শুক্রবার, ২৭ জানুয়ারী, ২০১২

শেখ হাসিনার উল্টো অবস্থান



shafik-rehman21শেখ হাসিনা সম্পূর্ণ উল্টো  হয়ে গিয়েছেন।
তার নেত্রীত্বে ১৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৯৬-এর সাধারণ নির্বাচন তৎকালীন বিরোধী দল আওয়ামী লীগ বয়কট করেছিল। কারণ তখন শেখ হাসিনা বলেছিলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন না হলে সেই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ অংশ নেবে না এবং সেই নির্বাচনের রায় মানবে না। ১৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৯৬-এ আওয়ামী  লীগের এই দাবি তুঙ্গে উঠেছিল। এর কয়েক মাস আগে থেকেই আওয়ামী লীগ এই দাবি আদায়ে সারা দেশে চরম অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টি করেছিল। ১৬ নভেম্বর ১৯৯৫-এ গাইবান্ধায় একটি জনসমাবেশে শেখ হাসিনা বলেছিলেন, জনগণের ভাত ও ভোটের অধিকার নিশ্চিত করতে তার দল আন্দোলনে নেমেছে। সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের লক্ষ্যে জনগণ আজ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে ঐক্যবদ্ধ। অন্য কোনো ফর্মুলা গ্রহণযোগ্য হবে না।
আওয়ামী লীগের এই আন্দোলনে প্রধান সহযোগী হয়েছিল  জামায়াতে ইসলামী (যাদের নেতাকর্মীকে এখন আওয়ামী সরকার বিনা বিচারে জেলবন্দি করে রেখেছে) এবং লে. জে, হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টি (যাদের সঙ্গে আওয়ামী লীগের সখ্য এখনো অটুট আছে)।
৭০ দিন হরতাল-অবরোধ
তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠার দাবিতে ১৯৯৪, ১৯৯৫ ও ১৯৯৬ সালে এ তিনটি দল অভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে মোট ৯৬ দিন হরতাল, অবরোধ এবং অসহযোগ কর্মসূচি পালন করেছিল। এর মধ্যে ৭০ দিন ছিল হরতাল-অবরোধ এবং ২৬ দিন অসহযোগ। এসব কর্মসূচিতে সকাল-সন্ধ্যা হরতালের পাশাপাশি একটি লাগাতার ৯৬ ঘণ্টা, দুটি ৭২ ঘণ্টা এবং পাঁচটি ৪৮ ঘণ্টার হরতাল ডাকা হয়েছিল।

আন্দোলনের এক পর্যায়ে তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়াকে টার্গেট করে আওয়ামী-জামায়াত-জাতীয় পার্টি জোট ঘোষণা দিয়েছিল, ১৯৯৬-এর নির্বাচনী অভিযানে যে জেলাতেই খালেদা সফর করবেন সেই জেলাতেই হরতাল হবে।
তাই হয়েছিল।

শুধু তাই নয়, দল হিসেবে আওয়ামী লীগের উগ্র, হিংস্র ও বেপরোয়া চারিত্রিক বৈশিষ্ট মোতাবেক এসব কর্মসূচিতে ব্যাপক ভাংচুর, বোমাবাজি, ককটেল ছোড়া, আগুন লাগানো ও গোলাগুলির ঘটনা ঘটেছিল। চট্টগ্রামে নতুন নির্মিত রেলওয়ে স্টেশনটি ধ্বংস হয়ে যায়। এসব সহিংসতায় নিহত হয় অর্ধশতাধিক ও আহত হয় সহস্রাধিক মানুষ। ১৬ ফেব্রুয়ারি ১৯৯৬-এ দৈনিক সংবাদ-এর রিপোর্টে বলা হয়, শুধু ১৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৯৬-এর নির্বাচনের দিনে হরতাল ও গণকারফিউ কর্মসূচিতে দেশের বিভিন্ন স্থানে সংঘর্ষে ১৫ জন নিহত এবং ছয় শতাধিক আহত হয়।

আওয়ামী লীগের এ আন্দোলনে বিভিন্ন যুক্তি দিয়ে জোরালো সমর্থন জানিয়েছিলেন আওয়ামী বুদ্ধিজীবীরা।

শেখ হাসিনার যুদ্ধ ঘোষণা
১৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৯৬-এ বিএনপি নির্বাচন করলেও এবং তাতে জয়ী হলেও তার আগেই দেশে প্রচ- নৈরাজ্য সৃষ্টি হয়েছিল। দেশ প্রায় অচল অবস্থায় পৌছে গিয়েছিল।

এসব সহিংসতার নির্দেশ আসে শেখ হাসিনার কাছ থেকেই। ৩ ও ৪ জানুয়ারি ১৯৯৬-এ ৪৮ ঘণ্টার হরতাল সফল করার ডাক দিয়ে তিনি বলেন, দাবি আদায় না করে ঘরে ফিরবেন না। সবাই মাঠে নেমে পড়–ন। যে কোনো ত্যাগ স্বীকারের জন্য প্রস্তুত থাকুন। … বিরোধী দলের (আওয়ামী লীগের) আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত কেউ যদি মোনাফেকি করে, সরকারের সঙ্গে নির্বাচনে যায় তাহলে তার সম্পর্কে আপনারা যা খুশি তাই ব্যবস্থা নেবেন। … প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া ভেবেছেন রোজার মাসে হরতাল হবে না। ইচ্ছা মতো ভোট চুরি করে একদলীয় নির্বাচন করিয়ে নেবেন। কিন্তু তিনি জানেন না রোজার মাসেও যুদ্ধ হয়েছিল। …।
১৯৯৬-এ শেখ হাসিনা যুদ্ধ করেছিলেন এবং সেই যুদ্ধে তার বিজয় দাবি করেছিলেন। নবনির্বাচিত বিএনপি সরকার কর্তৃক মার্চ ১৯৯৬-এ তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিল পাস এবং পরবর্তী তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা পদে বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান শপথ নেয়ার পর তার সাফল্য কামনা করে শেখ হাসিনা বলেছিলেন, জনগণের অপরিসীম ত্যাগ ও তিন দলের আন্দোলনের ফলে তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠার দাবি বিএনপিকে মানতে বাধ্য করা হয়েছে। … ন্যায় ও সত্যের সংগ্রাম সব সময় জয়ী হয়।
আমাদের আন্দোলনের ফসল
২০০৭-এ ঠিক একইভাবে ফখরুদ্দীন আহমদের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাফল্য কামনা করেছিলেন শেখ হাসিনা। অবশ্য তিনি জানতেন যে, জনগণের দাবিতে নয়, ১১ জানুয়ারি বা ওয়ান-ইলেভেনে জেনারেল মইন ইউ আহমেদের বন্দুকের জোরে সেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এরপর ১৫ মার্চ ২০০৭-এ আমেরিকায় নিরাপদ জীবন যাপনের লক্ষ্যে চলে যাওয়ার সময়ে ঢাকা এয়ারপোর্টে শেখ হাসিনা বলেন, আমাদের আন্দোলনের ফসল এই তত্ত্বাবধায়ক সরকার। তারা ফেল করলে আমাদের লজ্জা পেতে হবে। বিএনপি-জামায়াত আমাদের দোষারোপ করবে। আশা করবো, এ ধরনের পরিস্থিতি যেন না হয়। … তত্ত্বাবধায়ক সরকার তো মহাচোরদেরই ধরছে। এতে আমাদের ভীত এবং আতঙ্কিত হওয়ার কোনো কারণ নেই। দুশ্চিন্তার কী আছে? আমরা ক্ষমতায় গেলে তাদের এসব কার্যক্রম র‌্যাটিফাই করে দেবো। দেশের মানুষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কার্যক্রমের প্রশংসা করছে। এ সুন্দর পরিবেশ থাকতেই নির্বাচন সম্পন্ন করা উচিত। … সভা থাকতেই কীর্তন শেষ করতে হবে।

এখন সম্পূর্ণ উল্টো
কিন্তু ১৫ বছর পরে মে ২০১১-তে শেখ হাসিনা তার অবস্থান পুরোপুরিভাবে পাল্টে ফেলেছেন।
তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিষয়ে শেখ হাসিনা সম্পূর্ণ উল্টো হয়ে গিয়েছেন।
তিনি আর তত্ত্বাবধায়ক সরকার চান না।
তিনি এ বিষয়ে তার বিশ্বাসভাজন বিচারপতি (সদ্য সাবেক) এবিএম খায়রুল হকের রায়ের একাংশ মেনে ক্ষমতাসীন দলের (আওয়ামী লীগের) অধীনেই পরবর্তী সাধারণ নির্বাচনটা করতে চান।
শেখ হাসিনা যে এ পথেই যাবেন তার আভাস পাওয়া যাচ্ছিল কিছুকাল আগে থেকেই। ২৭ এপৃল ২০১১-তে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্রধান হিসেবে শেখ হাসিনা সংসদীয় কমিটির একটি বৈঠকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার রাখার পক্ষে মত প্রকাশ করেছিলেন। তিনি সেখানে বলেছিলেন, ৯০ দিনের মধ্যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার নির্বাচন দিতে ব্যর্থ হলে নির্বাচন আগের সরকারের (এক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের) অধীনেই অনুষ্ঠিত হবে।

আওয়ামী লীগের নীতি-নির্ধারক একটি সূত্রে জানানো হয়েছিল, শেখ হাসিনা কিছুদিন আগেও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বর্তমান ফর্মুলার বিকল্প নিয়ে দলের মধ্যে আলোচনা করেছিলেন। সেই সময় তারা পাকিস্তানের সাম্প্রতিক মডেলটি পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বিশ্লেষণ করেছিলেন।
পাকিস্তানি মডেলের মূল বৈশিষ্ট হচ্ছে, সরকারের মেয়াদ শেষে রাষ্ট্রপতি আলোচনা করবেন সংসদ নেতা এবং বিরোধী দলীয় নেতার সঙ্গে। এই আলোচনার ভিত্তিতে প্রধানমন্ত্রীসহ একটি অন্তর্বর্র্তীকালীন মন্ত্রিসভা গঠিত হবে।
উপরোক্ত সংসদীয় কমিটিতে শেখ হাসিনা যে প্রস্তাব দিয়েছিলেন তাতে এই পাকিস্তানি মডেলের কাছাকাছি একটি ব্যবস্থার আভাস তিনি দিয়েছিলেন। শেখ হাসিনা তখন বলেন, সংসদে সরকার এবং বিরোধী দলের ঐকমত্যের ভিত্তিতে সরকারপ্রধান নির্বাচিত হবেন অথবা সরকারি ও বিরোধী দলের পাঁচজন করে সদস্যের সমন্বয়ে গঠিত একটি কমিটি ঠিক করবে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান এবং অন্য উপদেষ্টা কারা হবেন।
এখন দেখা যাচ্ছে, শেখ হাসিনা সেই চিন্তা থেকেও সরে এসেছেন।

খণ্ডিত রায় মানতে ইচ্ছুক
কারণ স্বরূপ, ৩০ মে ২০১১-তে সংসদীয় কমিটির সদস্যদের বৈঠকে প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে অভিমত দেয়া হয়, আদালত যেহেতু তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করেছেন সেহেতু এ বিধানটি সংবিধানে রাখার দরকার আর নেই। উচ্চতর আদালতে তত্ত্বাবধায়ক সরকার সংক্রান্ত রায়ের একটি অংশ অর্থাৎ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা অবৈধ – শেখ হাসিনা মেনে নিলেন। কিন্তু ওই রায়ে আরো দুই দফায় তত্ত্বাবধায়ক সরকার রাখার পরামর্শটুকু বাদ দিলেন।

রায়ের একটি খ-িত অংশ মেনে নিয়ে শেখ হাসিনা তড়িঘড়ি করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার বিরুদ্ধে প্রচারণায় নেমে পড়লেন।
কিন্তু কেন?
কেন শেখ হাসিনা অত্যন্ত নির্লজ্জভাবে এখন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বুড়িগঙ্গায় ভাসিয়ে দিয়ে অত্যন্ত অনুগতভাবে আদালতের রায় মানতে বদ্ধপরিকর হয়েছেন?
এর উত্তর খুব সহজ।

১৯৯৬-এ শেখ হাসিনা তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা দাবি করেছিলেন। কারণ তখন তার ধারণা হয়েছিল, জনমতের অধিকাংশ ক্ষমতাসীন দল বিএনপির বিরুদ্ধে এবং একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা থাকলে আওয়ামী লীগ পরবর্তী সরকার গঠন করতে পারবে। তার এই ধারণা সত্য প্রমাণিত হয়েছিল। বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমানের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীন অনুষ্ঠিত নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টি জোট বেধে সরকার গঠন করতে পেরেছিল। ১১৬টি আসন পেয়ে বিএনপি হয়েছিল প্রধান বিরোধী দল।
তাই ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকাকালে তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার প্রতি অবিচল আস্থা ছিল। বস্তুত অক্টোবর ২০০১-এর নির্বাচন সামনে রেখে শেখ হাসিনা তৎপর হয়েছিলেন তার দৃষ্টিকোণ থেকে আওয়ামী অনুগত ব্যক্তিকে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) পদে নিযুক্তি দিতে (এমএ সাঈদ) এবং বিচারপতি লতিফুর রহমানকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হতে দিতে।
আস্থায় ফাটল
পরবর্তীকালে যখন দেখা গেল, প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রধান, উভয়েই নিজেদের বিবেক দ্বারা চালিত হচ্ছেন, তখন থেকেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার প্রতি শেখ হাসিনার আস্থায় ফাটল ধরে। ১ অক্টোবর ২০০১-এর  নির্বাচনে বিএনপি এবং তার সহযাত্রী দল জামায়াত দুই-তৃতীয়াংশের বেশি আসন পায় ও ক্ষমতাসীন হয়। শেখ হাসিনা তখন খোলাখুলিভাবে তদানীন্তন রাষ্ট্রপতি বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রধান বিচারপতি লতিফুর রহমানকে তার সহজাত অশালীন ভাষায় আক্রমণ করেন। আর সেই সময়েই শেখ হাসিনা দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ হন, ভবিষ্যতে কোনো সময়ে যদি আওয়ামী লীগ আবার ক্ষমতায় ফিরতে পারে তাহলে তখন তিনি তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাটির আমূল পরিবর্তন করবেন অথবা একেবারেই বর্জন করবেন। মে ২০১১-তে বিচারপতি খায়রুল হকের আনুকূল্যে শেখ হাসিনা ঠিক সেটিই করেছেন।

টিশু পেপার বনাম জায়নামাজ
দুটি বোধ থেকে শেখ হাসিনা জুন ২০১১-তে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বর্জনের যুদ্ধে নেমেছেন। একটি অনিশ্চিত বোধ এবং অন্যটি নিশ্চিত বোধ।

২০০১-এর পছন্দের তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রধান (বিচারপতি লতিফুর রহমান) এবং প্রধান নির্বাচন কমিশনার (এমএ সাঈদ) থাকা সত্ত্বেও ওই বছরের নির্বাচনে শোচনীয় পরাজয়ের পর কোনো তত্ত্বাবধায়ক সরকারই যে তার আশানুরূপ নির্বাচনী ফল এনে দেবে সে বিষয়ে শেখ হাসিনা অনিশ্চিত বোধ করছেন। উপরন্তু নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের অব্যাহত দাম বৃদ্ধি, বাড়ি ও বাস ভাড়া বৃদ্ধি, বেকারত্ব বৃদ্ধি, আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির গুরুতর অবনতি, বিদ্যুৎ, গ্যাস ও পানীয় জলের কমতির পরিপ্রেক্ষিতে শেখ হাসিনা এখন নিশ্চিত যে, প্রচলিত নিয়মে সুষ্ঠু ও স্বাভাবিকভাবে পরবর্তী নির্বাচন হলে আওয়ামী লীগের ভরাডুবি হবে।
আর তাই আওয়ামী লীগকে ক্ষমতাসীন রাখার বিকল্প ব্যবস্থা বের করতে হবে।
সে কারণেই সর্দি ঝাড়া টিশু পেপারের মতো শেখ হাসিনা এখন তত্ত্বাবধায়ক সরকার বর্জন করেছেন। বিচারপতি খায়রুল হকের রায়ের একাংশকে জায়নামাজের মতো পবিত্র ও শ্রদ্ধার আসন দিয়েছেন।

এর আগে কিছু বিষয়ে শেখ হাসিনা তার অবস্থান পাল্টেছেন। যেমন, ১৯৯৬-এ জামায়াত তার আন্দোলনে সহযাত্রী ছিল। এখন তিনি জামায়াত বিরোধী। ২০০৭-এ আওয়ামী লীগের তদানীন্তন জেনারেল সেক্রেটারি আবদুল জলিলকে ফতোয়াবাজ খেলাফত মজলিশ দলের সঙ্গে সমঝোতা চুক্তি করতে পাঠিয়েছিলেন। এখন বিশ্বস্ত আবদুল জলিল আওয়ামী রাজনীতিতে পতিত চরিত্র এবং খেলাফতে মজলিশ অনুক্ত দল। শেখ হাসিনা ঘোষণা দিয়েছিলেন, ৫৭ বছর বয়সে রিটায়ার করবেন। তিনি তা করেননি। বরং পূর্ণোদ্যমে কাজ করে চলেছেন। ১৯৯৬-এ ক্ষমতায় যাওয়ার পর শেখ হাসিনা বলেছিলেন, ভবিষ্যতে বিরোধী অবস্থানে গেলেও তার দল আর হরতাল করবে না। কিন্তু পরবর্তীকালে সেখান থেকে সরে এসে তার দল বহুবার হরতাল ডেকেছে। বলা যায়, এভাবেই শেখ হাসিনা বহুবার নিজের ভোল পাল্টেছেন। নিজের কথাকে নিজেই হাল্কা, ফালতু ও অবিশ্বাস্য করেছেন।
কেন এই সময়ে?
প্রশ্ন হচ্ছে, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ইসুটা তুলতে ঠিক এ সময়টাই কেন শেখ হাসিনা বেছে নিয়েছেন?
এর উত্তর হতে পারে দুটো।
এক. সাধারণ মানুষের জীবন ধারণের ইসুগুলো, যেমন দ্রব্যমূল্য, বাস ও বাড়ি ভাড়া বৃদ্ধি, বেকারত্ব বৃদ্ধি, খুন-রাহাজানি-ছিনতাই বৃদ্ধি, বিদ্যুৎ-গ্যাস পানির কমতি থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নেয়া এবং যুদ্ধ অপরাধীদের বিচার, বিভিন্ন হামলা-মামলা, শেয়ার বাজারে ধস, খালেদা জিয়াকে বাড়ি থেকে উচ্ছেদ, ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে গ্রামীণ ব্যাংক ও তার স্টাফ বাড়ি থেকে উচ্ছেদ, সিরাজগঞ্জ, রূপগঞ্জ ও অন্যান্য স্থানে কয়েক হাজার অজ্ঞাতনামা ব্যক্তির বিরুদ্ধে গনহুলিয়া জারি প্রভৃতি ইসুতে গত প্রায় আড়াই বছর বিএনপিকে ব্যতিব্যস্ত রাখার পর এখন তত্ত্বাবধায়ক সরকার বহাল রাখার ইসুতে ব্যস্ত রাখা।

দুই. এখনই বিএনপিকে আন্দোলনে নামতে বাধ্য করা। আগের নিয়ম অনুসারে ২০১৪-র প্রথম দিকে একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের কথা। অর্থাৎ এখন থেকে ৩১ মাস বা আড়াই বছর পর নির্বাচনটি হওয়ার কথা। আওয়ামী লীগ ভেবে দেখেছে, কোনো আন্দোলনই বিএনপি এতো দীর্ঘ সময় জুড়ে চালিয়ে যেতে পারবে না।
আওয়ামী লীগ মনে করছে, এখনই যদি বিএনপি আন্দোলনে হুড়মুড় করে নেমে পড়ে (এবং এই নেমে পড়ার জন্য বিএনপির একাংশের চাপও আছে) তাহলে আওয়ামী সরকার নিজেদের প্ল্যান ও টাইম অনুযায়ী বিএনপির শক্তি ক্ষয় করতে পারবে। বিএনপি আহূত প্রতিটি হরতালের আগে নিজেরাই বাসে গাড়িতে আগুন ধরিয়ে জনমনে ভীতি সঞ্চার এবং বিএনপি নেতা-কর্মীদের ব্যাপক ধরপাকড়ের মাধ্যমে বিএনপির মধ্যে নতুন উদ্দীপিত কর্মচাঞ্চল্য স্তিমিত করতে পারবে। অর্থাৎ ২০১৪ সাল আসার আগেই বিএনপি হয়ে যাবে সাংগঠনিকভাবে দুর্বল এবং মানসিকভাবে হতোদ্যম দল।
২০১১-এর গোড়া থেকেই আওয়ামী লীগ লক্ষ্য করেছে, তাদের জনপ্রিয়তা দ্রুত কমে গিয়েছে। পক্ষান্তরে রাজপথে বিএনপির উপস্থিতি জোরালো হচ্ছে। ২০১১-তে ৭ মার্চ এবং ১৭ মার্চ (শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মদিন)-এ ৭ মার্চের ভাষণটি খুব কমই শোনা গেছে বা একেবারেই শোনা যায়নি। পক্ষান্তরে ৩০ মে-তে জিয়াউর রহমান-এর ৩০তম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে ঢাকার দেয়ালে দেয়ালে দেখা গিয়েছে জিয়া-র ছবি সংবলিত পোস্টার এবং কয়েক দিনব্যাপী দুস্থ পরিবারের মধ্যে খাদ্য বিতরণ কর্মসূচি। এর আগে চট্টগ্রামের মেয়র নির্বাচনে দেখা গিয়েছে আওয়ামী লীগের প্রতি অনীহা এবং সাম্প্রতিক পৌর ও ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে দেখা গেছে বিএনপির প্রতি আকর্ষণ।
বস্তুত এসব কারণেই জুন ২০১১-কে আওয়ামী লীগ বেছে নিয়েছে বিএনপির আন্দোলন সূচিত হওয়ার বছর রূপে এবং আওয়ামী নির্ধারিত ইসু (তত্ত্বাবধায়ক সরকার বহাল)-তে বিএনপিকে ব্যস্ত রাখতে।
বিএনপিকে ভদ্র ইমেজ ধরে রাখতে হবে
অনেকেই সংবিধান জানেন না অথবা বোঝেন না। সংবিধান তাদের কাছে একটি দুর্বোধ্য বই ও জটিল বিষয়। সংবিধান সংশোধনের সুদূরপ্রসারী তাৎপর্যগুলো তাদের পক্ষে বুঝতে পারা আরো দুরূহ। সংবিধান সংশোধনী তাদের কাছে অনেক দূরের বিষয়। সাধারণ মানুষ তাৎক্ষণিকভাবে বোঝে বর্তমান সমস্যাগুলো। যেমন, দ্রব্যের দাম বৃদ্ধি, বাড়ি ভাড়া, ও বাস ভাড়া বৃদ্ধি। সাধারণ মানুষ বোঝে দেশে ও বিদেশে চাকরির বাজার সংকুচিত হয়ে যাওয়া। চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই বেড়ে যাওয়া। কারণ এসব তাকে রোজই আঘাত করে। এই আঘাতে তাদের দৈনন্দিন জীবন দুঃসহ হয়ে পড়েছে। তারা অবশ্যই এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে চায়। কিন্তু হরতাল তাদের দুঃসহ জীবনকে আরো দুঃসহ করে তোলে। তাই সাধারণ মানুষ সাধারণত হরতাল চায় না।

তাছাড়া ২০০৭ থেকে মানুষ হরতালে অনভ্যস্ত হয়ে পড়েছে। মানুষ কৃতজ্ঞতার সঙ্গে মনে করেছে ৫ জুন ২০১১-র হরতালসহ গত আড়াই বছরে বিএনপি মাত্র পাঁচটি হরতাল দিয়েছে। এখানেই আওয়ামী লীগের সঙ্গে বিএনপির খুব বড় পার্থক্য মানুষ বুঝতে পেরেছে। একটি সহিংস দল (আওয়ামী লীগ) এবং তুলনামূলকভাবে একটি অহিংস দল (বিএনপি)-র বর্ণনা মানুষ তার সহজ ভাষায় দেয়, একটি অভদ্র পার্টি এবং অন্যটি ভদ্র পার্টি।
বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া এবং সেক্রেটারি জেনারেল মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর উভয়ের শালীন, সংযত এবং ভদ্র ইমেজ চমৎকারভাবে মিলে গিয়েছে বিএনপির তুলনামূলকভাবে ভদ্র ইমেজের সঙ্গে। মানুষ চায় বিএনপি তার এই ভদ্র ইমেজ যেন আগামীতে ধরে রাখতে পারে।
৫ জুনের প্রয়োজনীয় হরতাল
সুতরাং এই মুহূর্তে বিএনপি পড়ে গিয়েছে একটি ডিলেমা (উরষবসসধ) বা সংকটে। একদিকে সাধারণ মানুষ চায় না হরতাল, অন্যদিকে বিএনপি নেতাকর্মী ও সমর্থকদের একাংশ চান বৃহত্তর আন্দোলন সূচনাকারী হিসেবে হরতাল। তাহলে বিএনপি কোনদিকে যাবে?

বিএনপির চারিত্রিক বৈশিষ্টের কারণে ঐতিহাসিকভাবে দেখা গিয়েছে, আওয়ামী লীগের তুলনায় তাদের আন্দোলন হয় দুর্বল। তাই বিএনপি বার বার ক্ষমতায় এসেছে আন্দোলনের ফসল হিসেবে নয়, আওয়ামী লীগের প্রতি বিরূপ ব্যাপক জনমতের ফসল হিসেবে। ফলে জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়েই বিএনপিকে এবারও এগিয়ে যেতে হবে।
এরপরও স্বীকার করতে হবে, গত রবিবার ৫ জুন ২০১১-তে বিএনপি ও জামায়াত আহূত দেশব্যাপী সকাল-সন্ধ্যা হরতাল পালনটা অতি প্রয়োজনীয় ছিল কয়েকটি কারণে। এক. তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিলের আওয়ামী সিদ্ধান্তকে যে মেনে নেয়া হবে না সেটা দেশবাসীকে জানানোর জন্য। দুই. তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বিষয়ে দেশবাসীকে সচেতন করে তোলার জন্য। তিন. এই মুহূর্তে মাঠে আওয়ামী লীগ যে পলায়নমুখী সেটা স্পষ্ট করে দেয়ার জন্য এবং চার. ভবিষ্যৎ আন্দোলনের লক্ষ্যে বিএনপির সাংগঠনিক শক্তি গড়ে তোলার জন্য। সুতরাং বিএনপি দাবি করতে পারে ৫ জুনের হরতাল ছিল যৌক্তিক ও সময়োচিত।
ইতিমধ্যে আওয়ামী লীগ তাদের অন্যায় অনড় অবস্থান থেকে কিছুটা পিছিয়ে এসে বলেছে, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের নতুন ফর্মুলা বিএনপিকে দিতে হবে। এই প্রস্তাবের তাৎক্ষণিক উত্তর দিয়েছেন মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তিনি বলেছেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের নতুন কোনো রূপরেখা দেবে না বিএনপি। … সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনীতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের রূপরেখা দেয়া আছে। বিএনপি অবিকল এই তত্ত্বাবধায়ক সরকার চায়। তাই নতুন ফর্মুলা নিয়ে আলোচনার কোনো দরকার নেই।
তাহলে দেশ কোনদিকে যাচ্ছে? প্রতি মাসেই ক্যালেন্ডারের পাতা বদলে যাচ্ছে। একত্রিশ মাস শেষ হওয়ার পর দেশ একটি সাংঘর্ষিক অবস্থানে পৌঁছাবে বলে রাজনৈতিক পণ্ডিতরা আশংকা করছেন। কিন্তু এই একত্রিশ মাসে সাধারণ মানুষ কী চাইতে পারে?
আওয়ামী লীগের সেট টাইমে নয়
এই সময়ের প্রারম্ভিক দিকে সাধারণ মানুষ ঘন ঘন হরতাল বা টানা হরতাল চাইবে না। তারা বিচার করবে, আওয়ামী লীগ সৃষ্ট দুঃসহ জীবনের কষ্ট বিএনপি আরো বাড়িয়ে তুলছে কি না।
২০১১ হচ্ছে বিএনপির আন্দোলনের জন্য আওয়ামী লীগের সেট টাইম ও প্ল্যান।
কিন্তু সাধারণ মানুষ আশা করছে, আওয়ামী লীগের এই ফাঁদে বিএনপি পা দেবে না।
সাধারণ মানুষ কী চায়?
যে কোনো বাসে উঠলেই উত্তরটা জানা যাবে।
তারা চায় তাদের দৈনন্দিন দুঃসহ জীবন নিয়ে বিএনপি সোচ্চার হোক, হরতাল বাদে অন্যান্য পন্থায় আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে প্রবল জনমত গড়ে তুলুক এবং বর্তমান সরকারের শেষ ছয় মাসে হরতালসহ দুর্বার আন্দোলন করে আওয়ামী সরকারকে উৎখাত করুক।

অর্থাৎ আগামী আড়াই বছরে বিএনপির আন্দোলন বিষয়ে একদিকে আওয়ামী লীগের প্ল্যানিং ও টাইমিং এবং অন্যদিকে সাধারণ মানুষের দুশ্চিন্তা-দুর্ভাবনা গণনার মধ্যে রেখে বিএনপির নেতৃম-লীকে নিজেদের প্ল্যান ও টাইম টেবিল স্থির করতে হবে।
শেখ মুজিবুর রহমানের চরিত্রে প্রস্তাবিত কোনো মুভিতে অমিতাভ বচ্চন অভিনয় করলেও করতে পারেন অথবা দেশ টিভি-তে কে হবে কোটিপতি কুইজ অনুষ্ঠানে শাহরুখ খান উপস্থাপক হলেও হতে পারেন অথবা ফারাক্কা পয়েন্টে ইনডিয়া পানি দিলেও দিতে পারে কিন্তু অন্তত তিনটি বিষয়ে বিএনপি নিশ্চিত থাকতে পারে-গত ২৯ ডিসেম্বর ২০০৮-এর নির্বাচনী অভিযানে শেখ হাসিনা প্রতিশ্রুত দশ টাকা কেজিতে চাল খাওয়ানো সম্ভব হবে না। ঘরে ঘরে একটি চাকরি হবে না। বিনা মূল্যে সার দেয়া যাবে না।
সুতরাং বিএনপি অপেক্ষা করতে পারবে নিজেদের কর্মীবল ও অর্থবল গণনায় রেখে নিজেদের সুচিন্তিত প্ল্যান এবং নিজেদের সেট টাইম অনুযায়ী আন্দোলন করতে।
৯ জুন ২০১১

শফিক রেহমান: প্রবীণ সাংবাদিক ও জনপ্রিয়  টিভি অনুষ্ঠান উপস্থাপক।

1 টি মন্তব্য: