শুক্রবার, ২৭ জানুয়ারী, ২০১২

স্টিভ জবসের মন্ত্র : হাল ছেড়ো না বন্ধু



shafik-rehman211111111112ইনভেনটর, ডিজাইনার এবং গত আগস্টে স্বেচ্ছায় অবসরে যাওয়া অ্যাপল প্রতিষ্ঠানের সিইও স্টিভ জবস ৫৬ বছর বয়সে ৬ অক্টোবর ২০১১-তে তিরোধান করেছেন। বেশ কয়েক বছর যাবৎ তিনি প্যাংকৃয়াসে ক্যান্সার রোগে ভুগছিলেন। তার লিভার নষ্ট হয়ে গিয়েছিল এবং নতুন একটি লিভার তার দেহে ট্রান্সপ্লান্ট বা সংযোজন করা হয়েছিল।
বলা হয়, আমেরিকান ইনভেনটর টমাস আলভা এডিসনের পর স্টিভ জবসই বিশ্বের সবচেয়ে বেশি মানুষের দৈনন্দিন জীবনকে পালটে দিয়েছেন। এডিসনের কল্যাণে আমরা পেয়েছি ইলেকট্রিক ল্যাম্প বা বালব, টেপ রেকর্ডার-সিডি প্লেয়ার প্রভৃতি। তিনি এক হাজারেরও বেশি প্রডাক্টের উদ্ভাবক ছিলেন। স্টিভ জবসের কল্যাণে আমরা পেয়েছি ইউজার ফ্রেন্ডলি (User Friendly বা ব্যবহার বান্ধব) কম্পিউটার ও মোবাইল ফোনসহ মিউজিক ও অ্যামিনেশন মুভিতে আধুনিক টেকনিক।
একটি আধুনিক রূপকথা
স্টিভ জবসের জীবনটা ছিল একটি আধুনিক রূপকথা। উত্থান-পতন এবং পুনরুত্থানে ভরা ছিল তার জীবন।
প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা তার প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনে বলেছেন, আমেরিকার বড় উদ্ভাবকদের অন্যতম ছিলেন স্টিভ। তিনি নির্ভীক ছিলেন, তাই ভিন্ন চিন্তা করেছিলেন। তিনি সাহসী ছিলেন তাই বিশ্বাসটা ছিল যে, পৃথিবীটাকে বদলে দিতে পারবেন। তিনি প্রতিভাবান ছিলেন তাই সেটা করতে পেরেছিলেন। (Steve was among the greatest of American innovators- brave enough to think differently, bold enough to believe we could change the world and talented enough to do it.)

Jobs-m
প্রতিকূলতা বিজয়ের অসাধারণ কাহিনী
মাতৃজঠর থেকে এই পৃথিবীতে ভূমিষ্ঠ হবার পরপরই মানুষ প্রতিকূল পরিবেশে পড়ে। তাই হয়তো জন্মের পরই শিশু কাঁদে। তারপর মানুষের জীবনের অধিকাংশ সময়ই কেটে যায় প্রতিকূল পরিস্থিতির বিরুদ্ধে লড়াই করতে। যারা দৃঢ়প্রতিজ্ঞ, পরিশ্রমী ও আত্মবিশ্বাসী, তারা এই লড়াইয়ে বিজয়ী হতে পারে। স্টিভ জবসের জীবন এ ধরনের একটি বিজয়ের আশ্চর্যকর অসাধারণ কাহিনী।

জন্মের পরপরই স্টিভ জবস বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিলেন তার জন্মদাত্রী মা ও পিতার কাছ থেকে। স্টিভ জবসকে দত্তক সন্তান রূপে গ্রহণ করেছিলেন ক্যালিফোর্নিয়ার সিলিকন ভ্যালিতে বসবাসকারী শ্রমজীবী পিতা ও মাতা। তারা নবজাত শিশুর নাম দিয়েছিলেন স্টিভেন পল জবস। সংক্ষেপে স্টিভ জবস।
মুসলিম পিতার দুঃখ
কিন্তু স্টিভ জবসের বায়োলজিকাল পিতা কে ছিলেন? স্টিভ জবসের মৃত্যুর পর তার জন্মদাতা পিতার প্রতিক্রিয়া কি হয়েছে? বিশ্বখ্যাত সন্তানের সঙ্গে সেই পিতার সম্পর্কটা কেমন ছিল?

স্টিভ জবসের পিতা আবদুলফাত্তা জন জানডালি একজন সিরিয়ান-আমেরিকান মুসলিম। তার বর্তমান বয়স ৮০। আগে তিনি ছিলেন ইউনির্ভাসিটি অফ নেভাদাতে পলিটিকাল সায়েন্স বা রাষ্ট্রবিজ্ঞানের প্রফেসর। তিনি যে তার ছেলেকে একজন পালক পিতার হাতে তুলে দিয়েছিলেন, সে জন্য অনুশোচনা প্রকাশ করেছিলেন। তবে এই লেখা পর্যন্ত স্টিভ জবসের মৃত্যুতে তিনি কোনো মন্তব্য করেননি। এখন জানডালি কাজ করছেন বুমটাউন হোটেল ক্যাসিনোর ভাইস প্রেসিডেন্ট পদে।
দুই মাস আগে আগস্ট ২০১১-তে দি সান পত্রিকায় একটি ইন্টারভিউতে জানডালি বলেছিলেন, শুনেছি স্টিভ খুব মারাত্মক রোগে ভুগছে। আমি বেঁচে আছি এই আশাতে যে, খুব দেরি হয়ে যাবার আগে সে আমার কাছে আসবে, অন্তত এক কাপ কফি একবার আমার সঙ্গে খাবে। তাহলে আমি সুখী হবো।
কিন্তু স্টিভের মৃত্যুর পর জানডালি কোনো কথা বলতে রাজি হননি। তিনি শুধু বলেছেন, সে যে মারা গেছে, সেটা আমি জানি।
তরুণ বয়সে সিরিয়ার হমস শহর থেকে আবদুলফাত্তা আমেরিকায় এসেছিলেন পলিটিকাল সায়েন্সে পড়তে। তিনি প্রেমে পড়েন একজন আমেরিকান গ্র্যাজুয়েট ছাত্রীর। তার নাম ছিল শিবেল। ১৯৫৫-তে যখন স্টিভের জন্ম হয়, তখন তার পিতা-মাতা ছিলেন অবিবাহিত ছাত্রছাত্রী। তাকে পালনের দায়িত্ব নেন ক্যালিফোর্নিয়ার মাউনটেইন ভিউ শহরের গরিব এক দম্পতি পল ও ক্লারা জবস। তারা নবজাত শিশুকে সাদরে বরণ করে নেন।

আবদুলফাত্তা জানডালি প্রকাশ্যে তার সন্তানের সঙ্গে দেখা করতে চাইলেও স্টিভ তাতে সাড়া দেননি। এ জন্য গত সেপ্টেম্বরে রেনো গেজেট পত্রিকায় আরেকটি ইন্টারভিউতে জানডালি বলেন, তিনি আর কখনো তার ছেলের বিষয়ে প্রকাশ্যে কিছু বলবেন না।
জানডালি আরো বলেন, যদিও তিনি তার ছেলের সঙ্গে দেখা করার জন্য ব্যাকুল, তবুও তার সিরিয়ান গর্বের জন্য, তিনি নিজে যেচে স্টিভের কাছে যাবেন না।

দি সানের ইন্টারভিউতে জানডালি বলেন, এটা খুবই অদ্ভুত মনে হতে পারে যে, আমাদের দুজনের একজন মৃত্যুশয্যায় থাকলেও কেউ কাউকে ফোন করে কথা বলতে চাইবো না। স্টিভ যদি চায় তাহলে সে ফোন করতে পারে আমাকে। আমি ফোন করবো না। কারণ স্টিভ মনে করতে পারে, আমি তার টাকায় ভাগ বসাতে চাই বলে ফোন করছি। আমার নিজেরই টাকা আছে। কিন্তু আমার যা নেই, তা হচ্ছে আমার ছেলে। সেটাই আমাকে খুব দুঃখ দেয়।
স্টিভকে তার পালক পিতা-মাতার হাতে তুলে দেয়ার দশ মাস পরে জানডালি ও শিবেল বিয়ে করেন। তাদের একটি কন্যা সন্তান হয়। স্টিভের বায়োলজিকাল এই বোন মোনা সিমসন বর্তমানে একজন ঔপন্যাসিক রূপে পরিচিত।
পিতা জানডালির সঙ্গে জবস দেখা করতে চাননি। কিন্তু তিনি তার বোনের সঙ্গে সম্পর্ক রেখেছিলেন।
খুব নাটকীয়ভাবে তাদের মধ্যে প্রথম দেখাটি হয়েছিল। তারা দুজনাই তখন ছিলেন প্রাপ্তবয়স্ক। মোনা সিমসন তার প্রকাশিত বই এনিহোয়ার বাট হিয়ার (Anywhere But Here)-এর প্রমোশন উপলক্ষে একটি পার্টির আয়োজন করেছিলেন। সেই পার্টিতে তিনি আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন স্টিভকে। স্টিভের বয়স তখন ছিল সাতাশ এবং এই প্রথম তিনি তার সহোদরাকে দেখেন। সেই অনুষ্ঠানে মোনা সবাইকে জানান স্টিভ তার সহোদর।
মোনা বলেন, সেই থেকে স্টিভ ম্যানহাটানে আমার ফ্ল্যাটে নিয়মিত আসতেন। আমরা খুব ঘনিষ্ঠ হই। আমি তাকে প্রশংসা করি। তাকে নিয়ে গর্ব করি।
স্টিভ বলেন, আমরা দুজনা একটি পরিবার। সে আমার সেরা বন্ধুদের একজন। আমি তার সঙ্গে দু-তিন দিন পরপরই দেখা করি।

অভিজ্ঞতা থেকে গঠিত চরিত্র
মোনার সঙ্গে পরিচয় এবং তাকে জানার প্রভাব বড়ভাবে পড়ে স্টিভের জীবনে। মোনা ও স্টিভের সাফল্য ও খ্যাতি দু’টি ভিন্ন ক্ষেত্রে এবং ভিন্নমাত্রার হলেও স্টিভ মনে করা শুরু করেন, কিছু বংশানুক্রমিক গুণ জীবনকে চালিত করে।
কয়েক বছর আগে স্টিভ জবস বলেছিলেন, জন্মদাতা পিতা-মাতা অথবা তাদের জিন থেকে আমার চরিত্র গঠিত হয়নি। তিনি বলেন, আমার সত্যিকারের পিতা-মাতা হচ্ছেন আমার পালক পিতা-মাতা। আমার চরিত্র গঠিত হয়েছে আমার অভিজ্ঞতা থেকে।
স্টিভ তার জন্মদাতা পিতার সঙ্গে কোনো দিনই দেখা না করলেও জন্মদাত্রী মাকে কয়েকটি অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ করেছিলেন।

বৈপরীত্যে ভরা জীবন
স্টিভ জবসের জীবন ছিল এমন বৈপরীত্যে ভরা। অ্যাপলের কো ফাউন্ডার বা সহপ্রতিষ্ঠাতা স্টিভ ওজনিয়াক এক সময়ে ছিলেন তার সবচেয়ে বড় বন্ধু। তারা অ্যাপল প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ১৯৭৬-এ। তারা দুজনা অ্যাপলকে একটি বড় প্রতিষ্ঠানে পরিণত করেছিলেন। কিন্তু ওজনিয়াকের সঙ্গে তার সম্পর্ক ম্লান হয়ে গিয়েছিল। সেই কম্পানি প্রায় দেউলিয়া হয়ে গিয়েছিল এবং স্টিভ জবসকে ছেড়ে যেতে হয়েছিল। আবার সেই প্রতিষ্ঠানেই তিনি ফিরে এসেছিলেন।

তারপর মাত্র এক যুগের কিছু কম সময়ের মধ্যে মার্কেট ক্যাপিটালাইজশনের বিচারে ২০১০-এ অ্যাপল হয়েছিল বিশ্বের সবচেয়ে বেশি দামি কম্পানিগুলোর মধ্যে দ্বিতীয়। শুধু জায়ান্ট তেল কম্পানি এক্সন (Exxon) ছিল অ্যাপলের ওপরে। এই সময়ে অ্যাপলের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে ছিল ৫০ বিলিয়ন ডলারের বেশি। অ্যাপলের এই সুবিশাল সাফল্যের মূলে রয়েছে অ্যাপল কম্পিউটার, আইপড মিডিয়া প্লেয়ার, আইফোন স্মার্টফোন এবং আইপ্যাড ট্যাবলেট কম্পিউটার।
আইপড, আইফোন ও আইপড মার্কেটে এসেছে খুব সাম্প্রতিককালে। কিন্তু দাম বেশি হওয়া সত্ত্বেও এসব প্রডাক্টের তুলনায় সনি, স্যামসাং, নকিয়া প্রভৃতি প্রতিদ্বন্দ্বীর প্রডাক্টকে পেছনে ফেলে দিয়ে অ্যাপল মার্কেটে আধিপত্য বিস্তার করেছে ও বজায় রেখেছে। এর অন্যতম কারণ হলো, প্রথমে অ্যাপল যেসব ভারশন মার্কেটে এনেছিল, সেগুলোর অবিরাম উন্নতি করে গেছে। তাদের উন্নততর পরিবর্তিত ভারশন ক্রেতাদের প্রিয় হয়েছে। মিউজিক, মোবাইল ফোন ও পার্সনাল কমপিউটিং এবং অ্যানিমেশন মুভিতে অ্যাপল নিয়তই নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে। ইউজাররা চমকিত হয়েছে এবং ঝাপিয়ে পড়েছে অ্যাপল প্রডাক্টগুলো কিনতে।
বিংশ শতাব্দীর সূচনায় হেনরি ফোর্ড ভেবেছিলেন সাধারণ মানুষের আয়ে কেনা সম্ভব হয় এমন মোটরকার বানাতে হবে। হেনরি ফোর্ডের সেই চিন্তা বাস্তবায়িত হয়েছে। ঠিক তেমনই অ্যাপল প্রডাক্টও এখন সাধারণ মানুষের জীবনে এসে গেছে।
এসব প্রডাক্ট স্টিভ জবস নিজেই মার্কেটে প্রথম লঞ্চ করেছেন। লঞ্চিং সেরিমনিতে এসেছে হাজার হাজার উচ্ছ্বসিত অনুরাগী এবং এসব অনুষ্ঠান পেয়েছে বিশাল মিডিয়া কভারেজ। এই কভারেজের একটা কারণ হচ্ছে, প্রকাশনা জগৎ যখন হট মেটাল এইজ (Hot metal age) থেকে বেরিয়ে এসে কোল্ড মেটাল এইজ (Cold metal age) বা কমপিউটার যুগে ঢোকে তখন প্রথম থেকে অ্যাপলের কম্পিউটার, অ্যাপল ম্যাকিনটশ ছিল ইউজার ফ্রেন্ডলি (user friendly) ব্যবহার বান্ধব। আমি নিজে সাপ্তাহিক যায়যায়দিন এবং দৈনিক যায়যায়দিন প্রতিদিন প্রতিষ্ঠার সময়ে অন্যান্য ব্র্যান্ডের তুলনায় অনেক বেশি দাম দিয়ে অ্যাপলম্যাক কম্পিউটার কিনেছিলাম। কারণ আমাদের কম্পোজাররা অনেক বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতেন অ্যাপলম্যাকে। এখনো মিডিয়া ওয়ার্ল্ডে অ্যাপল প্রডাক্টই বেশি কাম্য।
অ্যাপল শপ
স্টিভ জবস সচেতন ছিলেন তার প্রডাক্ট ক্রেতারা লুফে নেবে। তাই তিনি প্রডাক্ট লঞ্চিং ও মার্কেটিংয়ের প্রতি সদা সতর্ক দৃষ্টি রাখতেন। প্রডাক্ট মার্কেটিংয়ের জন্য জবস বিশ্ব জুড়ে ৩৫৭টি দোকান খুলেছিলেন। সাধারণত প্রডাক্ট নির্মাতারা সরাসরি মার্কেটিংয়ে যান না। স্টিভের এই ব্যতিক্রমী পদক্ষেপ তার প্রতিদ্বন্দ্বীদের করেছিল ভাবিত।

স্টিভ নিজে অ্যাপল শপ বা দোকানের ডিজাইন করেছিলেন। ২০০৯-এ উত্তর লন্ডনে আমি প্রথম ব্রেন্ট ক্রস শপিং সেন্টারে অ্যাপল শপ দেখি। সেখানে কোনো শোরুম বা শোকেস বা শেলফ ছিল না। অতি উজ্জ্বল আলোতে ভরা সম্পূর্ণ শাদা রংয়ের দোকানের ভেতরে দেয়াল ঘেষে ছিল একটানা প্রশস্ত শাদা কাউন্টার এবং দোকানের মধ্যেও ছিল প্রশস্ত শাদা কাউন্টার বা জিনিয়াস বার (Genius Bar)। এসব কাউন্টারে রাখা ছিল অ্যাপলের বিভিন্ন প্রডাক্ট। কৌতূহলীরা এসব প্রডাক্ট নেড়ে-চেড়ে দেখতে ও টেস্ট করতে পারতেন। যতক্ষণ খুশি। দোকানে বিশেষত তরুণদের সার্বক্ষণিক ভিড় ছিল। এদের মুখে মুখেই ছড়িয়ে পড়েছিল অ্যাপল প্রডাক্টগুলোর গুণাগুণ।
অতি সাধারণ অবস্থা থেকে শুরু
জবস বেঁচে ছিলেন ৫৬ বছর। কিন্তু তার প্রথম ৪৫ বছরে বোঝা যায়নি যে, কনজিউমার ইলেকট্রনিকস ও মিডিয়া ইনডাস্টৃতে তার এত ব্যাপক প্রভাব পড়বে এবং স্থায়ী হবে।

সিলিকন ভ্যালির কাছে মাউনটেইন ভিউতে তিনি বড় হয়ে ওঠেন। তার পালক পিতামাতা তাকে ভর্তি করেছিলেন হোমস্টেড হাই স্কুলে। এখানে পরিচয় হয় স্টিভ ওজনিয়াক-এর সঙ্গে। গ্রীষ্মকালে স্কুলে ক্লাস শেষের পরে স্টিভ জবস আর স্টিভ ওজনিয়াক কাজ করতেন কাছেই পালো আলটো-তে হিউলেট প্যাকার্ড প্রতিষ্ঠানে।
১৯৭২-এ হাইস্কুলে পড়াশোনা শেষে স্টিভ জবস যান উত্তরাঞ্চলে ওরেগন-এ পোর্টল্যান্ডে রিড (Reed) নামে একটি লিবারাল আর্টস কলেজে। এটি ছিল একটি ব্যয়সাপেক্ষ কলেজ। এক টার্ম পরেই তিনি কলেজে পড়া ছেড়ে দিলেও, কিছু ক্লাসে যেতেন। এই সময়ে ক্যালিগ্রাফি কোর্সে তিনি যোগ দেন। পপ গ্রুপ বিটলস, বিশেষত জর্জ হ্যারিসন দ্বারা অনুপ্রাণিত স্টিভ জবস খুব লম্বা চুল ও দাড়ি রাখেন। বন্ধুদের বাড়িতে ফ্লোরে ঘুমাতেন। ফৃ খাবার জন্য মাসে মাসে হরে কৃষ্ণ মন্দিরে যেতেন। তখন তার স্বপ্ন ছিল ইনডিয়াতে একটি গুরুর সান্নিধ্যে যাবেন। রিড কলেজের এক বন্ধু, ডন কোটকে এবং তিনি ইনডিয়াতে গিয়েওছিলেন। কিন্তু তারা পৌছানোর আগেই সেই গুরুটি মারা গিয়েছিলেন।
লোক পটানোর ক্ষমতা
এই পর্যায়ে জবসের শিক্ষা ছিল সীমিত এবং কোনো বিশেষ প্রতিভার স্ফূরণ ছিল অনুপস্থিত। তবে তার একটা গুণ ক্রমেই বিকশিত হচ্ছিল। সেটা ছিল লোক পটানোর ক্ষমতা, যাকে পরে তার সমালোচকরা আখ্যা দেন জবের বাস্তবতা বিকৃত করার ক্ষেত্র (Jobs’s reality distortion field)।

জবসের খুব অনুগত বন্ধু ওজনিয়াক ছিলেন ইলেকট্রনিকস প্রতিভা। তিনি অন্য যেকোনো ব্যক্তির চাইতে কম চিপস দিয়ে সার্কিট ডিজাইন করতে পারতেন এবং এই চ্যালেঞ্জ নিতে তিনি ভালোবাসতেন। অ্যাপল কম্পিউটার সৃষ্টিতে ওজনিয়াকের এই প্রতিভা জবস কাজে লাগিয়েছিলেন। কিন্তু ওজনিয়াকের এই প্রতিভা হয়তো ফলপ্রসূ হতো না এবং তিনি হয়তো বাকি জীবন হিউলেট প্যাকার্ডে হার্ডওয়্যার ডিজাইনিংয়েই কাটিয়ে দিতেন। তার পার্টনার স্টিভ জবস ছিলেন উচ্চাভিলাষী এবং সব সময় কাজে লেগে থাকতেন এবং অপরকে কাজ করতে ঠেলা দিতেন। সর্বোপরি স্টিভ জবসের সহজ ও সুন্দর ডিজাইনের প্রডাক্ট উদ্ভাবন করা, বিজনেস ডিল করা এবং মার্কেট করার ক্ষমতা ছিল। ওজনিয়াক কম্পিউটার সৃষ্টি করতে পারতেন। কিন্তু জবস মার্কেট সৃষ্টি করতে পারতেন।
বিজনেস সেন্স ছিল
১৯৭৬-এ পার্সনাল কম্পিউটিং জগতে স্টিভ ছিলেন প্রায় নবাগত। কিন্তু ২০০০-এর মধ্যেই তিনি হন এই ইনডাস্টৃতে সেরা বিজনেসম্যান। প্রথম অ্যাপল কম্পিউটারটি ছিল একটি কাঠের বাক্সে বানানো অ্যামেচারের মেশিন। জবস তার পিতামাতার বাড়ির গারাজে এটা তৈরি করেছিলেন। বিক্রি করেছিলেন ৬৬৬ ডলারে। জবস তখন বোঝেন, প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে হলে একটা যথাযথ কম্পানি করতে হবে, আর্থিক পৃষ্ঠপোষকতা লাগবে এবং কম্পানি চালাতে একজন অভিজ্ঞ সিইও লাগবে। মাইক মার্কুলা নামে ইনটেল-এর একজন সাবেক কর্মচারী রাজি হন ইনভেস্ট করতে। আর মাইক স্কট রাজি হন অ্যাপলের প্রথম সিইও হতে। স্টিভ জবসের লোক পটানোর ক্ষমতা ফলপ্রসূ হয়।

এরপরই ওজনিয়াক তৈরি করেন অ্যাপল টু (Apple II)। এটার ডিজাইন ছিল সুন্দর। কেইস ছিল অসাধারণ। এতে ছিল অনেকগুলো এক্সপানশন স্লট ও বিল্ট-ইন গ্রাফিকস। ফলে বহু কাজে এই কম্পিউটার ব্যবহার করা যেত।
অ্যাপল টু হয় বিগ হিট এবং আগস্ট ১৯৮১-তে আইবিএম পিসি (IBM PC)-র আবির্ভাবের আগে অবধি আমেরিকান মার্কেটে ছিল টপ সেলিং।
ওজনিয়াকের দুর্ঘটনা এবং স্টিভের নতুন ভূমিকা
ইতিমধ্যে ফেব্রুয়ারি ১৯৮১-তে একটি দুর্ঘটনা ঘটে যায়। একটি স্থানীয় এয়ারপোর্টে টেক অফ করার সময়ে ওজনিয়াকের প্রাইভেট প্লেন ক্র্যাশ করে। আহত ওজনিয়াক কম্পানি থেকে বিদায় নেন। তাকে ছাড়াই অ্যাপল কম্পিউটার উন্নয়ন এগিয়ে চলতে থাকে। ম্যাকিনটশ প্রজেক্টের সূচনাকারী জেফ রাসকিনের কাছ থেকে দায়িত্ব বুঝে নেন স্টিভ। তখন থেকে অ্যাপলের কম্পিউটার হয় জবসের– ওজনিয়াকের নয়।

জবস চান মাউস এবং গ্রাফিকাল ইউজার ইন্টারফেস ভিত্তিক এমন কম্পিউটার, যা ব্যাপকভাবে বিক্রি হবে। তিনি চান শুধু সৌখিন ইউজার, সায়েন্টিস্ট ও বিজনেসম্যানদের কাছেই নয়, সাধারণ কনজিউমারদের কাছেও অ্যাপল ম্যাক জনপ্রিয় হবে। জবস বলেন, মেট্যাগ ওয়াশিং মেশিন ব্যবহারকারী যেমন সবাই, ঠিক তেমনই অ্যাপলম্যাক ব্যবহারকারী হবে সবাই।
জবস বহিষ্কৃত
নতুন ম্যাক বাজারে আসার সময়ে কিছু ঐতিহাসিক ব্যয়বহুল বিজ্ঞাপন ক্যামপেইন হয়। আমেরিকার টপ স্পোর্ট ইভেন্ট সুপারবোল চলার সময়ে ১৯৮৪ টাইটেলে ম্যাকের বিজ্ঞাপন দেখানো হয়। এছাড়া আমেরিকার প্রধান ম্যাগাজিনগুলোতে ২০ পৃষ্ঠা জুড়ে ছিল ম্যাকের অ্যাড। লঞ্চিং অনুষ্ঠানে বিল গেটস মঞ্চে এসে ম্যাকের প্রশংসা করেন এবং বলেন, মাইক্রোসফট সফটওয়্যার তাকে সব ধরনের সাপোর্ট দেবে। ম্যাকের জন্য প্রথম মাইক্রোসফট অফিস ভারশন এবং ওয়ার্ড, একসেল ও পাওয়ার পয়েন্টের গ্রাফিকাল ভারশন হয়। কিন্তু ম্যাক ফ্লপ করে।

১৯৮৫-তে অ্যাপল ছয়টি ফ্যাক্টরির মধ্যে তিনটি বন্ধ করে দেয় এবং এক-পঞ্চমাংশ কর্মচারী (১,২০০) ছাটাই করে। অ্যাপল সেই প্রথম ত্রৈমাসিক ক্ষতি ঘোষণা করে। তখন অ্যাপলের সিইও ছিলেন জন স্কালি। তার চাপে স্টিভ জবস নিজের প্রতিষ্ঠিত কম্পানি থেকে পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। এই জন স্কালিকে কম্পানিতে নিয়ে এসেছিলেন স্টিভ জবসই। এর আগে জন স্কালি কাজ করতেন পেপসিতে। স্টিভ জবস তাকে বলেছিলেন, আপনি কি চিরকালই চিনি মেশানো পানি বিক্রি করতে চান? নাকি, পথিবীটাকে বদলানোর সুযোগটা নিতে চান?
সেই জন স্কালির বিরুদ্ধে পরাজিত হয়ে স্টিভ জবস বিদায় নেন। ম্যাকের নতুন ডিজাইন করা হয় ও ১৯৮৭-তে ম্যাকিনটশ টু (Macintosh II) বাজারে আসে। এটি সফল হয়। প্লেবয় ম্যাগাজিনকে দেয়া একটি ইন্টারভিউতে জবস তখন বলেন, আমার মনে হচ্ছে কেউ যেন আমার পেটে একটা ঘুষি মেরেছে। আমি পড়ে গিয়েছি। কিন্তু আমার বয়স মাত্র ৩০। সৃষ্টি করার সুযোগ আমি পেতে চাই। আমি জানি, অন্ততপক্ষে আরেকটি ভালো কম্পিউটার সৃষ্টির ক্ষমতা আমার আছে। কিন্তু অ্যাপল সেই সুযোগটা আমাকে দিচ্ছে না।
জবসের পুনর্জন্ম : আমেরিকান স্বপ্ন বাস্তবায়িত
জবস এরপর নেক্সট (NeXT) নামে একটি নতুন কম্পানি করেন। তার সঙ্গে যোগ দেয় অ্যাপলের বহু কর্মচারী, বিশেষত ম্যাক-এর সঙ্গে জড়িতরা। এই কম্পানি যথেষ্ট আর্থিক পৃষ্ঠপোষকতা পেলেও এবং নেক্সটের মাধ্যমে টিম বার্নাস লি ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েব উন্নয়ন করলেও, কম্পানির সেলস ভালো হয় না। নেক্সট তখন হার্ডওয়্যার বাদ দিয়ে শুধু অপারেটিং সিসটেম বিক্রি করতে থাকে।

ইতিমধ্যে জবস নিজেকে রূপান্তরিত করেছিলেন। বৃটেনে নেক্সট লঞ্চিংয়ের জন্য কোনো হোটেল নয়– জবস বেছে নেন বিখ্যাত শো হল লন্ডন প্যালাডিয়াম-এর মঞ্চ। তিনি চমৎকারভাবে তার প্রডাক্ট উপস্থাপন করেন। তিনি হন একজন সুপারস্টার। নিজের কায়িক ব্র্যান্ডিংয়ের জন্য পাবলিকলি তিনি সব সময় পরতেন কালো সেইন্ট ক্র (st. Croix) টার্টলনেক, নীল লিভাই (Levi) জিন্স এবং পায়ে নিউ ব্যালান্স ট্রেইনার্স (যাকে বাংলাদেশ বলা হয় কেডস)।
১৯৯৫-এ মাইক্রোসফট উইনডোস ৯৫ (Windows 95) চালু করার পর কম্পিউটার জগৎ তোলপাড় হয়ে যায়। মাউস এবং গ্রাফিকাল ইউজার ইন্টারফেস সাধারণের জন্য নিয়ে আসে উইনডোস ৯৫। অ্যাপলের সেলস হড় হড় করে পড়ে যেতে থাকে। ১৯৯৫-এ অ্যাপলের সেলস ছিল ১১ বিলিয়ন ডলার। ১৯৯৮-এ সেটা নেমে হয় ৬ বিলিয়ন ডলার। অ্যাপলের বড় লস হয়। অ্যাপল ঘুরে দাড়াতে চেষ্টা করে। তাদের অন্যতম ডিরেক্টর গিল অ্যামেলিওকে ভার দেয়া হয় কম্পানিকে বাঁচাতে। তিনি ৪২৯ মিলিয়ন ডলার দিয়ে নেক্সট কম্পানিকে কিনে নেন এবং সেই সঙ্গে স্টিভ জবসকে ফিরিয়ে আনেন অ্যাপলে। জবসের সঙ্গে ফিরে আসেন তার প্রতি অনুগত সব স্টাফ। অ্যামেলিওর উপদেষ্টা পদে জবস যোগ দিলেও অল্প কিছু দিনের মধ্যে সবই বুঝে গেলেন আসলে কে কম্পানি চালাচ্ছে। এবার জবস নিজেই বোর্ডরুম ক্যু করেন এবং বিজয়ী হন। সেপ্টেম্বর ১৯৯৭-এ তিনি হন অ্যাপলের অন্তর্বর্তীকালীন সিইও! তার এই প্রত্যাবর্তন ছিল আশ্চর্যজনক।
অনেকের মতে, এটা ছিল আমেরিকান স্বপ্নের বাস্তব রূপ। একটি দত্তক ছেলে যে কলেজে পড়াশোনা ছেড়ে দিয়ে লম্বা চুল দাড়ি রেখে ইনডিয়াতে চলে গিয়েছিল, তারপর পিতামাতার গারাজে একটি কম্পানি প্রতিষ্ঠা করেছিল, খ্যাতি ও সম্পদ অর্জন করেছিল, তারপর নিজের কম্পানি থেকেই বহিষ্কৃত হয়েছিল, সে বিজয়ীর বেশে সেই কম্পানিতেই ফিরে এসেছিল।
এবং এবার তার জন্য আরো সাফল্য ও বিশ্বখ্যাতি অপেক্ষা করছিল।
এটা নিশ্চিত যে, এই আধুনিক রূপকথা অচিরেই হলিউড মুভিতে রূপান্তরিত হবে।

সাফল্যের কারণ
এবার স্টিভ জবস সফল হলেন কীভাবে?
কাজটা সোজা ছিল না। অ্যাপল নিউটন-এর মতো দুর্বল প্রডাক্ট বানানো তিনি বন্ধ করে দেন। প্রডাক্ট লাইন খুব সিম্পল করে ফেলেন এবং চোখ ধাধানো ডিজাইন সৃষ্টি করেন। মেশিন সৃষ্টিকর্তা হন ডিজাইন সৃষ্টিকর্তাও। ডজন খানেকের বেশি ম্যাক মডেলের জায়গায় আসে আইম্যাক (iMac)। তারপর আসে পোর্টেবল আইবুক (iBook)।

স্টিভ জবস বোঝেন যে, ১৯৮৪-র পরে কমপিউটার জগতে অনেক পরিবর্তন এসেছে। এখন শুধু কমপিউটার বিক্রি করে কম্পানি চালানো সম্ভব হবে না। আইম্যাক সফল হলেও না। জবস বলেন, কমপিউটার এবং অপারেটিং সিসটেম নিয়ে বহু মাতামাতি হয়েছে। কিন্তু অনেক আগেই মাইক্রোসফট জিতে গিয়েছে।
জবস মনোনিবেশ করেন নতুন প্রডাক্ট ডিজাইন করতে। ফলে এপৃল ২০০৩-এ মিউজিক স্টোরগুলোতে আসে আইটিউন (iTune)। জানুয়ারি ২০০৭-এ আসে আইফোন (iPhone)। কমপিউটারে অ্যাপলের নাম থাকলেও এসব প্রডাক্টে সেই নাম ছিল না। তাতে কিছু আসে-যায় না। যে বার্ষিক সেলস ২০০০-এ ৮ বিলিয়ন ডলার ছিল, সেটা ঊর্ধ্বমুখী হয়ে ২০১০-এ হয় ৬৫ বিলিয়ন ডলার।
থিংক ডিফারেন্ট
যখন আইবিএম-এর বিরুদ্ধে বিশ্বের অন্যান্য কমপিউটার কম্পানিগুলো তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছিল, তখন আইবিএম-এর স্লোগান ছিল থিংক (Think) বা চিন্তা করো। স্টিভ জবস নতুন স্লোগান দেন থিংক ডিফারেন্ট (Think Different) বা ভিন্ন চিন্তা করো। এই স্লোগান-সংবলিত কয়েকটি পোস্টার বাজারে ছাড়েন। এসব পোস্টার ছিল শাদা-কালোতে এবং এতে ছবি ছিল বিভিন্ন খ্যাতিমান ব্যক্তির বা আইকন-এর যেমন, সায়েন্টিস্ট অ্যালবার্ট আইনস্টাইন, আর্টিস্ট পাবলো পিকাসো, ফিলসফার-পলিটিশিয়ান মোহনদাস গান্ধী এবং মুভিমেকার অ্যালফ্রেড হিচকক-এর। এসব পোস্টার আমি সংগ্রহ করেছিলাম এবং লাভ রোড, তেজগাওয়ে দৈনিক যায়যায়দিন-এর অফিসে বাধিয়ে রেখেছিলাম। আমিও বিশ্বাস করি, ভিন্ন চিন্তাই পৃথিবীটাকে বদলে দিতে পারে।

হাল ছেড়ো না
এই প্রসঙ্গে ২০০৫-এ স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটিতে স্টিভ জবস একটি ভাষণে বলেছিলেন, আমি যে শিগগিরই মারা যাবো, এই উপলব্ধিটাই ছিল আমার বড় হাতিয়ার। এই হাতিয়ারের সাহায্যেই আমি জীবনের বড় সিদ্ধান্তগুলো নিতে পেরেছি। কারণ মৃত্যুর মুখে প্রায় সব কিছুই যেমন, বড় আশা, সকল গর্ব, বিব্রত অথবা ব্যর্থ হবার আশঙ্কা, সবই দূর হয়ে যায়। শুধু পড়ে থাকে যা সত্যিই ইমপরটেন্ট বা গুরুত্বপূর্ণ। আমি জেনেছি, কিছু হারানোর ভয়কে এড়ানোর সবচেয়ে ভালো পন্থা হলো, মনে রাখা– মৃত্যু খুব কাছেই। সুতরাং তোমাদের বিবেক যা বলবে সেটা অনুসরণ না করার কোনো কারণ নেই।…. তোমার সময় সীমিত। সুতরাং অন্য কারো জীবন অনুসরণ করে সময় নষ্ট করো না। প্রচলিত নীতিকথায় আটকে যেও না। কারণ ওই সব পুরনো কথাগুলো হচ্ছে অন্যসব ব্যক্তির চিন্তার ফসল। অন্যদের মতামতের আওয়াজ যেন তোমাকে ডুবিয়ে না দেয়। তুমি তোমার নিজের ভেতরের কথা শোনো।… তোমার জীবনের একটি বড় অংশ জুড়ে থাকবে তোমার কাজ। সুতরাং সন্তুষ্ট হতে চাইলে তুমি যে কাজটায় বিশ্বাস করো, সেটাই করতে থাকো। সেই কাজটা যদি তুমি এখনো খুঁজে পেয়ে না থাকো, তাহলে খুঁজতে থাকো। তোমার হৃদয়ঘটিত অন্যসব কিছুর মতো। তোমার হৃদয়ই বলে দেবে সেই কাজটি যখন তুমি পাবে। সুতরাং খোঁজার চেষ্টা চালিয়ে যাও। কখনো থেমে যেও না।
… নেভার কুইট (Never quit) বা কখনই হাল ছেড়ে দিও না।

নেভার কুইট। জবসের জীবনে এটাই ছিল মন্ত্র। ২০০৫-এ তরুণদের প্রতি প্রেরণাদায়ক জবসের এই ভাষণটি পড়ে অনেকের হয়তো মনে পড়ে যাবে ১৯৯২-এ কবীর সুমন (তখন তার নাম ছিল সুমন চট্টোপাধ্যায়)-এর গানের কয়েকটি কলি :
হাল ছেড়ো না বন্ধু…
বন্ধু তোমার ভালোবাসার স্বপ্নটাকে রেখো
বেঁচে নেবার স্বপ্নটাকে
জাপটে ধরে থেকো।
দিন বদলের স্বপ্নটাকে
হারিয়ে ফেলো না
পালটে দেয়ার স্বপ্ন আমার
এখনো গেল না-
হাল ছেড়ো না।

স্টিভ জবসের মৃতু্যৃর পর শোক বিবৃতি দিয়েছেন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা থেকে শুরু করে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ডিমিটৃ মেডভেডেভ। বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন থেকে শুরু করে ইনডিয়ান ইনডাস্টৃয়াল টাইকুন রতন টাটা। মাইক্রোসফটের বিল গেটস থেকে শুরু করে ফেসবুকের মার্ক জুকারবার্গ, প্রমুখ।
প্রেসিডেন্ট ওবামা বলেন, কোটি কোটি শিশু, তরুণ এবং বয়স্কদের জীবনে স্টিভ আনন্দ এনেছেন। স্টিভ বলতে ভালোবাসতেন, তিনি প্রতিটি দিনকেই মনে করতেন তার জীবনের শেষ দিন এবং সেটা মনে রেখেই তিনি কাজ করতেন, বেঁচে থাকতেন। আর সেটা তিনি করেছিলেন বলেই স্টিভ আমাদের জীবনকে বদলে দিতে পেরেছিলেন, গোটা কমপিউটার ইনডাস্টৃকে রূপান্তরিত করতে পেরেছিলেন এবং মানব ইতিহাসে খুব দুর্লভ সাফল্য অর্জন করতে পেরেছিলেন। আমরা প্রত্যেকে যেভাবে পৃথিবীটাকে দেখি, সেটা তিনি বদলাতে পেরেছিলেন।
সমালোচিত জবস
নেভার কুইট, স্টিভ জবসের এই চমৎকার উপদেশ শুনে সেদিন তরুণরা হাততালি দিয়েছিল। তবে জবসের কিছু সমালোচক বলেন, মাত্র কয়েক হাজার ডলার দিয়ে তার আদি বন্ধু ওজনিয়াককে বিদায় দেয়াটা ছিল অতি অন্যায়।

জবস সমালোচিত হয়েছিলেন আরেকটি কারণে। ১৯৭৮-এ গার্লফ্রেন্ড কৃসান ব্রেনান-এর গর্ভে তার কন্যা লিসার জন্মের বিষয়টি জবস প্রথমে অস্বীকার করেছিলেন। এমনকি তিনি বলেছিলেন, তিনি বন্ধ্যা!
১৯৯১-এ জবস বিয়ে করেছিলেন লরেন্স পাওয়েলকে এবং তাদের তিনটি সন্তান (রিড, এরিন ও ইভ) হয়। স্টিভ ও লরেনের বিয়েটা হয়েছিল বৌদ্ধ ধর্মীয় অনুষ্ঠানে। কারণ ইতিমধ্যে স্টিভ হয়েছিলেন বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী। মৃত্যুকালে স্টিভ রেখে যান ব্যক্তিগত ৭ বিলিয়ন ডলারের বেশি সম্পদ।
জবসের বিরুদ্ধে তৃতীয় সমালোচনা ছিল। বিল গেটস, ওয়ারেন বাফে, প্রমুখের মতো তিনি জনহিতকর কোনো কাজে কোনো দান করেননি। অ্যাপল থেকে বহিষ্কৃত হওয়ার পর, অ্যাপল যেসব চ্যারিটিতে অনুদান দিচ্ছিল, স্টিভ জবস অ্যাপলে ফিরে আসার পর সেসব বাতিল করে দেন। এখন অনেকেই লক্ষ্য করবেন, মৃত্যুর পর জবস তার বিশাল সম্পত্তি কীভাবে বণ্টনের ব্যবস্থা করে গিয়েছেন।
অ্যাপলের সিইও পদে স্টিভ জবস কতো বেতন পেতেন?
উত্তর : বছরে মাত্র এক ডলার (প্রায় আশি টাকা)।
তাহলে জবসের চলতো কী করে?
উত্তর : অ্যাপল ও ডিজনি-তে তার শেয়ার থেকে পাওয়া ডিভিডেন্ড বা লভ্যাংশ থেকে।
শেয়ার মার্কেটে এই দুই কম্পানির শেয়ারের দাম যেন চড়া থাকে সে বিষয়ে জবস সতর্ক ছিলেন। সম্ভবত মেই কারণেই অ্যাপল থেকে সাম্প্রতিক কালে তিনবার ছুটি নিলেও জবস তার মারাত্মক রোগের কথা গোপন রাখতে চেয়েছিলেন। তিনি আশঙ্কা করতেন, তার রোগের সংবাদে শেয়ারের দাম পড়ে যাবে।

কৃশ্চিয়ান প্রভাব
শুরুতেই জানিয়েছি স্টিভ জবস-এর বায়োলজিকাল পিতা একজন সিরিয়ান মুসলিম। আমেরিকান প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার পিতা ছিলেন একজন কেনিয়ান মুসলিম। লক্ষ্যণীয় যে, জবস এবং ওবামা উভয়ই লালিত-পালিত হয়েছিলেন কৃশ্চিয়ান পরিবারে। বর্তমান সময়ে যে কৃশ্চিয়ান সভ্যতা ও সংস্কৃতির আধিপত্য চলছে, তার সুযোগ ও সুবিধা পেয়েছেন উভয়েই। ওবামা হয়েছেন কৃশ্চিয়ান। তবে, জবস হয়েছিলেন বৌদ্ধ।

স্বপ্নদ্রষ্টা হাইটেক সুপারস্টার
স্টিভ জবসের সাফল্যের মূল কারণ ছিল– তিনি বুঝতে পেরেছিলেন কম্পিউটার টেকনলজি সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চলে এবং বিজয়ী হতে হলে এখানে সময়ের আগে থাকতে হয়। সেজন্য তিনি সব সময়ই ইউজার ফ্রেন্ডলি কম্পিউটার ও অন্যান্য প্রডাক্ট উদ্ভাবন করেছেন। কনজিউমাররা কী চায় এবং কত সহজে প্রডাক্ট ব্যবহার করতে চায় সেটা তিনি বুঝতে চাইতেন।

জবসের অটোগ্রাফ দেয়ার গল্প
এ প্রসঙ্গে স্টিভ জবস সম্পর্কে একটি গল্প আছে।
অ্যাপল থেকে পদচ্যুত হওয়ার পর তিনি যখন নেক্সট প্রতিষ্ঠানটি গড়ে তুলছিলেন তখন একদল ছাত্রের সঙ্গে আলাপ করছিলেন। সেই সময়ে স্টিভকে বোকা বানানোর জন্য জুভেটসন নামে একটি ছাত্র তাকে হঠাৎ অনুরোধ করেন, আপনি কি দয়া করে এই কিবোর্ড (keyboard)-এর ওপরে আপনার একটা অটোগ্রাফ দেবেন?

স্টিভ বেশ উত্তেজিত হয়ে যান। তিনি বলেন, যে অ্যাপলকে আমি ঘৃণা করি তার সব কিছুই এই কিবোর্ড প্রতিনিধিত্ব করে। এটা একটা যুদ্ধজাহাজ। এখানে এতগুলো কি (Key) কেন আছে? তুমি এই F1 কি-টা ব্যবহার করো? করো না।
এটা বলে স্টিভ তার পকেট থেকে গাড়ির চাবির রিং বের করেন। একটি চাবি দিয়ে তিনি F1 কি-টা উপড়ে ফেলেন এবং বলেন, এটাই আমার অটোগ্রাফ।
তখন ছাত্ররা সবাই বলে, F2 কি-র কী হবে?
কিছুটা শান্ত স্বরে স্টিভ বলেন, একটা একটা করে কিবোর্ড বদলিয়ে আমি দুনিয়াটাকে বদলাচ্ছি।
আসলেই স্টিভ জবস প্রডাক্টগুলো ইউজার বা ব্যবহারকারীদের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতেন। তাই তিনি পারতেন ইউজার ফ্রেন্ডলি প্রডাক্ট বানাতে।

আগেই বলা হয়েছে, এসব কির বদলে জবস পছন্দ করতেন মাউস এবং তিনি মাউসের প্রয়োগ বাড়িয়েছিলেন।
জবসের মৃত্যুতে অনেকের মনে পড়েছে আরো কয়েক আইকনের হঠাৎ মৃত্যু। যেমন, পপ গায়ক জন লেনন, আমেরিকান প্রেসিডেন্ট জন কেনেডি, বিপ্লবী চে গুয়েভারা-র মৃত্যু।
স্টিভ জবসও এক ধরনের বিপ্লবী ছিলেন। তবে তার বিপ্লবটা হয়েছে রাজনৈতিক ক্ষেত্রে নয়– হাই টেকনলজির ক্ষেত্রে। বর্তমান যুগে পলিটিশিয়ান ও সাহিত্যিকদের চাইতে বিশ্ব জুড়ে বেশি জনপ্রিয় হন স্পোর্ট স্টার, মুভি স্টার ও পপ স্টাররা। স্টিভ জবস ছিলেন একজন জনপ্রিয় এবং সফল স্বপ্নদ্রষ্টা হাইটেক সুপারস্টার।
০৭-১০-২০১১
(বানান রীতি লেখকের নিজস্ব)
শফিক রেহমান : প্রবীণ সাংবাদিক ও জনপ্রিয়  টিভি অনুষ্ঠান উপস্থাপক।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন