শুক্রবার, ২৭ জানুয়ারী, ২০১২

নেড়িকুকুরের ইন্টারভিউ: আমেরিকার কুকুর, প্রেসিডেন্ট ও রাজনীতি



shafik-rehman21111উপস্থিত মানুষবৃন্দ
প্রথমেই সবাইকে জানাই লাল গোলাপ শুভেচ্ছা।
ঘেউ ঘেউ।
ঘেউ ঘেউ শব্দ দুটি শুনে আপনারা ঘাবড়ে যাবেন না। আমি বাংলাদেশ থেকে আসা নেড়িকুকুর। কিন্তু আমি সহিংস নই, মৌলবাদী নই, জংগি নই। আমি কাউকে কামড় দেই না। আমি একটি শান্তিপ্রিয় নেড়িকুকুর।

এবার ওয়াশিংটনে ফোবানার সিলভার জুবিলি সম্মেলন উপলক্ষে, আপনাদের এই শহরে, যাকে পৃথিবীর রাজধানীও বলা যায়, তাতে যোগ দেয়ার ইনভিটেশন পেয়ে যুগপৎ খুশি এবং অবাক হই। খুশি এই জন্য যে, আমেরিকায় যেতে পারবো এই ভেবে। অবাক এই জন্য যে, ফোবানা কর্তৃপক্ষের এতদিনে তাহলে আক্কেল হয়েছে বাংলাদেশ থেকে কোনো কুকুরকে ইনভাইট করার। এতদিন তো ফোবানা শুধু বাংলাদেশি সিংগার, পলিটিশিয়ান আর ইনটেলেকচুয়ালদের ইনভাইট করেছে। তাহলে এই প্রথম তারা ডগকেও ইনভাইট করলো।
বুঝলাম, হোয়াইট আমেরিকানদের মতো ব্রাউন বাংলাদেশিরাও এখন ডগ লাভার হয়েছে। আমেরিকান বাংলাদেশিরা কুকুর প্রেমে আসক্ত হয়েছে।
প্রবাসীরা হয়তো জানেন আমেরিকায় প্রায় ৩১ কোটি মানুষ আছে। আর কুকুর আছে প্রায় সাড়ে ছয় কোটি। অর্থাৎ, গড়ে প্রতি ৫ আমেরিকানের একটি পোষা কুকুর আছে। আদর-যত্নে পালিত এসব কুকুরকে পাহারা দেয় মানুষ।
আর বাংলাদেশে মানুষ আছে প্রায় ষোল কোটি। অর্থাৎ, আমেরিকার অর্ধেক। বাংলাদেশে কুকুরের সংখ্যা কেউ বলতে পারবে না। এককালে মানুষকে পাহারা দেয়ার জন্য কুকুর বাংলাদেশে ছিল। এখন কুকুর প্রায় অদৃশ্য হতে চলেছে। শুধু পুলিশ আর র‌্যাবের ডগ স্কোয়াডেই কুকুরদের দেখা যায়। তবে এসব কুকুর শান্তিপ্রিয়। পুলিশ আর র‌্যাবের মতো সহিংস হতে এদের দেখা যায়নি।
আমেরিকা আর বাংলাদেশের কুকুরদের মধ্যে সবচেয়ে বড় পার্থক্যটি হচ্ছে, আমেরিকা সরকারপ্রধান অর্থাৎ প্রেসিডেন্ট কুকুর ভালোবাসেন। যেমন, প্রেসিডেন্ট লিনডন জনসনের ছিল ইউকি নামে কুকুর। জর্জ হার্বার্ট ওয়াকার বুশের ছিল মিলি নামে কুকুর। এখন আপনারা জানেন বারাক ওবামার আছে বো নামে পর্টুগীজ ওয়াটার ডগ। আসলে এরা সবাই প্রেসিডেন্ট হ্যারি এস ট্রুম্যান-এর উপদেশ মেনে চলেছেন। ট্রুম্যান বলেছিলেন, If you want a friend in Washington, get a dog. আপনারা যারা নির্বান্ধব অবস্থায় ওয়াশিংটনে থাকেন, তারা আগামীকাল থেকেই কুকুর পালতে শুরু করুন। ভালো থাকবেন।
তবে হোয়াইট হাউসের ওভাল অফিসে, বো সম্প্রতি একটা কুকাণ্ড করেছিল। প্রেসিডেন্ট ওবামার ডেস্কের নিচে বো হাগু করে দিয়েছিল। কার্পেটে দাগ পড়ে গিয়েছিল। কিন্তু এতে ওবামা মোটেই রাগ করেননি। তার রিপাবলিকান সমালোচকরা বলেন, বো-র ওই হাগু, খুব যত্নের সঙ্গে ওবামা পৃজার্ভ করে রেখে দিয়েছেন। তার প্রেসিডেন্ট পদের মেয়াদ শেষ হয়ে গেলে, তিনি নাকি ওই শুকনো হাগু বা হাগি, সুভেনির রূপে বিক্রি করবেন। এটা নিছকই অপপ্রচার।
শুধু প্রেসিডেন্টরাই নন। আমেরিকায় কুকুরপ্রেমীদের মধ্যে আছেন মাল্টি মিলিয়নেয়াররাও। নিউইয়র্কের ধনী হোটেল ব্যবসায়ী মিসেস লিওনা হেলমসলি ২০০৭-এ মারা যান। তিনি উইল করে তার শাদা রংয়ের মলটিজ ডগ, সাইজে খুব ছোট, ট্রাবল-কে ১২ মিলিয়ন ডলার দিয়ে যান। ১২ মিলিয়ন ডলার! অর্থাৎ বাংলাদেশি প্রায় ৮৫ কোটি টাকা। বুঝুন ব্যাপারটা।
এই জুন মাসেই খবর বেরিয়েছে সেই মলটিজ ডগ ট্রাবল গত ডিসেম্বরে মারা গিয়েছে এবং পরলোকে তার প্রয়াত মনিবের সঙ্গে হয়তো আবার মিলিত হয়েছে। ইহলোকে, লিওনার উইলে ট্রাবলের কবর লিওনার পাশেই দেয়ার নির্দেশ ছিল। কিন্তু কবর কর্তৃপক্ষ সেই নির্দেশ অগ্রাহ্য করেছেন। ট্রাবলকে কৃমেট করা হয়েছে। তার মরদেহ আগুনে পুড়িয়ে ছাই করা হয়েছে।
এই ঘটনায় একটি বিষয় স্পষ্ট হয়েছে যে জীবিত অবস্থায় মানুষ আর কুকুর পাশাপাশি থাকতে পারলেও, অন্তত আমেরিকাতে, মৃত্যুর পর, মানুষ আর কুকুর পাশাপাশি থাকতে পারে না। এটা কুকুর জাতির প্রতি অসম্মানজনক এবং আমি এর তীব্র নিন্দা জানাচ্ছি।
কুকুর সম্পর্কে এত কথা বললাম, আমেরিকার সঙ্গে বাংলাদেশের তফাৎটা বোঝানোর জন্য। আমেরিকানরা কুকুরকে ভালোবাসে। বাংলাদেশে কুকুরকে মানুষ ভালোবাসবে কি? তারা তো গালি হিসেবে কুকুরকে ব্যবহার করে। যেমন : তারা বলে, কুত্তার বাচ্চা।
আর তাই ফোবানার ইনভিটেশন পেয়ে, আমি ভাবলাম, আমেরিকায় গিয়ে নিজের চোখে দেখে আসবো। উন্নত দেশে উন্নত কুকুরদের অবস্থাটা কী?
ফোবানা কর্তৃপক্ষ আমাকে জানিয়েছিলেন, বিজনেস ক্লাস টিকিট দেয়া হবে না। আমাকে ডি ক্লাস বা ডগ ক্লাস টিকিট দেয়া হবে। তাতে আমি রাজি হই।
তবে একটু ভয় ছিল। ঢাকা এয়ারপোর্টে আমাকে কোনো ছলছুতায় ইমিগ্রেশন পুলিশ আটকে দেয় কিনা। প্রায়ই বাংলাদেশ সরকার একটা গোপন লিস্ট আপডেট করে এয়ারপোর্টে জানিয়ে দেয় কাদের বিদেশ যেতে দেয়া হবে না। এয়ারপোর্টে মানুষকে হয়রানি করা একটা রেওয়াজে পরিণত হয়েছে।
যাক। আমার গুড লাক। তারা আমাকে প্লেনে বোর্ড করতে দেয়। প্লেনে আমাকে ডগ ফুড সার্ভ করা হয়। আমি ওয়াশিংটনে পৌঁছাই। ডালেস এয়ারপোর্টে আমার চার পায়ের চার আঙুলের ছবি এবং আমার মুখের ছবি তুলে ইমিগ্রেশন অফিসারটি জিজ্ঞাসা করেন, আমি কেন আমেরিকায় এসেছি?
উত্তর দিলাম, ফোবানা কনভেনশনে জয়েন করতে? তিনি বললেন, ওয়াশিংটনে তো দুটো ফোবানা কনভেনশন হচ্ছে। কোনটায়?
বললাম, আসলটায়। কৃষ্টাল গেইটওয়ে ম্যারিয়ট হোটেলে যেটা হচ্ছে।
গুড। এই বলে ইমিগ্রেশন অফিসার আমাকে ছেড়ে দিলেন।
সো, হিয়ার আই অ্যাম, ফোবানা।
ওয়াশিংটনে আসার পর আমি কয়েকটি জায়গায় ঘুরে বেড়িয়েছি। বাংলাদেশের সঙ্গে বেশ কিছু বড় তফাৎ আমার চোখে পড়েছে। তার কয়েকটি আমি এখানে বলতে চাই।
এক. আমেরিকা খুব বড় দেশ। আয়তন প্রায় ৩৮ লক্ষ বর্গমাইল। বাংলাদেশ ছোট দেশ। আয়তন প্রায় ৫৬ হাজার বর্গমাইল। অর্থাৎ বাংলাদেশের তুলনায় প্রায় ৬৮ গুণ বড় দেশ আমেরিকা। আমেরিকায় প্রতি বর্গমাইলে ৮৫ জন মানুষ থাকে। আর বাংলাদেশে থাকে প্রতি বর্গমাইলে ২,৮০০ মানুষ। বাংলাদেশে মানুষের সংখ্যা প্রতিনিয়তই বেড়ে চলেছে। এই যে এতক্ষণ আমি কথা বললাম, এরি মধ্যে কয়েক শ’ মানুষ বাংলাদেশে বেড়ে গিয়েছে। বলতে পারেন বাংলাদেশের মানুষ এ ক্ষেত্রে আমেরিকানদের তুলনায় অনেক বেশি কর্মতৎপর!
দুই. আমেরিকার তুলনায় তার দুটি প্রতিবেশী দেশ কানাডা ও মেক্সিকো ছোট। আমেরিকার ওপর তারা কোনো চাপ সৃষ্টি করতে পারে না। খবরদারি করতে পারে না। কিন্তু বাংলাদেশের তুলনায় প্রতিবেশী দেশ ইন্ডিয়া বড় ও শক্তিশালী। তারা প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি করেছে। খবরদারি করছে। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নতি ইন্ডিয়ান বিজনেসম্যানদের লক্ষ্যবস্তু হয়েছে। গঙ্গা ও ব্রহ্মপুত্রের পানি ইন্ডিয়ান পলিটিশিয়ানদের লক্ষ্যবস্তু হয়েছে। বাংলাদেশের বর্ডারে ফেলানিসহ বহু নিরীহ মানুষ ইন্ডিয়ান বিএসএফের শিকার হয়েছে। বাংলাদেশে স্যাটেলাইট টিভিতে ইন্ডিয়ান টিভি চ্যানেলগুলো একতরফা সুযোগ নিচ্ছে।
ইন্ডিয়া ট্রানজিট-করিডোর জোর করে নিচ্ছে।
তিন. আমেরিকায় জর্জ বুশের আমলে আমেরিকার শেয়ারবাজারে ধস নামলেও বারাক ওবামার আমলে সেটা সামলে নেয়ার প্রক্রিয়া চালু আছে। বাংলাদেশে শেয়ারবাজারে ধসের প্রক্রিয়া এখনও চলছে। প্রায় ৩৩ লক্ষ মানুষ এতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। যার ফলে দেশে এখন খুনখারাবি ও মস্তিষ্ক বিকৃতির ঘটনা ঘটছে। ঢাকা ইউনিভার্সিটির এক প্রফেসরের দুই চোখ নষ্ট করে দিয়েছেন শেয়ারবাজারে ক্ষতিগ্রস্ত এক ব্যক্তি।
চার. আমেরিকায় বারাক ওবামা তার নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি বজায় রাখতে সচেষ্ট আছেন। মেডিকেয়ার হয়েছে। আফগানিস্তান ও ইরাক থেকে সৈন্য ফেরত আনা হবে। কিন্তু বাংলাদেশে নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি রাখা হয়নি। চালের দাম দশ টাকা কেজি হয়নি, ঘরে ঘরে চাকরি হয়নি।
পাঁচ. ১৭৮৭ সালে আমেরিকার সংবিধান রচিত হয়েছিল। তারপর গত প্রায় সোয়া দু’শ বছরে আমেরিকার সংবিধানের ২৭টি সংশোধনী হয়েছে। অর্থাৎ গড়ে প্রতি ১০ বছরে মাত্র একটি সংশোধনী হয়েছে। আর বাংলাদেশ সংবিধান রচিত হবার পরে গত ৩৮ বছরে ১৬টি সংশোধনী হয়েছে। অর্থাৎ, প্রতি সোয়া দুই বছরে একটি করে সংশোধনী হয়েছে।
ছয়. আমেরিকায় সুনির্দিষ্ট দিনে প্রতি চার বছর অন্তর প্রেসিডেনশিয়াল নির্বাচন হয়। কিন্তু বাংলাদেশে সাধারণ নির্বাচনের তেমন কোনো সুনির্দিষ্ট দিন নেই। আর গত ৩০ জুন বৃহস্পতিবার রাতে পঞ্চদশ বা সর্বশেষ সংশোধনী পার্লামেন্টে পাস হবার পর, বাংলাদেশে শান্তিপূর্ণভাবে আগামী সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়া খুবই অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। বিষয়টি আমার খুব দুর্ভাবনার কারণ হয়েছে। কারণ, তাই যদি হয়, তাহলে বাংলাদেশে আগামীতে বহু মানুষ হতাহত হতে পারে।
এসব চিন্তা করে, আমেরিকায় এসে আমি দুশ্চিন্তায় পড়েছি।
আমার কয়েকটি অনুরোধ আছে।
এক. আপনারা যে দলেরই হোন না কেন, বাংলাদেশে শান্তি বজায় রাখার জন্য সর্বতোভাবে চেষ্টা করুন। পারস্পরিক সহ-অবস্থান, শ্রদ্ধা ও সমঝোতার ভিত্তিতে রাজনীতি করুন।
দুই. সেনাতন্ত্রের চাইতে গণতন্ত্র কাম্য এটা মনে রাখুন। আমেরিকায় জেনারেল পেট্রাউস কখনও আচমকা ক্ষমতা দখল করতে পারবেন না। বাংলাদেশে মইন-উ-আহমেদরা সেটা পেরেছেন। কিন্তু বাংলাদেশে যেন আবার এরশাদ-মইন গংদের কেউ ক্ষমতাসীন না হয়, সেদিকে লক্ষ্য রাখবেন।
তিন. বাংলাদেশের যে মানচিত্র আছে, সেটা রক্ষার জন্য দৃঢ়প্রতিজ্ঞ থাকুন।
চার. বাংলাদেশে রাজনৈতিক নির্যাতন হলে আমেরিকার কংগ্রেসম্যান ও সিনেটর এবং হিউম্যান রাইটস সংগঠনগুলোকে রিপোর্ট করবেন বিনা বিলম্বে। আর সেজন্যই আমেরিকার মেইনস্ট্রিম পলিটিকসে যোগ দিন।
আমার কথা শেষ করার আগে একটি বিখ্যাত ফটোর কথা আপনাদের মনে করিয়ে দিতে চাই। ওই ছবিতে দেখা যায় হোয়াইট হাউসের বারান্দা দিয়ে প্রেসিডেন্ট ওবামা দ্রুত হাঁটছেন। তার সামনে শিকলে বাঁধা, তার কুকুর, বো, দৌড়াচ্ছে। তাহলে ব্যাপারটা কী দাঁড়ালো? আমেরিকা তথা বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী পুরুষটিকে চালিত করছে একটি ছোট কুকুর, বো। আপনাদের কাছে আমার সনির্বন্ধ অনুরোধ, বো-র সঙ্গে আমার একটা অ্যাপয়েন্টমেন্ট করিয়ে দিন। আমি তার কাছ থেকে জেনে নেব, কোন কৌশলে কুকুররা চালিত করতে পারে পলিটিশিয়ানদের। তারপর সেই কৌশল, বাংলাদেশে ফিরে গিয়ে কাজে লাগাবো।
এতক্ষণ আমার কথা শোনার জন্য সবাইকে ধন্যবাদ। আমেরিকা-বাংলাদেশ বন্ধুত্ব জোরালো হোক। সবাই ভালো থাকুন।
ঘেউ ঘেউ।

কৃষ্টাল গেইটওয়ে ম্যারিয়ট হোটেল
ভার্জিনিয়া
১ জুলাই ২০১১
শফিক রেহমান:প্রবীণ সাংবাদিক ও জনপ্রিয়  টিভি অনুষ্ঠান উপস্থাপক।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন