শুক্রবার, ২৭ জানুয়ারী, ২০১২

বাস্তব পৃথিবীতে রূপকথার বিয়ে



shafik-rehman2শুক্রবার ২৯ এপ্রিল ২০১১-তে সকাল এগারোটায় লন্ডনে ওয়েস্টমিনস্টার অ্যাবিতে বৃটেনের রাজকুমার পৃন্স উইলিয়ামের সঙ্গে ইংল্যান্ডের সাধারণ ঘরের মেয়ে কেইট মিডলটনের বিয়ে হয়ে গেল। বৃটিশরা ছাড়াও এই বিয়ের প্রতি বিশ্বের বহু মানুষের গভীর কৌতূহল ছিল। কারণ ছিল দু’টি।
এক. বিশ্ব জুড়ে প্রতিদিন বহু ধরনের বিয়ে হলেও বর্তমান যুগে রাজপরিবারের সীমিত সংখ্যার মতোই কোনো রাজপরিবারের কোনো সদস্যের বিয়ের সংখ্যাও সীমিত।
দুই. বৃটিশ রাজপরিবার অসাধারণ। ১৭৮৯-এ যখন আমেরিকায় জর্জ ওয়াশিংটন প্রেসিডেন্ট হন, তখন বৃটেনের রাজা ছিলেন তৃতীয় জর্জ। সেই সময়ে ফ্রান্সেও একজন রাজা রাজত্ব করছিলেন। ইওরোপের অধিকাংশ স্থানে শাসন করতেন হোলি রোমান সম্রাট। রাশিয়াতে রাজত্ব করতেন একজন জারিনা। জাপানে একজন শোগান। চায়নায় একজন সম্রাট। এসব পদের মধ্যে এখন শুধু আমেরিকার প্রেসিডেন্ট পদ এবং বৃটেনের রাজা বা রাণীর পদটিই টিকে আছে। এই অসাধারণ বৃটিশ রাজপরিবারের একজন সদস্য যিনি ভবিষ্যতে বৃটেনের রাজা হতে পারেন, তার সঙ্গে একটি সাধারণ ইংরেজ পরিবারের সদস্যের বিয়েটা কৌতূহল সৃষ্টি করেছিল। রাণী এলিজাবেথের পর বৃটিশ সিংহাসনে বসার প্রথম অধিকার এখন তার প্রথম পুত্র চার্লস-এর। দ্বিতীয় অধিকার চার্লসের প্রথম পুত্র এই উইলিয়ামের।
বৃটিশ রাজতন্ত্রের নিয়ম অনুযায়ী রাজকুমার ও রাজকুমারীদের মধ্যে সিংহাসনে বসার প্রথম অধিকার রাজকুমারের। যদি একাধিক রাজকুমার থাকেন তাহলে বড় রাজকুমার বা বড় ছেলের অধিকারই প্রথম। কোনো কারণে বড় ছেলে সিংহাসনে বসতে না চাইলে অথবা বসতে না পারলে, তার পরের ভাই বসবেন সিংহাসনে। অর্থাৎ, রাজকুমারীর বৃটিশ সিংহাসনে বসার সুযোগ কম। ৬ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২-তে বর্তমান রাণী সিংহাসনে বসতে পেরেছিলেন। কারণ তার কোনো ভাই ছিল না। আগামী ৬ ফেব্রুয়ারি ২০১২-তে রাণীর শাসনকালের ৬০ বছর পূর্তি হবে। আশা করা যায় এ উপলক্ষে আগামী বছর বৃটেনে আরেক দফা রাজকীয় ধুমধাম হবে। রাণীর জন্ম হয়েছিল ২১ আগস্ট ১৯২৬-এ। তার বর্তমান বয়স ৮৪।
রাণী সমাচার
৩২টি শব্দ বিশিষ্ট রাণীর পুরো টাইটেল বেশ লম্বা : এলিজাবেথ দি সেকেন্ড, বাই দি গ্রেইস অফ গড অফ দি ইউনাইটেড কিংডম অফ গ্রেট বৃটেন অ্যান্ড নর্দার্ন আয়ারল্যান্ড অ্যান্ড অফ হার আদার রেলমস অ্যান্ড টেরিটরিজ কুইন, হেড অফ দি কমনওয়েলথ, ডিফেন্ডার অফ দি ফেইথ।
তবে রাণীকে সংক্ষিপ্তভাবে ডাকা হয় ‘হার ম্যাজেস্টি’।
‘ডিফেন্ডার অফ দি ফেইথ’ টাইটেলের মানে ‘ধর্মবিশ্বাস রক্ষক’। বৃটেনে রাজা বা রাণীকে অবশ্যই কৃশ্চিয়ান প্রটেস্টান্ট অ্যাংগলিকান চার্চ-এর সদস্য হতে হবে এবং সেই ধর্মবিশ্বাস তাকে রক্ষা করতে হবে। রাজা বা রাণী তার দেশে শুধু সর্বোচ্চ শাসকই নন, সর্বোচ্চ ধর্মীয় (অ্যাংগলিকান চার্চের) নেতাও বটে। এর তাৎপর্য হলো অন্য কোনো ধর্ম অনুসারী বৃটেনের রাজা বা রাণী হতে পারবেন না। অর্থাৎ, এক্ষেত্রে বৃটেন সাম্প্রদায়িক।

লক্ষনীয় যে রাজপরিবারের বিয়ের অনুষ্ঠানে ধর্মীয় সংস্কৃতি রক্ষা করা হয়েছে। বিয়ের অনুষ্ঠানে ১০ থেকে ১৫ মিনিট সামাজিক ও আইনগত কার্যাদি হয়েছে। আর বাকি ৪০ থেকে ৫০ মিনিট ছিল ধর্মীয় অনুষ্ঠান। ধর্মীয় গ্রন্থ পাঠ করা হয়েছে। এটা ডায়নার বিয়ের সময়ও হয়েছিল। বৃটিশরা তাদের নিজেদের বেলায় ধর্মকে ঠিক রেখেও একটি সেকুলার মতবাদ প্রচার করে। বৃটিশরা বলে, আমরা বাংলাদেশি মুসলিমরা, ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি করি। কিন্তু দেখা গেল, তারাও ধর্মকে গুরুত্ব দিচ্ছে। রাজপরিবারের বিয়ের ক্ষেত্রেও ধর্মীয় বিষয়টিকে অনেক গুরুত্ব দিচ্ছে। রাজ পরিবারের বিয়ের ক্ষেত্রেও ধর্মীয় বিষয়টিকে অনেক গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।
রাণীর প্রধান বাড়ির সংখ্যা আটটি :
১. বাকিংহাম প্যালেস, লন্ডন
২. উইন্ডসর কাসল। লন্ডন থেকে কিছু দূরে। এখানে বৃটেনে সাপ্তাহিক ছুটির দিনে অর্থাৎ, শনি-রবিবারে এবং ইস্টারের ছুটিতে রাণী থাকেন। এখান থেকে তিনি অ্যাসকট-এ ঘোড়দৌড় দেখতে যান। রাণী ঘোড়দৌড়ে বাজি ধরতে ভালোবাসেন। এটা তার এক ধরনের নেশা।
৩. প্যালেস অফ হলিরুড হাউস, স্কটল্যান্ড। এখানে বছরে অন্তত এক সপ্তাহ রাণী থাকেন।
৪. সেইন্ট জেমসেস প্যালেস, লন্ডন। এখানে রাণী অন্য দেশের রাষ্ট্রদূত ও হাই কমিশনারদের রিসিভ করেন বা অভ্যর্থনা জানান।
৫. ক্লারেন্স হাউস, লন্ডন।
৬. কেনসিংটন প্যালেস, লন্ডন।
৭. স্যানডৃংহাম হাউস, নোরফোক।
৮. বালমোরাল ক্যাসল, স্কটল্যান্ড।

রাণীর সম্পদ কতো এই প্রশ্নের উত্তরে ২০০৮-এ ফোর্বস ম্যাগাজিন জানিয়েছিল, ৬৫ কোটি পাউন্ড বা ৭,১৫০ কোটি টাকা।
রাণী যে বার্ষিক অনুদান পান তাতে ট্যাক্স দিতে হয় না। কারণ এই অনুদান তাকে দেয়া হয় রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানগুলোর খরচ মেটানোর জন্য। এই অনুদান ফিক্স করে দেয় পার্লামেন্ট প্রতি দশ বছরের জন্য। সর্বশেষ ২০০৭-৮-এ রাণীর বার্ষিক অনুদান ৪ কোটি পাউন্ড বা ৪,৪০০ কোটি টাকা ধার্য হয়।
তবে রাণীর ব্যক্তিগত আয় আছে এবং সেই আয়ের ওপর তাকে ইনকাম ট্যাক্স দিতে হয়।

নাতি উইলিয়ামের বিয়ের দিনে এলিজাবেথ ওয়েস্টমিনস্টার অ্যাবিতে গিয়েছিলেন। তখন তার পরনে ছিল হলুদ সুট ও মাথায় ছিল হালকা হলুদ হ্যাট। তাকে দেখে বেশ সুস্থ মনে হয়েছে। তবুও এই মুহূর্তে অনেকে জল্পনা-কল্পনা করছেন বড় ছেলে চার্লসের কাছে রাণী সিংহাসন ছেড়ে দিয়ে অবসরে যাবেন কিনা। কিন্তু রাণীর শারীরিক সুস্থতা দেখে মনে হয়েছে তিনিই আরও কয়েক বছর সিংহাসনে থাকবেন। সেক্ষেত্রে নাতি উইলিয়ামকে রাজা হতে হলে অনেক অপেক্ষা করতে হবে। উইলিয়ামের বর্তমান বয়স ২৮। তার জন্ম হয়েছিল ২১ জুন ১৯৮২-তে। বিয়ের দিন উইলিয়ামের মাথার ঠিক মাঝখানে টাক দেখা গেছে। এক সময়ে তিনি যখন রাজা হবেন তখন হয়তো তার মাথায় থাকবে পুরো টাক। কিন্তু সেটা ভবিষ্যতের কথা। এখন ফিরে আসা যাক বর্তমানে।
মিডিয়াকর্মীদের ডিসিপ্লিন বোধ
বিশ্ববাসীর কৌতূহল মেটানোর জন্য রাজ পরিবার ও বৃটিশ সরকার সুচারু ব্যবস্থা করেছিল। বাকিংহাম প্যালেসের অনতিদূরে তিনতলা বিশিষ্ট একটি মিডিয়া সেন্টার স্থাপন করেছিল। এখানে ৩৬টির বেশি টিভি স্টুডিও ছিল যেখান থেকে বিবিসি, সিএনএন, স্কাই টিভি, আল জাজিরা, সিএনএন, এবিসি, সিবিএস প্রভৃতি বিশ্বখ্যাত টিভি স্টেশনগুলো ধারাবিবরণী প্রচার করে। ওয়েস্টমিনস্টার অ্যাবির ভেতরে ৪০টি টিভি ক্যামেরা বসানো হয়েছিল। তবে সেখানে ঢোকার অনুমতি পেয়েছিলেন মাত্র ২৮ জন রিপোর্টার ও ১২ জন স্টিল ফটোগ্রাফার। অ্যাবির ভেতর থেকে ধারাবিবরণী দেয়ার অনুমতি পেয়েছিলেন মাত্র একজন, এড স্টাউরটন। ফলে বিয়ের সময়ে অ্যাবির মধ্যে রিপোর্টার, টিভি ক্যামেরাম্যান ও ফটোগ্রাফারদের কোনো বিশৃঙ্খলা বা হুড়োহুড়ি ছিল না।
শৃঙ্খলাবোধ ও সৌন্দর্যের ক্ষেত্রেও বিয়েটা উদাহরণ সৃষ্টি করেছে। এত বড় অনুষ্ঠানের কোথাও বিশৃঙ্খলা ছিল না। সীমাবদ্ধতা সত্বেও বিশ্বের ২০০ কোটি দর্শক ঠিকমতোই অনুষ্ঠানটির টিভি সম্প্রচার দেখেছেন।
আমাদের দেশের মিডিয়াকে এসব শিখতে হবে। পরিকল্পনা ও প্রশিক্ষিত কর্মীরা অনুষ্ঠান কভার করায় শৃঙ্খলার সঙ্গে সবকিছু সম্পন্ন করা সম্ভব হয়েছে।

এই প্রসঙ্গে বলা যেতে পারে বাংলাদেশে কী হয়। প্রায় প্রতিটি অনুষ্ঠানেই দেখা যায় বহু ক্যামেরাম্যান ও রিপোর্টারদের ভিড় ও উচ্ছৃঙ্খলতা। ফলে ঘটনার কেন্দ্রবিন্দু যে ব্যক্তি তাকে হয়তো দেখাই যায় না কিংবা তার কথা শোনা যায় না। ড. মুহাম্মদ ইউনূস যখন নোবেল পেলেন, তখন জাতীয় প্রেস ক্লাবের একটি অনুষ্ঠানে অন্তত ৫০ ফটোসাংবাদিক ও ক্যামেরাম্যান নোবেল বিজয়ীকে ঘিরে ফেলার ফলে তেমন কিছু দেখা ও শোনা যায়নি। উইলিয়াম আর কেইটের বিয়ে থেকে বাংলাদেশের মিডিয়াকর্মীরা ডিসিপ্লিন শিখতে পারে।
এই বিয়ে কভার করার জন্য রাজপরিবার থেকে অ্যাক্রেডিশন বা অনুমতিপত্র দেয়া হয়েছিল ৬,৫০০ মিডিয়াকর্মীকে। বিনা অ্যাক্রেডিশনে কভার করতে গিয়েছিল ২,০০০ মিডিয়াকর্মী। অর্থাৎ, মোট ৮,৫০০ মিডিয়াকর্মী সেদিন ঘটনাস্থলের কাছাকাছি থাকলেও তাদের মধ্যে কোনো বিশৃঙ্খলা দেখা যায় নি।
সেদিন ১০০টির বেশি বিদেশী ব্রডকাস্টিং কর্পোরেশন উপস্থিত ছিল। এদের বেশির ভাগ এসেছিল আমেরিকা থেকে যেখানে রাজতন্ত্র নেই। বলাবাহুল্য এই কভারেজ ছিল ব্যয়সাপেক্ষ। বিবিসি’র কভারেজের বাজেট ছিল ২২ কোটি টাকা। চ্যানেল আই সেদিন এই অনুষ্ঠানটি সরাসরি টেলিকাস্ট করে বাংলাদেশের টিভি ইতিহাসে একটি গৌরবজনক অধ্যায় যোগ করেছে।
চ্যানেল আইয়ের এই সরাসরি সম্প্রচারে উপস্থাপনা করেছিলেন অপু মাহফুজ ও মিশু রহমান।
অংশ নিয়েছিলেন, ডেমক্রেসিওয়াচের একজিকিউটিভ ডিরেক্টর তালেয়া রেহমান, যিনি ১৯৮১-তে চার্লস ও ডায়ানার বিয়ে বিবিসি বাংলা বিভাগের পক্ষে কভার করেছিলেন, বিউটিশিয়ান কানিজ আলমাস খান, ফ্লোরাল ডেকরেটর সিগমা মেহেদি, ব্যারিস্টার রোকনউদ্দিন মাহমুদ ও আমি। প্রযোজনা করেছিলেন তাহের শিপন ও কো-অর্ডিনেটর ছিলেন রাজু আলীম।
শুক্রবার সাপ্তাহিক ছুটির দিন থাকায় এবং বাংলায় ধারাবিবরণী ও মন্তব্য থাকায় সেদিন চ্যানেল আইয়ের এই অনুষ্ঠান অনেকে দেখেন।
ওদিকে বিবিসি ওয়ার্ল্ডের পক্ষে উপস্থাপনা করেন পাকিস্তানি বংশোদ্ভূত মিশাল হুসেইন। আর আমেরিকান উপস্থাপকদের মধ্যে ছিলেন কেটি কুরিচ (সিবিএস), ডায়ান সইয়ার (এবিসি) ও ব্রায়ান উইলিয়ামস (এনবিসি)। এদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন তাৎক্ষণিক মন্তব্য করার জন্য বৃটিশ রাজ পরিবার বিষয়ে কিছু বিশেষজ্ঞ মিডিয়া ব্যক্তিত্ব, যেমন, মার্টিন বশির, পিয়ার্স মরগান, ডেভিড স্টার কি, প্যাটৃক জনসন ডায়ান কুয়ারি (প্রিন্সেস ডায়ানার সহচরী) ও কলিন হ্যারিস (চার্লসের সাবেক প্রাইভেট সেক্রেটারি)।
বলা হয়েছে ২০০৮-এ আমেরিকার প্রেসিডেনশিয়াল নির্বাচনের পরে এটাই ছিল সবচেয়ে বড় এবং অ্যাডভান্সড টেকনিকাল টেলিকাস্ট। বিশ্বের প্রায় ২০০ কোটি দর্শক বিয়ের অনুষ্ঠানটি দেখেছে।

ইউকে এবং রাজতন্ত্র
যুক্তরাজ্য অর্থাৎ ইংল্যান্ড, ওয়েলস, স্কটল্যান্ড ও উত্তর আয়ারল্যান্ড, এই চারটি রাজ্যের সমন্বয়ে গঠিত ইউনাইটেড কিংডম, সংক্ষেপে ইউকে বা টক। ইউকে এবং কিছু বৈদেশিক এলাকার শাসক হচ্ছেন রাজা বা রাণী। বলা হয় যুক্তরাজ্যে আছে একটি কনস্টিটিউশনাল মনার্কি বা সাংবিধানিক রাজতন্ত্র। মজার কথা হলো এই যে, যুক্তরাজ্যের কোনো সংবিধান নেই। বহু শতাব্দী জুড়ে যেসব আইন পাস হয়েছে এবং যেসব প্রথা শিকড় গেড়ে বসেছে, তাদেরই ওপর ভিত্তি করে যুক্তরাজ্যের অলিখিত সাংবিধানিক রাজতন্ত্র চলছে। অবশ্য এখন কিছু রাজনৈতিক কর্মী ও চিন্তাবিদ বৃটেনে লিখিত সংবিধান চালু করার পক্ষে মাঝে মাঝে কথা বলছেন।
এই রাজতন্ত্রে রাজা বা রাণীর ক্ষমতা খুব সীমাবদ্ধ। নির্দলীয় ঘটনার ক্ষেত্রে তারা উপস্থিত হতে পারেন। বছরে দুইবার বিশিষ্ট নাগরিকদের খেতাব বিতরণ করতে পারেন। তবে এই খেতাবের লিস্ট তৈরি করে দেয় ক্ষমতাসীন দলীয় সরকার। রাজা বা রাণী সরকারের উপদেশ মোতাবেক পার্লামেন্ট বা সংসদের অধিবেশন ডাকতে পারেন, পার্লামেন্ট ভেঙ্গে দিতে পারেন এবং প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত করতে পারেন। এসব ক্ষেত্রে রাজা বা রাণীর নিজস্ব মতামত গৌণ।
১০০০ সাল থেকে বর্তমান বৃটিশ রাজতন্ত্র সিংহাসনে আছে। ১৯২১-এ বিশ্বের এক-চতুর্থাংশ শাসন করতো বৃটিশ রাজতন্ত্র। তখন বলা হতো বৃটিশ সাম্রাজ্যে সূর্য কখনও অস্ত যায় না। ১৯৪৫-এ দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পরে বৃটিশ সাম্রাজ্য শেষ হয়। বৃটিশ উপনিবেশগুলোতে স্বাধীনতার দাবি প্রবল হয়ে ওঠে। যুদ্ধক্লান্ত বৃটেনের শক্তি ছিল না উপনিবেশগুলো ধরে রাখার। বৃটেন তাদের স্বাধীনতা দিতে বাধ্য হয়। তবে সাবেক কলোনি বা উপনিবেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক ধরে রাখার জন্য বৃটেন প্রতিষ্ঠা করে কমনওয়েলথ অফ স্টেটস বা সংক্ষেপে কমনওয়েলথ। ১৯৪৭-এ ইনডিয়া ও পাকিস্তান, স্বাধীন হবার পর তারা কমনওয়েলথের সদস্য হয়। এখন বাংলাদেশও কমনওয়েলথের সদস্য।
১৯৪৭-এ এলিজাবেথ বিয়ে করেন পৃন্স ফিলিপকে। তাদের বড় ছেলে চার্লস। চার্লসের সঙ্গে ডায়ানার বিয়ে হয় ২৯ জুলাই ১৯৮১-তে। পনের বছর পরে তাদের বিয়ে ভেঙ্গে যায় ১৫ জুলাই ১৯৯৬-এ। ইতিমধ্যে ডায়ানার সঙ্গে বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে তুলেছিলেন ইজিপশিয়ান ধনকুবের মোহাম্মদ আল ফায়েদের ছেলে ডোডি আল ফায়েদ। ৩১ আগস্ট ১৯৯৭-এর ভোর রাতে প্যারিসে একটি মোটর দুর্ঘটনায় ডোডি ও গাড়ির ড্রাইভার হেনরি পল মারা যান অকুস্থলে। আহত ডায়ানাকে নেয়া হয় হসপিটালে। তিনি মারা যান সেখানে। কেউ কেউ মনে করেন, সেই সময়ে অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন ডায়ানা। তারা মনে করেন ডোডির ঔরসে ডায়ানার যেন কোনো সন্তান না হয় সে জন্য বৃটিশ গোয়েন্দা বাহিনী তাদের দু’জনকেই হত্যা করে। অনেকে এই মতামতকে নিছক গুজব বলে উড়িয়ে দেন। লক্ষণীয় যে, গোটা বিয়ের অনুষ্ঠানে কোথাও ডায়ানার ছবি ছিল না।
বিতর্কিত গেস্ট লিস্ট
দুর্ঘটনায় মৃত্যুর পরে চার্লস-ডায়ানার দুই ছেলে উইলিয়াম ও হ্যারিকে অফিশিয়ালি দেখাশোনার ভার নেন বৃটেনের সাবেক প্রধানমন্ত্রী জন মেজর। সেই কারণে উইলিয়াম তার বিয়েতে আমন্ত্রণ করেছিলেন জন মেজরকে। কিন্তু তারা আমন্ত্রণ জানান নি সাবেক প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ারকে যিনি ক্ষমতাসীন হয়েছিলেন জন মেজর বিদায় নেয়ার পরে। ধারণা করা হয় ব্লেয়ারের স্ত্রী শেরি ব্লেয়ার তার লেখা বইয়ে প্রয়াত ডায়ানার যৌন জীবন সম্পর্কে মন্তব্য করায় তাকে ডাকা হয়নি। এই বিয়েতে টনি ব্লেয়ারের উত্তরসুরী সাবেক প্রধানমন্ত্রী গর্ডন ব্রাউনও আমন্ত্রিত হননি। এসব কারণে বিয়ের গেস্ট লিস্ট নিয়ে কিছুটা বিতর্কের সৃষ্টি হয়।
প্রথমে ঠিক হয়েছিল ২,৫০০ গেস্টকে ইনভিটেশন কার্ড দেয়া হবে। পরে এই সংখ্যা কমিয়ে ১,৯০০-তে আনা হয়। সাতটি ক্যাটেগরির ব্যক্তিদের আমন্ত্রিত করা হয়।
১. বৃটিশ রাজপরিবারের সদস্যবৃন্দ।
২. অন্য দেশের রাজপরিবারের সদস্যবৃন্দ। যেমন, সৌদি আরব, আবু ধাবি, কুয়েত, মালয়েশিয়া, ওমান, কাতার, মরক্কো, ব্রুনেইয়ের বাদশাহ-সুলতান, বেলজিয়াম, ডেনমার্ক, নরওয়ে, সুইডেন, লুক্সেমবার্গ, নেদারল্যান্ডস, যুগোস্লাভিয়া, গৃস, স্পেন, বুলগারিয়া, লিসোথো, সোয়াজিল্যান্ড প্রভৃতি দেশের রাজা বা রাণীরা। বাহরাইনের সুলতান আমন্ত্রিত হলেও তার দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতার জন্য তিনি ইনভিটেশন প্রত্যাখ্যান করেন।
৩. বিভিন্ন দেশের বিশিষ্ট ব্যক্তিবৃন্দ। যেমন অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, নিউ জিল্যান্ডের গভর্নর জেনারেল ও কয়েকটি দেশের প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রী। আমাদের উপমহাদেশের কেউ এই ক্যাটেগরিতে আমন্ত্রিত হননি। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা-ও হননি। কানাডিয়ান প্রধানমন্ত্রী আমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করেন কারণ তার দেশে নির্বাচনী অভিযান চলছে।
৪. বৃটিশ সরকারের বিশিষ্ট ব্যক্তিবৃন্দ। যেমন, প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন, ডেপুটি প্রধানমন্ত্রী নিক ক্লেগ, বিরোধী নেতা এড মিলিব্যান্ড প্রমুখ।
৫. ধর্মীয় নেতারা। যেমন, বৃটেনে কৃশ্চিয়ান, হিন্দু, বৌদ্ধ, মুসলিম প্রভৃতি ধর্মের নেতারা। মুসলিম ধর্মীয় নেতা ইমাম মোহাম্মদ রাজা ও মাওলানা সৈয়দ রাজা শাব্বারাস এদের অন্যতম।
৬. বৃটিশ সশস্ত্র বাহিনীর ঊর্ধ্বতন অফিসাররা।
৭. অন্যান্য। এই ক্যাটেগরিতে আমন্ত্রিত হয়েছিলেন পপ গায়ক এলটন জন যিনি ডায়ানার মৃত্যুর পরে এক শোক সম্মিলনে ক্যান্ডল ইন দি উইন্ড গানটি গেয়েছিলেন। এই ক্যাটেগরিতে আরও আমন্ত্রিত হয়েছিলেন ফুটবলার ডেভিড বেকহ্যাম ও তার স্ত্রী ভিক্টোরিয়া, পপ গায়ক জস স্টোন, মি. বিন চরিত্রে অভিনেতা রোয়ান এটকিনসন প্রমুখ। রাজপরিবার ও পাত্রী পরিবারের সঙ্গে যারা সম্পৃক্ত তারা এই ক্যাটেগরিতে নিচের সংখ্যা অনুযায়ী আমন্ত্রণ করেছিলেন :

রাণী ৫০
চার্লস ও ক্যামিলা ২৫০
উইলিয়াম ও কেইট ২৫০
কেইট মিডলটন পরিবার ২৫০
মোট ৮০০

সিম্পল ইনভিটেশন কার্ড
এই গেস্টদের আমন্ত্রণপত্র বা ইনভিটেশন কার্ডে খুব শাদাসিধেভাবে লেখা ছিল :

এলিজাবেথ সেকেন্ড রেজাইনা
দি লর্ড চেম্বারলেইন ইজ কমানডেড বাই
দি কুইন টু ইনভাইট
…………..
…………..
টু দি ম্যারেজ অফ
হিজ রয়াল হাইনেস পৃন্স উইলিয়াম অফ ওয়েলস কে. জি.
উইথ
মিস ক্যাথরিন মিডলটন
অ্যাট ওয়েস্টমিনস্টার অ্যাবি
অন ফ্রাইডে টোয়েন্টি নাইনথ এপৃল ২০১১ অ্যাট ১১.০০ এ.এম

গিফট আনতে বারণ করা হয়েছিল। তার বদলে নির্বাচিত চ্যারিটিতে অর্থ সাহায্য দিতে অনুরোধ করা হয়েছিল।
লক্ষণীয় যে, রাণী বা তার স্বামী অর্থাৎ বরের মাতাপিতা আমন্ত্রণ করছেন না। রানী দ্বারা আদিষ্ট হয়ে লর্ড চেম্বারলেইন বিয়েতে আমন্ত্রণ জানাচ্ছেন। আরও লক্ষণীয় যে, এখানে পাত্রীর পিতামাতার নাম নেই।
তাহলে পাত্রপাত্রীর পূর্ণ পরিচয়টা কী?

পাত্র সমাচার
পাত্রের পূর্ণ নাম : উইলিয়াম আর্থার ফিলিপ লুইস মাউন্টব্যাটেন-উইন্ডসর।
জন্ম : ২১ জুন ১৯৮২
বয়স : ২৮
শিক্ষা : ইউনিভার্সিটি অফ সেইন্ট অ্যানড্রুজ থেকে ভূগোলে এমএ সেকেন্ড ক্লাস। স্কুল : ইটন। এ লেভেলে ভূগোলে এ, ইতিহাসে বি এবং বায়োলজিতে সি।
পেশাগত যোগ্যতা : পাইলট।
চাকরি : রয়াল এয়ার ফোর্সে রিসার্চ অ্যান্ড রেসকিউ হেলিকপ্টার কো-পাইলট।
খেলাধুলা : ফুটবল, রাগবি, সুইমিং, মোটর সাইক্লিং। ইংলিশ পৃমিয়ার লিগে অ্যাস্টন ভিলা ক্লাবের সাপোর্টার।
অন্যান্য ট্রেইনিং : বেলিজ-এ আর্মি ট্রেইনিংয়ে টয়লেট পরিষ্কার করা থেকে শুরু করে রেডিওতে ডিস্ক জকির কাজ।
উইলিয়াম হেলিকপ্টার পাইলট হয়েছেন। কিন্তু সাত বছর বয়সে তিনি হতে চেয়েছিলেন পুলিশ অফিসার।
মা ডায়ানা তাকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, তুমি পুলিশ অফিসার হতে চাও কেন?
উইলিয়াম উত্তর দিয়েছিলেন, আমি তোমাকে বিপদ থেকে রক্ষা করতে চাই।
এই সময়ে তার ছোট ভাই হ্যারি বলেছিলেন, ভাইয়া, তুমি পুলিশ অফিসার হতে পারবে না। তুমি রাজা হবে।
প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার বাইরেও ডায়ানা তার দুই ছেলেকে অন্যান্য ধরনের জীবনমুখী শিক্ষাও দিয়েছিলেন। ডায়ানা নিজে মাইনে আহত পঙ্গুদের জন্য এবং এইডস রোগাক্রান্তদের জন্য কাজ করতেন। উইলিয়াম ও হ্যারিকে তিনি নিয়ে গিয়েছিলেন এইডস ক্লিনিকে। দেখিয়েছিলেন কীভাবে রোগীদের সেবা শুশ্রুষা করতে হয়। এ ছাড়া তিনি তাদের সাধারণ খাবার জায়গাতে, যেমন, ম্যাকডোনাল্ডস, কেএফসি, পিৎজা হাট-এও নিয়ে গিয়েছিলেন। ডায়ানা তার দুই ছেলেকে পপুলার ভিডিও গেমসগুলো কিনে দিতেন।
সাংবাদিকদের এড়িয়ে চলার জন্য উইলিয়ামকে তার বন্ধুরা ডাকতো স্টিভ নামে। উইলিয়াম বাম হাতি।

পাত্রী সমাচার
পাত্রীর পূর্ণ নাম : ক্যাথরিন এলিজাবেথ মিডলটন।
জন্ম : ৯ জানুয়ারি ১৯৮২।
বয়স : ২৯। উইলিয়ামের চাইতে সাড়ে পাঁচ মাস বড়।
পড়াশোনা : সেইন্ট অ্যানড্রুজ ইউনিভার্সিটি থেকে এমএ।
পেশাগত যোগ্যতা : ফ্যাশন এজেন্ট।

কেইট মিডলটনের মা ছিলেন বৃটিশ এয়ারওয়েজের এয়ারহস্টেস এবং পিতা ছিলেন ওই এয়ারলাইনসেরই ডেসপ্যাচার। কেইটের বোনের নাম পিপপা ও ভাইয়ের নাম জেমস। যেহেতু এই পরিবারে কোনো রাজরক্ত নেই, সেহেতু কেইট টেকনিকালি পৃন্সেস টাইটেল পেলেও, পৃন্সেস ক্যাথরিন বা পৃন্সেস কেইট নামে কখনও পরিচিত হতে পারবেন না। শুক্রবারে বিয়ের পর তার পূর্ণ টাইটেল হয়েছে, হার রয়াল হাইনেস পৃন্সেস উইলিয়াম অফ ওয়েলস। অর্থাৎ, এক ধরনের পৃন্সেস হয়েছেন কেইট।
বিয়ের স্থান ওয়েস্টমিনস্টার অ্যাবি হাজার বছরের পুরনো গির্জা। এখানে রোজ প্রার্থনা অনুষ্ঠান হয়। রাজারাণীদের অভিষেক অনুষ্ঠান হয়। এখানে ১৭ জন রাজারাণীর কবর আছে। ওয়েস্টমিনস্টার অ্যাবিতে লাইব্রেরি, পেইনটিং, আর্কাইভ ও পাইপ অরগান বাদ্যযন্ত্র আছে। ওয়েস্টমিনস্টার অ্যাবিতে বরপক্ষ ও কনেপক্ষ এসেছিলেন আধুনিক চকচকে কালো বৃটিশ মোটর কারে, যেমন ডেইমলার বেঞ্জ, রোলস রয়েস, জাগুয়ার ও ল্যান্ড রোভারে। কিন্তু বিয়ের পর বর ও বধূ ফিরে যান শতাধিক বছরের পুরনো ঘোড়ায় টানা বহু বর্ণে সুসজ্জিত খোলা গাড়িতে। তাদের পেছনে আরেকটি ঘোড়ায় টানা গাড়িতে ছিলেন রাণী ও তার স্বামী। আধুনিকতার পাশাপাশি ঐতিহ্য ও ইতিহাসকে বজায় রাখার এই বৃটিশ রীতি অনুকরণীয়।
বিয়েতে খাবার
আমাদের দেশে বিয়ে হয় সন্ধ্যা অথবা রাতের বেলায় সাধারণত কোনো বাড়ি বা কমিউনিটি সেন্টারে, সকালবেলায় কোনো মসজিদে নয়। লক্ষণীয় যে, উইলিয়াম-কেইটের বিয়ে বৃটেনের রেওয়াজ অনুযায়ী হলো সকালে এবং গির্জায়। এখানে পাত্র পৌঁছান প্রথমে। পাত্রী আসেন পরে। বাংলাদেশে পাত্র আসেন পরে। পাত্রকে বিয়ে বাড়ির গেইটে আটকানো হয়। এখানে পাত্রীকে গেইটে আটকানো হয় না।
আমাদের দেশের বিয়ের সঙ্গে আরেকটি পার্থক্য লক্ষণীয়। বাংলাদেশের বিয়েতে খাওয়ার মেনুটা খুব ইমপরট্যান্ট। বৃটেনে জাকজমকটা ইমপরট্যান্ট। ওয়েস্টমিনস্টার অ্যাবিতে আনুষ্ঠানিক বিয়ের পর কোনো লাঞ্চ পরিবেশন করা হয়নি।
তবুও এই বিয়ের পরে বিশেষ ৩০০ অতিথি নিমন্ত্রিত হয়েছিলেন ওয়েডিং ডিনারে। কিন্তু সেই ডিনারের মেনু কী হবে সেটা আগেভাগে জানানো হয়নি। ধারণা করা হয় ডিনার মেনুতে ছিল ক্রে ফিশ, ক্র্যাব ও স্যামন মাছের স্টার্টার। মেইন কোর্সে ছিল স্যানডৃংহাম ল্যাম্ব বা ভেড়ার মাংস। সঙ্গে ছিল ভেজিটেবল যেমন রয়াল জার্সি পটেটো, ক্যারট, অ্যাসপারাগাস, বেবি কর্ণ, মাঞ্জ টু প্রভৃতি। এরপর মিষ্টি হিসেবে ছিল কয়েক রকমের পুডিং। এছাড়া ছিল শ্যামপেইন এবং রেড ও হোয়াইট ওয়াইন। সব খাবার ছিল হেলথি ফুড এবং প্যালেসেই রান্না করা। বাবুর্চি বা শেফ ছিলেন ইংরেজ। বাংলাদেশের ফখরুদ্দিন বাবুর্চির রান্না করা কাচ্চি বিরিয়ানি পরিবেশন করলে নিমন্ত্রিতরা নিশ্চয়ই আরও তৃপ্ত হতেন। জর্ডানে রাজপরিবারের বিয়েতে ফখরুদ্দিন সাহেবকে কাচ্চি বিরিয়ানি রান্নার জন্য নিয়ে যাওয়া হয়েছিল।
প্রণয় সমাচার
উইলিয়াম ও কেইটের বিয়ের আগে প্রণয়টা কীভাবে এবং কোথায় হয়েছিল? উত্তরটা হচ্ছে তাদের পারস্পরিক পরিচয় হয় ২০০৩-এ সেইন্ট অ্যানড্রুজ ইউনিভার্সিটিতে পড়াশোনার সময়ে। তারা ইউনিভার্সিটির ফ্ল্যাটে (হলে) ছিলেন। অর্থাৎ, তারা ফ্ল্যাটমেট ছিলেন। বলা যায়, এক ধরনের লিভ টুগেদার তারা করেন ছাত্রাবস্থায়।
তাদের এই সম্পর্কের খবর পেয়ে পপুলার পত্রিকাগুলো তৎপর হয়ে ওঠে। অনুসন্ধিৎসু সাংবাদিকরা কেইটের জীবন দুর্বিষহ করে তোলে। ডেইলি মিরর পত্রিকার বিরুদ্ধে তিনি মামলা করেন। এপৃল ২০০৭-এ এক পর্যায়ে উইলিয়ামের সঙ্গে তার সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে যায়। তারপর হঠাৎ তাদের পুনর্মিলন হয় নভেম্বর ২০১০-এ। তারা বিয়ে করবেন এমন ঘোষণা দেন। উইলিয়াম ১৮ ক্যারাট স্যাফায়ারের একটি আংটি এনগেজমেন্ট রিং হিসেবে কেইটের আঙ্গুলে পরিয়ে দেন।
চার্লস-ডায়ানার মতোই উইলিয়াম-কেইটের বিয়েটা ভেঙ্গে যাবে কিনা, সে বিষয়ে এখন বৃটেনে বাজি ধরা হচ্ছে। তবে অনেকে মনে করেন, যেহেতু উইলিয়াম ও কেইট বিয়ের আগেই পরস্পরকে খুব ঘনিষ্ঠভাবে জানার সুযোগ পেয়েছিলেন এবং যেহেতু প্রায় তিন বছর বিচ্ছিন্ন জীবনও কাটিয়েছিলেন, সেহেতু তাদের মধ্যে ছাড়াছাড়ি হবার সম্ভাবনা কম।
রূপকথার বিয়ে
এই বিয়েতে বৈপরীত্যের কিছু নমুনা দেখা গেছে। আধুনিক লন্ডন শহরে কোনো গাড়ি বা ট্রাফিক জ্যাম দেখা যায়নি। এর কারণ হলো আগে থেকেই এদিন ছুটি ঘোষণা করা হয়েছিল। কেউ যেন বলতে না পারে, তোমাদের বিয়ের কারণে আমরা রাস্তায় আটকে পড়েছি। একদিকে বৃটিশরা ব্যবসা ভালো বোঝে, অন্য দিকে আবার রাজপরিবারের প্রয়োজনে অন্যদের ছুটি দিয়েও আনন্দ করেছে। বৃষ্টির সম্ভাবনা ছিল শতকরা ৭০ ভাগ। কিন্তু ভাগ্য ভালো ছিল। বৃষ্টি হয়নি।
বিয়ের অনুষ্ঠানে যাওয়ার পথে হোয়াইট হলে অবস্থিত ওয়ার মেমরিয়ালকে স্যালিউট করে আমন্ত্রিতরা দুই মহাযুদ্ধে নিহত বীর শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়েছে।

এই বিয়ে থেকে অনেক কিছুই শেখার রয়েছে। যেমন তারা আমন্ত্রণের সময় বলে দিয়েছেন, কোনো গিফট দেবেন না। দিতে চাইলে চ্যারিটিতে দেবেন। সেবাকাজে তা ব্যয় করা হবে।
অনুষ্ঠানের প্রতিটি পর্ব কাটায় কাটায় নির্ধারিত সময় অনুযায়ী সম্পন্ন হয়। এ জন্য প্রতিটি পর্বেরই রিহার্সাল আগের অনেক দিন জুড়ে হয়েছিল্ সাফল্যের জন্য প্রস্তুতির কোনো বিকল্প নেই।

আমাদের দেশে এ ধরনের কোনো বিয়ে দেখতে পারব না। আমাদের কোনো রাজা-রানি নেই। রূপকথার বইতেই শুধু রাজা-রানি আছে। কিন্তু শিশুদের সুকুমার মনে বাচিয়ে রাখার জন্য এবং তাদের স্বপ্নের রাজ্য রাখার জন্য এই ধরনের বিয়ে দরকার। আমাদের দেশে এ ধরনের বিয়ের অস্তিত্ব শুধু কল্পনায় থাকবে। কিন্তু এটাকে বাস্তবে টিকিয়ে রেখেছে বৃটিশ রাজপরিবার। রাজতন্ত্রের ঐতিহ্য টিকিয়ে রেখেও তারা গণতন্ত্র চর্চা করছে। তার চেয়েও বড় বিষয় হলো, বিশ্বব্যাপী একটি আকর্ষনীয় ঐতিহ্য হিসেবে ধরে রেখেছে তারা রাজপরিবারকে। রাজপরিবারের বিয়ের কারণেই ২৯ এপ্রিল শুক্রবার লন্ডনে ছয় লাখের বেশি অতিরিক্ত টুরিস্ট ভিড় করেছিল।
বর্তমান পৃথিবীর রূঢ় বাস্তবতা হলো এই যে, অনেক বিয়েই টেকে না। বৃটেনের শতকরা পঞ্চাশ ভাগ বিয়ে টেকে না। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে ডিভোর্স হয়ে যায়। অনেকে বিয়ে না করে লিভ টুগেদার করার পন্থা বেছে নেন। সামাজিক রীতি ও বৈধতা হিসেবে বিয়ের মর্যাদা অনেক কমে গিয়েছে।
এই প্রেক্ষিতে উইলিয়াম ও কেইটের বিয়েটা হয়েছে রূপকথার মতো। এক রাজকুমারের সঙ্গে বিয়ে হলো রাজরক্ত বিহীন সাধারণ পরিবারের একটি মেয়ের!

পৃথিবীর সব দেশেই শিশুরা শুনতে চায় রূপকথার গল্প। পড়তে চায় রাজা, রাণী, রাজকুমার, রাজকুমারীর কাহিনী। শিশুদের সুকুমার বৃত্তি বাচিয়ে রাখার জন্য রূপকথার এসব রাজারাণীদের প্রয়োজন। তাই দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদারের ঠাকুরমা-র ঝুলি বইটি প্রয়োজন। যেমন পশ্চিমে প্রয়োজন, গৃমস ফেইরি টেইলস বা হান্স কৃশ্চিয়ান এন্ডারসেনের লেখাগুলো।
বর্তমান বিশ্বে কিছু দেশে রাজারাণী থাকলেও তাদের জীবনযাত্রায় রূপকথার রাজারাণীদের মতো জাকজমকপূর্ণ নয়। সেখানে নেই কোনো রাজকীয় আড়ম্বর; আছে সাধারণ জীবনের প্রলেপ। রাজতন্ত্রকে পূর্ণ মহিমা ও বিশাল গৌরবে বাঁচিয়ে রেখেছে একমাত্র বৃটেনের রাজতন্ত্র। এজন্য বিশ্বের কোটি কোটি শিশুদের ভালোবাসা, ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা দাবি করতে পারে একমাত্র বৃটিশ রাজতন্ত্র। তারা বাঁচিয়ে রেখেছে শিশুদের রূপকথার স্বপ্নরাজ্য, যে রাজ্যের সীমানা বৃটেন পেরিয়ে। যে রাজ্য পৃথিবী জুড়ে। যে রাজ্যে সূর্য কখনও অস্ত যায় না।

৩০ এপৃল ২০১১
শফিক রেহমানলেখক, সম্পাদক ও জনপ্রিয়  টিভি অনুষ্ঠান উপস্থাপক।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন