শুক্রবার, ২৭ জানুয়ারী, ২০১২

একটি ইন্টারভিউ এবং দুটি ভাষণ: জাতিসংঘে শেখ হাসিনার ভাষণ




shafik-rehman21111111111প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শুক্রবার ২৪ সেপ্টেম্বরে নিউ ইয়র্কে জাতিসংঘ ভবনে জাতিসংঘের ৬৬তম অধিবেশনে বাংলায় একটি সুদীর্ঘ ভাষণ দেন। এই ভাষণটি বাংলাদেশে বিটিভি সম্প্রচার করে ২৫ সেপ্টেম্বর শনিবার রাত সাড়ে দশটায়। এক ঘণ্টারও বেশি লম্বা তার এই ভাষণটির তাৎপর্য ও প্রতিক্রিয়া কী ছিল? বিশ্ববাসী কি বাংলাদেশের ‘গণতন্ত্রের মানসকন্যা’ রূপে পূর্ব প্রচারিত এবং ‘শান্তির সেবিকা’ রূপে সম্প্রতি প্রচারিত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভাষণটি শোনার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিল? এর সোজাসাপটা উত্তর হবে, না। তারা কেউই শেখ হাসিনার ভাষণ শোনার জন্য অপেক্ষমাণ ছিল না।
অ্যাসেম্বলি হলে নিষ্প্রাণ দর্শক
জাতিসংঘ বিশ্ববাসীর জন্য অতি গুরুত্বপূর্ণ একটি সংগঠন হলেও বিশ্ববাসী এখানে দেয়া ভাষণগুলোকে সাধারণত গুরুত্ববিহীন মনে করে। জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে বাংলাদেশ প্রতিনিধি দলের সদস্য রূপে একবার যোগ দেয়ার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল। জাতিসংঘের অ্যাসেম্বলি হলে উপস্থিতির সংখ্যা আমাকে অবাক করেছিল। আমি জানতাম ১৯৩ সদস্যদেশ বিশিষ্ট জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে যোগ দিতে আসেন বহু দেশের সরকারপ্রধান এবং তাদের সঙ্গে বড় প্রতিনিধিদল। কিন্তু অধিবেশন চলার সময়ে তাদের কম উপস্থিতি আমাকে বুঝিয়ে দেয় যে নিউ ইয়র্কে আগত বহু প্রতিনিধি জাতিসংঘ ভবনে এসে বক্তৃতা শোনার চাইতে নিউ ইয়র্ক শহর দেখা অথবা শপিং করাই পছন্দ করেন।
এবার জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে যোগ দিতে বাংলাদেশ প্রতিনিধিদলের সদস্যসংখ্যা কত ছিল? একটি পত্রিকার মতে সদস্যসংখ্যা ছিল ৪০জন। তবে অধিবেশনের সময়ে এদের সবার ভেতরে ঢোকার অনুমতিপত্র থাকে না। তা যদি থাকত তাহলে ভালো হতো। সেক্ষেত্রে শেখ হাসিনার ভাষণ শোনারত শ্রোতার সংখ্যা বাড়ত। বাংলাদেশে টিভি দর্শকরা লক্ষ্য করেন শেখ হাসিনার ভাষণের সময়ে দর্শক সংখ্যা ছিল মাত্র শ’ খানেক এবং তারা ছিল নিষ্প্রাণ।
ব্যতিক্রম হয় বিশ্ব ইসুতে
মাঝে মধ্যে অবশ্য জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশন হয়ে ওঠে প্রাণবন্ত। যেমন, অক্টোবর ১৯৬৮-তে সভিয়েট নেতা নিকিতা ক্রুশ্চেভ যখন এসেছিলেন এবং টেবিলে জুতা চাপড়ে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন আমেরিকানদের নাতি-নাতনিরা একটি সমাজতান্ত্রিক বা সোশালিস্ট দেশে বাস করবে। এ বছর জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে প্রধান আকর্ষণ ছিলেন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা, ইসরেলের প্রধানমন্ত্রী বেনইয়ামিন নেতানিয়াহু ও প্যালেস্টাইনি প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস। জাতিসংঘে প্যালেস্টাইনের সদস্যপদের আবেদনের পক্ষে ও বিপক্ষে এরা কি যুক্তি দেন সেটা জানতে বিশ্ববাসীর আগ্রহ ছিল। কারণ মিডল ইস্টে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠার ওপরই নির্ভর করছে বিশ্বের সামগ্রিক শান্তি। এদের ছাড়াও লিবিয়ার গৃহযুদ্ধে কর্নেল গাদ্দাফি সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহীদের প্রতি বৃটিশ তথা নেটোর সমর্থন দান বিষয়ে বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন জাতিসংঘে কী যুক্তি দেন সেটা জানতেও বিশ্ববাসী আগ্রহী ছিল। কারণ লিবিয়ায় শান্তি প্রতিষ্ঠার ওপর নির্ভর করছে বিশ্ববাজারে তেলের দামের স্থিতি অবস্থা।
দুঃখের বিষয় বিশ্ব মঞ্চে শান্তির নতুন দূত রূপে আবির্ভূত বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর এই ভূমিকা সম্পর্কে বিশ্ববাসী ছিল অজ্ঞাত। হয়তো তাই তার ভাষণ শোনায় ছিল তাদের অনাগ্রহ।
প্রেসিডেন্ট জিয়ার সাহসী বক্তব্য
কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর ভাষনের প্রতি স্বদেশে এবং বিদেশে বাংলাদেশিদের ছিল অপরিসীম আগ্রহ। বিশেষত ৬ ও ৭ সেপ্টেম্বরেই ঢাকায় ইনডিয়ান প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিংয়ের একতরফা সফল (ইনডিয়ানদের দৃষ্টিকোণ থেকে) সফরের পর তিস্তার পানি বণ্টন বিষয়ে শেখ হাসিনা জাতিসংঘে কী বলবেন, সেটা শোনার জন্য বাংলাদেশিরা ছিল অধীর। তাদের মনে পড়ে যাচ্ছিল, ৩৪ বছর আগে জাতিসংঘের ৩২তম সাধারণ অধিবেশনে বাংলাদেশের পানির অধিকার সম্পর্কে বক্তব্য রেখেছিলেন প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান। তার সেই বক্তব্য ছিল বিদ্বেষবিহীন কিন্তু যুক্তিপূর্ণ, আক্রোশবিহীন কিন্তু আবেগময়। এর ফলে পরবর্তীতে গ্যারান্টি ক্লজসহ গঙ্গার পানিবণ্টন চুক্তি হয়েছিল। বাংলাদেশ পানি পেয়েছিল।

অনুচ্চারিত তিস্তা

কিন্তু শেখ হাসিনার এই প্রায় ১৬৫০ শব্দবিশিষ্ট ভাষণে তিস্তা শব্দটি ছিল অনুচ্চারিত এবং নির্মিতব্য অথবা নির্মীয়মান টিপাইমুখ বাধ শব্দগুলো ছিল অনুপস্থিত। ইনডিয়ার সঙ্গে নদীর পানি বণ্টন বিষয়ে বর্তমান সমস্যাগুলো যেখানে উল্লেখযোগ্য মনে হয়নি, সেখানে শেখ হাসিনা ফারাক্কা-গঙ্গা বিষয়ে অতীত সমস্যার কথা যে আবার টেনে আনেন নি, সেটাও তার পক্ষে স্বাভাবিক ও মানানসই ছিল।
তাহলে শেখ হাসিনার ভাষণের মূল বিষয়বস্তু কী ছিল?
শান্তির নতুন দূত
এই ভাষণের প্রায় চার-পঞ্চমাংশ বা ৮০ শতাংশ ছিল তার সরকারের সাফল্যের ফিরিশতি যা অনেকটা বাজেট ভাষণের মতো মনে হয়েছে। বলা বাহুল্য জাতিসংঘে সেদিন কেউ বাংলাদেশের বাজেট কাহিনী শোনার জন্য উপস্থিত ছিলেন না। ভাষণের বাকি এক-পঞ্চমাংশ বা ২০ শতাংশ ছিল স্বদেশে তার শান্তি প্রতিষ্ঠায় সাফল্য এবং বিদেশে শান্তি প্রতিষ্ঠায় তার উদ্যোগের বিষয়। এই শান্তিকাহিনী দুই ভাগে বিভক্ত করা হয়েছিল।
ভাষণের প্রারম্ভে প্রয়োজনীয় সৌজন্য প্রকাশের পরই ছিল শেখ হাসিনার পিতা প্রয়াত শেখ মুজিবুর রহমানের শান্তি প্রচেষ্টার উল্লেখ। তারপরে আবার ভাষণের শেষের দিকে ছিল শেখ হাসিনার নিজস্ব শান্তি প্রচেষ্টার উল্লেখ। তার ভাষণের এই শেষাংশের কিছুটা নিচে উল্লেখ করছি :
সম্মানিত সভাপতি
গত অর্ধ শতাব্দি ধরে আমি রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত রয়েছি। পুরো সময় জুড়ে আমি ছিলাম শান্তির পক্ষে একজন অগ্রণী ও নির্ভীক যোদ্ধা। আমি মনে করি জবরদস্তি এবং আইনের শাসনের অনুপস্থিতির মতো অবিচার নিরসনের মাধ্যমে সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব। অসাম্য, অর্থনৈতিক বৈষম্য, বঞ্চনা, দারিদ্র, সাম্প্রদায়িকতা, নারী এবং ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর অধিকারহীনতা এবং সরকারি কাজে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার অভাব মানুষের ন্যায়বিচার প্রাপ্তির ক্ষেত্রে বাধা হিসেবে কাজ করে।

Uppsala Data Programme অনুযায়ী ১৯৬৪ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত এসব অন্যায্য কর্মকান্ডের ফলে গোটা বিশ্বে পাঁচ মিলিয়নেরও বেশি মানুষ প্রাণ হারিয়েছে।
আমার দৃঢ় বিশ্বাস জাতিসংঘের মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা জোরদার করার মাধ্যমে এসব অপমৃত্যু পরিহার করা যেত। শান্তি এবং উন্নয়নের কেন্দ্রবিন্দুতে মানুষকে স্থান দেওয়ার মাধ্যমে এই প্রাণহানি অবশ্যই এড়ানো সম্ভব হতো।
আমার সারা জীবনের অভিজ্ঞতার আলোকে আমি আপনাদের সামনে একটি শান্তির মডেল উপস্থাপন করতে চাই, যার ভিত্তি হচ্ছে জনগণের ক্ষমতায়ন। এটি একটি বহুমাত্রিক ধারণা, যেখানে গণতন্ত্র এবং উন্নয়নকে সর্বাগ্রে স্থান দেওয়া হয়েছে, যার কেন্দ্রে আছে জনগণের ক্ষমতায়ন।
আমি এর নাম দিয়েছি ‘জনগণের ক্ষমতায়ন মডেল’। এর মূল বিষয় হচ্ছে সকল মানুষকে সমান চোখে দেখা। শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য প্রয়োজন জনগণের ক্ষমতায়ন এবং মানবিক সক্ষমতা বৃদ্ধি।
আই প্রবলেম
পাঠকরা লক্ষ্য করুন, এই পর্যায়ে শেখ হাসিনা অন্ততপক্ষে সাতবার আমি ও আমার শব্দ দুটি উচ্চারণ করেছেন। বিশ্বশান্তি প্রচেষ্টায় শেখ হাসিনা যে আমিত্ব রোগে ভুগছেন সেটা এই দুটি শব্দের বহুল ব্যবহারে প্রমাণিত হয়েছে।
একই লক্ষ্যে একই অ্যাসেম্বলি হলে বারাক ওবামা ও ডেভিড ক্যামেরন যেসব যুক্তিপূর্ণ ভাষণ দেন সেখানে আমিত্ব ছিল নির্বাসিত। শেখ হাসিনা তাদের ভাষণ দুটি পড়ে দেখতে পারেন। এখানে জানিয়ে রাখা উচিত যে, সাধারণত পশ্চিমের শালীনতা ও সংযমপ্রিয় পলিটিশিয়ানরা ‘I’ বা ‘আমি’র বদলে ‘We’ বা ‘আমরা’ এবং ‘My’ বা ‘আমার’ বদলে Our বা ‘আমাদের’ শব্দ দুটি ব্যবহার করেন। বাংলাদেশের পলিটিশিয়ানরা ভবিষ্যতে ‘আমরা’ ও ‘আমাদের’ শব্দ দুটি ব্যবহারে উৎসাহী হতে পারেন এবং ‘I’ Problem (আই প্রবলেম) থেকে মুক্ত থাকতে পারেন।
এখন বিবেচনা করা যাক শেখ হাসিনার এই শান্তিবাদ প্রচারের উদ্দেশ্য কী ছিল? কেন ‘জননেত্রী’ থেকে ‘বিশ্বশান্তি নেত্রী’ রূপে উত্তরণের এই প্রচেষ্টা ছিল?
প্রয়োজন ইতিহাস উপদেষ্টা
এ কথা এখন অনেকেই জানেন শেখ হাসিনা চান নোবেল শান্তি পুরস্কার এবং ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বিরুদ্ধে তার ব্যক্তিগত আক্রোশের অন্যতম কারণও এটা।
দুঃখের বিষয় বর্তমানে বিভিন্ন বিষয়ে শেখ হাসিনার সাতজন শক্তিমান উপদেষ্টা থাকলেও ইতিহাস বিষয়ে একজন উপদেষ্টাও নেই। যদি কোনো ইতিহাস উপদেষ্টা থাকতেন, তাহলে তিনি হয়তো জানাতে পারতেন গত পঞ্চাশ বছরে ক্ষমতাসীন অবস্থায় মাত্র সাত জন নোবেল শান্তি পুরস্কার পেয়েছেন। এরা হচ্ছেন:
১. বারাক ওবামা (২০০৯)। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট পদে অভিষিক্ত হবার সূচনালগ্নে নোবেল পুরস্কার কমিটি তাকে এই পুরস্কারটি দেয়। সম্ভবত তাদের উদ্দেশ্য ছিল মিডল ইস্টে শান্তি প্রচেষ্টায় যেন ওবামা বদ্ধপরিকর থাকেন সেটা নিশ্চিত করা।
২. সাউথ কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট কিম দায়ে জং (২০০০)। ওই দেশে কিম দায়ে জং-ই প্রথম বিরোধী দল থেকে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছিলেন এবং গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।
৩. ইসরেলি প্রধানমন্ত্রী ইসহাক র‌্যাবিন (১৯৯৪)। প্যালেস্টাইনের নেতা ইয়াসির আরাফাতের সঙ্গে সমঝোতার পক্ষে গিয়েছিলেন র‌্যাবিন।
৪. সাউথ আফৃকার প্রেসিডেন্ট এফ ডাবলিউ ডি ক্লার্ক (১৯৯৩)। তিনি শ্বেতাঙ্গ হলেও কৃষ্ণাঙ্গদের নেতা নেলসন ম্যানডেলার সঙ্গে আপোষ করেছিলেন এবং সাউথ আফৃকাতে শ্বেতাঙ্গ বা বর্ণবাদী শাসনের অবসান ঘটান।
৫. ইজিপ্টের প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদাত ও ইসরেলের প্রধানমন্ত্রী মেনাখেম বেগিন (১৯৭৮)। এরা দুজনা আরব-ইসরেলি সমঝোতার পথে এগিয়ে যাচ্ছিলেন।
৬. জার্মানির চান্সেলর উইলি ব্রান্ডট (১৯৭১)। তদানীন্তন পূর্ব জার্মানি, পোল্যান্ড ও সভিয়েট ইউনিয়নের মধ্যে সম্পর্ক উন্নয়নে তার অস্টপলিটিক নীতি প্রচারের জন্য ব্রান্ডট এই পুরস্কার পেয়েছিলেন।
ভূতের মুখে রাম নাম
লক্ষ্য করুন এদের মধ্যে চারজন মিডল ইস্টে শান্তি প্রতিষ্ঠায়, দুই জন (কিম দায়ে জং ও ডি ক্লার্ক) তাদের দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় এবং একজন (ব্রান্ডট) পূর্ব ইওরোপে শান্তি প্রতিষ্ঠায় জড়িত ছিলেন। ভিন্ন মাত্রার হলেও এ সব প্রক্রিয়ারই বিশ্ব তাৎপর্য ছিল। অথাৎ ক্ষমতাসীনরা স্বদেশে তাদের দাবি করা সাফল্যের জন্য নোবেল পুরস্কার পাননি।
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর শান্তি প্রচেষ্টার বিশ্ব তাৎপর্য এদের তুলনায় খুব কম। সুতরাং পজিটিভলি চিন্তা করলে, এদের তুলনায় শেখ হাসিনার নোবেল শান্তি পুরস্কার পাওয়ার সম্ভাবনা নগণ্য।
অন্য দিকে নেগেটিভলি চিন্তা করলে শেখ হাসিনার নোবেল শান্তি পুরস্কার পাওয়ার আদৌ কোনো সম্ভাবনা যে নেই সেই সিদ্ধান্তে আসা যেতে পারে। প্রধান কয়েকটি কারণ :
এক. মৃত্যুদন্ড দেওয়া ও তা কার্যকর করায় শেখ হাসিনার ও তার দলের আগ্রহ। আগে দেখা যেত ব্যানার, পোস্টার ও দেয়াল লিখনে “ফাঁসির রায় কার্যকর কর” স্লোগান। পাঁচজনের ফাঁসি হয়ে যাবার পর এখন দেখা যাচ্ছে “হত্যাকারীদের দেশে ফিরিয়ে আনো ও ফাঁসি দাও” স্লোগান। শেখ হাসিনার নির্দেশে তার সরকার এখন বিভিন্ন দেশে যেমন, আমেরিকা, কানাডা, লিবিয়া, পাকিস্তান ও ইনডিয়াতে অভিযুক্ত হত্যাকারীদের খুঁজে বেড়াচ্ছে। লক্ষ্য, তাদের স্বদেশে ফিরিয়ে এনে ফাঁসি দেয়া। এই লক্ষ্য শেখ হাসিনাকে নোবেল শান্তি পুরস্কার পাওয়ার লক্ষ্য থেকে দূরে সরিয়ে দিয়েছে। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের তথ্য অনুযায়ী এখন বিশ্বের ১৩৭টি দেশে মৃত্যুদন্ড রহিত করা হয়েছে। এমনকি কিছু দেশে মৃত্যুদন্ড দেয়া হলেও তা কার্যকর করা হয় না। অ্যামনেস্টি মৃত্যুদন্ডের ঘোর বিরোধী এবং অপ্রকাশ্যে তারা নোবেল শান্তি পুরস্কারের পেছনে কাজ করে। সুতরাং….।
দুই. এই সেদিনও আমেরিকার সাবেক প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন তার বন্ধু ড. ইউনূস প্রসঙ্গে বলেছেন শেখ হাসিনা পরশ্রীকাতর ও প্রতিহিংসাপরায়ণ। প্রতিহিংসা কোনো গুণ নয়। রোমান স্যাটায়ার লেখক জুভেনাল (খৃষ্টাব্দ ৬০-১৩০) লিখেছিলেন, প্রতিহিংসা সব সময়ই হচ্ছে তুচ্ছ, দুর্বল ও ছোট মনের আনন্দ (Indeed, revenge is always the pleasure of a paltry, feeble, tiny mind).
ইংরেজ চিন্তাবিদ ফ্রান্সিস বেকন লেখেন, প্রতিহিংসা হচ্ছে এক ধরনের বন্য বিচার। মানুষ স্বভাবতই যতই সেদিকে ছুটবে ততই আইন দিয়ে সেটা উপড়ে তুলতে হবে। (Revenge is a kind of wild justice, which the more man’s nature runs to, the more ought law to weed it out)
প্রেসিডেন্ট জিয়াউল হকের সাজানো বিচারের পর পাকিস্তানের নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টোকে ফাসিতে প্রাণ হারাতে হলেও, তার মেয়ে বেনজির ভুট্টো ডটার অফ ডেসটিনি (Daughter of Destiny) বইয়ে লেখেন, তিক্ততা নিয়ে আপনি চালিত হতে পারেন না। তিক্ততা আপনাকে খেয়ে ফেলতে পারে কিন্তু এটা আপনাকে সামনের দিকে নিয়ে যেতে পারবে না (You can’t be fulled by bitterness. It can eat you up, but it cannot drive you) শেখ হাসিনার “একটার বদলে দশটা লাশ চাই” প্রভৃতি উক্তি কোনো দিনই তার শান্তিবাদী অহিংস ইমেজ আনবে না।
তিন. বিরোধী রাজনৈতিক দলকে শত্রু আখ্যায়িত করা এবং বিরোধীদের দমনপীড়ন শেখ হাসিনাকে অশান্তির পক্ষে একজন অগ্রণী ও নির্ভীক যোদ্ধা রূপে প্রতিষ্ঠিত করেছে। শেখ হাসিনা যখন জাতিসংঘে শান্তির ভাষণ দিচ্ছিলেন তখন জাতিসংঘ ভবনের বাইরে বাংলাদেশে তারই পুলিশবাহিনীর হাতে নির্যাতিত ও আহত এবং এখন নিউ ইয়র্কে চিকিৎসাধীন বিএনপি নেতা বিরোধীদলীয় চিফ হুইপ জয়নুল আবদিন ফারুক এমপি প্রতিবাদ জানাচ্ছিলেন। শেখ হাসিনার মুখে শান্তির কথা শুনে জয়নুল আবদিন ফারুক তখন নিশ্চয়ই আওড়াচ্ছিলেন “ভূতের মুখে রাম নাম” বাক্যটি।
চার. জয়নুল আবদিন ফারুক নির্যাতন প্রক্রিয়ার পরেই সেপ্টেম্বরে প্রকাশিত হয়েছে, ইসলামী ব্যাংক হসপিটালের ক্লিনার ইউসুফকে ভূপাতিত করে তার বুকের ওপর সদর্পে দাড়িয়ে আছে আবু হাজ্জাত নামে জনৈক পুলিশ অফিসার। ইউ টিউব এবং ইন্টারনেটের কল্যাণে এই ছবি বিশ্বের অন্তত ৮০টি দেশে প্রচারিত হয়েছে এবং শেখ হাসিনার শান্তির চাকা পাংচার করে দিয়েছে।
পাচ : বিনা বিচারে মতিউর রহমান নিজামীসহ অন্যান্য জামায়াত নেতাকর্মীদের এবং বিএনপি নেতা সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে জেলে আটক রাখার বিষয়টি আন্তর্জাতিকভাবে আর গ্রহণযোগ্য হচ্ছে না। তাই যুদ্ধাপরাধের বদলে এখন মানব অধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ এদের বিরুদ্ধে তোলা হচ্ছে। সে যা-ই হোক না কেন, বিনা বিচারে এত দীর্ঘ সময় রাজনৈতিক প্রতিপক্ষদের আটকে রাখা শেখ হাসিনার জুলুমবাদকে সুপ্রতিষ্ঠিত করেছে, শান্তিবাদকে নয়।
দিল্লি নজদিক, কিন্তু নোবেল দূর অস্ত
উপরোক্ত বিষয়গুলো বিবেচনা করলে এই সিদ্ধান্তে আসতেই হবে যে, জাতিসংঘে শেখ হাসিনার ভাষণে উন্নয়ন বিষয়ক ফিরিশতি ছিল নিষ্প্রয়োজনীয় এবং শান্তি বিষয়ক তত্ত্বটি ছিল নিরর্থক। সব মিলিয়ে এই ভাষণটি ছিল বাংলাদেশীদের জন্য গুরুত্বহীন।
অথচ এই ভাষণই হতে পারত খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং ঐতিহাসিক। যদি শেখ হাসিনা শুধু বলতেন বাংলাদেশের জীবনমরণ সমস্যা, পানি সমস্যার কথা, সেপ্টেম্বরে ইনডিয়ার নিলর্জ্জ প্রতারণার কথা। স্বঘোষিত টপ দেশপ্রেমিক যদি সত্যিই দেশের কথা ভাবতেন তাহলে তিনি তা-ই বলতেন। কিন্তু না। তিনি প্রমাণ করেছেন তিনি আত্মপ্রেমিক। তাই তিনি বহু খরচ করে জাতিসংঘে গিয়ে দিয়ে এসেছেন ‘জনগণের ক্ষমতায়ন মডেল’ নামে শান্তি প্রতিষ্ঠার থিওরি। বাস্তবে বাংলাদেশে এটি ‘আমার (হাসিনার) ক্ষমতায়নের থিওরি’ বলে বিবেচিত হবে। বাংলাদেশিরা বলতে বাধ্য হবে দিল্লি হাসিনার নজদিক হলেও, নোবেল শান্তি পুরস্কার দূর অস্ত!
৩০ সেপ্টেম্বর ২০১১
(বানান রীতি লেখকের নিজস্ব)
শফিক রেহমান: প্রবীণ সাংবাদিক ও জনপ্রিয়  টিভি অনুষ্ঠান উপস্থাপক।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন