শুক্রবার, ২৭ জানুয়ারী, ২০১২

নেড়িকুকুরের ইন্টারভিউ: ইস্টিশনের রেলগাড়িটা … সময় বাজে ছয়টা



shafik-rehman2111ঢাকার মানুষ ভালো খেতে কোথায় যায়?
চায়নিজ ফুড প্রেমিকরা যান গুলশানে গোলডেন রাইস রেস্টুরেন্ট অথবা উত্তরাতে মেইনল্যান্ড রেস্টুরেন্ট-এ।
তন্দুরি ফুড লাভার্সরা যান গুলশানে খাজানা রেস্টুরেন্ট অথবা ধানমন্ডিতে সানতুর রেস্টুরেন্ট-এ।
স্বদেশি খাবার রসিকরা যান বিজয়নগরে কস্তরী রেস্টুরেন্ট-এ বড় মাছের বড় টুকরো এবং বিভিন্ন ভর্তা ও ভাজি খেতে।
আর যারা অ্যাডভেঞ্চারাস তারা যান ধানমন্ডিতে বারবিকু টুনাইট-এ। সেখানে আকাশের নিচে বসে ন্যায়সঙ্গত দামে নান-চিকেন, টিক্কা-বটি ও শিক কাবাব, মাটন চাপ, কড়াই গোস্ত ইত্যাদি পাওয়া যায়।
মুখে লালা আসছে?
আমাদেরও আসে। তবে তফাতটা হচ্ছে এই যে, মনুষ্যকুল তাদের লালা সংবরণ করতে পারে এবং ওই সব রেস্টুরেন্টে গিয়ে রসনেন্দ্রিয়কে তৃপ্ত করতে পারে। আমরা সেটা পারি না।
ঢাকার নেড়িকুকুরদের সে রকম কোনো সুযোগ নেই।
আমরা নির্ভর করি প্রধানত ডাস্টবিনের ওপর। ঢাকার মেয়র মিস্টার সাদেক হোসেন খোকার কিছুটা এলোপাতাড়িভাবে বসানো ভারী লোহার ডাস্টবিনই আমাদের প্রথম ভরসা। সেখানে ফ্রেশ উচ্ছিষ্টের সঙ্গে মিশে থাকে পচা ও বাসি খাবার। বিভিন্ন বর্জ্য, যেমন, স্যানিটারি ন্যাপকিন, প্যামপার্স, ড্রাগসের সিরিঞ্জ, ব্যবহৃত কনডম, ভাঙা কাচ, ইট-কাঠ, লোহার জিনিস, প্লাস্টিকের জিনিস, পলিথিন, আরো কতো কি!

মাঝে মধ্যে সেখানে মানব দেহের খণ্ডিত অংশও পাওয়া যায়। সেটা হতে পারে খুন-খারাবির পরিণতিতে। সেটা হতে পারে হসপিটালে বৈধ অস্ত্রোপচারের পরিণতিতে।
একবার মগবাজারে একটি হসপিটালে অপারেশনের পর ডাস্টবিনে ফেলে দেয়া রক্তাক্ত ব্যান্ডেজ মোড়ানো একটা কাটা হাত খুব চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছিল।
এসবের সঙ্গে যুক্ত হতে পারে সদ্যপ্রসূত অবাঞ্ছিত মানবশিশুর মৃতদেহ!
আর এসবেরই মধ্য থেকে খুব সাবধানে আমাকে বের করে নিতে হয় আমার খাবার। সেটা করতে গিয়ে প্রায়ই আমার আঙুল কেটে যায়। কিন্তু আমি খুব দুঃখ পাই যখন আমার এই খাদ্য সংগ্রহের সতর্ক প্রচেষ্টায় যোগ দেয় ক্ষুধার্ত কোনো নর অথবা নারী। ওদের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় আমি যাই না। আমি একটু দূরে সরে দাড়িয়ে থাকি। অপেক্ষা করি ওদের চলে যাওয়ার জন্য।

কল্পনাতীত, তাই ইস্টিশনে
ডাস্টবিন যেখানে আমাদের ফুডের প্রধান সোর্স সেখানে চায়নিজ বা তন্দুরি খাবার কল্পনাও করতে পারি না আমরা। করিও না। তবে স্বাদ বদলানোর জন্য আমরা জনবহুল এলাকায় ঘুর ঘুর করি। যেমন, সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনাল, গাবতলি, সায়েদাবাদ, মহাখালী বাস টার্মিনাল এবং রেল স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে।

বিশেষত রেল স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে তুলনামূলকভাবে কিছুটা ক্লিন ফুড পাওয়া যায়। এগুলো আমরা পছন্দ করি।
তাই পারলে আমি ঢাকায় কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে যাই। সেখানেও অবশ্য ফকিরদের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে হয়। তবুও রেলওয়ে স্টেশনে বিভিন্ন টার্মিনালের তুলনায় মানুষ কম থাকে। সুতরাং প্রতিদ্বন্দ্বিতাও থাকে কম।
রেলওয়ে স্টেশনে গেলে একটি গানের কথা আমার মনে পড়ে যায়।

ইস্টিশনের রেলগাড়িটা
মাইপা চলে ঘড়ির কাটা
প্ল্যাটফর্মে বইসা ভাবি
কখন বাজে বারোটা?
কখন বাজে বারোটা?

রুনা লায়লা জানেন না তার এ গানটি যে আমি কতোবার শুনেছি। এ তথ্য যদি হিজ মাস্টার্স ভয়েস রেকর্ড কম্পানি কর্তৃপক্ষ জানতেন তাহলে আমার ছবি দিয়েই হয়তো তাদের সেই বিখ্যাত লোগো-র নতুন সংস্করণ করতেন।
গানটি সত্যিই সুন্দর।
গানটির মধ্যে একটা দর্শন বা ফিলসফি আছে।
গানটি রাজনৈতিকও বটে।

আড়াই বছর = ছয়টা বাজে
বিশেষত ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের এই সময়ে এ গানটি বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতাসীন হয়েছিল ৬ জানুয়ারি ২০০৯-এ। অর্থাৎ তাদের ক্ষমতায় থাকার আড়াই বছর পূর্ণ হবে ৬ জুলাই ২০১১-তে।
আওয়ামী লীগ সরকারের পূর্ণ মেয়াদ পাঁচ বছর যদি হয় তাহলে ৬ জুলাই ২০১১-তে তাদের আড়াই বছর পূর্ণ হওয়া মানে হবে ছয়টা বেজেছে। আর ৬ জানুয়ারি ২০১৪-তে মেয়াদ পূর্ণ হলে বারোটা বাজবে।

সেদিন কমলাপুর রেল স্টেশনে রুনা লায়লার সেই গানটি আবার মনে পড়ছিল। একটু অন্যভাবে।
ইস্টিশনের রেলগাড়িটা
মাইপা চলে ঘড়ির কাটা
প্ল্যাটফর্মে বইসা ভাবি
কখন বাজে ছয়টা?
কখন বাজে ছয়টা?

আমি জানি ছয়টা বাজবে ৬ জুলাই ২০১১-তে।
ঘড়ির কাটা কি সত্যিই আরো আড়াই বছর পরে দেশটাকে বারোটা বাজানোর দিকে নিয়ে যাবে?
দেশের বারোটা বাজলে সাধারণ মানুষের কী হবে? নেড়িকুকুরদেরই বা কী হবে?
এ তো জীবন-মরণের প্রশ্ন।

সুতরাং খুব গভীরভাবে বিবেচনা করতে হবে যখন ছয়টা বাজবে ৬ জুলাই ২০১১-তে। এই সময়ের মধ্যে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ কি করেছে? প্রধান বিরোধী দল বিএনপি কী করেছে? জাতীয় পার্টি কী করেছে? জামায়াত কী করেছে?
আমি নেড়িকুকুর। ইতিহাসবিদ নই। তবু গত আড়াই বছর আওয়ামী লীগের পারফরম্যান্সকে পাঁচ ভাগে বিবেচনা করতে পারি।

প্রথম ভাগ. প্রতিহিংসা চরিতার্থ করা।
দ্বিতীয় ভাগ. ইনডিয়ার সঙ্গে আরো সুসম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করা অথবা ইনডিয়াকে আরো তোষণ করা।
তৃতীয় ভাগ. ইলেকশন ম্যানিফেস্টোতে দেয়া প্রতিশ্রুতি পালন করা বা না করা।
চতুর্থ ভাগ. উল্টো অবস্থান নিয়ে সংবিধান সংশোধন করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল করা।
পঞ্চম ভাগ : অন্যান্য বিষয়।

প্রতিহিংসার সাফল্য
অন্তত পাঁচটি ক্ষেত্রে প্রতিহিংসা চরিতার্থ হয়েছে।
এক. জেনারেল মইন ইউ আহমেদের ওয়ান-ইলেভেন ক্যু-র পর আওয়ামী লীগের যে অংশটি সংস্কারপন্থি রূপে পরিচিত হয়েছিল তাদের নেতাদের হট পটেটো-র মতো শেখ হাসিনা ফেলে দিয়েছেন। হট পটেটো ইংরেজি বাক্যটি এসেছে মুখের মধ্যে গরম আলু ঢুকলে তাকে দ্রুত ফেলে দেয়া থেকে। আওয়ামী সংস্কারপন্থি নেতা রূপে বিবেচিত রাজ্জাক, আমু, তোফায়েল ও সুরঞ্জিত, যারা তাদের ইংরেজি আদ্যক্ষর RATS(র‌্যাটস বা ইদুরবৃন্দ) নামেও খ্যাতিমান হয়েছিলেন, তারা অতি অপ্রত্যাশিতভাবে আওয়ামী সরকারের মন্ত্রিসভা থেকে বাদ পড়ে যান। রাআতোসু-র চিরতা হৃদয়ে মনে পড়ে যায় শেখ হাসিনার সেই কথাটি, আই শ্যাল ফরগিভ, বাট নট ফরগেট। অর্থাৎ আমি ক্ষমা করে দেবো, কিন্তু ভুলবো না। তাদের মধ্যে সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত প্রকাশ্যে হাসিনা-প্রবক্তা হয়ে আওয়ামী প্রভাববলয়ে একটি স্থান সংগ্রহের প্রাণান্ত চেষ্টা করেছেন গত আড়াই বছরে এবং কিছুটা সফল হয়েছেন বলে তিনি মনে করছেন। তবে অপ্রকাশ্যে তার সংস্কারপন্থি মনোভাব প্রায়ই ফুটে ওঠে বলেও গুজব রয়েছে।

দুই. ১৫ আগস্ট ১৯৭৫-এ সংঘটিত ক্যু-তে জড়িত থাকার অভিযোগে পাঁচ সেনা অফিসারের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়েছে। এক্ষেত্রে হাসিনা ফরগিভ করেন নি, ফরগেটও করেন নি।
তিন. ১৯৭১ বিভিন্ন ধরনের মানব অধিকার লঙ্ঘনের অপরাধে মতিউর রহমান নিজামীসহ জামায়াতের বহু শীর্ষ নেতাকে জেলবন্দি করা হয়। তাদের সঙ্গে জেলবন্দি করা হয় বিএনপি নেতা সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে। এক্ষেত্রে হাসিনা ফরগিভ করেন নি, ফরগেটও করেন নি।
চার. প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া-কে তার প্রায় ৪০ বছরের বাসস্থান থেকে উচ্ছেদ করা হয়েছে। ১৩ নভেম্বর ২০১০-এ যেদিন সকালে খালেদাকে উচ্ছেদ করা হয় সেদিনও আদালতের উচ্ছেদ আদেশ বিষয়ে আইনি প্রক্রিয়া চলমান ছিল। কিন্তু সেটা অন্যায়ভাবে উপেক্ষা করা হয়। এক্ষেত্রে হাসিনা ফরগিভ করেন নি, ফরগেটও করেন নি। হাসিনা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, খালেদাকে উচ্ছেদ করার পর তার বাড়ি ডিমলিশ করে ওই স্থানে বহুতলার ফ্ল্যাট ভবন বানানো হবে দুই শতাধিক সেনা অফিসারদের জন্য। হ্যাঁ, উচ্ছেদের পর বাসস্থান ডিমলিশ করা হয়েছে বলে শোনা গিয়েছে। কিন্তু নতুন ফ্ল্যাট নির্মাণ শুরুর কথা শোনা যায় নি। এক্ষেত্রে হাসিনা ফরগেট করেছেন।
পাঁচ. গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা, ম্যানেজিং ডিরেক্টর ও নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস-কে তার ব্যাংক থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। পরে তার বহু বছরের বাসস্থান গ্রামীণ ফ্ল্যাট থেকেও বহিষ্কার করা হয়েছে বলে শোনা গিয়েছে। এক্ষেত্রে হাসিনা ফরগিভ করেন নি, ফরগেটও করেন নি।
উপরোক্ত পাঁচটি পয়েন্ট থেকে বোঝা যায়, প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার প্রধান পাঁচটি এজেন্ডা কার্যকর হয়েছে গত আড়াই বছরে। আশা করা যায়, অন্যান্য প্রতিহিংসা চরিতার্থ সম্ভব হবে আগামী আড়াই বছরে।
আই লাভ ইনডিয়া
উই কিল বাংলাদেশি

এবারে আসুন, বিবেচনা করা যাক ইনডিয়ার সঙ্গে আরো সুসম্পর্ক স্থাপন অথবা ইনডিয়াকে তোষণ নীতির বিষয়টি।
ক্ষমতায় যাওয়ার প্রথম বছরেই শেখ হাসিনা দিল্লিতে গিয়ে দুই দেশের মধ্যে একটি চুক্তি করে এসেছেন, যে চুক্তিটি এখনো পার্লামেন্টে আলোচিত হয়নি এবং যাতে ভবিষ্যতে কখনোই আলোচিত না হয় সেই ব্যবস্থাও নেয়া হচ্ছে। শেখ হাসিনা এই জুনে দাবি করেছেন, তার চেয়ে বেশি দেশপ্রেমিক আর কেউ নেই। সুতরাং ধরে নেয়া যেতে পারে, ওই চুক্তিতে দেশদ্রোহিতামূলক কোনো শর্ত নেই।

তারপরও আমার চোখে পড়ছে, চড়া সুদে ইনডিয়ান ঋণে ইনডিয়ান ট্রানজিটের জন্য পথ নির্মাণের কথা বলা হচ্ছে। জলপথে ইনডিয়াকে ট্রানজিট দেয়ার ব্যবস্থা হচ্ছে। প্রথমে বলা হয়েছিল, এসব ট্রানজিটের ফলে সিংগাপুরের মতো সমৃদ্ধিশালী হয়ে যাবে বাংলাদেশ। এখন বলা হচ্ছে, সেটা হবে না। বরং বলা হচ্ছে, ট্রানজিট ফি চাইলে আমরা অসভ্য হয়ে যাবো। হয়তো আমরা ট্রানজিট ফি চেয়ে অসভ্য হয়ে যাচ্ছি। কিন্তু এক্ষেত্রে কে বা কারা বেশি নিন্দনীয়? যারা অসভ্যতা করছে তারা, নাকি যারা দেশদ্রোহিতা করেছে ও করছে তারা?
এছাড়া গত আড়াই বছরে দেশের পূর্ব দিকে ফারাক্কা পয়েন্টে পানিস্বল্পতা বিষয়ে আওয়ামী সরকারকে সোচ্চার হতে দেখা যায়নি। বরং দেশের পূর্ব দিকে ইনডিয়ার নির্মিতব্য অথবা নির্মীয়মান টিপাইমুখ বাধ বিষয়ে আওয়ামী সরকারের নিষ্ক্রিয়তা দেখা গিয়েছে।
ইনডিয়ার সঙ্গে আরো সুসম্পর্ক স্থাপন করতে গিয়ে বাংলাদেশের শিল্প ও চাকরি ক্ষেত্রে ইনডিয়ানদের সুযোগ-সুবিধা দেয়া হয়েছে। যেমন, এয়ারটেল বাংলাদেশে এসেছে এবং বহু কম্পানিতে সিইও-সহ উঁচু পদে বহু ইনডিয়ান অফিসার নিযুক্ত হয়েছেন। তাদের বিপরীতে কোনো বাংলাদেশি ইনডাস্টৃকে, যেমন, রহিমআফরোজকে কোনো সুবিধা ইনডিয়াতে দেয়া হয়েছে কি? বাংলাদেশি কোনো টিভি চ্যানেলের অনুষ্ঠান ইনডিয়াতে প্রদর্শিত হচ্ছে কি? বাংলাদেশি কোনো অফিসার ইনডিয়াতে কোনো কম্পানিতে সিইও বা কোনো উঁচু পদে নিযুক্ত হয়েছেন কি?
জলে ও স্থলে, শিল্প ও বাণিজ্যে গৃধ্নু ইনডিয়ান আগ্রাসনের সঙ্গে এখন যুক্ত হয়েছে বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনীর ওপর তাদের দৃষ্টি। ইনডিয়ান সেনা কর্মকর্তারা এখন বাংলাদেশের সেনাবাহিনীর সঙ্গে জান পহছান কর্মসূচি বাস্তবায়নে আগ্রহী।
কিন্তু বাংলাদেশি সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের মনে রাখা দরকার, বর্তমান বাংলাদেশ সশস্ত্রবাহিনীর প্রথম ও প্রধান পৃষ্ঠপোষক ছিল চায়না। এ পর্যায়টি শুরু হয়েছিল প্রেসিডেন্ট জিয়ার শাসন আমলে। এখনো সেটির ধারাবাহিকতা রক্ষাই বাংলাদেশের জন্য মঙ্গলকর হবে।
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের আই লাভ ইনডিয়া মনোভাবের বিপরীতে ফুটে উঠেছে ইনডিয়ান সীমান্তরক্ষীদের উই কিল বাংলাদেশি জিঘাংসা। গত আড়াই বছরে এই হিংস্রতার চূড়ান্ত বহিঃপ্রকাশ ঘটে সীমান্তে বাংলাদেশি নারী ফেলানি-কে গুলি করে হত্যার পর কাঁটাতারের দেয়ালে তার ঝুলন্ত লাশের ছবিতে। প্রসঙ্গত, এটা বলা উচিত যে, আওয়ামী সরকারের ভয়ে ভীত অথবা ভক্তিতে নতজানু বাংলাদেশি মিডিয়ার বড় অংশটি এই ছবি প্রথমে ছাপায়নি। এই ছবিটি প্রথম প্রকাশিত হয় কলকাতায়। থ্যাংকস কলকাতা মিডিয়া।
প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ
এবারে বিবেচনা করুন তথাকথিত ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার অঙ্গীকারে ২০০৮-এর নির্বাচনী অভিযানে আওয়ামী লীগের কয়েকটি প্রধান প্রতিশ্রুতির কথা। এক. চালের দাম কেজিপ্রতি দশ টাকা হবে। দুই. ঘরে ঘরে একটি করে চাকরি হবে। তিন. বিনা মূল্যে সার দেয়া হবে। এ তিনটিই শেখ হাসিনা ফরগেট করেছেন। কিন্তু সাধারণ মানুষ ফরগেট করেনি এবং ফরগিভও করবে না। শেখ হাসিনা এটা বোঝেন। এটাই তার সবচেয়ে বড় সমস্যা, বিশেষত চালসহ অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের অনিয়ন্ত্রিত ঊর্ধ্বগতি। এই গতিবেগ রমজান মাসে আরো বাড়তে পারে।

আওয়ামী লীগ সরকারের এসব সমস্যার সঙ্গে গত আড়াই বছরে যুক্ত হয়েছে কিছু গভীর সমস্যা। যেমন, ক্ষমতায় আসার পর পরই বিডিআর বিদ্রোহ। ফলে সেনাবাহিনীর ৫৭ জন অফিসার নিহত হন, কিছু অফিসারের স্ত্রী লাঞ্চিত হন এবং পরবর্তীকালে বিচারাধীন অবস্থায় ৫৭ বিডিআর কর্মচারী মারা যান। এই ঘটনার রিপল এফেক্ট (Ripple effect) বা ঢেউ ছড়িয়ে পড়ার ক্রিয়া এখনো চলমান আছে।
এর কিছুকাল পর নামে শেয়ার বাজারে অভাবনীয় ধস। জানা যায়, এর ফলে ৩৩ লাখ বিনিয়োগকারী ক্ষতিগ্রস্ত হন। এই হিসাবে (যদি ধরে নিই, প্রতিটি বিনিয়োগকারীর সঙ্গে আছেন পাঁচজন পারিবারিক সদস্য ৩,৩০০,০০০ ী ৫ = ১৬,৫০০,০০০) দেড় কোটির বেশি ব্যক্তি স্টক এক্সচেঞ্জে বিপর্যয়ের শিকার হয়েছেন।
এই বিশাল জনগোষ্ঠি আওয়ামী লীগ সরকারকে ফরগিভ করবে না। ফরগেট করার প্রশ্নই ওঠে না।

জনমত বিপক্ষে
তাদের বাইরেও একই ক্যাটেগরিতে আরো জনগোষ্ঠি আছে। যেমন, জামায়াতের সমর্থক ও তাদের আত্মীয়স্বজন। তারা দেখছেন, মাসের পর মাস তাদের নেতা ও কর্মীদের বিচারের নামে জেলবন্দি করে রাখা হয়েছে। যেমন, সিরাজগঞ্জ, রূপগঞ্জ ও আড়িয়ল বিলের কয়েক হাজার মানুষ যাদের বিরুদ্ধে গণহুলিয়া জারি করা হয়েছিল। তারাও ফরগিভ করবে না। লক্ষণীয় যে, এই ইন্টারভিউ দেয়ার সময়ে সম্প্রতি অনুষ্ঠিত ১৪৪টি ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে জামায়াতের রাজনৈতিক পরিচয়ে প্রার্থীরা বিজয়ী হয়েছে।

গত আড়াই বছরে কয়েকটি নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সমর্থক প্রার্থীদের পরাজয় এ সত্যটাই প্রতিষ্ঠা করেছে, ভোটাররা ফরগেট করার মুডে নেই।
চট্টগ্রাম সিটি কর্পরেশন নির্বাচনে প্রায় এক লাখ ভোটের ব্যবধানে নির্বাচিত হয়েছেন বিএনপি সমর্থিত প্রার্থী মনজুর আলম। সেখানে পরাজিত হয়েছেন আওয়ামী লীগের একটি বড় শক্তি মহিউদ্দিন আহমেদ। এর ফলে ঢাকা সিটি কর্পরেশনে মেয়র নির্বাচন অনুষ্ঠান থেকে পিছিয়ে যায় আওয়ামী লীগ।
জানুয়ারি ২০১১-র ২৫৪টি পৌরসভা নির্বাচনে বিএনপি বিজয়ী হয়েছে ৯৮-তে, আওয়ামী লীগ ৯৬টিতে, জামায়াত ছয়টিতে এবং জাতীয় পার্টি মাত্র একটিতে।
চলমান ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দল সমর্থকদের ব্যাপক সহিংসতা সত্ত্বেও এখন পর্যন্ত, বিএনপি ও আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থীরা প্রায় সমান সংখ্যক স্থানে বিজয়ী হয়েছেন। আগেই বলেছি, ১৪৪টি ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে জামায়াত প্রার্থীরা বিজয়ী হয়েছেন। জাতীয় পার্টি বিজয়ী হয়েছে ৮৫টিতে।
নির্বাচনের এসব ফল থেকে আওয়ামী লীগ সিদ্ধান্তে পৌঁছেছে, জনমত তাদের বিপক্ষে চলে গিয়েছে। এ কারণে সংবিধান সংশোধন করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল করা হয়েছে। এখন দলীয় সরকারের অধীনে সাজানো নির্বাচন কমিশনের মাধ্যমে মেয়াদ শেষের আড়াই বছর আগে ক্ষমতায় আসার পরিকল্পনা করা হচ্ছে। এরশাদকে করা হবে বিরোধী দলের নেতা।
নতুন অভিজ্ঞতা
এই অভিজ্ঞতা আওয়ামী লীগের জন্য সম্পূর্ণ নতুন।
আওয়ামী লীগ যারা মনে-প্রাণে বিশ্বাস করে তারাই শুধু এ দেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ করেছে, স্বাধীনতা এনে দিয়েছে এবং সেই সুবাদে শুধু তাদেরই এ দেশে সরকার গঠনের অধিকার আছে। এর আগে সরকারে থাকার সময় এবং সরকারে না থাকার সময়ও বিশ্বাস করেছে তারা জনপ্রিয়। ভোটাররা তাদের চায়। সুতরাং নির্বাচন হলে তারাই বিজয়ী হবে।

এই বিশ্বাস থেকে আওয়ামী লীগ ১৯৯১-র নির্বাচনে অংশ নিয়েছিল। কিন্তু তখন তারা পরাজিত হয়েছিল। এরপর এই একই বিশ্বাস থেকে তারা জুন ১৯৯৬-র নির্বাচনে অংশ নিয়েছিল এবং জাতীয় পার্টির সঙ্গে মিলে-ঝুলে একটি তথাকথিত ঐকমত্যের সরকার গঠন করেছিল।
এরপর নির্বাচন কমিশন সাজিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা পদে বিচারপতি লতিফুর রহমানের (যাকে মনে করা হয়েছিল আওয়ামী লীগের প্রতি সহানুভূতিশীল) নিয়োগ নিশ্চিত করে এবং কুমির বাহিনীর প্রধান হারুনকে (যিনি বঙ্গবন্ধুর ছবি সংবলিত টিশার্ট পরে কুমিরমেন্টে মিছিল করেছিলেন) আস্থায় রেখে অক্টোবর ২০০১-র নির্বাচনে গিয়েছিল আওয়ামী লীগ। তারা পরাজিত হয়েছিল।
তারপর ডিসেম্বর ২০০৮-এর নির্বাচনে অংশ নেয় আওয়ামী লীগ। কারণ তারা জানত ওয়ান-ইলেভেনের কুশীলব এবং ইনডিয়া, ইউএস ও ইইউ-র আনুকূল্যে তারাই বিজয়ী হবে। ওই নির্বাচনের মাত্র দেড় মাস আগে শেখ হাসিনা ৬ নভেম্বর ২০০৮-এ বিদেশ থেকে বাংলাদেশে আসেন। প্রত্যাশিত ভাবেই হাসিনা নির্বাচনে বিজয়ী হন।
কিন্তু এই প্রথমবার ক্ষমতায় থেকে শেখ হাসিনা দুশ্চিন্তায় পড়েছেন। তিনি আশংকা করছেন, কোনো সাধারণ নির্বাচন হলে তার দলের শোচনীয় পরাজয় ঘটবে।
কুমির ঘনিষ্ঠতা
এসব কারণে জুন মাসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অনুরোধ করেছেন খাল কেটে কুমির আনার সুযোগ সৃষ্টি না করতে। তিনি মনে করছেন, বিরোধী দলগুলো যদি জোরালো আন্দোলন শুরু করে তাহলে আওয়ামী লীগ সরকারের বিদায় ঘটলেও বিএনপির আগমন ঘটবে নাÑ সেক্ষেত্রে ওয়ান ইলেভেনের মতো মতি-মাহফুজ প্রেরণায় কুমিরবাহিনীর আগমন হবে।

এই প্রসংগে আমি ইতিপূর্বে মনে করিয়ে দিয়েছিলাম কুমিরদের সঙ্গে, বিশেষত বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন কুমির বাহিনীর প্রধানদের সঙ্গে শেখ হাসিনার সুসম্পর্ক এবং আমি বলেছিলাম সেজন্যই শেখ হাসিনা সঠিকভাবে কুমিরবাহিনীর নড়াচড়া বিষয়ে ফোরকাস্ট করতে পারেন। আমি জানিয়েছিলাম তিনজন কুমিরপ্রধান, এরশাদ, নাসিম ও মইন ইউয়ের সঙ্গে শেখ হাসিনার সুসম্পর্কের কথা। তবে, আমি বলতে ভুলে গিয়েছিলাম, আরো তিন কুমির প্রধানের সঙ্গে তার সুসম্পর্কের বিষয়টা।
১৯৯৬-এ ক্ষমতাসীন হবার পর শেখ হাসিনা তার ফুপা মেজর জেনারেল মুস্তাফিজ (যিনি বিয়ে করেছিলেন শেখ মুজিবুর রহমানের কাজিন সিস্টারকে)-কে, তাকে এলপিআর বা লিভ পৃপারেটরি টু রিটায়ারমেন্ট থেকে ফিরিয়ে এনে কুমিরপ্রধান পদে নিযুক্ত করেছিলেন। শেখ হাসিনা ওই প্রধানমন্ত্রীত্বের সময়ে নিকট অতীতের এক কুমিরপ্রধান লেঃ জেনারেল নুরুদ্দীন খানকে মন্ত্রী পদে নিয়োগ দিয়েছিলেন। আরেক কুমিরপ্রধান জেনারেল শফিউল্লাহকে আওয়ামী লীগের এমপি করেছিলেন।
সে যাই হোক। এখন দেখা যাচ্ছে শুধু দেশি কুমিরপ্রধানদের সঙ্গে নয়, বিদেশি কুমিরপ্রধানের সঙ্গেও সুসম্পর্ক প্রতিষ্ঠায় শেখ হাসিনা সচেষ্ট হয়েছেন। কুমিরবাহিনীতে পদ পরিবর্তনে শেখ হাসিনা হয়েছেন মনোযোগী!
বলা যায়, জনগণের ওপর আস্থা রাখার চাইতে শেখ হাসিনা গত আড়াই বছরে বেশি নির্ভরশীল হয়ে পড়েছেন সাজানো বিচারবিভাগ, ঘনিষ্ঠ কুমিরকর্তাবৃন্দ এবং প্রতিবেশী রাষ্ট্রের নেত্রী মন্ত্রীদের ওপর। এখন বাংলাদেশে ঘনঘন আসছেন প্রতিবেশী রাষ্ট্রের নেত্রী-মন্ত্রীরা। সুন্দরবন দেখতে? নাকি কক্সবাজার সিবিচ দেখতে? এদের পিছু পিছু যদি ইনডিয়ান টুরিস্টরা আসত তাহলে আমার বলার কিছুই থাকত না।
নাম বদল ম্যানিয়া
৬ জানুয়ারি ২০০৯-এ ক্ষমতা নেয়ার পর থেকে আরেকটি দিকে আওয়ামী লীগ ব্যস্ত ছিল। নাম বদলে।
গত আড়াই বছরে তারা বহু প্রতিষ্ঠানের নাম বদল করেছে। এসবের মধ্যে সবচেয়ে বেশি উল্লেখযোগ্য হচ্ছে জিয়া ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোটের নাম বদল। এখন আওয়ামী লীগ মনোনিবেশ করেছে খালেদা জিয়া নামে ঢাকা ইউনিভার্সিটির একটি ছাত্রাবাসের নাম বদলে।

নাম করণের এই ম্যানিয়া শুধু নাম পরিবর্তনেই সীমাবদ্ধ থাকেনি। নতুন নামে নতুন প্রতিষ্ঠান ও সংস্থাও হয়েছে। যেমন, শেখ জামাল ফুটবল টিম। ইংল্যান্ডের পৃমিয়ার ফুটবল লিগ যারা দেখে থাকেন তারা নিশ্চয়ই লক্ষ্য করেছেন সেখানে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে বৃটিশ হিরো চার্চিল ফুটবল টিম অথবা সন অফ চার্চিল ফুটবল টিম নেই। সাধারণত, সেখানে স্থানের নামে, যেমন, ম্যানচেস্টার, লিভারপুল, চেলসি, আর্সেনাল, ফুটবল টিম হয়, কোনো ব্যক্তির নামে নয়।
দিন পালনের হিড়িক
আওয়ামী লীগের মধ্যে বিভিন্ন দিবস বা দিন পালনের যে প্রবণতা আছে সেটা গত আড়াই বছরে পরিমিতি বোধ ছাড়িয়ে গেছে। এই সময়ের মধ্যে বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন, মৃত্যুদিন, ৭ মার্চ ভাষণ দিন, পাকিস্তান থেকে প্রত্যাবর্তন দিন, প্রভৃতির সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে তাঁর কন্যার বিদেশ (আমেরিকা) থেকে ফেরার দিন, জন্মদিন ইত্যাদি। এসব দিনের সঙ্গে নিয়মিত রবীন্দ্রজন্মবার্ষিকী, রবীন্দ্র মৃত্যু বার্ষিকী, নজরুলজন্মবার্ষিকী, নজরুলমৃত্যুবার্ষিকীর সঙ্গে সবশেষে রবীন্দ্রসার্ধশতবার্ষিকী। এই শেষোক্ত দিনটি পালনের জন্য মহা প্রচারণা চালানো হয়। পশ্চিম বাংলার পত্রপত্রিকার সঙ্গে বাংলাদেশের পত্রপত্রিকার তুলনা করা সাধারণ পাঠকের পক্ষে সম্ভব হয় না। তবুও পাঠকরা সকৌতুকে লক্ষ্য করেন ইত্তেফাক থেকে শুরু করে বিভিন্ন দৈনিক পত্রিকা রবীন্দ্রসার্ধশতবার্ষিকী উপলক্ষে ঢাউস রবিছবিসহ ফার্স্ট, সেকেন্ড, থার্ড লিড নিউজ করতে থাকে। পাশাপাশি টেলিভিশনে চলতে থাকে মাত্রাতিরিক্ত রবি অনুষ্ঠান, খবর বাদে অনুষ্ঠানগুলো হয়ে যায় মার্জিনালাইজড। কিন্তু টিভির ক্ষেত্রে বাংলাদেশী দর্শকদের সুযোগ ছিল ওই সময়ে পশ্চিমবাংলা থেকে সম্প্রচারিত অনুষ্ঠানগুলো দেখার। তারা অবাক হয়ে লক্ষ্য করে রবীন্দ্রনাথ বিষয়ে খুবই সীমিত সময়ের অনুষ্ঠান প্রচারিত হয় ওপার বাংলা থেকে।

সম্ভবত বাংলাদেশের সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় এই বাড়াবাড়ির প্রতিক্রিয়া হয় আওয়ামী লীগের মধ্যেই। তাই রবীন্দ্রনাথকে ব্যালান্স করার জন্যে সহসা উদ্ভাবিত হয় নজরুলের বিদ্রোহী কবিতার ৯০-তম রচনা বার্ষিকী। যার উর্বর মস্তিষ্ক থেকে এই ব্যালান্সিং ফর্মুলাটি বেরিয়েছে তিনি অবশ্যই কৃতিত্ব দাবি করতে পারেন। তারপর? আগামী আড়াই বছরে কী হবে? জীবনানন্দ দাশের কোনো বার্ষিকী? এবং তাঁকে ব্যালান্স করার জন্যে জসীমউদ্দীনের কোনো বার্ষিকী? মাইকেল মধুসূদন দত্তকে ব্যালান্স করার জন্যে মীর মোশাররফ হোসেনের কোনো বার্ষিকী?
বস্তুত এই ধরনের দিন পালন বিষয়ে সাধারণ মানুষের কোনো উৎসাহ নেই। বরং বাংলাদেশে যেসব সংসারে শেয়ারবাজার ধসের সিডর বয়ে গেছে, তাদের মর্মবেদনা বিবেচনা করে আগামীতে শেয়ারবাজার ধসবার্ষিকী উদযাপিত হলে আওয়ামী সরকার মানুষের কাছাকাছি যেতে পারবে।
কালো কেশে এরশাদ
গত আড়াই বছরে আওয়ামী লীগের সহযোগী এরশাদের জাতীয় পার্টির বিশেষ কোনো ভূমিকা ছিল না। তবে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিলকে জাতীয় পার্টি বোধগম্য কারণে ওয়েলকাম করেছে। বিদেশে মরিয়ম বিবিকে অবৈধভাবে ডলার পাচারের মামলা থেকে এরশাদ নিষ্কৃতি পেয়েছেন। এরশাদের বৈধ নাম্বার ওয়ান স্ত্রী রওশনের সঙ্গে তার দূরত্ব গত আড়াই বছরে কমেছে, নাকি বেড়েছে সেটা বোঝা যায়নি। যা বোঝা গেছে তা হলো এরশাদের সর্বশেষ বৈধ এবং ডিভোর্সড স্ত্রী বিদিশার সঙ্গে দূরত্ব বেড়েছে। এরশাদের মাথার চুল এখন আরো কালো হয়েছে। হায়! আমরা নেড়িকুকুররা চুলে কলপ দেয়ার টেকনিক জানি না। নইলে এই বয়সে আমিও …।

জামায়াতে ইসলামী গত আড়াই বছরে নিস্তেজ হয়েছে। যুদ্ধাপরাধের দায়ে তাদের নেতাদের অভিযুক্ত করে জেলবন্দি রাখা হয়েছে। বিকল্প কোনো শক্তিমান নেতা জামায়াতে আবির্ভূত হননি। এটাই দলের বর্তমান প্রধান ব্যর্থতা।
বিএনপির বিলম্ব
গত আড়াই বছরে বিএনপি তার দল পুনর্গঠনে অনেক দেরি করেছে। এর প্রধান দুটি কারণ ছিল, এক. দলের সেক্রেটারি জেনারেল পদ থেকে রিটায়ার করতে খোন্দকার দেলোয়ার হোসেনের অনিচ্ছা। সৎ ও সাহসী এই নেতা বিএনপির ঘন দুর্যোগের সময়ে খালেদা জিয়ার অনুরোধে হাল ধরেছিলেন। কিন্তু সেপ্টেম্বর ২০০৮ খালেদা জিয়ার জেলমুক্তির পরে এবং বিশেষত ডিসেম্বর ২০০৮-এর সাধারণ নির্বাচনের পরে দলকে সাংগঠনিকভাবে শক্তিশালী করার লক্ষ্যে, নিজের বার্ধক্য ও অসুস্থতার বিষয় বিবেচনা করে, দেলোয়ার পদত্যাগ করতে পারতেন। তা তিনি করেননি। শেষে ১৭ মার্চ ২০১১-তে মৃত্যুই তাকে রিটায়ার করায়।

এরপর খালেদা জিয়া ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি জেনারেল রূপে নিযুক্ত করেন প্রাক্তন শিক্ষক ও সাবেক মন্ত্রী, সুদর্শন মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে। এই নিযুক্তি সাধারণ মানুষের কাছে ব্যাপকভাবে প্রশংসিত হয়েছে। আওয়ামী লীগে তার কাউন্টারপার্টের তুলনায় মির্জা ফখরুলের পড়াশোনায় আসক্তি এবং মদ্যপানে অনাসক্তি প্রথম থেকেই একটি দৃঢ় অবস্থানে তাকে নিয়ে গিয়েছে। এখন লক্ষ্যণীয় যে আগামী আড়াই বছরে দলকে পুনর্গঠিত ও সুসংহত করতে মির্জা ফখরুল কতোখানি সফল হন।
দুই. ঢাকা মহানগর বিএনপিতে অনিশ্চয়তা। অবশেষে সেই অনিশ্চয়তা দূর হয়েছে।
গত মে মাসে বিএনপিতে আরেকটি নিযুক্তি দলের অধিকাংশ কর্মীদের মধ্যে প্রশংসিত হয়েছে। ঢাকা মহানগর বিএনপিকে আবার গড়ে তোলার দায়িত্ব পেয়েছেন মেয়র সাদেক হোসেন খোকা। ধারণা করা হয় এক্ষেত্রে তার প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন মির্জা আব্বাস। দায়িত্ব পাওয়ার পরপরই সাদেক হোসেন খোকা ফোন করে মির্জা আব্বাসের সহযোগিতা চেয়েছেন। এ কথা অনস্বীকার্য যে মির্জা আব্বাসের প্রতি গভীরভাবে অনুগত আছেন স্থানীয় নেতাকর্মীরা। মির্জা আব্বাসসহ এদের সবার সহযোগিতা পেলে ঢাকা শহরে বিএনপি তার পুরনো আধিপত্য ফিরে পাবে।

গত আড়াই বছরে বিএনপির একটি দলগত সাফল্য ছিল ডিসেম্বর ২০০৮-এর কাউন্সিল অধিবেশন। বহু বিদেশী অতিথি এবং কয়েক হাজার নেতা-কর্মীর উপস্থিতিতে চীন বাংলা মৈত্রী সম্মেলন হলে অনুষ্ঠিত এই কাউন্সিল অধিবেশন ছিল সর্বতোভাবে সফল এবং রাজনীতিতে বিএনপির সরব প্রত্যাবর্তনের সূচনা।
আওয়ামী লীগের প্রথম পিছু হটা
এর বিপরীতে আওয়ামী লীগের প্রায় নীরব পশ্চাদপসরণের সূচনা হয়েছে আড়িয়াল বিলে নতুন ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট নির্মাণের প্ল্যান বাতিল থেকে। এই ঘটনাই ছিল গত আড়াই বছরে আওয়ামী লীগের প্রথম পিছু হটা।

যে দেশের রাজধানীতে নেই পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন পর্যাপ্তসংখ্যক আসন বিশিষ্ট বাস, যে দেশের ইন্টারসিটি ট্রেনগুলোতে নেই পর্যাপ্তসংখ্যক ইঞ্জিন ও কোচ, যে দেশের এয়ারলাইন্স, বাংলাদেশ বিমান-এ নেই প্রয়োজনীয়সংখ্যক প্লেন এবং যে দেশের বর্তমান এয়ারপোর্টের মাত্র এক-তৃতীয়াংশ ব্যবহৃত হচ্ছে, সেই দেশে মালটিমিলিয়ন ডলার ঢেলে এবং মিলিয়ন মানুষকে ভিটেবাড়ি থেকে উচ্ছেদ করে আরেকটি এয়ারপোর্ট নির্মাণের প্ল্যান কেন হয়েছিল?
সীমিত হরতাল রাজনীতি
উত্তর যাই হোক না কেন, নিরস্ত্র জনগণের বিশাল প্রতিরোধের মুখে আওয়ামী লীগ সভয়ে পিছু হটতে বাধ্য হয়। ওই প্ল্যান আপাতত স্থগিত রাখা হয়।

গত আড়াই বছরে আওয়ামী লীগের সঙ্গে বিএনপির পার্থক্য স্পষ্টভাবে ধরা পড়েছে। আওয়ামী লীগের প্রতিহিংসাপরায়ণতা ও ইকনমিক মিসম্যানেজমেন্টের বিপরীতে মানুষ দেখতে চায় একটি ভদ্র এবং অহিংস পার্টিকে যাদের ইকনমিক ম্যানেজমেন্টের অতীত রেকর্ড ভালো এবং যারা ভবিষ্যতে আবার দেশবাসীকে উপহার দিতে পরবে গুড ইকনমিক ম্যানেজমেন্ট।
গত আড়াই বছরে মাত্র সাতটি হরতাল ডেকে বিএনপি যুগপৎ শান্তিপ্রিয়তা এবং অর্থনীতির অগ্রগতি চালু রাখার সদিচ্ছা দেখিয়েছে। আগামী আড়াই বছরে যদি আওয়ামী লীগের মতোই লাঠি বৈঠা লগি এবং টানা হরতালের কর্মসূচিতে বিএনপি লিপ্ত হয়, তাহলে মানুষ হয়তো আবার কুমিরশাসনে আগ্রহী হবে। মনে রাখতে হবে। ওয়ান-ইলেভেনের পর প্রথম দিকে কুমিরদের স্বাগত জানিয়েছিল সাধারণ মানুষ।
কিন্তু এটাও ঠিক যে, ক্ষমতায় থেকে যাবার জন্য অনুগত সাংসদ এবং বশীভূত বিচার বিভাগের ওপর ভর করে আগামী আড়াই বছরে আওয়ামী লীগ দমনমূলক আইন পাস করবে এবং মরিয়া হয়ে দমননীতি অনুসরণ করবে। সেক্ষেত্রে বিএনপিকেও চ্যালেঞ্জ নিতে হবে। তবে সেটা করতে হবে অবশ্যই জনগণকে পাশে নিয়ে। সেজন্য যেকোনো কর্মসূচি পালনের আগে লিফলেট বিলি থেকে শুরু করে, ঘরে ঘরে, দোকানে দোকানে, গ্রামেগঞ্জে বিএনপি নেতাদের প্রত্যক্ষ জনসংযোগ করতে হবে। মানুষকে আগেই সঙ্গে নিয়ে, তাদের কনভিন্স করিয়ে, প্রয়োজনীয় হরতাল অথবা টানা হরতাল করতে হবে। তবেই মানুষ বুঝবে আওয়ামী হরতালের সঙ্গে বিএনপি হরতালের মৌলিক তফাৎ।
ইস্টিশনের রেলগাড়িটা…
আমি গানটা শুনছি।
আপনারা জানেন গান শুনতে কুকুররা ভালোবাসে।
কিন্তু এখন গানটা শুনে আমি আনন্দিত হচ্ছি না।
আমি উদ্বিগ্ন হচ্ছি।
এখন তো বাজে ছয়টা।
ভাবছি, কখন বাজবে বারোটা?
সেটা কি হবে আওয়ামী লীগের বারোটা?
নাকি, দেশের বারোটা?

৩ জুলাই ২০১১
শফিক রেহমান:প্রবীণ সাংবাদিক ও জনপ্রিয়  টিভি অনুষ্ঠান উপস্থাপক।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন