শুক্রবার, ২৭ জানুয়ারী, ২০১২

সংবিধান, দেশপ্রেম ও ড. জনসন: নেড়িকুকুরের ইন্টারভিউ



shafik-rehman211111কুকুররা দেশপ্রেমের জন্য খ্যাত নয়।
আর যেহেতু কুকুরদের কোনো নিজস্ব দেশ, যেমন কুকুরদেশ অথবা কুকুরস্তান কিংবা ডগল্যান্ড নেই সেহেতু কুকুরদের কোনো সংবিধানও নেই।

বলা যায়, এ দুটি দিকের বিবেচনায় মনুষ্যকুল, বিশেষত বাংলাদেশের মনুষ্যকুলের তুলনায় কুকুর জাতি বিতর্কের ঊর্ধ্বে এবং অনেকটা বিপদমুক্ত।
কুকুরদের দেশপ্রেমের পরীক্ষা দিতে হয় না। সুতরাং কুকুরদের মধ্যে কে টপ দেশপ্রেমিক সেই তর্ক হয় না। আর যেহেতু কুকুরদের কোনো সংবিধান নেই সেহেতু সংবিধান সংশোধনী, সংবিধান ছুঁড়ে ফেলা, সংবিধান সম্পর্কিত ধৃষ্টতামূলক উক্তির জন্য কারো ফাঁসির দাবি তোলা অথবা কাউকে পাকিস্তানে চলে যেতে বলা প্রভৃতি রাজনৈতিক ঝড়ের কবলে কুকুরদের পড়তে হয় না।
সম্প্রতি বাংলাদেশে এই রকম একটা ঝড় যখন শুরু হয় তখন আমি আমেরিকায় ছিলাম। কাকতালীয় ভাবে এ দুটি বিষয় দেশপ্রেম এবং সংবিধান-এর সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র বা ইউনাইটেড স্টেটস অফ আমেরিকা অষ্টাদশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধ থেকে বিশ্বের অন্য যে কোনো দেশের চাইতে বেশি ওতপ্রতোভাবে জড়িয়ে আছে। আরো সুনির্দিষ্টভাবে বলা যায়, ১৭৭৬ থেকে যখন আমেরিকার ডিক্লারেশন অফ ইনডিপেনডেন্স বা স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে প্রথম ৫৬ পেট্রিয়ট বা দেশপ্রেমিক সই করেন, তখন থেকে।
আমারই কপাল! আমেরিকায় যখন ছিলাম তখন বাংলাদেশে শুরু হলো দেশপ্রেম ও সাংবিধানিক বিষয়ক ঝড়। আমি আমেরিকান ইতিহাস ঘাটাঘাটি শুরু করলাম। বোঝার চেষ্টা করলাম দেশপ্রেমিক কারা? দেশপ্রেমিক কাদের বলা হয়? সংবিধান কী? সংবিধান কারা লেখে? সংবিধান কারা মেনে চলে? ইত্যাদি ইত্যাদি।
উদারনৈতিক চিন্তাধারার ফসল
আমেরিকান সংবিধান

আমেরিকার ডিক্লারেশন অফ ইনডিপেনডেন্সে স্বাক্ষরদাতা ৫৬ পুরুষ, বা আমেরিকার প্রথম ৫৬ দেশপ্রেমিক, সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, তারা বৃটিশ শাসন অমান্য করবেন এবং বৃটিশ উপনিবেশের বদলে উত্তর আমেরিকায় হবে স্বাধীন দেশ, ইউনাইটেড স্টেটস অফ আমেরিকা। এ ঘোষণাপত্রে এই ৫৬ জন পারস্পরিক অঙ্গীকার করেন, স্বাধীনতা অর্জনের জন্য তারা তাদের জীবন, ধন-সম্পত্তি ও মান-সম্মান বিসর্জন দিতে প্রস্তুত থাকবেন। এই দেশপ্রেমিকদের মধ্যে একজন বাদে বাদবাকি সবাই ছিলেন ধনী ভূস্বামী। অর্থাৎ, স্বাধীন না হতে পারলে তারা প্রভূত ক্ষতিগ্রস্ত হতেন। সুদূর বৃটেনের রাজতন্ত্রকে হটিয়ে দিয়ে একটি প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় তারা তাদের জীবন ও সম্পত্তি বিসর্জন দিতে প্রস্তুত ছিলেন। তারা চেয়েছিলেন ব্যক্তি স্বাধীনতা, আইনের শাসন, ব্যক্তিগত দায়িত্বশীলতা এবং সাংবিধানিকভাবে সীমিত ক্ষমতার সরকার। মূলত এ চারটি উদারনৈতিক চিন্তাধারাই ছিল তাদের প্রজাতন্ত্রের ভিত্তি।

তারপর ইউনাইটেড স্টেটস অফ আমেরিকা তিনটি ধাপ পেরিয়েছে।
এক. প্রজাতন্ত্র রূপে যাত্রা শুরু (১৭৭৬-১৮৬৪)।
দুই. গৃহযুদ্ধে আমেরিকার দক্ষিণ অঞ্চল পরাজিত হওয়ার পর নেশন বা একটি ঐক্যবদ্ধ জাতি হিসেবে পরিচয় প্রতিষ্ঠা (১৮৬৫-১৯১৬)। এবং
তিন. প্রেসিডেন্ট উইলসন যখন ইওরোপের প্রথম মহাযুদ্ধে আমেরিকান সৈন্যদের পাঠান তখন একটি সাম্রাজ্যবাদী শক্তি রূপে আমেরিকার আত্মপ্রকাশ (১৯১৭ থেকে বর্তমানকাল পর্য়ন্ত)।

যদিও ১৭৭৬-এ যুক্তরাষ্ট্রের সূচনালগ্নে মাত্র ৫৬ জন দেশপ্রেমিক ছিলেন এবং সাধারণ আমেরিকানরা এর বাইরে ছিলেন। তবুও পরবর্তীকালে এ তিনটি ধাপেই সাধারণ মানুষের দেশপ্রেমকে কাজে লাগিয়েছে আমেরিকার শাসক ও পলিটিশিয়ানরা।
সার্বক্ষণিক দেশপ্রেম
বস্তুত আমেরিকার মতো এতো সার্বক্ষণিক দেশপ্রেমের বহিঃপ্রকাশ বোধহয় অন্য কোনো দেশে আর দেখা যায় না। আমেরিকার সাধারণ মানুষ তাদের এই বহিঃপ্রকাশ ঘটায় বাড়ির সামনে আমেরিকান ফ্ল্যাগ প্রতিদিন টাঙিয়ে রেখে। আর আমেরিকার রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলো : হোয়াইট হাউস, ক্যাপিটল হিলে হাউস অফ কংগ্রেস প্রভৃতি সরকারি স্থাপনার ওপরে আমেরিকান ফ্ল্যাগ রেখে। বিভিন্ন দোকানপাটে বিভিন্ন সাইজের আমেরিকান ফ্ল্যাগ রেখে।

ওয়াশিংটন, নিউ ইয়র্ক ও আটলান্টিক সিটিতে আমাকে গাড়ির পেছনের সিটে বসিয়ে ঘুরিয়ে দেখান পালাক্রমে ইউনিক জুয়েলার-এর স্বত্বাধিকারী হোসেন, ম্যাকডোনাল্ডস-এর এরিয়া সুপারভাইজর মাসুদুর রহমান, ল্যান্ডমার্ক কন্সট্রাকশনের কর্ণধার ফিরোজ আহমেদ, রেপটাইলস ফার্মস লিমিটেডের অ্যাডভাইজর ফারুক আহমেদ ও ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের কর্মকর্তা জিয়াউদ্দিন হায়দার প্রমুখ। তাদের সঙ্গে যখনই বেড়াতে গিয়েছি তখনই অবাক হয়ে লক্ষ্য করেছি বহু আমেরিকানদের বাড়ির সামনে, বারান্দায় অথবা ছাদে আমেরিকান ফ্ল্যাগ শোভিত হচ্ছে। বোঝাই যায়, তাদের দেশ আমেরিকার সুরক্ষার জন্য এসব গৃহবাসীর অনেকেই মৃত্যুর ঝুকি সত্ত্বেও হাসিমুখে বিদেশে, যেমন, ইরাক ও আফগানিস্তানে যেতে প্রস্তুত, যেমনটা তাদের পূর্বসূরিরা গিয়েছিলেন কোরিয়া ও ভিয়েতনামে। দেশপ্রেমের সঞ্জীবনী সুধা আমেরিকান জনগণের মধ্যে খুব কার্যকর ভূমিকা পালন করে। তাই তাদের ফ্ল্যাগ (স্টারস অ্যান্ড স্ট্রাইপস) এবং জাতীয় সঙ্গীত (স্টার-স্প্যাংগল্ড ব্যানার) তাদের এতো প্রিয়।
একই সঙ্গে সাধারণ আমেরিকানরা তাদের কন্সটিটিউশন বা সংবিধান বিষয়ে সচেতন ও গর্বিত সঙ্গত কারণেই।
প্রথম সংবিধান ইরাকে
ল্যাটিন শব্দ কন্সটিটিউশো থেকে ইংরেজি শব্দ কন্সটিটিউশনের উৎপত্তি। রোমান সাম্রাজ্যের বিভিন্ন নিয়ম এবং আদেশকে বোঝাতে কন্সটিটিউশো শব্দটি ব্যবহৃত হতো। পরবর্তীকালে রোমের ভাটিকান সিটি থেকে কৃশ্চিয়ান ধর্মের সর্বোচ্চ নেতা পোপ যেসব আদেশ জারি করতেন সেসবকে কন্সটিটিউশো বলা হতো।

তবে বিশ্বের প্রথম কন্সটিটিউশন বা সংবিধানটি চালু হয়েছিল ইরাক নামে আধুনিক কালে পরিচিত ভূখ-টিতে। ১৯৭৭-এ প্রতœতাত্তিক আর্নেস্ট ডি সারজে ইরাকে কাজ করার সময়ে প্রমাণ পান যে, খৃস্ট জন্মের ২৩০০ বছর আগে সুমেরিয়ান সভ্যতার সময়ে লাগাশ-এর রাজা উরুকাগিনা (King Urukagina of Lagash) ন্যায়বিচার সম্পর্কিত একটি কোড (code) বা আইনের সংকলন জারি করেছিলেন। এই ডকুমেন্ট বা দলিলটি যদিও এখনো আবিষ্কৃত হয়নি তবুও এটা জানা যায় যে, এ দলিলের ফলে সাধারণ নাগরিকরা কিছু অধিকার পেয়েছিল। যেমন, বিধবা ও অনাথদের ট্যাক্স দিতে হতো না এবং সুদখোর ধনীদের কাছ থেকে গরিবদের রক্ষা করা হতো।
সুমেরিয়ান সভ্যতার পরে অন্যান্য অনেক সরকার নাগরিকদের অধিকার রক্ষার জন্য লিখিতভাবে কোড জারি করেছিল। যেমন, উর-নাম্মু, লিপিট-ইশতার, হামুরাবি-র কোড, হিটাইট কোড, অ্যাশিরিয়ান কোড ও মোজেইক আইন।
এরপর খৃস্টপূর্ব ৫৯৪-তে গৃসের এথেন্সে সোলোন জারি করেন সোলোনিয়ান কন্সটিটিউশন। গৃক দার্শনিক অ্যারিস্টটল (খৃস্টপূর্ব ৩৫০) সর্বপ্রথম সাধারণ আইন ও সাংবিধানিক আইনের মধ্যে তফাতটা তুলে ধরেন। সংবিধানের চিন্তা এবং সংবিধান মোতাবেক একটি দেশ পরিচালনার চিন্তা বিষয়ে অ্যারিস্টটল লেখেন কন্সটিটিউশন অফ এথেন্স, পলিটিক্স অ্যান্ড নিকোমেচিয়ান এথিক্স নামে রচনাটিতে। এই রচনায় তিনি শুধু এথেন্সেই নয়, অন্যান্য স্থানের, যেমন স্পার্টা, কার্থেজের সংবিধান বিষয়ে লেখেন। সংবিধান বলতে অ্যারিস্টটল বোঝান, একটি রাষ্ট্রের বিভিন্ন দফতর পরিচালনার নিয়মাবলি। সেই সময়ের বিভিন্ন সংবিধানকে তিনি দুই ভাগে ভাগ করেন। ভালো এবং মন্দ। তবে তিনি সিদ্ধান্তে আসেন যে, সেরা সংবিধানে ভালো-মন্দ দুটিই থাকতে পারে। এই প্রসঙ্গে তিনি রাজতন্ত্র, গণতন্ত্র প্রভৃতি বিষয়ে আলোকপাত করেন। তিনি নাগরিকদের চিহ্নিত করেন কারা রাষ্ট্র পরিচালনায় অংশ নিতে পারবেন এবং কারা পারবেন না। যেমন, ক্রীতদাসদের তিনি সেই অধিকার থেকে বঞ্চিত করেছিলেন।

গৃক সভ্যতার পর আসে রোমান সভ্যতা। খৃস্টপূর্ব ৪৫০-এ রোমানরা টুয়েলভ টেবলস (Twelve Tables) নামে প্রথম তাদের সংবিধানকে বিধিবদ্ধ করে।
ুআরো কিছু পরে ইনডিয়ায় মৌর্য সম্রাট অশোক খৃস্টপূর্ব তৃতীয় শতাব্দীতে সাংবিধানিক নীতিমালা প্রতিষ্ঠা করেন।
এশিয়ার রাজনৈতিক ইতিহাসে আরেকটি পুরনো সংবিধান লেখা হয় জাপানে ৬০৪ খৃস্টাব্দে। বলা হয়, পৃন্স শোটুকু লিখেছিলেন, সতেরোটি অনুচ্ছেদের সংবিধান বা সেভেনটিন আর্টিকল কন্সটিটিউশন।

মদিনা সনদ
এর মাত্র কয়েক বছর পরেই, খুব সম্ভবত ৬২২ খৃস্টাব্দের পরই মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) প্রকাশ করেন মদিনার সংবিধান বা সাহিলাত আল-মদিনা, যেটি চার্টার অফ মদিনা বা মদিনা সনদ নামেও খ্যাত। মহানবী এ সনদটি লিখেছিলেন আরব উপজাতীয়দের মধ্যে রক্তক্ষয়ী হানাহানি বন্ধ করার লক্ষ্যে। শুধু একটি সম্প্রদায় বা উম্মা-র ছত্রচ্ছায়ায় মুসলিম, ইহুদি ও পৌত্তলিকতাবাদী, সবাইকে জড়ো করা ছিল মদিনা সনদের মূল উদ্দেশ্য। এ সনদের ফলেই বিশ্বে প্রথম ইসলামি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়। এই সংবিধান প্রতিষ্ঠা করে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের নিরাপত্তা, ধর্মীয় স্বাধীনতা, একটি পবিত্র স্থান রূপে মদিনার ভূমিকা যেখানে সকল সহিংসতা ও অস্ত্র নিষিদ্ধ করা হয়, নারীদের নিরাপত্তা, যুদ্ধ চলাকালে সমাজ চালিয়ে নেয়ার জন্য ট্যাক্স ব্যবস্থা, রাজনৈতিক মৈত্রী ব্যবস্থার বিভিন্ন সীমারেখা, ব্যক্তির বিভিন্ন নিরাপত্তা দানের ব্যবস্থা ও বিচার ব্যবস্থা।

এরপর ১৩৭৫ খৃস্টাব্দে চায়নাতে সম্রাট হোংউ অ্যানসেস্ট্রাল ইনজাংশনস (Ancestral Injunctions) নামে একটি দলিল প্রকাশ করেন। পরবর্তী ২৫০ বছরে মিং (Ming) বংশীয় শাসন আমলে এই দলিলের বিধিমালা চায়নার সংবিধান রূপে কাজ করে।
সংবিধানের ঐতিহাসিক উৎস ম্যাগনা কার্টা
ওদিকে ইওরোপে ইংল্যান্ডে রাজা জন ১২১৫ খৃস্টাব্দে ম্যাগনা কার্টা নামে একটি সনদে সই করতে বাধ্য হন। এই সনদে সই দিয়ে রাজা জন স্বীকার করে নেন যে, তার ইচ্ছাই সর্বোচ্চ নয় এবং তার ক্ষমতা সীমাবদ্ধ। তিনি আরো স্বীকার করে নেন যে, স্বৈরাচারীভাবে কাউকেই শাস্তি দেয়া যাবে না। কাউকে কোনো শাস্তি দেয়ার আগে দেশের আইন অনুযায়ী তার বিচার হতে হবে। তৎকালীন ইংল্যান্ডের শক্তিশালী ভূস্বামীরা বা ফিউডাল ব্যারনরা নিজেদের অধিকার রক্ষার্থে রাজা জনকে বাধ্য করেছিলেন এই সনদে সই করতে।

সেই সময়ে এ সনদ গুটিকয়েক ভূস্বামীর স্বার্থে চালু হলেও পরবর্তীকালে ম্যাগনা কার্টা স্বৈরাচারী শাসকের স্বেচ্ছাচারিতার বিরুদ্ধে ব্যক্তি স্বাধীনতা রক্ষার সবচেয়ে বড় দলিল রূপে বিবেচিত হয়েছে। বৃটেনের অলিখিত সংবিধানের অংশ রূপে বিবেচিত ম্যাগনা কার্টাই বর্তমান কালের বহু সাংবিধানিক অধিকারের প্রাথমিক ভিত্তি। এসব অধিকারের মধ্যে রয়েছে, বিল অফ রাইটস, পিটিশন অফ রাইট এবং হেরিয়াস কর্পাস আইন যার প্রয়োগ বাংলাদেশে দেখা যায়।
পরবর্তী সময়ে ইংল্যান্ড ও আয়ারল্যান্ড থেকে যারা আটলান্টিক পাড়ি দিয়ে উত্তর আমেরিকায় বসবাস শুরু করেছিলেন তারা ম্যাগনা কার্টা দ্বারা প্রভাবান্বিত ছিলেন এবং স্বাধীন যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধান রচনার জন্য অনুপ্রেরণা পেয়েছিলেন।
আমেরিকান সংবিধান আধুনিক কালের স্ট্যান্ডার্ড
২১ জুন ১৭৮৮-তে গৃহীত যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানকে আধুনিক কালের সকল প্রজাতন্ত্র এবং লিখিত সংবিধানের একটি মানদ- বা স্ট্যন্ডার্ড রূপে বিবেচনা করা হয়। এই সংবিধানের মূল প্রণেতা ছিলেন টমাস জেফারসন। তিনি ও তার সহপ্রণেতারা উদার ইংরেজ দার্শনিক টমাস হবস ও জন লক এবং উদার ফরাশি দার্শনিক জ জ্যাক রুশোর দ্বারা প্রভাবান্বিত হয়েছিলেন।

মজার কথা হচ্ছে এই যে, এখন পর্যন্ত আমেরিকান সংবিধানই বিশ্বের সবচেয়ে ছোট লিখিত সংবিধান যেখানে আছে মাত্র ৭টি অনুচ্ছেদ ও ২৭টি সংশোধনী। অন্যদিকে ইনডিয়ান সংবিধান হচ্ছে বিশ্বের সবচেয়ে বড় লিখিত সংবিধান যেখানে আছে ৪৪৪টি অনুচ্ছেদ, ১২টি শেডিউল ও ৯৪টি সংশোধনী। ইনডিয়ান সংবিধানের ইংরেজি সংস্করণে আছে ১১৭,৩৬৯টি শব্দ! আরেকটি কথা, ম্যাগনা কার্টার দেশ বৃটেনে এখন পর্যন্ত কোনো লিখিত সংবিধান হয়নি!
সংবিধান কী?
একটি সংবিধান হচ্ছে কয়েকটি মৌলিক নীতির অথবা প্রতিষ্ঠিত অতীত ঘটনাবলির (পৃসিডেন্ট) মালা যার আওতায় একটি রাষ্ট্র অথবা কোনো সংগঠন শাসিত হয়। সুমেরিয়ান সভ্যতা থেকে শুরু করে আমেরিকান সংবিধান পর্যন্ত যেসব ধাপ মানুষ পেরিয়েছে সেসব বিবেচনা করলে দেখা যায়, যেহেতু মানুষের জন্য মানুষই সংবিধান রচনা করেছে সেহেতু যুগে যুগে বিভিন্ন সংবিধানের বৈশিষ্ট পাল্টে গিয়েছে। যুগ এবং রাষ্ট্রের বিশেষ চাহিদা অনুযায়ী বিভিন্ন সংবিধান রচিত হয়েছে। এসব সংবিধান বদলে গিয়েছে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন কারণে বিভিন্ন সংশোধনীর মাধ্যমে অথবা বৈপ্লবিক ঘটনার পরিণতিতে।

শেখ মুজিবুরের চতুর্থ সংশোধনী

বাংলাদেশে প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানের আওয়ামী লীগ সরকার ২৫ জানুয়ারি ১৯৭৫-এ সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনী পার্লামেন্টে পেশ করে। ওই দিনেই উত্থাপিত বিলটি গৃহীত ও রাষ্ট্রপতির অনুমোদন পায়। এই সংশোধনীর মাধ্যমে বাংলাদেশের সংবিধানের কয়েকটি মৌলিক পরিবর্তন করা হয়। যেমন :
এক. চতুর্থ সংশোধনীর ফলে দেশে সংসদীয় শাসন পদ্ধতির বদলে রাষ্ট্রপতি শাসন ব্যবস্থা প্রবর্তিত হয়।
দুই. রাষ্ট্রপতিকে রাষ্ট্রের সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী করা হয়।
তিন. সকল রাজনৈতিক দল বিলুপ্ত করে জাতীয় দল নামে একটি মাত্র দল থাকবে বলে বিধান করা হয়। চতুর্থ সংশোধনী গৃহীত হওয়ার পর সরকার সব দল বিলুপ্ত করে বাংলাদেশ কৃষক-শ্রমিক-আওয়ামী লীগ (সংক্ষেপে বাকশাল) নামে একটি জাতীয় দল গঠন করে।
চার. প্রথম জাতীয় সংসদের মেয়াদ বাড়িয়ে দেয়া হয়।
পাঁচ. এরপর জুন ১৯৭৫-এ মাত্র চারটি সরকারি মালিকানাধীন দৈনিক পত্রিকা চালু রেখে দেশের অন্য সকল দৈনিক পত্রিকা বন্ধ করে দেয়া হয়।

সংক্ষেপে বলা যায়, একটি বহুদলীয় গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা প্রবর্তক সংবিধানকে পরিবর্তিত করে একটি একদলীয় স্বৈরতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা চালু করা হয়, প্রধানমন্ত্রীর বদলে রাষ্ট্রপতির শাসন প্রবর্তিত হয়।
এরপর অন্যান্য দলের সঙ্গে দল রূপে আওয়ামী লীগও বিলুপ্ত হয়। অন্যভাবে বলা যায়, সংসদে আওয়ামী লীগের দুই-তৃতীয়াংশের বেশি সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে শেখ মুজিবুর রহমানই তার দলের বিরুদ্ধে এক ধরনের সংসদীয় ক্যু করেন। ১৯৭১-এ বাংলাদেশের মানুষ সংসদীয় গণতন্ত্রের জন্য মুক্তিযুদ্ধ করেছিল এবং ৪ নভেম্বর ১৯৭২-এ যে সংবিধানের মাধ্যমে তাদের সেই লক্ষ্য অর্জিত হয়েছিল, সেই সংবিধান গৃহীত হওয়ার মাত্র তিন বছর পরেই তার মূলনীতিগুলো বদলে ফেলা হয়।
এই পরিবর্তনের মাত্র সাড়ে সাত মাস পরে একটি সামরিক অভ্যুত্থানে আগস্ট ১৯৭৫-এ শেখ মুজিবুর রহমান নিহত হন।
জিয়াউর রহমানের পঞ্চম সংশোধনী
এই ঘটনার প্রায় সাড়ে তিন বছর পরে ৪ এপৃল ১৯৭৯-তে তদানীন্তন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের উদ্যোগে দ্বিতীয় জাতীয় সংসদে সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী আনা হয়। এ প্রস্তাবটি ৫ এপৃলে গৃহীত এবং ৬ এপৃলে রাষ্ট্রপতির অনুমোদন পায়। এই সংশোধনীর ফলে বাংলাদেশে বহুদলীয় গণতন্ত্র আবার বৈধতা পায়, যদিও প্রধানমন্ত্রীর বদলে রাষ্ট্রপতির শাসন ব্যবস্থা চালু থেকে যায়।

সংক্ষেপে বলা যায়, পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে জিয়াউর রহমান বাংলাদেশের বহুদলীয় গণতান্ত্রিক আকাক্সক্ষাকে পুনরুজ্জীবিত এবং বহুদলীয় সংসদ পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করেন।
নিয়তির অদ্ভুত পরিহাস এই যে, একজন নির্বাচিত বেসামরিক নেতা চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ সকল নির্বাচনে অন্যান্য রাজনৈতিক দলের অংশ নেয়ার পথ রুদ্ধ করে দেন। অন্যদিকে একজন সমরনায়ক (পরে নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি) পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে আওয়ামী লীগসহ বাংলাদেশের সকল রাজনৈতিক দলের অংশ নেয়ার পথ খুলে দেন।

শেখ হাসিনার পঞ্চদশ সংশোধনী

এখন, পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে আওয়ামী লীগ চতুর্থ সংশোধনীর জনককে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করতে চাইছে এবং স্বাধীনতার ঘোষণা সম্পর্কে একটি কাহিনী সন্নিবেশিত করছে। ২৬ মার্চ ১৯৭১-এ এই কাহিনীটি কেউ শোনেনি এবং পঞ্চদশ সংশোধনী আনয়নকারী আওয়ামী লীগও এই কাহিনীর সোর্স বা সূত্রটি উল্লেখ করেনি। কিন্তু চতুর্থ সংশোধনীর জনক এবং স্বাধীনতার ঘোষণার এই কাহিনী যাতে ভবিষ্যতে চ্যালেঞ্জড না হয় এবং বিরূপ সমালোচনার মুখে যেন না পড়ে, সে জন্য রাজনৈতিক ও সামাজিক জীবনে পঞ্চদশ সংশোধনীতে নিচের সতর্ক বাণীটি দেয়া হয়েছে।

৭ (খ) এই সংবিধান বা ইহার কোনো বিধানের প্রতি নাগরিকদের আস্থা, বিশ্বাস বা প্রত্যয় পরাহত করিলে কিংবা উহা করিবার জন্য উদ্যোগ গ্রহণ বা ষড়যন্ত্র করিলে… তাহার এই কার্য রাষ্ট্রদ্রোহিতা হইবে এবং ঐ ব্যক্তি রাষ্ট্রদ্রোহিতার অপরাধে দোষী হইবে।
রাষ্ট্রদ্রোহিতার অপরাধে সর্বোচ্চ শাস্তি হতে পারে মৃত্যুদণ্ড। আওয়ামী লীগের একাধিক নেতা ইতিমধ্যেই বিরোধী দলীয় নেত্রী খালেদা জিয়ার মৃত্যুদ- দাবি করেছেন। কেননা তিনি (খালেদা) পঞ্চদশ সংশোধনী সংবলিত পরিবর্তিত সংবিধানের তীব্র সমালোচনা করেছেন।
গণতন্ত্র বিকাশের লক্ষ্যে নয়, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকার চিরস্থায়ী ব্যবস্থা স্বরূপ সংশোধিত সংবিধানকে রাজনৈতিক ও সামাজিক জীবনের শীর্ষ স্থানে স্থাপিত করতে যাচ্ছে। কিন্তু নিশ্চিতভাবে কে বলতে পারে এই পঞ্চদশ সংশোধনীর ভবিষ্যৎ ঠিক চতুর্থ সংশোধনীর মতোই হবে কি না?
দুর্বৃত্তদের শেষ ভরসা দেশপ্রেমের কথা
পেট্রয়টিজম বা দেশপ্রেম সম্পর্কে কালজয়ী উক্তিটি করেছিলেন লন্ডনে ১৭৭৫-এর ৭ এপৃলের সন্ধ্যায় অষ্টাদশ শতাব্দীর ইংরেজ লেখক, সমালোচক ও কবি স্যামুয়েল জনসন (১৭০৯-১৭৮৪)। তার সুবিখ্যাত রচনা ডিকশনারি অফ দি ইংলিশ ল্যাংগুয়েজ বা ইংরেজি ভাষার অভিধান। ১৭৪৭-এ এই ডিকশনারি লেখায় তিনি নিজেকে নিয়োজিত করেন এবং আট বছর প্রচুর পরিশ্রমের পর এ কাজ সমাপ্ত করেন।

সেই ঐতিহাসিক সন্ধ্যায় তিনি পেট্রয়টিজমের ডেফিনেশন দিতে গিয়ে বলেছিলেন, পেট্রয়টিজম ইজ দি লাস্ট রিফিউজ অফ এ স্কাউনড্রেল (Patriotism is the last refuge of a scoundrel)। বাংলায় এর মানে দাড়ায়, দেশপ্রেম প্রদর্শন বা প্রচার করা হচ্ছে একজন দুর্বৃত্তের শেষ আশ্রয় বা ভরসাস্থল।
স্যামুয়েল জনসন খুব প-িত ব্যক্তি ছিলেন এবং ড. জনসন নামে বেশি পরিচিত ছিলেন। রাজনীতি বিষয়ে তিনি গভীর চিন্তা-ভাবনা করতেন এবং তার সময়ের (অষ্টাদশ শতাব্দী) রাজনীতি বিষয়ে বহু প্রবন্ধ লেখেন।
১৭৭৪-এ ড. জনসন দি পেট্রিয়ট নামে একটি প্রবন্ধ প্রকাশ করেন। এই প্রবন্ধে তিনি পলিটিশিয়ানদের মিথ্যা দেশপ্রেমের কড়া সমালোচনা করেন। তিনি খুব ধর্মপরায়ণ কৃশ্চিয়ান ছিলেন এবং চার্চ ও রাষ্ট্রের মধ্যে একতায় বিশ্বাস করতেন। তিনি মনে করতেন, ইংরেজ ও ফরাশিরা উত্তর আমেরিকায় গিয়ে আদিবাসীদের জমিজমা চুরি করছে। ড. জনসনের মতে, উত্তর আমেরিকা দখলকারী ইংরেজ ও ফরাশিরা ছিল ডাকাত এবং কারোরই সেখানে বসবাসের অধিকার ছিল না। আমেরিকান ঔপনিবেশিকরা যখন তাদের স্বাধীনতা যুদ্ধে ইংরেজদের পরাজিত করে তখন ড. জনসন খুব বিমর্ষ ও বিচলিত হয়েছিলেন। উত্তর আমেরিকায় ক্রীতদাস প্রথার বিরোধী ছিলেন ড. জনসন। যারা নিজেদের দেশপ্রেমিক বলতেন, তিনি তাদের ঘোর বিরোধী ছিলেন ।
লেখালেখির চাইতে তিনি বেশি বিখ্যাত হয়েছিলেন তার ধারালো ও বুদ্ধিদীপ্ত সংলাপের জন্য। আর তার সব উক্তির মধ্যে সবচেয়ে বেশি বিখ্যাত দেশপ্রেম সম্পর্কিত উক্তিটি।

দেশপ্রেম একটি রাজনৈতিক হাতিয়ার

এ বিষয়ে বছর দশেক আগে আমেরিকান প্রাবন্ধিক জেমস লিরয় উইলসন লেখেন, ডেমাগগ (Demagogue) বা বক্তৃতাবাগীশ রাজনৈতিক নেতারা যুক্তিতর্ক উপস্থাপনের বদলে স্বদেশপ্রেমের প্রতি আনুগত্য দেখানোর জন্য জনসাধারণকে আবেগ তাড়িত করে খেপিয়ে দেন। দেশপ্রেমকে রাজনৈতিক হাতিয়ার রূপে ব্যবহারকারী বক্তৃতাবাগীশ নেতাদের সমালোচনা করেছিলেন ড. জনসন তার ওই উক্তিতে। জেমস লিরয় উইলসন লেখেন, এই ধরনের নেতারা জনসাধারণের সমর্থন পাওয়া এবং রাজনৈতিক ক্ষমতা ধরে রাখার আশায় যা খুশি তাই বলতে পারেন। কোনো ব্যক্তি যদি এই ধরনের কোনো নেতার সঙ্গে এক মত না হন তাহলে সেই নেতা ভিন্নমত পোষণকারী ব্যক্তিটিকে দেশপ্রেম, দেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও দেশের বিরোধী রূপে আখ্যায়িত করতে পারেন। সৎ মনে ভিন্ন মত প্রকাশ করলেও সেই ব্যক্তির চরিত্র হনন করা হতে পারে। এই ধরনের নেতা যখন দেশপ্রেম প্রচার করেন তখন তার আসল মতলব থাকে জনসাধারণের সরল অনুভূতিগুলোকে নিজের স্বার্থ সিদ্ধির জন্য ব্যবহার করা।

১৭৭৫-এ ড. জনসনের এই উক্তি এবং ২০০১-এ জেমস লিরয় উইলসনের এ ব্যাখ্যার মধ্য সময়ে দেশপ্রেম বিষয়ে বহু দার্শনিক, পণ্ডিত ও লেখক তাদের মতামত দিয়েছেন। অন্তত পাঁচজনের মতামত উল্লেখ করা উচিত হবে।
নোবেল বিজয়ী ইংরেজ দার্শনিক বারট্রান্ড রাসেল বলেন, খুব তুচ্ছ কারণে হত্যা করতে এবং নিহত হতে রাজি হওয়াই হচ্ছে দেশপ্রেম (Patriotism is the willingness to kill and be killed for trivial reasons).
আমেরিকান দার্শনিক রালফ বি পেরি বলেন, যদি দেশপ্রেম হয় একজন দুর্বৃত্তের শেষ আশ্রয়স্থল তাহলে সেটা শুধু দেশপ্রেমের নামে খারাপ কাজ করার জন্যই সে সেটা প্রচার করে না, সে দেশপ্রেমের তীব্র আবেগ সৃষ্টি করে নৈতিকতার সকল সীমারেখা নিশ্চিহ্ন করার লক্ষ্যেও দেশপ্রেমের কথা বলতে পারে। (If patriotism is the “last refuge of a scoundrel” it is not merely because evil deeds may be performed in the name of patriotism, but because patriotic fervour can obliterate moral distinctions altogether).

নোবেল বিজয়ী আইরিশ সাহিত্যিক জর্জ বার্নার্ড শ বলেন, দেশপ্রেম হচ্ছে চরম বুদ্ধিহীনতার একটি বিধ্বংসী ও বিকারগ্রস্ত রূপ (Patriotism is the pernicious. psycho pathetic form of idiucy).
ইংরেজ নাট্যকার অসকার ওয়াইল্ড আরো সোজাসাপটা ভাবে বলেন, দেশপ্রেম হচ্ছে দুষ্টের গুণ (Patriotism is the virtue of the vicious).
আমেরিকান স্যাটায়ার লেখক অ্যামব্রোস বিয়ার্স অতি বিনয়ের সঙ্গে বলেন, যদিও আমি ড. জনসনের মতো পণ্ডিত নই তবুও আমার মনে হয় তিনি একটা ভুল করেছিলেন। দেশপ্রেম প্রদর্শন বা প্রচার করা হচ্ছে একজন দুর্বৃত্তের শেষ আশ্রয় বা ভরসাস্থল নয়, এটি হচ্ছে তার প্রথম আশ্রয় বা ভরসাস্থল (I beg to submit that it is the first)।
স্কাউনড্রেল কাকে বলা হয়?
এই উপমহাদেশে ইংরেজ শাসন আমলে স্কাউনড্রেল শব্দটি বহুল প্রচলিত ছিল। এখন বাংলাদেশে ইংরেজি ভাষার প্রচলন কমে আসার সঙ্গে সঙ্গে স্কাউনড্রেল শব্দটি কম শোনা যায়। সর্বজন শ্রদ্ধেয় পণ্ডিত জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী সম্পাদিত, বাংলা একাডেমি প্রকাশিত ইংরেজি-বাংলা ডিকশনারিতে স্কাউনড্রেল শব্দের ছয়টি মানে দেয়া হয়েছে বদমাশ, দুর্বৃত্ত, দুরাচার, পামর, দুরাত্মা, পাপিষ্ঠ।

আমার কাছে মনে হয়েছে, উপরোক্ত ছয়টি শব্দের মধ্যে দুর্বৃত্তটাই কিছুটা নম্র ও ভদ্রজনোচিত। অবশ্য কেউ কেউ বলতে পারেন, একজন দুর্বৃত্ত কীভাবে নম্র বা ভদ্র হতে পারে?
সে যাই হোক। ২৩৬ বছর আগে ড. স্যামুয়েল জনসনের কালজয়ী উক্তি এবং তারপর সেই বিষয়ে বিদেশের বিভিন্ন মনীষীর মতামতের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের মনুষ্যকুল প্রথমে বিবেচনা করতে পারে নিচের দুটি উক্তি এবং তারপর বিবেচনা করতে পারে স্কাউনড্রেল শব্দটির কোন মানে তারা বেছে নেবে?
এক. তেল-গ্যাস অনুন্ধানে কনোকো-ফিলিপসের সঙ্গে চুক্তির বিরোধিতাকারীদের সমালোচনা করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাদের দেশপ্রেম নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। তিনি বলেন, যারা এখন দেশপ্রেমের কথা বলছেন, দেশের কোনো সংকটেই তাদের পাওয়া যায় না। তিনি বলেন, আমার প্রশ্ন হচ্ছে : আমার চেয়ে কে বেশি দেশপ্রেমিক? (ইউএনবি/বাসস/নয়া দিগন্ত, ১৯ জুন ২০১১)।
দুই. সংবিধান শুধু দেশের সর্বোচ্চ আইনই নয়, এটি দেশের সার্বভৌমত্বেরও প্রতীক। পবিত্র সংবিধানকে নিয়ে কটূক্তিকর বক্তব্য খুবই জঘন্য। আদালত (বিচারপতি এএইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরী ও বিচারপতি গোবিন্দচন্দ্র ঠাকুরের সমন্বয়ে গঠিত ডিভিশন বেঞ্চ) আরো বলেন, আমরা শুনেছি বিরোধী দলীয় নেতাও একই ধরনের বক্তব্য রেখেছেন। তার ভেতরেও দেশপ্রেমের অভাব রয়েছে। বিষয়টি আমরা বিচারিক এখতিয়ারে (জুডিশিয়াল নোটিশে) নিচ্ছি (যুগান্তর, ৩ আগস্ট ১১)।
আপনার রায় দিন
মনুষ্যকুল যেন কিছুটা সহজে নিজস্ব সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারে সে জন্য কয়েকটি টিপস আমি দিচ্ছি।

এক. সাধারণ ও স্বাভাবিক জীবনে সকল মানুষই সৎ, সজ্জন, দেশপ্রেমিক ইত্যাদি গুণের অধিকারী। কোনো চ্যালেঞ্জ বা কোনো অসাধারণ ঘটনার মুখোমুখি না হওয়া পর্যন্ত মানুষ তার আত্মপরিচয় জানতে পারে না। যেমন ধরুন, একজন পিয়ন যখন পাঁচশ টাকা ঘুষের প্রস্তাব পায় অথবা একজন ক্লার্ক পাঁচ হাজার টাকা, একজন পুলিশ কর্মকর্তা পাঁচ লাখ টাকা কিংবা একজন মন্ত্রী যখন পাঁচ কোটি টাকা ঘুষের অফার পান তখনই তাদের ব্যক্তিগত সততা পরীক্ষার মুখোমুখি হয়। এই পরীক্ষায় পাস করলে তিনি আত্মতুষ্টি লাভ করতে পারেন এটা ভেবে যে, তিনি সত্যই একজন সৎ ব্যক্তি। এই ধরনের কোনো পরীক্ষার আগে তিনি নিজের সম্পর্কে সেই রকম দাবি করতে পারেন না। প্রশ্ন হচ্ছে, দেশপ্রেমের পরীক্ষাটা কী? আশা করা যায়, অচিরেই আদালত এ বিষয়ে মনুষ্যকুলের অজ্ঞানতা দূর করবেন।
দুই. দেশপ্রেমের পরীক্ষার ধরনটি যদি জানা যায় তাহলে প্রশ্ন হবে, শেখ হাসিনা কি সেই পরীক্ষাটি দিয়েছিলেন? দিয়ে থাকলে, কবে? কোথায়?
তিন. সেই পরীক্ষায় শেখ হাসিনা কি টপ মার্কস পেয়েছিলেন যে, তিনি নিজেকে টপ দেশপ্রেমিক দাবি করতে পারছেন?
চার. শেখ হাসিনার এই টপ দেশপ্রেমিক স্টেটাসের সঙ্গে জীবিত বীর উত্তম ও বীর প্রতীকদের স্টেটাসের কোনো সামঞ্জস্য বিধান কি করা হয়েছে? বীর উত্তম ও বীর প্রতীকরা কি টপ দেশপ্রেমিকের উপরে, না নিচে?
পাঁচ. সাধারণত যিনি জ্ঞানী বা গুণী, তার যদি ন্যূনতম বিনয় থাকে তাহলে তিনি কখনো দাবি করেন না যে, তিনিই টপ জ্ঞানী বা টপ গুণী। তার শ্রেষ্ঠত্বের বিচারের ভার তিনি ছেড়ে দেন মানুষের কাছে। তাদের মনে থাকে হরিশচন্দ্র মিত্র-র কবিতাটি :

আপনারে বড় বলে
বড় সেই নয়
লোকে যারে বড় বলে
বড় সে-ই হয়।

যেহেতু শেখ হাসিনাই দাবি করেছেন, তিনিই সেরা দেশপ্রেমিক সেহেতু তার দেশপ্রেম সম্পর্কে সাধারণ মানুষের মনে প্রশ্ন উঠতে পারে।
পক্ষান্তরে খালেদা জিয়া কিন্তু দাবি করেননি যে, তিনি দেশপ্রেমিক। তবে তার দেশপ্রেম বিষয়ে প্রশ্ন উঠিয়েছেন আদালত। এক্ষেত্রে আদালতের মনে পড়তে পারে কুসুম কুমারী দাশ-এর কবিতাটি :

আমাদের দেশে হবে
সেই ছেলে কবে?
কথায় না বড় হয়ে,
কাজে বড় হবে।

ছেলে না হোক, বাংলাদেশে অন্তত একজন মেয়ে কাজে বড় হয়েছেন।
সবাই জানেন, মাইনাস টু ফর্মুলা কার্যকর করার লক্ষ্যে ১১ জানুয়ারি ২০০৭-এ জেনারেল মইন ইউ আহমেদের সেনা শাসন প্রতিষ্ঠত হওয়ার পর য: পলায়তি স: জীবতি মন্ত্রে দীক্ষিত শেখ হাসিনা আমেরিকাতে চলে গিয়েছিলেন। কিন্তু খালেদা জিয়া দেশের মাটি কামড়ে পড়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, বাংলাদেশই তার একমাত্র ঠিকানা। বহু চেষ্টা সত্ত্বেও তদানীন্তন সেনা অফিসাররা খালেদা জিয়াকে সাবজেল থেকে এয়ারপোর্টে নিয়ে যেতে পারেননি। দেশপ্রেমের কঠিনতম পরীক্ষায় খালেদা জিয়া তখন তার কাজ দেখিয়ে পাস করেছিলেন।
তার সেই সাফল্যের কারণেই মতিউর রহমান-মাহফুজ আনামের মাইনাস টু ফর্মুলা অর্ধেক সফল হলেও পূর্ণ সফল হয়নি। আর মাইনাস টু ফর্মুলা ব্যর্থ হয়েছিল বলেই শেখ হাসিনা দেশে ফিরে আসতে পেরেছিলেন। ইনডিয়ার ব্যাগ ভর্তি টাকা ও পরামর্শে (দেখুন দি ইকনমিস্ট, ৩০ জুলাই ২০১১) আওয়ামী লীগ ডিসেম্বর ২০০৮-এর নির্বাচনে বিজয়ী হতে পেরেছিল। ফলে মইনউদ্দিন-ফখরুদ্দীনের ক্যাঙ্গারু কোর্টগুলো বিদায় নিয়েছিল এবং দেশের রাজনীতি, প্রশাসন ও বিচার ব্যবস্থা স্বাভাবিক গতি এবং চরিত্র ফিরে পেয়েছিল।
অর্থাৎ, আজ যে বিচার ব্যবস্থায় খালেদা জিয়ার দেশপ্রেমকে প্রশ্নবিদ্ধ করা হয়েছে সেই বিচার ব্যবস্থাকে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেছিল খালেদা জিয়ারই দেশপ্রেম!
সুতরাং, আমি নেড়িকুকুর, আদালতের প্রতি পূর্ণ শ্রদ্ধা, অগাধ আস্থা ও গভীর বিশ্বাস রেখেই বলতে বাধ্য হচ্ছি, বিচারকদের উচিত আইনের পাশাপাশি সঠিক ইতিহাসেরও জ্ঞান রাখা। বাংলাদেশের সঠিক ও সম্পূর্ণ রাজনৈতিক ইতিহাস সম্পর্কে যদি বিচারকরা অবহিত থাকেন তাহলে ড. স্যামুয়েল জনসনের কালজয়ী উক্তিটি বিচারকদের ক্ষেত্রে নয়, শুধু পলিটিশিয়ানদের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য হতে পারে।
১২ আগস্ট ২০১১।
(বানান রীতি লেখকের নিজস্ব)
শফিক রেহমান: প্রবীণ সাংবাদিক ও জনপ্রিয়  টিভি অনুষ্ঠান উপস্থাপক।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন