দিন। ফর্শা, লম্বা এবং কিছুটা কৃশকায় মুসলেহউদ্দিনের বোন জহরত আরা ছিলেন ছাত্রীদের মধ্যে ভালো অভিনেত্রী। পরবর্তীকালে জহরত আরা হয়েছিলেন পূর্ব পাকিস্তানের প্রথম মুভি ‘মুখ ও মুখোশ’-এর নায়িকা ও ইংল্যান্ড প্রবাসী। মুসলেহউদ্দিন হয়েছিলেন পাকিস্তানি মুভির সুরকার ও লাহোর প্রবাসী।
মুসলেহউদ্দিনের সঙ্গীত প্রতিভার প্রথম বিকাশ ঘটেছিল সেইসব রেস্টুরেন্টে। প্রায় প্রতি সন্ধ্যায় তিনি সেখানে নিজের এবং অপরের গান হারমোনিয়াম বাজিয়ে শোনাতেন।
স্লো ফুড, ক্যাপস্টান সিগারেট, চা, গান ও রাজনীতির ফাস্ট আলোচনা ছিল এসব রেস্টুরেন্টে আড্ডার চালিকাশক্তি। ১৯৫২-র ফেব্রুয়ারিতে আমি ঢাকা কলেজের ছাত্র জীবন শেষ করে আই-এ পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে ঢোকার লক্ষ্যে। আমার বয়স ১৭ হলেও উচ্চতা ছিল কম এবং হাফপ্যান্ট পরতাম। রেস্টুরেন্টের ওইসব আড্ডায় যোগ দেয়ার বয়সগত ও আর্থিক যোগ্যতা আমার ছিল না। তবুও মাঝে মাঝে সেখানে যেতাম। শুনতাম চলমান রাজনীতির কথা।
জিন্নাহ-র ঘোষণা
১৯ মার্চ ১৯৪৮-এ ঢাকায় এসেছিলেন পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা আন্দোলনের নেতা ও পাকিস্তানের প্রথম গভর্নর জেনারেল মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ। দুই দিন পরে ২১ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে এবং তার তিন দিন পরে ২৪ মার্চ ঢাকা ইউনিভার্সিটির সমাবর্তনে তিনি ভাষণ দেন।

দুটি ভাষণে জিন্নাহর মূল বক্তব্য ছিল অভিন্ন। সব আঞ্চলিকতা ও প্রাদেশিকতা (সিন্ধি, পাঠান, বালুচি, পাঞ্জাবি, বাঙালি) এবং ধর্মীয় (মুসলিম সুন্নি-শিয়া-হিন্দু-কৃশ্চিয়ান-বৌদ্ধ) ভেদাভেদের উর্ধ্বে উঠে এক পাকিস্তানি চেতনাকে ধারণ করে সবাইকে জাতি গঠনের ডাক তিনি দেন।
২১ মার্চ রেসকোর্সের ভাষণে জিন্নাহ বলেন, “পূর্ব বাংলার অফিশিয়াল ভাষা বাংলা হবে কি না তা এখানকার নির্বাচিত প্রতিনিধিরাই ঠিক করবেন। এটি সম্পূর্ণরূপে এ অঞ্চলের জনগণের বিষয়। তারাই এটি নির্ধারণ করবেন। আমি আশা করি এ অঞ্চলের মানুষের আশা-আকাঙক্ষা অনুযায়ী এ সমস্যার সমাধান হবে।
আমি পরিষ্কার ভাষায় এ কথা আপনাদের জানিয়ে দিতে চাই, বাংলা ভাষার প্রশ্নে এই অঞ্চলের মানুষের দৈনন্দিন জীবনযাপনে চাকরি-বাকরিতে কোনোরূপ ক্ষতি, হতাশা বা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির কারণ ঘটবে না। এ প্রদেশের অধিবাসী হিসেবে আপনারাই আপনাদের প্রাদেশিক ভাষা যথাসময়ে নির্ধারণ করে নেবেন।

তবে আমি আপনাদের পরিষ্কার বলে দিতে চাই, নিখিল পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হতে যাচ্ছে উর্দু। অন্য কোনো ভাষা নয়। একটি রাষ্ট্রভাষা ছাড়া কোনো রাষ্ট্রকে কার্যকর ও শক্তিশালী ঐক্যের বন্ধনে আবদ্ধ করে রাখা যায় না। ইতিহাস তাই বলে। তাই পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে উর্দু। এ বিষয়ে সুরাহা যথা সময়ে হবে।
একই কথা তিনি আবার বলেন ২৪ মার্চ ঢাকা ইউনিভার্সিটির সমাবর্তনে। জিন্নাহ বলেন,
“পাকিস্তান রাষ্ট্রের বিভিন্ন অঞ্চলের মধ্যে অন্তঃবিনিময়ের জন্য একটি লিঙ্গুয়া ফ্রাঙ্কা নির্ধারণ করা যেতে পারে এবং এটি হতে হবে উর্দু। অন্য কোনো ভাষা নয়। পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে অবশ্যই উর্দু।”

সেদিনই সমাবর্তনে উপস্থিত ছাত্ররা জিন্নাহর এই বক্তব্যের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছিল। বলা যায় সেই দিন থেকে সূচিত হয়েছিল ছাত্রদের নেতৃত্বে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন। অন্যভাবে বলতে হয় এই আন্দোলন কোনো রাজনৈতিক নেতা বা দলের নেতৃত্বে সূচিত হয়নি। আওয়ামী লীগের তখন জন্ম হয়নি। সেই সব রেস্টুরেন্ট, আর্টস বিলডিংয়ে মধু-র ক্যান্টিন এবং পুরানা পল্টন ও আজিমপুরের টি স্টলে ছাত্ররা সেই প্রথম জড়িয়ে পড়লো স্বাধীনতা-উত্তর পাকিস্তানের সবচাইতে বেশি আবেগী রাজনৈতিক ইসুতে।
প্রশ্ন হচ্ছে ছাত্ররা কেন এই আন্দোলনের সূচনা করল এবং কেনই বা তারা পরবর্তী কয়েক বছরের আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে গেল? রাষ্ট্রভাষা বা অফিশিয়াল সরকারি ভাষার সঙ্গে ছাত্রদের কী সম্পর্ক ছিল? তাদের কী স্বার্থ ছিল?
রাষ্ট্রভাষা মানে কী?
একটি সরকারি ভাষা অফিশিয়াল ল্যাংগুয়েজ বলতে বোঝায় তেমনি একটি ভাষা যাকে বিশেষভাবে আইনগত মর্যাদা দেয়া হয়েছে কোনো রাষ্ট্রে। অথবা কোনো দেশে বা প্রদেশে। কোনো রাষ্ট্রের পার্লামেন্টে, প্রশাসনে ও আদালতের কার্যক্রমে যে ভাষা ব্যবহৃত হয় সেটাকে বলা হয় সরকারি ভাষা বা রাষ্ট্রভাষা। দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ যে ভাষায় কথা বলে সেটাই সাধারণত হয় রাষ্ট্রভাষা। তবে কিছু সংখ্যালঘিষ্ঠ অধিবাসীদের, যেমন আদিবাসীদের ভাষাও সরকারি ভাষা হতে পারে যদিও তা কদাচিৎ সরকারি কাজে ব্যবহৃত হয়। যেমন নিউ জিল্যান্ডে মাওরি ভাষা আইন ১৯৮৭ ((Maori Language Act 1987)-এ মাওরি জাতিদের ভাষা মাওরিকে সরকারি ভাষার স্বীকৃতি দেয়া হয়। যদিও নিউ জিল্যান্ডের ৫%-এরও কম মানুষ মাওরি ভাষায় কথা বলে। শুধু রাষ্ট্রই নয়, বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থারও অফিশিয়াল ভাষা থাকে। যেমন, জাতিসংঘের এবং ইওরোপিয়ান ইউনিয়নের কার্যক্রমে একাধিক অফিশিয়াল ভাষা ব্যবহৃত হয়।

রাষ্ট্রভাষা ও রাজনীতি
কোন দেশের সরকারি ভাষা কী হবে সেই প্রশ্নের সঙ্গে জড়িয়ে থাকে সেই দেশের সার্বভৌমত্ব, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও জাতীয়তাবাদ, আদিবাসী, সংখ্যালঘু সম্প্রদায় এবং বহিরাগত সম্প্রদায় সমূহের অধিকার প্রভৃতি বিষয়গুলো। যেমন, ইউনাইটেড স্টেটস বা আমেরিকার ৫০-টি অঙ্গরাজ্যে ইংলিশ এবং স্প্যানিশ।

স্প্যানিশ (নিউ মেক্সিকো, ক্যালিফোর্নিয়া, টেক্সাস ও ফ্লোরিডা রাজ্যের কয়েক স্থানসহ পুয়ের্তো রিকোতে সরকারি ভাষা এবং )।
নাভাহো (নিউ মেক্সিকো ও আরিজোনায়)।
ক্যারোলাইনিয়ান (উত্তর মারিয়ানা দ্বীপপুঞ্জে)।
চামোরো (গুয়াম ও উত্তর মারিয়ানা দ্বীপপুঞ্জে)।
ফ্রেঞ্চ (লুইসিয়ানা এবং নিউ হ্যাম্পশায়ার, ভারমন্ট ও মেইন-এ)।
হাওয়াইয়ান (হাওয়াইতে সরকারি ভাষা)।
স্যামোয়ান (আমেরিকান স্যামোয়াতে)। ইউনাইটেড স্টেটসে দেশ জুড়ে কোনো একটি অফিশিয়াল ভাষা নেই। সেখানে ফেডারাল সরকার পর্যায়ে ডি জুর (de jure) বা আইনত না হলেও, ডি ফ্যাক্টো (de facto ) বা কার্যত অফিশিয়াল ভাষা হচ্ছে ইংরেজি। ইংরেজি ভাষার জন্মস্থান খোদ ইউনাইটেড কিংডম বা ইউকে-তে ইংরেজি সরকারি ভাষা রূপে স্বীকৃত হলেও দেশের দশটি অঞ্চলে আরো দশটি ভাষা স্বীকৃত হয়েছে। যেমন
কর্নিশ (কর্নওয়ালে সংখ্যালঘুদের ভাষা)।
ডিজেরনিসিআইস (Degernesiais, গার্নসি-তে)।
ফ্রেঞ্চ (গার্নসি ও জার্সি-তে)।
জেরিআইস ( Jerriais জার্সি-তে)।
ম্যাংকস (আইল অফ ম্যান-এ)।
পিটকেইরনিজ (পিটকেইন দ্বীপপুঞ্জে)।
স্কটস (উত্তর আয়ারল্যান্ড ও স্কটল্যান্ডের সংখ্যালঘুদের ভাষা)।
স্কটিশ (গেইলিক স্কটল্যান্ডে)।
ওয়েলশ (ওয়েলস-এ)।

ছাত্ররা নেতৃত্ব দিল কেন?
একটু আগেই বলা হয়েছে কোনো রাষ্ট্রের পার্লামেন্টে, প্রশাসনে ও আদালতের কার্যক্রমে যে ভাষা ব্যবহৃত হয় সেটাকে বলা হয় সরকারি ভাষা বা রাষ্ট্রভাষা। ২৪ মার্চ ১৯৪৮-এ ঢাকা ইউনিভার্সিটির সমার্বতনে উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা জিন্নাহ-র এমন উক্তির তাৎক্ষণিক প্রতিবাদ জানিয়েছিল যেসব ছাত্র এবং ২১ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২-তে ঢাকা ইউনিভার্সিটিসহ বিভিন্ন শিক্ষায়তনে বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে যেসব ছাত্র সোচ্চার হয়েছিল তারা নিশ্চয়ই ভবিষ্যতে পার্লামেন্টে, প্রশাসনে ও আদালতের কার্যক্রমে তাদের কী সুবিধা-অসুবিধা হবে সেটা ভেবে ঝাপিয়ে পরেনি। ১৯৪৮-এ তাদের তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া এবং ১৯৫২-তে আন্দোলনের সূচনায় তারা বুঝেছিল তাদের মাতৃভাষা বাংলা এমন একটি সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের মুখে পড়েছে যাকে সর্বশক্তি দিয়ে রোধ না করলে এই ভূখণ্ডের বাঙালি জাতির বৈশিষ্ট্য হবে নিশ্চিহ্ন এবং অস্তিত্ব হবে বিপন্ন।

সাংস্কৃতিক আগ্রাসন বিরোধী এই চেতনার জন্ম হয়েছিল পুরানা পল্টন-শান্তিনগর থেকে প্রকাশিত ফজলে লোহানী সম্পাদিত মাসিক অগত্যা কেন্দ্রিক লেখকদের বিভিন্ন লেখালেখিতে। ১৯৪৭-এ উপমহাদেশ বিভক্তির পর পূর্ব পাকিস্তানে মিডিয়ার ব্যাপ্তি ছিল খুবই সীমিত। কলকাতা থেকে ঢাকায় আসার পরে দৈনিক, সাপ্তাহিক ও মাসিক পত্রিকার অভাব তীব্রভাবে অনুভব করতাম। আমাদের তখন নির্ভর করতে হতো সকাল দশটা-এগারোটার দিকে কলকাতা থেকে ডাকোটা প্লেনে আসা দৈনিক লোকসেবক, দৈনিক সত্যযুগ ও ইংরেজি দৈনিক দি স্টেটসম্যান-এর ওপর। আনন্দবাজার পত্রিকা পূর্ব পাকিস্তানে কখনোই কাঙিক্ষত ছিল না। সাপ্তাহিক পত্রিকা আসতো সচিত্র ভারত এবং মাসিক পত্রিকা আসতো অচলপত্র। এছাড়া বম্বে থেকে আসতো ইংরেজি সাময়িকী দি ইলাসট্রেটেড উইকলি অফ ইনডিয়া ও ফিল্মফেয়ার। আর করাচি পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আসতো ইংরেজি দৈনিক ডন (Dawn)।
ঢাকায় এসে পেয়েছিলাম সাপ্তাহিক ঢাকাপ্রকাশ যার প্রকাশ, ১৯৫০-এ পূর্ব পাকিস্তান থেকে শিক্ষিত হিন্দুদের অনেকাংশ ইনডিয়াতে চলে যাওয়ার পর হয়ে গিয়েছিল অনিয়মিত।
আগস্ট ১৯৪৭ পর্যন্ত আমরা কলকাতায় নির্ভরশীল ছিলাম মওলানা আকরাম খান সম্পাদিত দৈনিক আজাদ (যার ভাষা ছিল সনাতনী) এবং সাহিত্যিক আবুল মনসুর আহমদ সম্পাদিত দৈনিক ইত্তেহাদ-এর ওপর। পূর্ব পাকিস্তান সৃষ্টি হবার পর দৈনিক ইত্তেহাদ বিলুপ্ত হয়ে যায়। আর দৈনিক আজাদ আজিমপুর ঢাকা থেকে পুনঃপ্রকাশিত হলেও মুসলিম লীগ পন্থী হওয়ায় বিশ্বাসযোগ্যতা ও জনপ্রিয়তা হারিয়ে ফেলে।
আজিমপুর থেকেই প্রকাশিত সাপ্তাহিক সৈনিক তরুণ সমাজের কাছে গ্রহণযোগ্য হলেও তাতে ১৯৪৭ পূর্ববর্তী পাকিস্তান আন্দোলনের রেশ থেকে যাবার ফলে এবং ইসলামি ভাবাদর্শে পরিচালিত হবার কারণে তার প্রভাব হয় সীমিত।
কিন্তু ঠিক সেই সময়ে পুরানা পল্টন- শান্তিনগর ভিত্তিক মাসিক অগত্যা অতি দ্রুত তরুণ সমাজের ওপর ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করেছিল। এর কারণ ছিল অগত্যা লেখক গোষ্ঠীর আধুনিকতা ও অসাম্প্রদায়িকতা।
কিন্তু অগত্যার ভাবাদর্শ ও স্টাইল যে পুরোটা মৌলিক ছিল সেটা বলা যাবে না। ঢাকার মাসিক অগত্যা অনুপ্রাণিত হয়েছিল কলকাতার মাসিক দীপ্তেন্দ্র কুমার সান্যাল সম্পাদিত অচলপত্র দ্বারা। মাসিক অচলপত্র নিজেই ছিল লন্ডন থেকে প্রকাশিত ইংরেজি সাপ্তাহিক পাঞ্চ (Punch, ঘুষি) দ্বারা অনুপ্রাণিত। পাঞ্চের মতোই অচলপত্রে ছিল স্যাটায়ার, উইট ও পান ( pun, )ভরা শক্তিশালী লেখা, সমালোচনা ও কার্টুন। ইনডিয়া স্বাধীন রাষ্ট্র হবার পরপরই সেখানে হিন্দি ভাষার প্রাধান্য বিস্তারের প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিল বাংলাপন্থী অচলপত্র।

অচলপত্রই জানিয়েছিল বহুল প্রচলিত ইংরেজি শব্দগুলোকে হিন্দিতে রূপান্তরিত হবার প্ল্যান হয়েছে। ফলে, রেলওয়ে ইঞ্জিন হয়ে যাবে ভো পুকপুক, পোস্টবক্স হয়ে যাবে পত্রঘুসেট, নেকটাই হয়ে যাবে কণ্ঠিলেংগট, ইত্যাদি।
পাকিস্তানে তখন গোদের ওপর বিষফোড়া দেখা দিয়েছিল। শুধু উর্দুই যে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হবে এমন সিদ্ধান্ত প্রকাশ করেই পাকিস্তানি শাসক মহল থেমে যায়নি- করাচি থেকে তারা জানাচ্ছিল আরবি হরফে বাংলা লেখারও প্ল্যান হচ্ছে। এই সময়ে অগত্যায় ফজলে লোহানী একটি রূপান্তরিত কবিতা প্রকাশের মাধ্যমে তুলে ধরেন উর্দু-আরবির আগ্রসনে বাংলা ভাষার কী পরিণতি হতে পারে। সেটি ছিল:
বাংলা কবিতা
সকালে উঠিয়া আমি
মনে মনে বলি
সারাদিন আমি যেন
ভালো হয়ে চলি।
আদেশ করেন যাহা
মোর গুরুজনে
আমি যেন সেই কাজ
করি ভালো মনে।

রূপান্তরিত কবিতা :
ফজরে উঠিয়া হাম
দেলে দেলে বলি
পূরা রোজ হাম যেন
আচ্ছা হয়ে চলি।
হুকুম ফরমান যাহা
মোর মুরুব্বিয়ানে
হাম যেন ওহি কাজ
করে সাফ মনে।

অগত্যায় প্রকাশিত এই রূপান্তরিত কবিতাটি অতি সহজেই বুঝিয়ে দিয়েছিল বাংলা ভাষা কী ভীষণ বিপদে পড়েছে। সেই সময়ে টিভি ছিল না। একমাত্র রেডিও ছিল সরকার নিয়ন্ত্রিত। পত্রপত্রিকার সংখ্যা ছিল খুবই কম। তবুও শিক্ষায়তনে মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়েছিল এই রূপান্তরিত কবিতাটি। নোবেল বিজয়ী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের, ঔপন্যাসিক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের, বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের, কবি জীবনানন্দ দাশের, তারাশংকর, বিভূতিভূষণ, মানিক বন্দোপাধ্যায়, মীর মোশাররফ হোসেন, যাযাবর, সৈয়দ মুজতবা আলীর বাংলা ভাষার অস্তিত্ব রক্ষার দায়িত্ব তখন ছাত্ররাই নিজেদের কাঁধে তুলে নেয়।
কোনো স্বার্থপর রাজনৈতিক চেতনা নয়, সম্পূর্ণ নিঃস্বার্থ সাংস্কৃতিক চেতনাই ভাষা আন্দোলনের ভিত্তি রচনা করেছিল। এখানে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় জানিয়ে রাখা উচিত ২৩ জুন ১৯৪৯-এ প্রতিষ্ঠিত আওয়ামী মুসলিম লীগের কোনো সম্পৃক্তি ছিল না এই চেতনার উন্মেষে। প্রতিষ্ঠার সোয়া ছয় বছর পরে ২১ থেকে ২৩ অক্টোবরে আওয়ামী মুসলিম লীগের কাউন্সিল অধিবেশনে মুসলিম শব্দটি বাদ দিয়ে পার্টির সংশোধিত নাম হয় আওয়ামী লীগ। এই ঐতিহাসিক সত্যতার ভিত্তিতে বলতেই হবে যে ১৯৫২-র ভাষা আন্দোলনে আওয়ামী লীগের কোনো অবদান ছিল না। আর বিএনপির জন্ম তখনও হয়নি।
সমস্যা হচ্ছে এই যে এখন আওয়ামী লীগ বিভিন্নভাবে দাবি করছে তাদের নেতা শেখ মুজিবুর রহমান ভাষা আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০১১-তে ঢাকায় ওয়ার্ল্ড কাপ ক্রিকেটের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে ভাষা আন্দোলন ভিত্তিক একটি গ্রুপ নাচে পুরুষ নৃত্যশিল্পীদের গায়ে মুজিব কোট পরানো দেখা হয়। ১৯৫২-তে পূর্ব পাকিস্তানে মুজিব কোট কোনো রাজনৈতিক লেবাস ছিল না এবং শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে ভাষা আন্দোলনের তেমন কোনো সম্পৃক্তি ছিল না। আমাদের সৌভাগ্য যে আয়োজকরা দাবি করেন নি ওয়ার্ল্ড কাপ ক্রিকেটেরও স্বপ্ন দেখেছিলেন আওয়ামী লীগের কোনো নেতা এবং এর নেতৃত্ব দিয়েছিল আওয়ামী লীগ।
ভাষা আন্দোলন ছিল ছাত্রদের আন্দোলন। ছাত্ররাই প্রতিবাদ করেছিল। ছাত্ররাই মিছিল করেছিল। ছাত্ররাই জেলে গিয়েছিল। শেখ মুজিবুর রহমান অথবা আওয়ামী মুসলিম লীগের কোনো প্রথম সারির নেতাকে তখন আমি এ বিষয়ে প্রতিবাদীর ভূমিকায় দেখি নি। তাদের কথা শুনিনি। পড়িনি। এটাই সত্য। সেই সময়ে আমরা অনুপ্রাণিত হয়েছিলাম ছাত্রনেতা গাজীউল হক (প্রয়াত), ছাত্রনেতা আব্দুল মতিন, কবি-সম্পাদক হাসান হাফিজুর রহমান (প্রয়াত), গায়ক আবদুল লতিফ (প্রয়াত) সুরকার ও গায়ক আলতাফ মাহমুদ (প্রয়াত) প্রমুখ দ্বারা।
প্রসঙ্গত বলা উচিত যে আবদুল গাফফার চৌধুরী রচিত এবং আলতাফ মাহমুদ সুরারোপিত, একুশে ফেব্রুয়ারি আমি কি ভুলিতে পারি গানটি রচিত হয়েছিল ২১ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২-র ঘটনাগুলো ঘটে যাবার পরে, আগে নয়। ভাষা আন্দোলনের সূচনা লগ্নে যেসব গান আমাদের গভীরভাবে অনুপ্রাণিত করেছিল সেগুলোর রচয়িতা ছিলেন কাজী নজরুল ইসলাম (কারার ওই লৌহ কপাট, দুর্গম গিরি কান্তার মরু, চল চল চল উর্ধ্ব গগনে বাজে মাদল), সলিল চৌধুরী (নওজোয়ান নওজোয়ান, বিশ্বে জেগেছে নওজোয়ান) ও আব্দুল লতিফ (ওরা আমার মুখের ভাষা কাইড়া নিতে চায়), প্রমুখ।
আমার মনে আছে কারার ওই লৌহ কপাট গানটি গাইবার সময়ে লাথি মার ভাঙরে তালা লাইনটি একাধিকবার গাইতাম এবং আকাশের দিকে লাথি মারতাম।
সেই সময়ে একটি বিষয়ে ক্ষুব্ধ হতাম। তখন বলা হতো পাকিস্তানের মোট জনসংখ্যা সাড়ে সাত কোটি, যার মধ্যে সাড়ে চার কোটি বাঙালি। ভাবতাম সেক্ষেত্রে আমাদের আন্দোলনের মূল স্লোগান পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই কিছুটা নতজানু প্রকৃতির। সংখ্যাগরিষ্ঠের ভাষা হিসেবে স্লোগানটা হওয়া উচিত ছিল পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই।
অনুতপ্ত জিন্নাহ?
শেষ পর্যন্ত বাংলা ১৬ ফেব্রুয়ারি ১৯৫৬-তে পাকিস্তানের অফিশিয়াল ভাষা বা রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা পায়। একই সময়ে উর্দুও সেই মর্যাদা পায়। এখন জানা যাচ্ছে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা ইসুতে জিন্নাহ তার ভুল বুঝতে পেরে তারপর আর কখনো এ নিয়ে মন্তব্য করেন নি। ১৯৪৮-এ মৃত্যুর আগে বেলুচিস্তানে স্যানাটরিয়ামে থাকার সময়ে তার ব্যক্তিগত চিকিৎসক ড. এলাহি বক্স-এর কাছে রাষ্ট্রভাষা ইসুতে তার অবস্থান যে ভুল ছিল তা জিন্নাহ স্বীকার করেন। এখন পাকিস্তানে উর্দু হচ্ছে জাতীয় ভাষা, ইংরেজি সরকারি ভাষা, পাঞ্জাবি-বালুচি, পশতু হচ্ছে আঞ্চলিক ভাষা এবং হিন্দি হচ্ছে সিন্ধু প্রদেশের সহ-সরকারি ভাষা। জিন্নাহ অন্তিম শয়ানে তার ভুল স্বীকার করেছিলেন কিনা সেই সত্যতা প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হয়তো হবে না। কিন্তু এটা সত্য যে তিনি যদি পাকিস্তান আন্দোলনের নেতৃত্ব না দিতেন এবং পাকিস্তান জন্মের মাত্র সাত মাস পরেই উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা এমন উক্তি যদি না করতেন, তাহলে হয়তো এই উপমহাদেশে বাংলা একটি রাষ্ট্রভাষা হিসেবে কোনো দিনই আবির্ভূত হতো না। যেমন পশ্চিম বাংলায় অচলপত্র এবং সেই দেশের বহু বাঙালির প্রচন্ড আগ্রহ সত্ত্বেও বাংলা ইনডিয়ার রাষ্ট্রভাষা হয়নি । ইনডিয়াতে বাংলা সরকারি ভাষার মর্যাদা পেয়েছে শুধু পশ্চিম বাংলা, ত্রিপুরা, আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ এবং আসামের কিছু অংশে।

নতুন প্রজম্মের দায়িত্ব
নতুন প্রজম্মের কাছে আমি কামনা করছি বাংলাদেশের ভাষা আন্দোলন যে ছাত্রদের দ্বারাই পরিচালিত হয়েছিল সেই সত্য প্রতিষ্ঠায় সচেতন থাকবে এবং মহান ভাষা আন্দোলনকে দলীয়করণের অসভ্য, অন্যায় ও অশ্লীল প্রচেষ্টাকে রুখতে তৎপর থাকবে। আমি এটাও কামনা করবো প্রয়াত ফজলে লোহানীর মতো আরো অনেক লেখক, সাহিত্যিক, কবি ও গায়ক যারা ভাষা আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা রেখে এখন বিস্মৃতির অন্তরালে চলে গিয়েছেন, তাদের নাম ঠিকানা বের করে পাঠকদের জানাবে এবং একটি অতি প্রয়োজনীয় ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন করবে।

২০ ফেব্রুয়ারি ২০১১ ঢাকা।
শফিক রেহমান :
লেখক, সম্পাদক, টিভি অনুষ্ঠান উপস্থাপক

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন